#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা
পর্বঃ বারো
(লেখিকার অনুমতি ব্যাতিত কপি নিষেধ)
দীর্ঘ ছয়ঘন্টা যাবত সুখকে পাগলের মতন খুঁজছে মেঘ। সকাল হতেই সে চলে এসেছিলো সুখের বাড়ি কিন্তু সেখানে এসেই শুনতে পায় চাঞ্চল্যকর খবর। সুখ গতরাতেই বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে গেছে। বের হয়ে গেছে বললে ভুল হবে বের করা হয়েছে। মেঘের রাগ জেনো আকাশ ছুঁয়েছিলো, ইচ্ছে করছিলো সবাইকে গলা টিপে মেরে ফেলতে। তারপর সেখান থেকে বের হয়ে অনুর বাড়ি আর হিমার বাড়িও খোঁজ করেছে।
এত বড় শহরে কোথায় খুঁজবে অপরিচিতাকে? তবে কী অপরিচিতা, অপরিচিতা হয়েই থেকে যাবে? উপায়ন্তর না পেয়ে মেঘ কল লাগায় ইউসুফকে। অপর পাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই মেঘ ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলল,
-‘ইউসুফ তোমার মেমকে খুঁজে পাচ্ছি না। তাকে কাল রাতে ঘর থেকে বের করা হয়েছে। কী করবো ইউসুফ? আমার মাথা যে কাজ করছে না।’
-‘স্যার, এখন আপনি কোথায় আছেন?’
-‘এইতো ইউসুফ বাস স্ট্যান্ড এর কাছে। খোঁজ করে দেখতে হবে কেউ কিছু বলতে পারে কি না।’
ইউসুফ ছোট্ট শ্বাস ফেলল। প্রণয় বুঝি এমন হয়? একজন গম্ভীর মানুষকে কেমন মাতোয়ারা করে দিয়েছে। প্রেম নামক বস্তুটা মরুভূমিতেও জল বের করতে পারবে বোধহয়। ইশ্ মাঝে মাঝে মনে হয় “যে মানুষ একবার জীবনে প্রণয়ে জড়ায় নি, সে সমস্ত জীবনটাই মধু বিহীন কাটিয়েছে। প্রেম এমন একটা জিনিস যার প্রাপ্তিতে মিলবে অমৃত আর বিচ্ছেদে মিলবে গরল। তবুও একবার স্বাদ গ্রহন করা উচিত। হয় অমৃত নাহয় গরল কিছু তো মিলবে।”
ইউসুফকে চুপ থাকতে দেখে মেঘ অধৈর্য হয়ে বলল,
-‘ইউসুফ কিছু বলবে না আমি ফোনটা রাখবো?’
ইউসুফ থতমত খেয়ে বলল,
-‘না স্যার কাটবেন না। আপনি তো বাস স্ট্যান্ডে আছেন,গাড়িটা ঘুরিয়ে আরেকটু এগিয়ে আমার বাড়ির সামনে চলে আসুন আমিসহ মেমকে খুঁজবো। আর এ সময় আপনার ড্রাইভিং করাও ঠিক না।’
ইউসুফের যুক্তিটা অর্থবহ মনে হলো মেঘের। সে “আচ্ছা” বলেই ফোনটা কেটে গাড়িটা আরেকটু সামনে নিয়ে ইউসুফদের বাড়ির সামনে দাঁড়ালো।
মেঘ গাড়ি থামাতেই দেখে ইউসুফ বেশ সুন্দর ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ ভ্রু কুঁচকে বলল,
-‘উঠো গাড়িতে।’
ইউসুফ এগিয়ে আসলো, মেঘের পাশের দরজাটা খুলে দিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
-‘আমরা মেমকে খুঁজতে ঠিকই যাবো স্যার তবে, তার আগে আম্মু আপনাকে দেখা করতে বলেছে। চলুন।’
মেঘ বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে বলল,
-‘তুমি আন্টিকে কোনো বললে আমার আসার কথাটা? জানোই তো এখন আমার স্বস্তি মিলবে না যতক্ষণ অব্দি অপরিচিতার দেখা না পাই।’
-‘জ্বি স্যার জানি। তবুও আম্মু বলেছে একটু রাখুন।’
মেঘ আর কথা বললো না। গাড়ি থেকে নেমেই গটগট পায়ে হাঁটা ধরলো। তার পিছু পিছু ভিতরে গেলো ইউসুফও।
ফ্লাটের দরজাটায় কলিং বেল বাজাতেই ইউসুফের বোন দরজাটা দ্রুত খুলে দেয়। মেঘ ভিতরে ঢুকে আন্তরিকতার সাথে ইউসুফের আম্মু আমেনা রহমানের পানে তাকিয়ে মিষ্টি কন্ঠে বলল,
-‘আন্টি কেমন আছেন?’
মহিলাও মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলল,
-‘ভালো,বাবা। তুমি কেমন আছো?’
মেঘ “ভালো আছি” উচ্চারণ করার আগেই সোফায় বসে থাকা ব্যাক্তিটাকে দেখে চক্ষু চড়কগাছ। মুখের কথা মুখের ভিতরই রয়ে গেলো। বরং সে কথার বদলে বিষ্ময়কর কন্ঠে বলল,
-‘অপরিচিতা আপনি?’
মেঘ দ্রত এগিয়ে গেলো সুখের কাছে। সুখ সোফাতেই তখনও ঠাঁই বসে রইলো। মেঘ এগিয়ে গিয়ে আবারও একই প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো। এবার পিছন থেকে ইউসুফ জবাব দিলো,
-‘আমিই মেমকে কাল রাতে এখানে এনেছিলাম। আপনাকে তো আর শ্বাসকষ্ট নামক রোগে ডুবাতে পারি না।’
ইউসুফের কথা থামতেই ড্রয়িং রুমে হাসির জোয়ার বসে গেলো।মেঘও হেসে দিলো। মেঘের নিজেকে অতি সুখে পাগল মনে হলো। কি জেনো হারিয়ে গেছে অনুভূতিটা হঠাৎ করেই চলে গেলো। সে অপরিচিতার পাশে গিয়ে বসলো।
ইউসুফ মেঘের সামনে এসে দাঁড়ালো। সুখ এবার মুখ খুললো,ধীর কন্ঠে বলল,
-‘ভাইয়া বসুন।’
ইউসুফ হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে “না” ইশারা করলো। মেঘ গলা পরিষ্কার করে ইউসুফকে চোখের ইশারায় বসতে বলল। সেকেন্ড দুইও ইউসুফ অপেক্ষা করেনা বোধহয় বসতে। সুখ অবাক হয় তবে এই ইউসুফ নামক মানুষটার প্রতি তার সম্মান আরেকটু বেড়ে যায়।
মেঘ এবার অধৈর্য কন্ঠে বলল,
-‘এবার বলো তো ইউসুফ,তুমি তোমার মেমকে কোথায় পেলে?’
মেঘের কথায় ইউসুফ বলা শুরু করলো। সুখও হারিয়ে গেলো কালকের বিভীষিকাময় রাতে,
রাত বারোটার কাছাকাছি। যশোরের মতন শহরেও একদম জনমানবশূণ্য মনে হচ্ছে এই সময়টা। সুখ ফুটপাতের উপর বসে আছে। দিনের বেলাতে অনেক রৌদ থাকলেও রাতের বেলাতে বেশ ঠান্ডা। শরীরে বিয়ের বেনারসী টা এখনো জড়িয়ে আছে সে। মাঝে মাঝে হিম শীতল বাতাস আচমকা হাড় কাঁপানো অনুভূতি দিয়ে চলে যাচ্ছে।
সুখ নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে পথের মলিন ধূলার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। রাস্তাটা একবারে শুনশান হওয়াতে ভালো হয়েছে, না আছে ভালো মানুষ আর না আছে খারাপ মানুষ। রীতিমতো গলার স্বর বসে গেছে। নিজের বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রথমে অনুদের বাড়িতে গিয়েছিল,কিন্তু গিয়ে শুনে অনুর মায়ের শরীর ভীষণ অসুস্থ হওয়ায় তারা তাকে হসপিটালে নিয়ে গেছে। আর, হিমার বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে সত্যি বলতে সুখের হয় নি। হিমার পরিবারে একমাত্র হিমা’ই সুখের ভরসা কিন্তু বাকি সদস্য গুলো সুখকে পছন্দ করেনা তৎকালীন ঘটনার জন্য। শুধু শুধু সেখানে গেলে ভীষণ ঝামেলা ছাড়া কিছুই হবে না তাই সুখ সেখানে যাওয়ার চেয়ে রাস্তাকেই উত্তম বলে ভেবে নিয়েছে।
এই বিপদের দিনে না চাইতেও সুখের আরেকজনের কথা মনে পড়েছে,সে হলো মেঘ সাহেব। কিন্তু এমন উদ্ভট ভাবনার জন্য সুখ নিজেই নিজেকে ভর্ৎসনা করেছে। এই পৃথিবীতে নিজের বাড়িটা ছাড়া আর কোনো জায়গা যে তার নেই।
সুখ যে ফুটপাতে বসে আছে তার ঠিক বিপরীত দিক থেকে কেউ একজন দ্রুত গতিতে সুখের দিকে ছুটে আসলো। কারো হিম শীতল হাত সুখের বাহুতে ঠেকল। সুখ ভয় পেলো, আৎকে উঠলো মনের কু ডাকে। দ্রুত গতিতে উঠে পিছে তাকাতেই চমকে উঠলো ভীষণ বিষ্ময়ে, অবাক কন্ঠে বলল,
-‘আপনি এখানে?’
সুখের চেয়েও দ্বিগুণ অবাক হয়ে ইউসুফ বলল,
-‘মেম,আপনি এখানে কেনো? এই এত রাতে একা এ রাস্তায় কী করছেন?’
সুখের উত্তর দিতে হয় না। ততক্ষণে ইউসুফ সুখের পাশে থাকা ট্রলি ব্যাগটা দেখে যা বুঝার বুঝে যায়। করুণ স্বরে বলল,
-‘অবশেষে বাড়ি ছাড়া হলেন? ঠাঁই দিলো না আপনার পাষাণ পরিবার?’
ইউসুফের করুন স্বরে বলা কথাটা সুখের হৃদয়ের গহীনে আন্তঃ ক্ষরণ করলো। ভীষণ রক্ত ঝড়ে পরলো হয়তো হৃদয় নিংড়ে। চোখ টলমল করে উঠল,কথা বললেই হয়তো কেঁদে দিবো তাই মুখ বন্ধ করে কেবল ডানে বামে মাথা নাড়ালো,যার অর্থ “নাহ্, এ বার আর ঠাঁই মেলে নি বাড়িতে।”
ইউসুফ কতক্ষণ চুপ রয়। নিরব রয় কিছুকাল। তারপর ধীর গতিতে কাপড়ের ব্যাগ টা হাতে নিয়ে নমনীয় স্বরে বলে,
-‘আমার সাথে চলুন মেম। আপনার এ ভাই আছে তো। আপনার চিন্তা কিসের?’
সুখ অবাক হয়। তার কানে “আপনার এ ভাই আছে তো” কথাটি পৌঁছাতে মস্তিষ্কের সব গুলো নিউরন সচল হয়ে উঠলো। কী পরম ভরসার কথা খানা তার কান শ্রবণ করলো বোধহয়। তবুও নিজেকে আরেকটু সংযত করে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-‘কোথাও যাবো ইউসুফ ভাই?’
-‘এই যে মেম,এই ভাইটার বাসায়। ভাই ডাকছেন অথচ কোথায় যাবেন তা নিয়ে চিন্তা করছেন? আপনার এ পৃথিবীতে আপনার ভাই তো বেঁচে আছে। এত চিন্তা কিসের?’
সুখের জেনো মনে হলো কূল কিনারা বিহীন সমুদ্র আশার প্রদীপ পেলো। কৌতূহল দমাতে না পেরে সে জিজ্ঞেস করল,
-‘আপনি এত রাতে এখানে কেন ভাইয়া?’
-‘আগে বাসায় আসুন তারপর সব কথা। আমার বোন আছেন বাসায় সাথে মা-ও। নির্দ্বিধায় চলুন।’
ইউসুফের গভীর সর্তকতার সাথে সুখের মনের দ্বিধা দূর করার প্রক্রিয়াটা অসাধারণ লাগলো সুখের। যতই ইউসুফ ভরসা যোগ্য হোক কিন্তু এত রাতে তার সাথে একটা বাড়িতে যাওয়া টা নিত্যান্তই দৃষ্টিকটু মনে হচ্ছিলো সুখের। সুখের এ ভাবনা ইউসুফ হয়তো আঁচ করতে পেরেছে তাই তো কৌশলে মা আর বোনের কথাটা বলেছে।
সুখ ইউসুফে কথায় মাথা নাড়াতে ইউসুফ ধীর গতিতে পা ফেলল পথে। রাস্তাটা পাড় হতেই একটা বাড়িতে ঢুকে পড়লো ইউসুফ, তার সাথে সাথে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো সুখও।আট তলা বিল্ডিং। তত আলিশান না হলোও বেশ স্বচ্ছল ভাবে থাকার মতন।
ইউসুফ সিঁড়ি ভেঙে তিন তলা উঠে বা’পাশের ফ্লাট টাই চলে গেলো। দরজা খোলাই ছিলো। রুমে প্রবেশ করতেই পুরো ড্রয়িং রুম জুড়ে অন্ধকার। ইউসুফ দ্রুত গতিতে হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে ড্রয়িং রুমের লাইট জ্বালায়। ফিল্টার থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে সুখের দিকে এগিয়ে দেয় এবং আশ্বস্ত কন্ঠে বলে,
-‘মেম আপনি পানিটুকু সোফায় বসে খান আমি আম্মুকে ডাক দিচ্ছি।’
অতঃপর ইউসুফ তার মা, বোনকে ডেকে আনলো। বেশ আদর যত্ন করে রাতটা অতিবাহিত করলো।
সমস্ত কথা শোনার পর মেঘ কতক্ষণ চুপ করে রয়। তারপর ধীর কন্ঠে সুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘অপরিচিতা আপনি আমার সাথে আমার বাসায় চলুন। আপনার থাকার জায়গার অভাব পরবে না।’
সুখ তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
-‘শেষমেশ লোকে আশ্রিতা বলুক সেটাই চাচ্ছেন? এই কলঙ্কও যেনো লেপিত হয়!’
সুখের এহেন প্রশ্নে ভড়কে যায় মেঘ। তারপর মনের গহীন কোণে খারাপ লাগাটা তড়তড় করে বেড়ে যায়। এই মেয়ে ভালো কথার মানুষ না। হঠাৎই শান্ত মেঘ অশান্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। রাগী কন্ঠে ইউসুফকে বলে,
-‘ইউসুফ, তোমার মেমদের বাড়ি যাবে এখন আর উনার দাদীকে নিয়ে আসবে। গো,ফাস্ট।’
স্যারের হঠাৎ বদলে থতমত খায় ইউসুফ। সেও দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। সুখ মেঘের আচরণ বুঝতে না পেরে অবাক কন্ঠে বলল,
-‘দাদীকে দিয়ে কী হবে? আগে আমার থাকার জায়গা ঠিক করি।’
মেঘ সুখের দিকে তাকায়। ইউসুফকে শক্ত কন্ঠে বলল,
-‘এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আচো কেন ইউসুফ? যা বলেছি তা ফাস্ট ফাস্ট করো। আর শুনো সাথে কাজি নিয়ে আসবে।’
ইউসুফ আর সুখ উভয়ে বিষ্ময় কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
-‘কাজি?’
মেঘ দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-‘হ্যাঁ কাজি। আশ্রিতা না বউয়ের পরিচয়ে অপরিচিতা আমার বাড়িতে উঠবে। এটাই লাস্ট কথা।’
#চলবে
[কি মনে হয়? বিয়েটা হবে?]