#সুতোয় বাঁধা সংসার
writer::প্রিয়া
১৮
সালমান রেগেমেগে বাইরে যেতে গেলে রিদ্ধ পিছন থেকে ডাক দিলো।
-আপনি আইনের ভয় দেখিয়ে প্রুফ করে দিলেন।আপনি নামে মাত্র বাবা, কাজে না।
-রিদ্ধ……
-শুনোন আমার আপু কোনো অন্যায় করেনি।আর আমার মাকে কথা শোনানোর আগে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করুন।
টিনেজ বয়স খুব খারাপ সেটা জানেন তো?এই বয়সের ছেলে মেয়ে ভুল করে কিন্তু আপু সেই ভুল করেনি।
উল্লাসের মাকে বলবেন আমার মায়ের কাছে ফোন দেয়ার জন্য।আপু দোষ করলে আমরা পরিবারের লোকজন মিলে শাসন করবো।বাইরের কারো দরকার নেই।
-আমি বাইরের কেউ?
-আপাতত রুমার মতো মহিলার স্বামী।
-তুমি কি বড়দের শ্রদ্ধা করা ভুলে গেছো?
-প্রয়োজন হলে আপনি রুমাকে পূজা করুন।কিন্তু আমরা শ্রদ্ধা করতে পারবো না।
-ছিঃ ছিঃ এতো অধঃপতন।
-আপনি নিজেও জানেন আপনি কোন চোরাবালিতে ডুবে মরতে যাচ্ছেন।আমি দোয়া করি আল্লাহ যাতে আপনার সুবুদ্ধি দেন।
-রিদ্ধ তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস।
-জ্বি না আমার মাথা পুরো ভালো আছে।
আর আশা করি আমার এই ব্যবহারের পর নিজেকে আর আমাদের বাবা বলে দাবি করবেন না।আমাদের মা-বাবা একজনই।আপনার মতো বাবার চাইতে বাবা না তাকাই ভালো।
সালমান ছেলের কথায় যথেষ্ট কষ্ট পেলো।চোখের কোণে জল আড়াল করে বেড়িয়ে গেলো।
ওরা বেড়িয়ে যেতেই স্বপ্না সজোরে থাপ্পড় মারলো রিদ্ধের গালে।
-এতোটা খারাপ বিহেভিয়ার তোর।নিজের বাবার সাথে কেউ এতো উঁচু গলায় কথা বলে?
-মা লোকটাকে বাবা বলতে আমার লজ্জা হয়।
-রিদ্ধ ভুলে যাচ্ছিস বাবারা খারাপ হয় না।
-উনি খারাপ বাবা।
-তোদের খারাপ তিনি কখনোই চাইবেন না।মাকে অধিক ভালোবাসতে গিয়ে বাবাকে এতোটা অপমান করা ঠিক না।
এতে মায়ের শিক্ষার উপর প্রশ্ন উঠে।আশা করি বুঝতে পেরেছিস।
রিদ্ধের রাগ হলো প্রচুর,রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।রিদ্ধের দাদু এবার স্বপ্নাকে বলতে শুরু করলেন।
-ছেলে কি শিখবে বল,যার বাবা এমন নির্লজ্জ কাজ করে।এমন বাবার প্রতি সন্তানদের সম্মান আসে না।
-আমি তো এমন চাই না মা,আমার সন্তানরা নিজের বাবাকে সম্মান করুক।শত হোক জন্মদাতা তো।
-তুই এমন কেনো?
স্বপ্না কথা বাড়ায় না। এতো অশান্তি ভালো লাগছেনা।সব সুতো ছেড়ে বসে তো আছে তবুও কেনো সুতোয় টান লাগছে বারবার।
রিদ্ধ অনেকক্ষণ একাকি বসে রইলো।তরী দরজা ধাকাচ্ছে বাধ্য হয়ে দরজা খুলে দিলো।
-ডাকছিস কেনো?
-তুই এতো বড় হলি কবে রে?
-যা ভালো লাগছেনা।
-খেতে আয়?
-খাবো না।
-রিদ্ধ ভাই আমার বাবার সাথে এভাবে কথা বলা ঠিক না।
-তুই ও বলছিস।আমি চাইলে ও পারিনা ওই মানুষটাকে সম্মান করতে।
-সম্মান করিস না,তবে অপমান করা ঠিক না।বাবার চোখে জল আসছিলো দেখেছিস তুই।
-দেখতে চাই না।
-চল খাবি?
-খাবো না।
-মাইর খাবি বলে রাখলাম।
রিদ্ধ আর কিছু বলে না, তরীর সাথে খাবার টেবিলে চলে আসে।
খাবার খেয়ে নিজের রুমে উঠে চলে গেলেই মায়ের দিকে তাকিয়ে সরি বলে।
সালমান ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে । রিদ্ধের কথাগুলো খারাপ লাগছে।এতে রিদ্ধের দোষ কোথায়।
বাবার চাইতে মাকে বেশি ভালোবাসে সন্তানরা।স্বপ্নার এমন দুঃখী ভাব দেখে ছেলেমেয়ে বাবাকে ঘৃণা করছে।
রুমার সাথে বিয়ে কি তবে ভুল ডিসিশন। রুমাকে তো আমি ভালোবাসি,রুমার সাথে ভালো আছি এটাই অনেক।
আর ওই পরিবারের কোনোকিছুতেই নিজেকে জড়াতে যাবো না।সালমান তখন নিজেই নিজের প্রতিচ্ছবি দেখলো কেউ একজন হাসছে আর বলছে তুই রুমাকে নিয়ে সুখে আছিস, তোর ছেলেমেয়ে ওরা ওদের ভালো খারাপ তুই সামলাবি।তুই কাপুরুষ সন্তানদের মুখোমুখি দাঁড়াতে তুই ভয় পাচ্ছিস।
সত্যিকারের বাবা হয়ে উঠতে পারছিস না।
সালমান অনের রাত অবধি ছাদে ছিলো।শেষরাতে রুমে আসে রুমা তখনও জেগে আছে।
-তুমি ঘুমাওনি?
-না, তুমি বাইরে আমি কি করে ঘুমাই?
-আমি বাবা হিসাবে বড্ড খারাপ ছেলেমেয়ের কাছে।
-সব আমার জন্য হলো।
-নিজের সুখের কথা চিন্তা করে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিলাম।
-আসো, আমি তোমার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিচ্ছি।
সালমান গিয়ে রুমার পাশে শুইয়ে পরলো।নির্ঘুম রাত কাটলো সকালে ঘুম থেকে উঠে বাজারে গেলো।
আজ রিদ্ধ,তরী,রিহানের পছন্দের সব খাবার কিনলো।আর কিছু বাজার করলো।সকাল সকাল কলিংবেল বাজতেই স্বপ্না দরজা খুলতে যায়।চা ফুটছে দেখে দরজা কাছ থেকে আবার ফিরে আসে চুলা বন্ধ করতে।
তরী এসে দরজা খুলে বাবাকে দেখে চমকে উঠলো। সেই আগের বাবা দু হাত ভর্তি বাজারের ব্যাগ। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম আজ কেমন বাবা বাবা গন্ধ আসছে।
-আপনি?
-রিহান আর রিদ্ধকে ডাক দে তো মা।
স্বপ্না রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞাসা করে কে এসেছে।তরী কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো বাবা।
স্বপ্নার রাগ এবার বেড়ে গেলো আজ যদি লোকটা বাড়াবাড়ি কিছু করে তাহলে ছাড় দিবো না।
-কি রে ডাক রিদ্ধ, রিহান কে।
তরী ভয়ে ভয়ে রিদ্ধ আর রিহানকে ডাক দিলো।স্বপ্না রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠে।
-উনাকে বল ভালোই ভালোই চলে যেতে।
রিদ্ধ আর রিহান ড্রইংরুমে আসে।রিহান এসেই বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
-রিদ্ধ বস এখানে।
রিদ্ধ কিছুই বলছেনা, কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা
-আমি তোদের প্রতি অন্যায় করেছি সেটা গত রাতে বুঝতে পারছি।বাবার এই ছোট ভুল কে কি মাফ করে দেয়া যায় না?
-আমাদের মায়ের কি দোষ ছিলো। কেনো আমাদের মা এতো কষ্ট সহ্য করছেন বলতে পারেন?
-নিশ্চুপ..
-আপনি মায়ের নামে মিথ্যা বদনাম তুলেছেন।আমাদের মা আপনার জন্য কি না করেছেন তবুও আপনি যে প্রতিদান দিয়েছেন আমরা ভুলবো না।
-তোদের সবার জন্য কিছু বাজার এনেছিলাম।দেখ রিদ্ধ তোর প্রিয় কোকোনাট চকলেট, তরীর গরম গরম সিংগারা, রিহানের প্রিয় লাড্ডু।
-লাগবেনা আমাদের।
-ফিরিয়ে দিস না বাবা।
রিদ্ধ কিছু বলতে পারছেনা, আজ উনাকে কথা শুনাতে রিদ্ধের বুক কাঁপছে। আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছু স্বপ্না দেখলো।
বাপ-সন্তানদের মাঝে ও কথা বলবে না,সন্তানদের ইচ্ছে হলে রাখবে, না হলে ফিরিয়ে দিবে।
রিদ্ধ কিছু না বলে রুমে চলে গেলো।
-তরী এক গ্লাস জল দে মা?
তরী জলের গ্লাস এগিয়ে দিতেই তিনি জল খেয়ে হাসিমুখে তরীকে বললেন।
-তোদের ইচ্ছে হলে খেয়ে নিস,না হলে ফেলে দিস।
তরী ওর বাবাকে পাগলের মতো ভালোবাসে।বাবাকে কষ্ট দিয়ে কিছু বলতে ওর বিবেক স্বায় দেয় না।
-খেয়ে নিবো আমরা।
রিহানকে সোফায় বসিয়ে তরীর মাথায় হাত ভুলিয়ে সালমান চলে গেলো।
তরী ব্যাগগুলো নিয়ে রান্নাঘরে যায়।
-মা বিশ্বাস করো আমি ইচ্ছে করে রাখিনি।বাবার এমন নিরিহ মুখ দেখে আমি ফিরিয়ে দিতে পারিনি।
স্বপ্না কথা বলছেনা,তরী মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
-মা তুমি কষ্ট পাচ্ছো।
-নাহ, তোরা খেয়ে নে।
তরী চকলেট গুলো নিয়ে রিদ্ধের রুমে গেলো।রিদ্ধ টেবিলে মাথা গুজে বসে আছে।
-ভাই।
-বল
-চকলেট
-খাবো না।
-রেখে দে।
রিদ্ধ কিছু বলছেনা, তরী চকলেট টেবিলে রেখে দিলো।
সালমান ঘরে যেতেই রুমা হুংকার দিয়ে উঠলো।
-কোথায় গিয়েছিলে?
-বাজারে।
-বাজার কোথায়?
-ওই বাড়িতে দিয়ে আসছি।
-দরদ উথলে উঠছে দেখছি।দেখো সালমান আমি এসব মানতে পারবো না।
-কি মানতে পারবে না?
-তোমার এমন দরদ আমার ভালো লাগে না।
-রুমা তুমি জানো আমি গত রাত একদম ঘুমাইনি।আমার বাচ্চাদের কাছে আমি খারাপ বাবা হয়ে গেছি।
আমি কেনো যে এতো বড় ভুল করলাম।
-তাহলে ভুল শুধরে নাও।আমাকে ছেড়ে স্বপ্নার পায়ে গিয়ে পরো।
-রুমা বাজে কথা বলো না।
-কি বাজে,কোনটা বাজে তোমার এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল।আমার সংসার কেড়ে নেয়ার সময় ভুল চোখে পড়েনি।না নিজের পুরুষত্ব হাসিল করার জন্য পরকীয়ায় অন্ধ হয়ে গেছিলে।
-রুমা ঠিক করে কথা বলো।
-এখন বুঝি আমাকে ভালো লাগছেনা।অন্য কারো বউকে চোখে ধরছে।আমি ভুল, এবার আরেকজনের বউয়ের কাছে যাচ্ছো।
-আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
-আমার যাচ্ছে না,তুমি কি বুঝতে পারছোনা। তুমি যে অন্যায় স্বপ্নার সাথে করেছিলো সেই অন্যায়ের রিপিট করছো আমার সাথে।
-আমি তোমার সাথে কিছুই করছিনা রুমা।
-আমি তোমাকে ক্লিয়ার একটা কথা জানিয়ে রাখছি।তুমি যদি ওই পরিবারের সাথে কোনো সম্পর্কে নতুন করে জড়াতে চাও,আমি গলায় দঁড়ি দিবো।
-রুমা।
-সত্যি বলছি।তোমাকে ভালোবেসে নষ্টা মেয়ে হয়েছি।সমাজের মানুষ কত খারাপ কথা বলে হজম করে যাচ্ছি তুমি আছো বলে।যদি তুমি আমার সাথে এমন করে তখন আত্মহত্যা করতে আমি দু বার ভাববো না।
-রুমা প্লিজ শান্ত হও।আমি তোমার সাথে অন্যায় কিছুই করবো না।
রুমা কিছু না বলে রুমের দরজা ঠাস করে বন্ধ করে দিলো।সালমান অফিসের জন্য তৈরি হয়ে কিছুক্ষণ রুমাকে ডাকাডাকি করলো।রুমা সাড়া দেয়নি তাই অফিসে চলে গেলো।
অফিসে গিয়ে রুমাকে ফোন দিলো।নাম্বার বিজি অনেকক্ষণ ফোন দিয়ে ভাবলো হয়তো ব্লক করে দিয়েছে।তাই মেসেজ দিয়ে রাখলো।
রুমা বিজি রাসেলের সাথে ফোনে।
-রুমা কাজ কিন্তু অনেকদূর এগিয়ে গেছে।
-কিসের কাজ গো?
-বিদেশে যাওয়ার।তুমি জানো আমরা পর্তুগাল যাচ্ছি।
– সিরিয়াসলি।
-হ্যা গো, কাজ অনেকদূর এগিয়ে গেছে এবার এডভান্স কিছু টাকা হলে দ্রুত হয়ে যেতো।
-কত টাকা।
-এই ধরো ১লক্ষ।
-তুমি আমাকে ঠকাবে না তো রাসেল।
-ছিঃ ছিঃ রুমা তুমি আমাকে এভাবে বলতে পারলে।
আমি আমার মতো যেভাবে আছি সেইভাবেই থাকবো।লাগবেনা বিদেশ,টাকাপয়সা। শুধুমাত্র তোমার সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি বিদেশে যাওয়ার চিন্তা করেছিলাম।তুমি আমাকে ভুল বুঝলে, না না আমার কিছুর দরকার নেই।
-রাসেল প্লিজ আমি এভাবে বলতে চাই নি।
-আর কিছু বলতে হবে না।তুমি ভালো থেকো। ঠকবাজ হয়ে আমি তোমার সাথে থাকতে চাই না।
-আরে বুঝার ট্রাই করো।আমি এভাবে বলতে চাই নি।
-আমি রাখছি তুমি ভালো থেকো।
-রাসেল শুনো।
সালমান কিছুতেই মন কে মানাতে পারছেনা। তাই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসলো।
রাসেল ফোন কেটে দিলো,রুমার একের পর এক কল দিয়ে যাচ্ছে।রাসেল কিছুতেই ফোন রিসিভ করছেনা শেষমেশ রাসেলকে মানানোর জন্য হাতে ইঁদুর মারার বিষের বোতল নিয়ে ছবি তুলে রাসেল কে পাঠালো।
সালমান রুমে ঢুকে বিষের বোতল দেখেই চিৎকার করে উঠলো।টান দিয়ে বোতল ফেলে দিলো।
-পাগল হয়ে গেছো তুমি?
রুমা এবার ভং ধরলো।
-কেনো ফেলে দিলে,আমি মরতে চাই বেঁচে থেকে কি করবো?
-রুমা পাগলামি করো না।
-কথা দাও আর কখনোই ওই বাসায় যাবে না।
-রুমা।
-ঠিক আছে তাহলে আমাকে মরতে দাও।
-আচ্ছা আর যাবো না।
রাসেল ফোন দিচ্ছে,রুমা বাথরুমে গিয়ে ফোন রিসিভ করলো।ওপাশ থেকে রাসেল কাঁদছে।
-আমি আর এভাবে বলবো না কখনো।
-তুমি মরতে চাইছিলে কেনো?
-কিছু হয়নি।শুনো আমি যেভাবে হোক কাল টাকা ম্যানেজ করবো।
-লাগবে না।আমরা দুজন আমাদের কুঁড়েঘরে থাকবো।
-নাহ আমরা রাজপ্রাসাদে থাকবো।
১লক্ষ টাকা ম্যানেজ করা কষ্টকর তবুও রুমা অন্য পথ অবলম্বন করবে।
চলবে