সিন্ধু ইগল – (৫)
ইসরাত জাহান দ্যুতি
১৩
মাথা যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে জায়িন বেলা সাড়ে বারোটায় নিচে নামল। সকালের নাশতাটাও করেনি সে। এই সময়ে বাড়িতে জান্নাতি বেগম আর কাজের দু’টো মানুষ ছাড়া আর কেউ থাকে না। তার ওপর আজ শুক্রবার। মাহতাব শেখ আর বাড়ির মেজো ছেলে জাহিদ এখন মসজিদে। ভাগ্যক্রমে কাল রাতে জায়িন আর রেজা বাড়ি ফিরেছিল বলে তারাও এই মুহূর্তে বাড়িতে উপস্থিত আছে।
জান্নাতি বেগম প্রতি শুক্রবার দুপুরের আয়োজনে খাবার-দাবারের এলাহি আয়োজন করেন। কারণ, এই দিনটাকে তিনি আর মাহতাব শেখ ঈদের দিনের মতোই গুরুত্ব দেন।
খাবারের গন্ধে জায়িন মাথা যন্ত্রণার কথা ভুলে গেল। শুক্রবারের কথা মনে হতেই বুঝতে পারল এত সুস্বাদু খাবারের গন্ধ কেন চারপাশে! জান্নাতি বেগম তাকে দেখে কঠোরভাবে আদেশ জানালেন, ‘এক্ষুনি গোসল করে, অযু করে মসজিদে যাবি। আমাকে যেন আর দ্বিতীয়বার এই কথা উচ্চারণ করতে না হয়।’
মায়ের এই আদেশে বিরক্তির সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জায়িন আবার ওপরে চলে গেল। মায়ের কথামতোই জলদি গোসল সেড়ে ছুটল মসজিদে।
রান্নাবান্না শেষে জান্নাতি বেগম ফুলিকে পাঠালের জাদু মাধুর বাসায়। ওদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে বললেন তিনি। এই ফাঁকে তিনি নিজেও ফ্রেশ হয়ে পরিপাটি হয়ে নিলেন। সুইটি নামের আরেকজন কাজের মেয়েটিকে সঙ্গে করে গেস্টরুমে আলাদাভাবে খাবারের আয়োজন করে রাখলেন। মাহতাব শেখ আর বাড়ির দু’ছেলের সাথে বসে জাদু মাধুকে নিয়ে তিনি খেতে বসতে পারবেন না। কারণ, মাহতাব সাহেব তা পছন্দ করবেন না।
জান্নাতি বেগমের অনুরোধ আর ফুলির জোরাজোরিতে মাধুকেও তৈরি হতে হলো শেখ বাড়ি যাবার জন্য। দু’বোনই ধবধবে সাদা রঙের সেলোয়ার-কামিজ পরে, চোখে চশমা নিয়ে, মাথায় ভালোভাবে ওড়না টেনে চলে আসলো শেখ বাড়িতে। মুখে প্রকাশ না করলেও জাদুর সঙ্গে মাধুও বেশ উত্তেজিত। কিন্তু তার মাঝের এই উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু যে জায়িনই, তা সে নিজেই বিশ্বাস করতে চাইছে না। দু’বোনের চেহারা অবিকল একই হলেও বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য তাদের মাঝে ভিন্ন। যেমন, এ বাড়িতে আসার জন্য উত্তেজনা দু’বোনের মধ্যে কাজ করলেও তা শুধু জাদুর চেহারা দেখেই মানুষ বুঝতে পারবে। কিন্তু মাধুকে দেখে বোঝার উপায় নেই, যে সেও একইরকম উত্তেজিত।
জান্নাতি বেগম মাত্র একবারই মাধুকে দেখেছিলেন। আজ পাশাপাশি দু’বোনকে এক সাথে দেখে তিনি একেবারেই বিভ্রান্তে পড়ে গেছেন, কে জাদু আর কে মাধু! এগিয়ে গিয়ে দু’বোনকে বসার ঘরে নিয়ে এলেন। দু’জন এক সঙ্গেই সালাম দিয়ে উঠতেই জান্নাতি বেগম হাসি মুখে সালামের জবাব দিয়ে বললেন, ‘আমাকে তোমরাই চিনিয়ে দাও তো। কে জাদু আর কে মাধু? আমি একেবারেই আলাদা করতে পারছি না তোমাদের।’
মাধু মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘আমি মাধু, আন্টি। তবে আমাদেরকে আলাদা করা ভীষণ মুশকিল। বলা যায় অসম্ভব।’
জাদু তখন বলল, ‘অসম্ভব তো বটেই। কিন্তু একটা উপায় আছে। সেটা হলো আমাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে চিনে নেওয়া সম্ভব।’
জান্নাতি বেগমও হেসে বললেন, ‘কিন্তু তা তো আর সম্ভব হচ্ছে না। তাই তোমরাই আমাকে সাহায্য কোরো তোমাদেরকে চিনতে।’
-‘জি অবশ্যই।’ জবাব দিলো মাধু।
নামায শেষ করে তিন বাপ ছেলে এক সঙ্গেই ঘরের মূল ফটক পেরিয়ে বসার ঘরে এলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তিনজনের নজর আটকাল সোফায় পাশাপাশি বসে থাকা একইরকম দেখতে দু’টো মেয়ের দিকে। রীতিমতো হতবুদ্ধি অবস্থা মাহতাব শেখ আর জাহিদের। জায়িন এক ঝলক ওদেরকে দেখে সোজা রেজার ঘরে চলে গেল। ঘুমানোর সুযোগ পেলে রেজা ছেলেটা দিন দুনিয়া ভুলে যায়। তার এই ব্যাপারটাতে জায়িন ভীষণরকম বিরক্ত। ঘরে ঢুকেই রেজার নিতম্বের ওপর সজোরে একটা চাপড় মেরে খেঁকিয়ে উঠল, ‘জমিদারের পুত্র! আপনার আজ্ঞাবহ দাস এসে হাজির হয়েছেন। তিনি আপনার ফরমায়েশ পাবার জন্য আকুলভাবে অপেক্ষা করছেন।’
ততক্ষণে রেজা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে বিছানা থেকে নেমে। জায়িন কটমট চোখে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আমি কাজের প্রেশারে মরি আর তুমি ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে ভাসো?’
বেচার রেজার অসহায় চেহারাটা দেখার মতো ছিল তখন। যেন উদ্বাস্তু একজন মানুষ সে। ‘স্যরি স্যার’ বলে মাথা ঝুঁকিয়ে ফেলতেই জায়িন কড়াভাবে তাকে আদেশ করল, ‘ফ্রেশ হয়ে জলদি খাবারের টেবিলে আসো।’
বলেই বেরিয়ে গেল সে। গেস্টরুম থেকে তার মায়ের সঙ্গে জাদুর কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে আসছে। সেদিকে অবশ্য এই মুহূর্তে তার ধ্যান দেওয়ার ইচ্ছা নেই। আপাতত দুপুরের ভোজটা আগে তার কাছে।
১৪
দুপুরের খাবারদাবারের পাট চুকে গেছে প্রায় ঘণ্টাখানিক হলো। বসার ঘরে এখন জান্নাতি বেগম আর জাদু মাধু বসে গল্প করছে। এর মাঝে জায়িনকে আর দেখতে পায়নি জাদু মাধু কেউ-ই। কিন্তু দু’বোনই ভেতরে ভেতরে একজনকে দেখার অপেক্ষাতে আছে। সেই অপেক্ষার অবসান ঘটল ঘণ্টা একটা পার হয়ে যাবার পর।
জায়িন ফরমাল বেশে রেজাকে নিয়ে খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথা বলতে বলতে সিঁড়ি বেঁয়ে নিচে নামছে। বসার ঘরে পা পড়তেই জায়িনের চোখ আটকাল সরাসরি জাদু আর মাধুর দিকে। জাদুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই জাদু মুচকি হেসে জায়িনকে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছেন?’
জায়িন আর রেজা তখন বুঝতে পারল এটা তবে জাদু। জায়িন উত্তরে মুচকি হেসে জানাল, ‘বেশ ভালো। আপনারা দু’বোন টুইন। তা জানা থাকলেও আজ সচক্ষে দেখার ভাগ্য হলো। আপনাদেরকে এক সঙ্গে দেখে খুব ভালো লাগছে।’
জাদু বলল, ‘আপনি বোধ হয় কোথাও যাচ্ছিলেন। দেরি করিয়ে ফেললাম বলে খুবই দুঃখিত।’
-‘দুঃখিত হবার কিছু নেই। আর দেরিও করাননি।’
বলে রেজাকে আদেশ করল গাড়িতে গিয়ে বসতে। সে কিছুক্ষণ বাদে আসছে। রেজা চলে গেল। জায়িন এসে সরাসরি জাদুর মুখোমুখি বসল। জান্নাতি বেগম তখন জায়িনকে বললেন, ‘আমি ওদের দেখে চিনতেই পারিনি কোনটা জাদু আর কোনটা মাধু। এই যে এখনো ওরা যদি না বলত কে কোনটা, তাও চিনতে পারতাম না।’
জায়িন হাসল মায়ের কথা শুনে। তারপর জাদুর দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনাকে কাল রাতে ওই সময়ে দেখে একটু খারাপ লেগেছিল। তাই ওভার রিয়্যাক্ট করে ফেলেছিলাম। কিছু মনে করেননি তো? আসলে বাংলাদেশের মতো জায়গায় রাত দিন কোনো সময়ই আজকাল মেয়েদের জন্য সেফ নয়।’
জায়িনের কথাগুলো শুনে জান্নাতি বেগম কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকালেন ছেলের দিকে। ঘটনা কী তা জানার জন্য। জাদু আর মাধু অবশ্য নির্বিকারই রইল। জাদু হেসে জায়িনকে ইশারায় মাধুকে দেখিয়ে বলল, ‘আমার বোন ছিল আপনার সামনে তখন। ওর রাতে ঘুমানোর অভ্যাসটা খুবই কম। অভ্যাসটা বদলানো ভীষণ দায় হয়ে পড়েছে ওর জন্য।’
জায়িন মুখটা লজ্জিত ভঙ্গিতে কুঁচকে ফেলল, ‘ওপস্! তাহলে তো প্রথম দেখায় বেশ বাজে আচরণ করে ফেলেছি ওনার সঙ্গে। রিয়্যালি ভেরি স্যরি মাধু। জাদুর সঙ্গে চেনাজানা ছিল বলে ওইভাবে কথাগুলো বলে ফেলেছিলাম।’
মাধু কৃত্রিম হাসি টেনে উত্তর দিলো, ‘সমস্যা নেই। বরং ভালোই লেগেছিল আমার। মনে হচ্ছিল আপন একজন দায়িত্ববান পুরুষের মতো কথাগুলো বলেছিলেন। তাই খারাপ লাগেনি।’
মুখে হাসিটা থাকলেও জায়িন স্পষ্ট ধরতে পারল, মাধুর চোখে মুখে বিরক্তিভাব। কিন্তু হঠাৎ বিরক্ত হয়ে পড়ল কেন মেয়েটা, সেটাই বুঝতে পারল না সে।
মাধু আর একটা মুহূর্ত এখানে বসে ফালতু সময় কাটাতে চাইছে না। যে ভাবনা ভেবে সে উত্তেজনা নিয়ে এ বাড়িতে আসতে রাজি হয়েছিল, আসার পর ধৈর্য সহকারে অপেক্ষায় থেকে জায়িনকে দেখার পর তার সেই ভাবনা পালটে গেছে। নিজের ভাবনার ওপর নিজেই রাগান্বিত হলো সে। যাকে সে ভেবেছিল, সেই মানুষটির সঙ্গে জায়িনের মিল থাকতেই পারে না। গতকাল রাতে জায়িনের মুখটার দিকেই শুধু তাকিয়ে ছিল। আর কিছু লক্ষ করেনি। কিন্তু এখন সে জায়িনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিজের ভাবনার ভুল প্রমাণ পেল। তাই আর এখানে বসে থেকে সময় নষ্টের আর কোনো মানেই হয় না। জাদুর দিকে একবার তাকাল সে। জায়িন আর জান্নাতি বেগমের সাথে এমনভাবে গল্পে মেতে উঠেছে, যেন একেবারের জন্য থেকে যেতে পারলে খুব খুশি সে। না চাইতেও জায়িনের দিকে তাকাল আরেকবার। জাদুর জন্য জায়িনের চোখেও স্পষ্ট আগ্রহ দেখতে পাচ্ছে সে। এরপর যে ধারণাটা হলো তার, তা হলো খুব শীঘ্রই দুজনের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক ঘটতে চলেছে। তবে জাদু চাইলেও জায়িনের দিকে চেয়ে থেকে কথা বলতে পারছে না। এই ব্যাপারটা মাধু দেখতে পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু জায়িনের চোখের দিকে জাদুর তাকাতে না পারার কারণটা সে ধরতে পারছে না। জাদু বলেছিল, জায়িনের চোখে ওর প্রতি খুব রাগ দেখতে পায়। কিন্তু কই? তার সাথে কথা বলার সময় সে তো তা দেখতে পেল না জায়িনের চোখে! জাদুর এই বিষয়টাতে মাধু খানিকটা বিরক্তই হলো জাদুর প্রতি। যার জন্য মনের মধ্যে ভালোবাসার অনুভূতি তৈরি হচ্ছে অথচ সেই মানুষের চোখের দিকেই তাকাতে নাকি সাহস পায় না সে! তাহলে দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা হবে কী করে? তবে জাদুর পছন্দের তারিফ সে মনে মনে ঠিকই করল। লন্ডন থাকাকালীন কখনো কোনো ছেলের দিকেই দৃষ্টি আটকায়নি তার। কিন্তু জাদুর মতো তারও মনে হচ্ছে, কিছু একটা আছে জায়িনের মাঝে। যা তার দিকে তাকাতে বাধ্য করবে। নিঃসন্দেহে জায়িনের কণ্ঠ, কথা আর হাসি সুন্দরের দাবিদার। এমনকি তার উচ্চতা থেকে শুরু করে দৈহিক কাঠামোও নজরকাড়া। কিন্তু এগুলো নিশ্চয়ই এমন বিশেষ কিছু নয়, যা তারা দু’বোন কোনোদিন কোনো ছেলের মাঝে দেখেনি?
ভ্রুকুটি চোখে তাকিয়ে মাধু লক্ষ করেই চলেছে জায়িনকে। যা ড্রয়িংরুমে বসা তিনটি মানুষের মধ্যে জায়িন নিজেই তা টের পাচ্ছে মাধুর দিকে সরাসরি না চেয়েই। হঠাৎ করেই মাধু একটুখানি হেসে জান্নাতি বেগমকে প্রশ্ন করে বসল, ‘আন্টি, আপনাদের পরিবারে আর কেউ কালো বা শ্যামবর্ণ আছে? আপনি আর আঙ্কেল দুজনেই এত ফর্সা, এমনকি আপনার মেজো ছেলেও। সেখানে জায়িন সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি আপনাদের থেকে অনেকটাই ভিন্ন হয়েছেন।’
মাধুর অকপটে বলা এমন কথাগুলোতে জান্নাতি বেগম আর জাদুও ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়লেন। বোনের কাণ্ডে জাদু রীতিমতো লজ্জাবোধ করছে। এই প্রশ্নটা যে তার মনেও আসেনি, তা নয়। কিন্তু তা সরাসরি জিজ্ঞাসা করতে পারেনি সে। আর এমন কথা সরাসরি জিজ্ঞাসা করার মতোও নয়। বিব্রতকর চেহারায় জাদু জায়িনের দিকে তাকাল। সে সোফার হাতলের ওপর ডান হাতের কনুই ঠেকিয়ে দু আঙুল ঠোঁটের ওপর চেপে রেখে মিটিমিটি হাসছেন, মায়ের দিকে চেয়ে। আর জান্নাতি বেগম ভেতরে ভেতরে জায়িনের ওপর রাগে ফাটছেন এই ভেবে, শেষে কিনা ছেলের কাণ্ডকারখানার জন্য তাকে মিথ্যা বলতে হবে? কিন্তু জায়িন সে সুযোগ দিলো না। জাদুর দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে জবাব দিলো, ‘আমি অমবস্যা তিথিতে হয়েছিলাম তো, তাই অন্ধকারের মতোই দেখতে হয়েছিলাম। শেষে বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তায়ালার অসীম ক্রিপায় অন্ধকার রংটা বদলে শ্যামবর্ণে এসে ঠেকেছে। এ জন্যই আমি আব্বা আম্মা আর দু’ভাইয়ের মতো সুন্দর সাদা হইনি।’
কথাগুলো যে মশকরার ছিল, তা মাধু ভালোই টের পেয়েছে। তবে সে আর ঘাটাঘাটি করল না জায়িনকে নিয়ে। ইতোমধ্যে জায়িনের মাঝের বিশেষ দিকটা তার নজরে ধরা পড়ে গেছে। জাদু ঠিকই বলেছিল, এই ছেলের হাসি আর চোখের চাউনি এতটাই সুন্দর যে নারী হৃদয় খুন হবেই। জাদুর ভাষায় এই দুই জিনিস ভয়ঙ্কর সুন্দর। কিন্তু মাধুর ভাষায় তা, শুভ্রের মতো পবিত্র আর নির্মল। তবে নিজের বলা একটা কথাতে মাধু বিশ্বাসী। যা দেখতে অতিরিক্ত সুন্দর আর স্বচ্ছ, তার ভেতরের বৈশিষ্ট্য ততটাই কঠিন আর বিষাক্ত। আর তা অর্জন করাও অনেকটা দুরূহ৷
১৫
হঠাৎ কল আসায় মাধু তখন ‘আর্জেন্ট কল’ বলে জায়িনদের থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে এসেছিল জাদুকে রেখেই। কারণ, জান্নাতি বেগম আজ ওদের দুজনকে নিজের বাড়ি, বাগান, আশপাশ ঘুরিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জান্নাতি বেগমের পরিবর্তে জায়িন আগ্রহ দেখায়, জাদুকে সব কিছু ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য। তাতে জান্নাতি বেগম বাধা দিলেন না৷ বরঞ্চ খুশিই হলেন। খালি সাবধানে থাকলেন, এই ঘটনা তার স্বামীর চোখে যেন না পড়ে।
আজ অনেকক্ষণই জায়িন আর জাদু এক সঙ্গে সময় কাটিয়েছে। এমনকি তাদের মধ্যে ফোন নাম্বারও আদান প্রদান হয়ে গেছে। দেশে ফেরার পর জাদু মাধু কেউ-ই তেমন কোথাও এখন অবধি যাবার সুযোগ পায়নি। শুধু নিজেদের জন্মস্থান সিলেট ছাড়া। তা শোনার পর জায়িন নিজে থেকেই তাকে গাজীপুরের দর্শনীয় সব স্থানে নিয়ে যেতে চেয়েছে। জায়িনের এত সহজ স্বাভাবিক ব্যবহারের পরও জাদু কিছুতেই তার সাথে সহজ হতে পারছিল না। কারণ পুরোটা সময় জায়িন স্বাভাবিকভাবে কথা বললেও চোখে মুখে ছিল তার ভীষণ গম্ভীরতা। আর কেমন যেন জহুরি চোখে তাকে দেখছিল কথার ফাঁকে ফাঁকে। যেই দৃষ্টিতে তার ঘায়েল হবার কথা, সেই দৃষ্টিতে সে নিজের জন্য যেন মৃত্যু দেখতে পাচ্ছিল। এমনটা কেন মনে হচ্ছিল তা যে জাদুর জানা নেই। কিন্তু পরক্ষণেই সে এই ভেবে নিজেকে বোঝায়, সব প্রেমিকের চোখেই প্রেমিকারা তাদের সর্বনাশ দেখতে পায়। তাই তো জায়িনের অত সুন্দর দৃষ্টিতে সে আতঙ্কিত হলেও তার থেকে দূরে থাকতে পারে না৷
শেখ বাড়ি থেকে ফিরেই জাদু দেখতে পেল তার ছুরিতে মাধু ধার দিচ্ছে বসে৷ তা দেখে খানিকটা অবাক হলো সে। জিজ্ঞেস করল, ‘হঠাৎ আমার ছুরিতে ধার দিতে বসলি যে?’
-‘কাজ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই অকাজ করতে বসলাম।’
জাদু গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে ফোনটা নিয়ে মাধুর পাশে বসল। তা খেয়াল করে মাধু হেসে ফেলল। বোনের মনে বসন্তের বাতাস দোলা দিচ্ছে যে! জাদু জিজ্ঞেস করল ওকে, ‘কেমন দেখলি ওকে তা তো বললি না।’
-‘প্রশংসার দাবিদার তোর পছন্দ।’
-‘তাহলে কি এগোনো যায়?’
-‘নিশ্চয়ই।’
-‘কিন্তু আমি ওর সাথে একদমই সহজ হতে পারছি না। প্রেমটা করব কী করে?’
-‘যেভাবে বাকিরা করে।’
-‘তুই একটু সিরিয়াস হ মান আমাকে নিয়ে। তুই ভালো করেই জানিস আমার এই সমস্যাটা খুবই জঘন্য। একবার কোনো কিছুতে ভয় ধরে গেলে তা থেকে আমি হাজার মাইল দূরে থাকি। শুধু জায়িনের বেলাতেই তার উলটো হচ্ছে। এতক্ষণ সময়ের মাঝে আমি হাতে গুনে চারটা কথা বলেছি। বাকি সময় জায়িনই কথা বলেছে। কথাই যেখানে বলতে পারছি না, সেখানে ওকে ইমপ্রেস করব কীভাবে?’
-‘এই ব্যাপারে আমি তোকে পরোক্ষভাবে হেল্প করতে পারব, নানারকম সাজেশন দিয়ে। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে না।’
জাদু অসহায় মুখ করে তাকাল। তা দেখে মাধু চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে তাকিয়ে রইল বোনের দিকে।
_________