#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা
রহস্যময়ঃ আঠারো
(লেখিকার অনুমতি ব্যাতিত কপি নিষেধ)
কুঠির ঘরের সামনে দরজায় ঝুলছে বড্ড পুরোনো এবং বিশাল একটি তালা। সুখ তালা’টার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। কতক্ষণ দরজায় টুকটাক শব্দ করলো নিজের হাত দিয়ে। অপরপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় কিনা সেই আশায়, কিন্তু কোনোরূপ সাড়া পাওয়া গেলো না। হঠাৎ সুখ খেয়াল করলো দরজার বা’পাশে একটা জানালা রয়েছে। জানালাটা আটকানো তবে মাঝে একটু ফাঁকা আছে। কিছু দেখা যায় কিনা সেই চেষ্টায় সুখ জানালাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দুপুরের কড়া রোদে শরীরে একটা উষ্ণ ভাব ভড় করলো সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ভেবে ভয় ধরলো হৃদয় গহীনে। দুপুরের রোদে বাড়ির ছাদে বসে এক আধাঁরিয়া কাক বেসুরে কন্ঠে কা কা করে যাচ্ছে। কাকের ডাক অকল্যাণের সুর,তবে এ বেলাও কী কাক অকল্যাণের সংকেত জানাচ্ছে!
সুখ মাথা নামালো জানালা বরাবর,ফাঁকাটার দিকে। গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো ভেতরের পরিস্থিতি। কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘামের আভাস। গভীর পর্যবেক্ষণার মাঝে ঘাঁড়ে কারো শীতল স্পর্শ অনুভব করলো,ছিটকে উঠলো ক্ষানিকটা। পিছে তাকাতে দেখে কাজের মেয়েটা দাঁড়িয়ে বিষ্ময়মাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার পানে।
সুখ চোখ বন্ধ করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। অন্য কেউ হলে তাকে লজ্জা আর অস্বস্তিতে পরতে হতো নিজের সন্দেহের জন্য। সুখের ভাবনার মাঝে কাজের মেয়েটা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-‘আরে ভাবী! আপনি এইখানে কী দেখেন? ভাগ্য ভালো আমি এসেছি অন্য কেউ না, তা নাহলে তো এই কাজের জন্য বড় মূল্য দিতে হইতো।’
কাজের মেয়েটার কথায় ভ্রু কুঁচকায় সুখ। এখানে আসার জন্য বড় মূল্য দিতে হতো মানে! সে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-‘এখানে আসার জন্য বড় মূল্য দিতে হতো কেন? কী আছে এখানে?’
-‘এখানে আছে এই বাড়ির রহস্য। ধূলোর মাঝে গড়া রাজ প্রাসাদের আন্তঃ খবর।’
সুখ আরও কিছু বলার আগে পেছন থেকে একটা গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসলো,
-‘মিনা, তুই আবারও উল্টাপাল্টা বকছিস?’
সুখ কন্ঠের অধিকারী ব্যাক্তিটার দিকে তাকালো,মেঘ সাহেব। সুখ অবাক কন্ঠে বলল,
-‘উল্টাপাল্টা কথা বলছে মানে?’
মেঘ মুচকি হেসে এগিয়ে আসলো। মিনা নামের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
-‘আর কী বলবো অপরিচিতা, এই মিনা এমন উদ্ভট উদ্ভট কথা বলে জানেন না। আমাদের বাড়িতে গত বছরের মাঝা মাঝি সময়ে দুইটা কাজের মেয়ে নেওয়া হয়েছিলো তারপর একদিন ওরা আমাদের কিছু জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। তার দু একদিন বাদে এই স্টোর রুমে নাকি ও তাদের’কে দেখেছে। পরে রুমে তালা খোলার পর দেখে কিছু নেই। এমন আরও নানান রকম কথা ও ছড়ায়। আমাদের এখানের অনেক মানুষের কাছে বলে বেড়ায় আমাদের বাড়িতে অনেক রাতে নাকি মানুষের শব্দ শোনা যায়, গাড়ির শব্দ শোনা যায়, কান্নার শব্দ আসে। আরও কত কী।’
সুখ হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা কী পাগল! প্রথম দিন যে বলেছিলো অদ্ভুত কথা টা, সেটাও কী এমনেই বলেছিলো? নাকি সব কিছুর পিছে কারণ আছে?
-‘কী করছিস তোরা এখানে? আর মিনু,তোকে না বলেছিলাম এখানে আসতে না? এখানে কী করছিস? কাজ নেই তোর?’
একটা মেয়েলী কন্ঠে সবাই ঘুরে তাকায়। মসৃনের মা দাঁড়িয়ে আছে আর তার পিছে মেঘের মা রেহেনা বেগম। মিনা নামের মেয়েটি মাথা নামিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
-‘হ্যাঁ, আমি এখানে আসলেই তো রহস্য ফাঁশ হয়ে যাবে। কবে জানি নির্মম ভাবে আমিও উধাও হয়ে যাই। এ মানুষ গুলোর মাঝে কিছু তো লুকিয়ে আছে।’
মিনুর সাথে সুখ দাঁড়িয়ে ছিলো বিধায় সে সবটাই সুন্দর পরিষ্কার শুনতে পেরেছে। বাকিরা অবশ্য বুঝতে পারে নি কী বলেছে এ মেয়ে। সুখ আনমনেই ভাবে,মেয়েটা কী উন্মাদ!
মেঘের মা মিনাকে চুপ থাকতে দেখে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-‘কী বিড়বিড় করছিস! তোকে না বলা হয়েছে এখানে আসবি না। এখানে আসলেই তুই নতুন গল্প বানিয়ে ফেলিস।’
মিনা আর কথা বলে নি কোনো,গটগট পায়ে ভেতরে চলে গেলো। সুখ মিনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আনমনেই বলল,
-‘যেহেতু ও ভুল’ই রটে তবে ওকে রেখে দিছেন কেনো? আমি তো শুনেছি যা রটে তা কিছু ঘটে।’
মেঘ অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সুখের পানে, অবিশ্বাস্যকর কন্ঠেই সামান্য হেসে বলল,
-‘আপনিও কী ওর সাথে পাগল হলেন অপরিচিতা! ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন, তাই ভাবে উল্টোপাল্টা। আর,ও অনেক বছর পুরোনো প্রায় তিনবছর হবে তাই মায়ার বশে ওকে ছাড়তে পারি না। ও অবুঝ বলে আমরাও কি অবুঝ হবে! পনেরো বছরের মিনা’কে বাসায় এনেছিলো। কীভাবে মেয়েটাকে বের করি বলেন!’
-‘আরে মেঘ! তুমিও না, মেয়েটা নতুন এসেছে আমাদের পরিবারে। আমাদের ব্যাপারে জানতে বুঝতে ওর তো একটু সময় প্রয়োজন তাই? আমাদের সাথে মিশলেই ওর সব প্রশ্নের উত্তর পাবে।’
রেহানা বেগমের এমন সুমিষ্ট আচরণে মুগ্ধ নাহয়ে পারলো না সুখ। কী সুন্দর তার আচরণ। মেঘ মাথা নাড়িয়ে বলল,
-‘না মা, আমি তো কেবল এমনেই বললাম। আমিও জানি অপরিচিতার সময় প্রয়োজন।’
সুখ সবার অগোচরে ছোট্ট শ্বাস ফেলল। মিনা মেয়েটা এতটাও অবুঝ না। সব কথা কী কেবল হাওয়ায় গড়া প্রাসাদ নাকি মাটির উপরে ভিত্তি আছে? কোনটা বিশ্বাস করবে সে?
___
“আমার ভাইকে জালে ফাঁসালে কেনো সুখোবতী? আমার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য? ছিহ্! তুমিও তোমার বাবার মতন।”
কথাটির পর ভীষণ জোড়ে একটা চড়ের শব্দ হলো এবং তারপর নিরবতায় ঘিরে গেলো রুমটা।
সন্ধ্যার মুহূর্ত বারান্দায় বসে অনুভব করছিলো সুখ। মেঘ বাহিরে গিয়েছিলো একটু কাজে। সেই সময়’ই মসৃনের আগমনে সুখ একটু অস্বস্তি অনুভব করলো কিন্তু পরক্ষণেই মসৃনের বলা কথা টাই অস্বস্তি সরিয়ে রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো, অতঃপর সশব্দে চড়।
মসৃন গালে হাত দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-‘তুমি,তুমি আমাকে চড় মারলে সুখোবতী? আমাকে?’
-‘কেনো? চড় কী আপনাকে মারার কথা ছিলো না? এই চড়টা সেদিন বিয়ের আসরে মারা উচিৎ ছিলো। আমি আমার বাবার মতন হয়েছি তাই না! তা আপনি কী মহাপুরুষ? আপনার ঐ মুখে আমার বাবার নাম নিবেন না। আপনার চেয়ে আমার বাবা হাজার হাজার গুণ ভালো ছিলো। তখন পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে হয়তো বিয়েটা করতে পারে নি তাই বলে তার জীবন সবটাই খারাপ কাজে অতিবাহিত হয় নি। আর আপনি, আপনি কী করেছেন বলুন! একটা কাজের রেশ ধরে রেখে আমার জীবনটা নষ্ট করলেন, আমার বোনের জীবনটা নষ্ট করলেন। আর আপনার এই কৃতকর্মের জন্য আমার বাবাটা আমায় এই পুরো দুনিয়ায় একা ছেড়ে চলে গেলো। আপনি আমার বিষন্নতার কারণ। আপনি আমার আকাশসম অ-সুখের কারণ।’
মসৃন জেনো একটু থমকে যায়। দু’কদম পিছিয়ে যায়। অবাক কন্ঠে বলে,
-‘তোমার বাবা আর বেঁচে নেই!’
-”আপনি তো এটাই চেয়েছিলেন, তাহলে অবাক হচ্ছেন কেনো? খুশি হোন। মিথ্যে কথার মায়ায় ফেলে বিয়ের আসর অব্দি টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন আমায় তাই না? মেঘের মা একা কাটাচ্ছে দিন, এটাই বলেছিলেন তাই না? তাহলে, মেঘ এর পরিচয় কী মসৃন?যার প্রতিশোধ নিতে গিয়েছিলেন সে তো আমায় নির্দ্বিধায় মেনে নিলো। আর আপনি কিনা আমাদের জীবনটা শেষ করে দিলেন।”
মসৃন উত্তর দেয় না। কিছুটা সময় নিশ্চুপ রয়। হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই সুখের দিকে তাকায়। চারপাশে তখন সন্ধ্যা গাঢ়ো হয়ে রাত নেমেছিলো। সুখের অশ্রুসিক্ত চোখ গুলো তবুও জানান দিচ্ছে অশ্রুর উপস্থিতি। মসৃন সেখাে পাত্তা না দিয়ে অবাক কন্ঠে বলে,
-‘তোমাদের জীবন মানে? ওয়েট ওয়েট,একটু আগে বললে তোমার বোনের জীবনও নষ্ট করেছি। কী করেছি আমি?’
সুখ দ্বিগুণ রেগে কিছু বলতে গেলেই বারান্দার দরজায় মেঘের উপস্থিতি টের পায়। মেঘ তড়িৎগতিতে এগিয়ে আসে সুখের দিকে। সুখ থমকে যায় সাথে ভড়কেও যায়। মসৃনও ভয় পেয়ে যায়। ভাই সবটা শুনে ফেলল না তো?
মেঘ সুখের সামনে এসে ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল,
-‘আপনি কান্না করছেন কেনো অপরিচিতা? কী হয়েছে? ঘরের লাইট অব্দি জ্বালান নি।’
এবার মসৃনের দিকে তাকিয়ে মেঘ অধৈর্য কণ্ঠে বললো,
-‘তুই তো অন্তত বল বিহঙ্গ। তোর ভাবী কান্না করছিলো কেনো? কী বলেছিস তুই?’
মেঘের হাত পা কাপিয়ে ঘাম দেয় শরীরে। আমতা-আমতা করে বলে,
-‘আসলে, আসলে ভাইয়া,,
-‘আসলে উনি আমার বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করাতে আমার কান্না চলে আসছে। সবাইকে খুব মনে পড়ছে তো।’
মেঘ এগিয়ে যায়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অপরিচিতা’কে। সুখ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে,যাক মেঘ অন্তত কিছু শুনে নি।
মসৃন আলগোছে বেরিয়ে আসে। তার জন্য একজন মানুষ আত্মহত্যা করেছে সে ভাবতে পারে নি। সে তো একা দোষী না। আরেকজনও সে দোষের ভাগীদার। আর এমন হওয়াটা কী স্বাভাবিক না? মানুষটা অপমানে আত্মহত্যা করতে পারে সেটা তো আগেই ভাবা উচিৎ ছিলো। ভালোবাসা আর ক্রোধে অন্ধ না হলেও পারতো। আজ কেনো ব্যাথা হচ্ছে গোপনে? কেনো সুখকে ভাই এর পাশে সহ্য হচ্ছে না? মায়া নাকি প্রতিশোধ থেকে এ খারাপ লাগা?
_____
গভীর রাতে একটা অস্পষ্ট শব্দ ভেসে হলো সুখের কানে। আধো নিদ্রা আধো জাগরণের কারণে ঠিক আন্দাজ করতে পারলো না শব্দের উৎসটা। তবে খুব পরিচিত শব্দ এটা। চোখে রাজ্যের ঘুমের আবরণের কারণে শব্দের সন্ধানে যেতে পারে নি সুখ। ঘুমটা আরও গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে অতলে তলিয়ে নিলো তাকে।
—
সকাল হতে হৈ হুল্লোড়ে সুখের শ্বশুরবাড়ি রমরমা। সুখ চিৎকার চেঁচামেচিতে আর টিকতে না পেরে উঠে বসলো। ড্রয়িং রুম থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসতেই সেখানে পা বাড়ালো।
ঘুমো ঘুমো কন্ঠে অবাক হয়ে সে জিজ্ঞেস করলো,
-‘কী হয়েছে?’
মেঘ সুখের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-‘দেখছেন,মিনা মায়ের সব গয়না নিয়ে পালিয়েছে। ওর এসব উদ্ভট কথার কারণ এটাই। কত বিশ্বাস করতাম ওরে। এবার বুঝলেন তো ও কতটুকু সত্যি বলে?’,
সুখের মস্তিষ্ক অব্দি কথাটা পৌঁছাতেই আৎকে উঠলো সে। মিনা পালিয়েছে? মিনা মেয়েটাকে যতটুকু মনে হয়েছে সে তো এমন না। তবে? হঠাৎ কাল রাতের অস্পষ্ট শব্দের কথা মনে পড়লো সুখের। শব্দের উৎসটা পরিষ্কার হলো। এটা গাড়ির শব্দ ছিলো। তবে কী মিনা পালায় নি। তার সাথে অন্য কিছু হয়েছে?
#চলবে