সিন্ধু ইগল – (১৫)
ইসরাত জাহান দ্যুতি
শেখ বাড়িতে দেখতে দেখতে তিনটা দিন কেটে গেল মাধুর। তিনটা দিনে এই পরিবারের প্রতিটা মানুষকে সে খুব কাছ থেকে চিনতে এবং বুঝতে পারলেও শুধু একজনকে তার সেভাবে চেনা হলো না এবং জানা হলো না। জাকিরকে ছেড়ে মাহতাব শেখ কেন জাহিদকে আগে বিয়ে দিলেন তা জানতে পারল না সে৷ আবার একদিন জান্নাতি বেগম মুখ ফসকে আফসোসের সুরে বলে ফেলেছিলেন ‘আমার জায়িনের ভাগ্যটাও জাকিরের মতোই হলো বোধ হয়।’ বেশ সরল মনের মানুষ জান্নাতি বেগম। তাই যাকেই আপন মনে হয় তার, সেই ব্যক্তির কাছেই মনে জমিয়ে রাখা যত গল্প আছে সব হড়বড় করে বলতে থাকেন তিনি। সেদিনও গল্পে গল্পে মাধুর কাছে এমন একটি কথায় বলে ফেলেছিলেন। কথাটি বলার পর তিনি নিজেই প্রসঙ্গ বদলে নেন। তাই আর সেই ব্যাপারে দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করেনি মাধু। কিন্তু সেই একটি কথা প্রচণ্ড ভাবায় মাধুকে। জাদু তাকে জায়িনের ব্যাপারে খুটিনাটি সব তথ্য জানিয়েছিল। কারণ, সে নিজেই জায়িনের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছিল। কিন্তু তারপরও জায়িনের সম্পর্কে অজানা আরও অনেক কিছুই রয়ে গেছে। যা জাদু সংগ্রহ করতে পারেনি। এমনটাই মনে হলো মাধুর। তবে তিনদিনের বেশি আর থাকার ইচ্ছা হয়নি তার। খানিকটা সুস্থবোধ করতেই সে নিজের বাংলোতে ফিরে আসে। আর এই তিনদিনে জায়িন নিজেও সারাক্ষণ বাসায় থেকেছে। কিন্তু তার সঙ্গে খুব একটা দেখা করতে আসেনি। সৌজন্য রক্ষার্থে যতটুকু খোঁজ নিতে হয়, কেবল ততটুকুই নিয়েছে সে।
খুব সকালে বাংলোতে ফিরলেও মাধু সারাদিন বাইরে সময় কাটিয়েছে। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই সে প্রথমে এক ঘণ্টা ধরে গোসল নিয়ে রুমে ফেরে। ক্লজেট থেকে জামা-কাপড় বের করতে গিয়েও হঠাৎ কী ভেবে মুচকি হেসে ওঠে সে। পরনের টাওয়াল ছেড়ে আর জামা কাপড় পরা হলো না তখন। শরীরে টাওয়ালটা প্যাচানো অবস্থাতেই রান্নাঘরে গিয়ে কফি তৈরি করে চলে আসে জাদুর ঘরে। গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে লক্ষ করতে থাকে জায়িনের ঘরের জানালাটা। জায়িন সেখানে থাকলেও সে দেখতে পাবে না। তবুও চেয়ে থাকে সে। অল্প কয়েক মুহূর্ত পর মোবাইলে কিছু একটা লিখে বার্তা প্রেরণ করে জায়িনকে। তারপর সে ফিরে যায় নিজের ঘরে। রাতের পোশাকটা পরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে খুব যত্নের সাথে সেজে নেয়। আজ জাদুর মতো তারও অন্ধকারের মাঝে থাকার ইচ্ছা জেগেছে খুব। সারা বাংলোর আলো নিভিয়ে সে কর্টইয়ার্ডে গিয়ে বসে।
পঁচিশ মিনিট পেরিয়ে মাধু দেখতে পায় তার আকাঙ্ক্ষিত প্রিয় মানুষটিকে। যার অপেক্ষাতেই বসে আছে সে। সারা বাংলো আঁধারে ডুবে থাকলেও সারা পৃথিবী জ্যোৎস্নাতে মাখামাখি। সেই আলোতেই তার দিকে হেঁটে আসা সুপুরুষটিকে দেখতে পাচ্ছে সে। শোনা যায় জ্যোৎস্নার আলোতে মায়াবী মেয়েদের রূপ ঝলকানি দেয়। কিন্তু আজ তার সুপুরুষের বেলায় সেই কথাটি খাটবে বলে মনে হচ্ছে । এতকাল সবার চোখে সেজে থাকা মেঘবর্ণ সুপুরুষটি শুধু তার সামনে স্বরূপে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে সংবেশিত করে তুলেছে। কোনোদিনও কল্পনা করেনি সে, তার ভাগ্যে এমন একটি মানুষ তার জীবনসঙ্গী হবে। বহুদিনের স্বপ্ন যেন পূর্ণ হতে চলেছে।
কর্টইয়ার্ডের সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল জায়িন। বলা যায় দাঁড়িয়ে যেতে হলো। এমন জ্যোৎস্নার রাতে শুভ্র নির্মল খোলামেলা নাইট স্যুটে কোনো সুন্দরী রমণীকে নির্বিকার রূপে কেউ বসে থাকতে দেখলে কেউ কেউ পরী ভেবেও ভয় পেয়ে যেতে পারে। জায়িন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মাধুর সামনে। মাধুর নগ্ন ডান পায়ের উরুতে দৃষ্টি বুলিয়ে সে স্মিত হেসে ফিসফিসিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে খুন করার ষড়যন্ত্র করেছ না কি?’
তার কণ্ঠ নকল করেই মাধু জবাব দিলো, ‘হুঁ, শেখ বাড়িতে সুযোগ পাইনি বলেই তো নিজ বাড়িতে চলে এলাম। আর তোমাকে ডেকে আনলাম খুন করতে।’
কথাটা শুনে জায়িনের ঠোঁটের হাসি চওড়া হলো। চট করেই কোলে তুলে নিলো মাধুকে। আরও একবার মাধুর কানেকানে বলল, ‘খুন করতে নয়, খুন হতে চলেছ তুমি।’
___________
মানসিক প্রশান্তির খোঁজ পাওয়াটা জাদুর কাছে সোনার হরিণ পাবার মতোই একটি ব্যাপার। নেশায় মত্ত থাকাকালীন এই শান্তির খোঁজ করতে হয় না তাকে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় থাকাটা তার জন্য ভারী দুরূহ বলেই মনে হয়। নিজের ব্যক্তিত্ব থেকে বেরিয়ে অভিনয় করে চলতে চলতে ক্লান্তি আসলেও তার বিশ্রামের সুযোগ নেই। এই জীবনটাকে সে কোনোদিনই বেছে নিতে চায়নি। আর এখন এই জীবনটাকেই তার মেনে নিতে হবে মৃত্যুদূত তার দুয়ারে না আসা অবধি। স্বাভাবিক অবস্থায় তার অন্তরে কখনো কারও প্রতি ভালোবাসা, দুঃখ, রাগ, ক্ষোভ, কিছুই অনুভূত হয় না। প্রিয়জনদের স্মৃতিও তার মানসপটে ভেসে ওঠে না। মনেই পড়ে না তার, এই পৃথিবীতে তার আপন বলতে কেউ ছিল। শুধু বোনটাকে তার প্রয়োজনে মনে রাখতে হয়। বোনটা না চাইলেও সে সব সময় বোনের কাছেই থাকতে চায়৷ একাকিত্ব তাকে ভোগায় না। তবুও সে একা নিজেকে রাখতে চায় না। অথচ সে জানে, বোনকে কাছে রাখা অর্থই নিজের জীবনটা হাতের তালুতে নিয়ে ঘোরা। তার কাছে মনে হয়, সাধারণ মানুষদের মতো জীবনযাপন তার জন্য নয়। তার জীবনটার প্রতিটি ধাপে ধাপে থাকবে সংগ্রাম আর কষ্ট। সংগ্রাম করে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে সে প্রচণ্ড উপভোগ করে। সে মনে করে, সহজভাবে জীবন পরিচালনার মাঝে কোনো আনন্দ নেই। ভারী অদ্ভুত তার চিন্তাগুলো!
বান্দরবন বগালেকে আদিবাসীদের ছোটো একটা কটেজ নিয়ে থাকছে সে প্রায় একটা সপ্তাহ। তার সঙ্গে যোগাযোগ করার মতো কোনো উপায় নেই কারও৷ যার প্রয়োজন তাকে, এতদূর ছুটে এসেই দেখা করে যেতে হচ্ছে। আর তার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কেবল অবগত চারজন মানুষ। যারা তার টেরোরিস্ট টিমের সদস্য। মাধুও এই মুহূর্তে জানে না তার অবস্থান। তবে তাকেও কিছুক্ষণের মাঝেই এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ভোর পাঁচটা বাজতে চলেছে। কেওক্রাডাং এর চূড়ায় দাঁড়িয়ে পাহাড় আর শুভ্র মেঘের মিলন ক্ষণকে দেখতে হঠাৎ খুব ভালো লাগছে জাদুর। দেশে বিদেশে কম সফর করতে হয়নি তাকে। কিন্তু নিজ দেশের সৌন্দর্যের মতো এমন করে কোনো রাজ্যের সৌন্দর্যই তার মনকে পুলকিত করেনি, নির্মল চোখদু’টোকে সিক্ত করেনি। খুব অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে তার৷ বারবার তার অন্তরাত্মা বলছে যেন ‘এ আমার সোনার দেশ, আমার দেশ।’ হঠাৎ দেশের প্রতি এমন অনুভূতি অনুভব হওয়ার কোনো নির্দিষ্ট কারণ সে খুঁজে পেলো না। আর খুঁজতে চাইলও না। তবে এটাই যে তার শেষ দেখা।
____________
বুকের মাঝের রক্ত জমাট বেঁধে থাকা জায়গাটুকু দেখে জায়িনের শীতল মেজাজ বারবারই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। আজ দু’দিন ধরেও দাগটাকে হালকা করতে পারেনি সে। কত সময় ধরে মাধু এই দাগটা তৈরি করেছিল কে জানে! কিন্তু এমন ধরনের দাগগুলো সে আজ অবধি সহজভাবে মেনে নিতে পারে না কারও থেকেই৷ তাই তো তার সকল প্রেমিকাকেই কাছে টানার মুহূর্তে মোলায়েম কণ্ঠে হুকুম জানায়, ‘তোমার আদরের চিহ্নগুলো ভুলেও যেন আমার শুভ্র শরীরকে কলঙ্কিত না করে।’ শুধু মাধুর বেলাতেই তা বলা হয়নি তার। এখন না পারছে সে এই দাগটুকু মুছতে, আর না পারছে এর বিনিময়ে মাধুকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে৷
রেজা এসে উপস্থিত হলো জায়িনের ঘরে৷ এসে দেখল, তার স্যার কপাল কুঁচকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বুকের মাঝটায় কী যেন দেখছে। হালকা কাশি দিয়ে তার উপস্থিতি জানিয়ে সে বলে উঠল, ‘স্যার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আপনি এখনো রেডি হননি?’
গম্ভীর স্বরে জবাব দিলো জায়িন, ‘হচ্ছি৷ বসো তুমি।’
বলেই গায়ে সাদা শার্টটা দ্রুত ঢুকিয়ে নিলো। রেজা জিজ্ঞেস করল, ‘মাধু কি পৌঁছে গেছে?’
-‘হুঁ, একটু আগেই মেসেজে জানাল।’
খুব ভার লাগছে জায়িনের কণ্ঠ। মুখটাও কেমন গম্ভীর করে রেখেছে। এমনভাবে তাকে খুব কমই দেখেছে রেজা। হঠাৎ কী হলো তার স্যারের? তা জানতে একটু আমতা আমতা সুরেই জিজ্ঞেস করল সে, ‘স্যার কি কোনো কারণে চিন্তিত?’
প্রশ্নটা শুনে শার্টের স্লিভের বোতাম লাগাতে লাগাতে জায়িন আয়নার মাঝেই তাকাল রেজার দিকে। রেজাও তখন চেয়ে ছিল তার দিকেই। জায়িন মুহূর্তেই উত্তর দিলো না। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, একটু অস্থিরও হয়ে আছে মনটা।’
রেজা স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করল এবার, ‘টেনশন হচ্ছে আমার ভাবিজানকে নিয়ে?’
-‘টেনশন তো হওয়ারই বিষয়।’
-‘আমি কথা দিয়েছি তো স্যার। ভাবিজানের কোনো ক্ষতি হতে দেবো না। ওনার গায়ে যেন কোনো আঁচ না পড়ে সেদিকটা আমি দেখব।’
-‘আজ প্রথমবার আমি আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছি, রেজা৷ মনে হচ্ছে দ্বিতীয়বার এবং শেষবারের মতো ওকে আমি হারিয়ে না ফেলি।’
-‘ভাগ্যে বিশ্বাসী তো আপনি। এই ভাগ্যই সতের বছর পর আপনার সামনে ভাবিজানকে এনে দাঁড় করিয়েছে৷ আর তার কোনো কারণও রয়েছে নিশ্চয়ই। কারণটা হলো, এবার আপনি তাকে একেবারের জন্য পাবেন বলেই। আমার বিশ্বাস, ভাবিজানকে আপনি হারাবেন না। ভরসা রাখুন আল্লাহর ওপর।’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জায়িন মনে মনেই বলল শুধু, ‘আল্লাহ ভরসা। তাই-ই যেন হয়।’
জায়িন সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হতেই রেজা তাকে বলে উঠল, ‘আপনাকে কিন্তু বরাবরের মতোই আজও দারুণ লাগছে স্যার৷’
রেজার প্রতিদিনকার এই প্রশংসা বাক্য শুনতে শুনতে জায়িন বিরক্ত হলেও আজ সে একটু হাসল। খুব চেষ্টা করছে সে নিজের মনকে স্থির রাখার, চিন্তামুক্ত থাকার৷ তাকে নিজের প্রতি বিশ্বাস হারালে চলবে না। তার একটু ভুলের কারণে যে তার ভালোবাসার রমণীকে মরতে হতে পারে।
আর দেরি করল না ওরা। খুব দ্রুত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বান্দরবনের উদ্দেশ্যে পুলিশ ফোর্স নিয়ে। আজই সেই টেরোরিস্ট চক্রটিকে ধরতে চলেছে তারা। খবর পাওয়া গেছে, খুব দ্রুতই তারা দেশ ছাড়তে চলেছে৷
___________
প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মাধু। কিছুদিন আগেই জাদুর সঙ্গে সাংঘাতিক ঝামেলা তৈরি হয়েছিল তার। বলতে গেলে ঝামেলাটা সেই করেছিল৷ রাগের বশে জাদুকে ছুরির আঘাতও করতে গিয়েছিল সে। কিন্তু বরাবরের মতোই সে নিজেই আহত হয়ে পড়ে। তাকে আটকানোর জন্যই জাদু আঘাত করতে বাধ্য হয়েছিল। তবে এবার জাদুর হাতে একটু বেশিই মার খেতে হয়েছে। যার দরুন শরীরটা এখনো আগের মতো তরতাজা হয়ে ওঠেনি। জার্নিতে তাই নেতিয়ে পড়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়েছে মাত্রই। কটেজ এসে জাদুকে এখনো সে দেখেনি। সেই যে ঝামেলা করে জাদু সেদিন রাতে বেরিয়ে গিয়েছিল, এরপর তাদের মাঝে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। মাধু জানতেও পারেনি জাদু কোথায়।
দরজা খুলেই একটি আদিবাসী মেয়ে এসে ঘরে ঢুকল। বিনাবাক্যে খাবারগুলো মাধুর সামনে রেখে তারপরই বেরিয়ে গেল। খাবারগুলো একবার দেখে তারপর দরজার দিকে খেয়াল করল সে। উঠে গিয়ে দরজাটা ভালোভাবে বন্ধ করে জায়িনকে কল করল। এখানে পৌঁছনোর পর জায়িনের সাথে কোনো কথা হয়নি তার।শুধু মেসেজেই জানিয়েছে তার পৌঁছনোর কথা৷ কিন্তু তারপর অজস্রবার কল করেছে সে। জায়িন রিসিভ করেনি। অবশ্য জায়িন বলে রেখেছিল তাকে, কল ধরার মতো পরিস্থিতিতে সে থাকবে না হয়তো। তবুও তার জানতে ইচ্ছা করছে, জায়িন কি পৌঁছে গেছে বান্দরবন?
দরজাতে করাঘাত পড়ছে। মাধু আর কল করল না। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে দরজা খুলতেই জাদুকে দেখতে পেলো। মাত্র সাতদিনের ব্যবধানে জাদুকে আজ তার কাছে অনেকটা পরিবর্তন লাগছে। চোখের নিচের কালি কমে গেছে। বছরের পর বছর রাত জাগার ফলে চোখের শুভ্র অংশ রক্তলাল হয়ে থাকত তার। কিন্তু তা আজ নেই। চেহারাতে আজ তার সেই খোলামেলা হাসিটা আগের মতোই আছে। তবে সেই হাসিটা আজ ভীষণ প্রাণবন্ত লাগছে। এত খুশি কেন লাগছে জাদুকে? এই দেশ ত্যাগ করতে চলেছে অতি জলদি। শুধু কি এই কারণেই? প্রশ্নটি অন্যভাবে করে বসল মাধু, ‘খুব ভালো আছিস বুঝি?’
-‘আমি সব সময়ই ভালো থাকি প্রিয়।’ খোলামেলা হাসিটা ঠোঁটে ধরেই বলল জাদু।
হঠাৎ ওর মুখে প্রিয় ডাকটি শুনে মাধুর ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত হয়ে উঠল। কিছু বলল না সে। জাদু ভেতরে এসে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বলল, ‘খেয়ে নে। তারপর বিশ্রাম কর। খুব ভোরেই যাত্রা শুরু হবে আমাদের।’
-‘জায়িনকে ধোঁকা না দিলেই পারতি।’
কথাটা বলে বিছানাতে খাবার নিয়ে বসল মাধু। জাদু কোনো উত্তর দিলো না। মৃদুহাসিটা ঠায় পেল এবার তার ওষ্ঠকোণে।
মাধুর খাওয়ার মাঝেই জাদু তার ব্যাগ থেকে কী কী যেন নিয়ে আবার বাইরে যাবার জন্য দরজাটা খুলল। মাধু তখন জিজ্ঞেস করল, ‘আবার কই যাস?’
-‘পাহাড়ের চূড়ায়।’
-‘রাত নামছে। এখন কী কাজ ওখানে?’
-‘কোনো কাজ নেই। ভালো লাগে ওখানে। খাওয়া শেষে বিশ্রাম নিয়ে চলে আসিস। তোরও ভালো লাগবে। রাতটা ওখানেই পার করব আজ।’
-‘জায়গাটা নিরাপদ নাও হতে পারে।’
-‘আমার জন্য সব জায়গায় নিরাপদহীন। নিরাপদ করে নিতে হয় আমাকে।’
জাদু চলে গেল। মাধু তেমন গায় মাখাল না তার কথাগুলো। খাওয়া শেষেই বিছানাতে গা এলিয়ে দিলো। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে তার। কিন্তু আজ রাতে যে ঘুম হারাম করে রাখতে হবে তাকে। চোখদু’টো বুজে রইল শুধু। তখনই ফোনটা বেজে উঠল তার৷ অচেনা রবি নাম্বার থেকে কলটা এসেছে। বুঝতে বাকি রইল না কলটা জায়িনের। কারণ, এই নাম্বারটা জায়িন ছাড়া আর কারও জানা নেই। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জায়িনের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘তুমি ঠিক আছ?’
মাধু একটু হাসল, ‘এত চিন্তার কী আছে আমাকে নিয়ে বলো তো? আমি ঠিক আছি। তুমি কোথায়?’
-‘আমি আছি আমার জায়গাতেই। তোমার কাছাকাছি। ও কোথায়?’
-‘ও সম্বোধনটা কি শুধু আমার ক্ষেত্রে করা যায়?’
জায়িন একটু হাসল বোধ হয়। বলল, ‘ভালোই লাগে মেয়েদের এই জেলাসি ব্যাপারটা। বলো এখন তোমার বোন কোথায়?’
-‘পাহাড়ের চূড়ায়। রাতটা ওখানে পার করবে সে।’
-‘তুমি কোথায় তাহলে?’
-‘ঘরে।’
-‘ওর কাছাকাছিই থাকতে হবে তোমাকে। বিশ্রাম নিচ্ছিলে বোধ হয়৷ বিশ্রাম করা শেষ হলে কষ্ট করে তুমিও চূড়াতে উঠো। রাখছি এখন। আর প্রস্তুত থেকো অতর্কিত আক্রমণের জন্য।’
ফোনটা রাখতেই মাধুর আরেকটা নাম্বারে কল এলো এবার। রিসিভ করতেই জাদু বলল, ‘ফাস্ট বেরিয়ে পড় কটেজ থেকে। আমরা এখনি বের হবো। তবে আলাদা আলাদা।’ কথাটা শেষ করেই জাদু কল কেটে দিলো। মাধু একটু আন্দাজ করেছিল, জাদু যে কোনো মুহূর্তে পরিকল্পনা বদলাবে। তাই সে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিল৷ ঘাড়ে ব্যাগটা ঝুলিয়ে মাধু বেরিয়ে পড়ল কটেজ থেকে। জাদুকে কল করল। রিসিভ হতেই তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কোথায়?’
-‘আমার খোঁজ জেনে যাবি এমনিতেই৷ বেরিয়ে যা, সামনে তোর জন্য জীপ ওয়েট করছে।’
কলটা কাটতেই মাধু কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর ফোন থেকে জায়িনের দেওয়া সিমটা খুলে সেটা ভেঙে ফেলে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে এগোতে থাকল জীপ গাড়িটার দিকে৷ গাড়িতে উঠেই সিটে বসে চোখদু’টো বুজে ফেলল। জায়িনের সঙ্গে কাটানো শেষ রাতটার মুহূর্ত ভেসে উঠল চোখের পর্দায়। মনে মনে আওড়াল, ‘আমাকে তুমি চাইলে কোনো যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াই খুঁজে বের করবে, জায়িন।’
__________
দূরে দাঁড়িয়ে মাধুর যাত্রাপথে চেয়ে রইল জাদু। নিরবে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর হেঁটে হেঁটে চলে গেল পাহাড়ের কাছে। আজ তার টিমের সবাই এ দেশ ছাড়লেও সে যাবে না। এমন পরিকল্পনাই করা হয়েছে। তার যাত্রা শুরু হবে যে প্রভাতেই৷
বেশ কয়েকবার কল করেও জায়িন মাধুকে পেল না। তার সিনিয়র অফিসার উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। শেষবার চেষ্টা করল সে। কিন্তু এবারেও ব্যর্থ। সিনিয়র স্যারকে বলল, ‘প্ল্যান বি-ই তবে কার্যকর করতে হবে স্যার।’
তিনি বললেন, ‘তাহলে আর দেরি করে লাভ নেই। রেডি হও সবাই।’
জায়িন মাধুর নাম্বারটার দিকে একবার চেয়ে স্বগোতক্তি করল, ‘তুমি চাইলেও যে ভাগতে পারবে না মাধু।’
সাতদিন পর আজই ফোনটা অন করেছে জাদু৷ তারপর থেকে একের পর এক কল এসেই চলেছে তার। বিরক্ত হবারও উপায় নেই৷ তার ওপর যে অনেক দায়িত্ব ন্যাস্ত করা হয়েছে৷ ধৈর্যের পরিচয় সে সব সময় দিয়ে এসেছে। আজও দিতে হচ্ছে। ঝুঁকি নিয়ে তাকেই সবার পরে দেশ ছাড়ার হুকুম দিয়েছে। কিছুই যে করার নেই। কথা শেষ করেই ফোনটা পকেটে রাখল সে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে থাকা বগালেক হ্রদটাকে দেখে চলেছে নিরলসভাবে। গভীর কোনো এক চিন্তায় মগ্ন সে। ঘণ্টাখানিক পার হয়ে গেছে কখন যেন। এখন একবার মাধুর খোঁজটা নেওয়া জরুরি৷ কতদূর যেতে পারল সে? তাকে কল করবার পূর্বেই ওর মনে হলো কিছু মানুষের পদচালনার আওয়াজ কানে ভেসে আসছে। এবার ওর নেমে পড়া উচিত বলে মনে হলো। কিন্তু তার পূর্বেই মাথা থেকে বহু ওপরে হেলিকপ্টারের উপস্থিতি টের পেল সে। বুঝতে আর বাকি নেই একটু পর কী হতে চলেছে। তবে মাধুকে নিয়ে টেনশনটা বাড়তে থাকল। ও কি পৌঁছে গেছে গন্তব্যে?
পাহাড়ের চূড়াতে অবস্থান করছে সে। চারপাশে একবার চোখ বুলাল। রাতের অন্ধকারে অনেক কিছুই তার চোখে পড়ছে। শুধু তাকে ধরার জন্য এত আয়োজন দেখে একটু ঘাবড়ানো উচিত তার। কিন্তু কেন যেন নিজেকে নিয়ে তার এই মুহূর্তে একটুও চিন্তা হচ্ছে না৷ ওপরে একবার তাকিয়ে এখন দুটো হেলিকপ্টার আবিষ্কার করল। এবার সে পিছু ফিরেই দেখতে পেল আলোর ঝলকানি। বোধ হয় শ’খানেক লাইটের আলো ফেলা হয়েছে তার দিকে। তাকানোর উপায় নেই বলে মাথাটা নিচু করে রাখল। একটু দূর থেকেই ভেসে আসলো অপরিচিত কণ্ঠ, ‘ইট’স টাইম টু সারেন্ডার।’
নজর উঁচিয়ে দেখল জাদু, তার সামনে সত্যিই শ’খানেকের অর্ধেক পুলিশ ফোর্স দাঁড়িয়ে। তাদের মাঝে অতি পরিচিত একটি মুখ খুঁজে পেল সে। জায়িন ঠোঁটের কিণারাতে সেই খুনি হাসিটা ধরে চেয়ে আছে। ওদের উদ্দেশ্যে জাদু বলল, ‘ইট উইল বি ডিফিকাল্ট ফর ইয়্যু।’
উত্তরে অফিসারটি বলল, ‘ওপরে কি দেখোনি?’
জাদু বলল, ‘আর আমি যা দেখেছি তোমরা তা দেখোনি।’
কথাটা শোনা মাত্রই জায়িন বলল, ‘দেখাটা জরুরি নয়।’
বলেই পেছন থেকে দু’জন পুলিশ মাধুকে ধরে সামনে আনল। তা দেখে জাদুর কপাল কুঁচকে গেল। মাধু ভীত চাউনিতে চেয়ে আছে তার দিকে। জায়িন একবার মাধুর দিকে চেয়ে তারপর জাদুকে বলল, ‘বোনকে ছেড়েই চলে যাবে?’
মুখটা কাঠিন্য করে জাদু কিছুক্ষণ চুপ রইল। সেই ফাঁকে জায়িন বলল, ‘কোনো সুযোগ নেই সারেন্ডার করা ছাড়া। আরও একবার চারপাশে চেয়ে দেখো জাদু। খামোখা আহত হওয়ার কী দরকার? চলে এসো।’
জাদু মাধুর চোখের দিকেই চেয়ে আছে তখনো। কিন্তু মাধু তার চোখের ইশারা বুঝতে পারছে না। এমন তো হওয়ার কথা নয়। না কি মাধু ইচ্ছা করেই বুঝতে চাইছে না? জাদু চেষ্টা করেও পারল না মাধুকে কিছু বোঝাতে। কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তা করে জায়িনকে সে বলল, ‘যা চাইছ তাই হবে। আমাদের কাছাকাছি আসার সুযোগ দাও শুধু।’
প্রস্তাবটা শুনে জায়িন মিটিমিটি হাসতে থাকল। তার সিনিয়র অফিসার বলল, ‘খুবই ধূর্ত সে। সাবধান জায়িন।’
-‘আদৌ কি ভাগতে পারার সুযোগ আছে স্যার? যদি থাকে তাহলে ওর প্রস্তাব মানার প্রশ্ন আসে না।’
অফিসারটি বলল তখন, ‘কোনো ফাঁক নেই। তাই পালানোর সুযোগও নেই।’
-‘তাহলে যেতে দিন।’
জায়িনের ইশারা পেয়ে মাধুকে ছেড়ে দেওয়া হলো। গুটিগুটি পায়ে মাধু এসে থামল জাদুর কাছে। জাদু এগিয়ে এসে সরাসরিই জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কি আমাকে চাস না কি স্বাভাবিক জীবন?’
মাধু এমন প্রশ্নে কিছুটা অবাক হলো। বুঝতে চাইল জাদু ঠিক কী বোঝাতে চাইছে এ প্রশ্নের দ্বারা। জাদুর হাতে সময় নেই। মাধুর নিরবতা এই মুহূর্তে তাকে বিরক্ত করে তুলল৷ মাধুর হাতটা ধরে জায়িনকে সে বলল, ‘আমার বিরুদ্ধে চাক্ষুষ প্রমাণ যোগাড় করতে পারোনি তা আমি নিশ্চিত।’
কথাটা শুনে জায়িন আর বাকিরাও কিছুটা নিভল। জায়িন বলল, ‘তোমার মুখেই তোমার স্বীকারোক্তি নেব। তুমি চিন্তা কোরো না।’
জাদু একটু হাসল, ‘যাকে ধরতে এসেছ তার সম্পর্কে এটুকুও জানো না যে, মুত্যু সমতুল্য যন্ত্রণাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত সে। তবু স্বীকারোক্তি দিতে নয়। আমি নিজ দায়িত্বে সমস্ত প্রমাণ, আমার স্বীকারোক্তি আর পরবর্তী পরিকল্পনার ইনফরমেশন দিয়ে দেবো। শুধু কন্ডিশন একটাই। যদি মানতে প্রস্তুত থাকো তাহলে আমি সারেন্ডার করব। নয়তো এই মুহূর্তেই নিজের প্রাণ নিজে নেব।’
শেষ কথাটা শোনা মাত্রই জায়িন এক মুহূর্ত দেরি করল না। তার সিনিয়র স্যারের অনুমতি না নিয়েই সে বলে উঠল, ‘যে-কোনো কন্ডিশনে রাজি। তার আগে তোমার কাছের সব আর্মস নিচে ফেলো।’
জাদু বলল, ‘আগে আমার কন্ডিশোন শুনতে হবে এবং মানতে হবে। মাধুকে ছেড়ে দিতে হবে। এমনিতেও ও নির্দোষ। এখন অবধি যা হয়েছে সব আমার দ্বারাই। ওকে শুধু সকলের সামনে শো করা হয়েছে। কিন্তু মূল সিক্রেট আমি।’
জায়িন তার স্যারের কানেকানে কিছু একটা বলল জাদুর কথা শেষ হতেই। তা শোনার পর অফিসার বললেন, ‘ঠিক আছে। আমরা রাজি। মাধুকে খালাস দেওয়া হবে। তুমি চলে এসো। নিজের আর্মস আমাদের দিকে ফেলো।’
মাধু জাদুর দিকে একবার তাকাল। জাদুর এবারের চোখের ইশারা সে বুঝে নিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। জাদু তখন তার কাছের সমস্ত আর্মস নিচে ফেলে দিলো। তারপর মাধুর পিছু পিছু এগিয়ে গেল সেও। রেজা সেই মুহূর্তে হেলিকপ্টারে বসে আছে। জায়িন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জাদুকে এগিয়ে আসতে দেখে৷ কিন্তু স্বস্তিটুকু আর বেশি সময় রইল না। মাধুকে পেছন থেকে জায়িনদের দিকে ধাক্কা দিয়েই সে পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিচে। সেই মুহূর্তে চিৎকার করে জায়িন ডেকে উঠল জাদুকে, ‘আয়মান!’
জায়িনের ওপরই এসে পড়েছে মাধু। ওকে সামলিয়ে নিতে নিতে ওপর থেকে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছে জাদুর দিকে। যা নিষেধ ছিল জায়িনের কথা মতো। রেজা হেলিকপ্টারে ওঠার পূর্ব পর্যন্ত জায়িন তাকে বারবার সাবধান করেছে, ‘কোনো পরিস্থিতিতেই যেন আয়মানের দিকে শুট করা না হয়।’
____________
সিন্ধু ইগল – (১৬)
ইসরাত জাহান দ্যুতি
স্টিলের একটা গ্লাসে পানি ঢেলে টেবিলের অপর প্রান্তে বসা মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিলো জায়িন। মাথাটা নিচু করে গম্ভীরভাবে বসে আছে মেয়েটি। টেবিলের ওপর পানি ভর্তি গ্লাসটা দিয়ে কয়েকবার ঠকঠক শব্দ করে মেয়েটির মনোযোগ কাড়তে চেষ্টা করল সে। কিন্তু মেয়েটি ভীষণ একরোখা আর রাগী। রাগের আভাসটা চেহারাতেই প্রকাশিত তার৷ ওভাবেই বসে রইল তাই। মোলায়েম স্বরে জায়িন তাকে একবার ডেকে উঠল, ‘আলিয়া মেহজাবিন!’
চোখ তুলে তাকাল এবার মেয়েটি। চোখে তার ভয়ঙ্কর ক্রোধ। ঠোঁটদু’টো চেপে ধরে শক্ত মুখ করে চেয়ে রইল জায়িনের দিকে৷ ঘামে জর্জরিত শরীর তার। গলা, ঘাড়, কপালের কোণ বেঁয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে৷ জায়িন তার মুখের সামনে একটু এগিয়ে এসে শুধাল, ‘ক্লান্ত ভীষণ?’
এক টানা বিশদিন ধরে চিৎকার চেঁচামেচি করার জন্য কণ্ঠ ডেবে গেছে মেয়েটির। স্বরভঙ্গি বদলে গেছে তার। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল সে, ‘বিট্রে করে পার পেয়ে যাবে তুমি?’
-‘বিশ্বাসঘাতকতা আমার বৈশিষ্টে নেই। ওটা তোমার বৈশিষ্ট্য, ডিয়ার প্রেমিকা।’ বলেই ফিচেল হাসল সে।
বিদ্রুপাত্মক হাসি ধরে জবাব দিলো মেয়েটি, ‘আয়মান মেহরিন। আ সাইকো অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডিক্টেড সিরিয়াল কিলার। যে শুধু মানি আর ড্রাগস চেনে৷ এর বাইরে সে দুনিয়া বলতে কিছু বোঝে না। তাকে বউ করার স্বপ্ন দেখাটা সাগেশিয়াস জায়িন মাহতাবের সঙ্গে ঠিক যায়নি। এখনো সময় আছে জায়িন৷ আমাকে এখান থেকে বের করো। অনেক উপভোগ্য জীবনযাপন করার সুযোগ পাবে তুমি আমার সঙ্গে।’
জায়িন চিন্তামগ্ন চেহারায় গম্ভীর হয়ে বসে রইল শেষ কথাটি শুনে। তারপর মেয়েটির দিকে চেয়ে বলল, ‘শেষবার জিজ্ঞেস করব মাধু। উপস্ স্যরি, আলিয়া। বাংলোর মালিক কে? কোথায় আছে সে? তার ডিটেইলস বলো আমাকে। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, স্বাভাবিক জীবন দেবো তোমাকে। আমার কথা আমি রাখব।’
মাধুও এবার জায়িনের মতোই গম্ভীর স্বরে বলল, ‘সেই জীবনটা আমি তোমার সঙ্গে চেয়েছিলাম, জায়িন। তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছ আমার সঙ্গে।’
-‘উহুঁ, আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম এই ভয়ঙ্কর জীবন থেকে তোমাকে বের করে আনব৷ স্বাভাবিক জীবন উপহার দেবো তোমাকে। একবারও বলিনি, বিয়ে করব তোমাকেই। তুমি আমার সঙ্গে ঘুমাতে চেয়েছিলে, তোমার আশা পূরণ করেছি কতগুলো রাত ধরে। এর থেকে আরও বেশি কিছু পাওয়ার যোগ্যতা তুমি রাখো না।’
-‘কেন রাখি না? তোমার আর আমার মাঝে পার্থক্য কোথায়?’
জায়িন হাসতে হাসতে বলল, ‘এই একটা জায়গায় তোমার সঙ্গে আমার দারুণ মিল৷ নারী শরীরের ঘ্রাণে না ডুবলে আমার মন আর মস্তিষ্ক চাঙ্গা থাকে না। আমি কখনো ভাবিনি, আমারই মতো কেউ একজন কখনো আমার প্রেমিকা হতে পারে।’
-‘স্টপ ইট জায়িন। তোমাকে কাছে পাবার পর থেকে আমি দ্বিতীয় কোনো পুরুষকে কাছে টানিনি।’
-‘বেচারা লেকচারার! নামটা যেন কী ছিল? টিটো না কি টিটু? হোয়াটএভার, ছেলেটা তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। ওকে বিয়েটা করলে তোমাকে আজ এখানে থাকতে হতো না।’
-‘আমার আর তোমার কথা বলো জায়িন। তুমি কেন আমার সাথে এমন করলে?’
-‘কারণ, তোমার বোনকেই আমার চায়। তোমাকে নয়।’
উত্তেজিত হয়ে পড়ে মাধু জিজ্ঞেস করল, ‘ওর আর আমার মাঝের তফাৎটা কী? স্বাদ তো নিয়েছ আমার শরীরেরই। ওর প্রতি কেন এত টান তাহলে?’
-‘ভালোবাসা! ভালোবাসা! আর ভালোবাসা।’
আর শুনতে মন চাইল না মাধু। চোখমুখ খিঁচে জায়িনকে শুধু বলল, ‘আমাকে এখান থেকে মুক্ত করো প্লিজ৷ আর সহ্য করতে পারছি না আমি।’
-‘কথা যেহেতু দিয়েছি, সেই কথা রাখব তো অবশ্যই। দু’দুটো খুনের আসামি হয়েও তোমাকে ফাঁসিতে ঝুলাইনি। সমস্ত ব্লেম মৃত আয়মানের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তোমাকে মাত্র কয়েকটা বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। শুধু ওকে সাপোর্ট করার দায়ে। একটু তো কষ্ট করতেই হবে। দাঁতে দাঁত চেপে এখানেই পড়ে থাকতে হবে। এ ছাড়া কোনো উপায় নেই তোমাকে মুক্ত করার। সেই পথ তোমার বোন বন্ধ করে দিয়ে গেছে নিজেকে ধরা না দিয়ে।’
-‘ও মরে গেছে, এটা বিশ্বাস করতে বলছ? কোনো ব্যাকআপ প্ল্যান না রেখে ও লাইফ রিস্ক নেয়নি।’
-‘আমি নিজ হাতে ওর ডেডবডি উদ্ধার করেছি।’
-‘ওই ডেডবডি দেখলেও আমি বিশ্বাস করব না।’
জায়িন মুচকি হেসে বলল, ‘আমিও না। এ জন্যই তো বলছি, ওকে খুঁজতে হলে আমার জানা প্রয়োজন বাংলোর মালিকের বায়োডাটা।’
-‘এতোটা বোকা আমি নই, জায়িন। আমাকে এখান থেকে বের না করলে মানকে তুমি কোনোদিনও খুঁজে পাবে না।’
বিশটা দিন ধরে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে চলেছে জায়িন। কোনোভাবেই মাধুর মুখ থেকে বাংলোর মালিকের খোঁজ জানতে পারছে না সে। যতদূর মাধুকে চিনেছে সে, মরবে তবু জাদুর হদিস সে পেতে দেবে না। কিন্তু জাদুকে না পেলে সে মাধুকেও বাঁচিয়ে রাখবে না।
এগিয়ে এসে মাধুর দু’আঙুলের ফাঁকে কলম গুঁজে খুব শক্ত করে চেপে ধরে বলল, ‘এই হাতে প্রথম যাকে খুন করেছিলাম, সে আমার অতি প্রিয় একজন মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ঠিক একইভাবে তুমিও আমার আরেকজন প্রিয়’র সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ৷ তোমাকে মেরে দিতে আমার খুব বেশি সমস্যা হবে না। শুধু এই মুখটার সঙ্গে আয়মানের মুখটা মিল বলেই তোমাকে মারতে আমার মায়া লাগছে। সেই সতের বছর আগে থেকেই তুমি আমার চক্ষুশূল ছিলে। তার দুটো কারণ, আমার যা পছন্দ তা আমি ওয়ান পিস দেখতেই ভালোবাসি। সেই জিনিসের সেকেণ্ড পিস থাকলে তা আমি কোনোদিনও গ্রহণ করিনি। সেখানে আমার সব থেকে দামী সম্পদটারই আরেক পিস, তা আমি মানতে পারছিলাম না। আজও পারি না। তোমাকে দেখলেই আমার ইচ্ছা করত, এই চেহারাটা আগুনে পুড়িয়ে দিই। তোমাকে সহ্য করতে না পারার সেকেণ্ড অ্যান্ড লাস্ট রিজনটা কী জানো? আমার আয়মান বড্ড সরল আর বোকা ছিল। তার জন্যই ওকে মারলে কাটলেও ও প্রতিবাদ করতে জানত না৷ যেখানে ও মায়ের অতি আদরের কন্যা ছিল, সেখানে প্রায়ই ওর গালে থাপ্পড়ের দাগ, হাতে, গলায় খামচির দাগ দেখতে পেতাম। কে মেরেছে জিজ্ঞেস করলেই ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলত, “আমার বোন মেরেছে।”
যন্ত্রণায় আওয়াজটুকুও করতে পারছে না মাধু। তবু একবার মুখে উচ্চারণ করল না ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে৷ ওর এত সহন শক্তি দেখে জায়িন আঙুল থেকে কলম তুলে বলল, ‘এখন অবধি অল্পের ওপর দিয়ে যাচ্ছি আমি। ওকে খুঁজে না পেলে কসম, তোমাকে জানে শেষ করব।’
কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মাধু, ‘খুব দরদ, না?’
চকিতেই জবাব দিলো জায়িন, ‘হ্যাঁ ভীষণ।’
-‘আজ কিংবা কাল, যখনই মুক্তি পাই। আমাকে ধোঁকা দেওয়ার খেসারত মানকে নিজের জীবন দিয়ে দিতে হবে। আর তোমাকেও।’
হেলেদুলে হেঁটে এসে জায়িন আবার তার পূর্বের জায়গায় বসল। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে জবাব দিলো, ‘ধোঁকা তো তুমি দিলে তোমার বোনকে৷ কিন্তু আমাকে ধোঁকা দেওয়ার শাস্তি তোমার বোনও পাবে। আর তুমি তো পাচ্ছই।’
কথাটা বলে আবার সোজা হয়ে বসে মাধুকে বলল, ‘কী বললে তখন? আমি তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি না তোমরা দুইবোন আমাকে দিয়েছ? প্রপোজ করেছি একজনকে, আর প্রেম করেছ আরেকজন। তুমি নিজে থেকেই বাঘের খাঁচায় এসে ধরা দিয়েছিলে। এমনটা কেন করেছিলে বলো তো? এর পেছনের উদ্দেশ্য কী ছিল? একবারের জন্যও মনে হয়নি, তোমাদের এই অদল বদল খেলা আমি ধরতে পারব?’
এতক্ষণ জিদ দেখিয়ে পানিটা না খেলেও এবার আর জিদ ধরে রাখতে পারল না মাধু। পানিটা খেয়ে চুপচাপ মাথা নত করে রইল। জায়িন নিরবে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল মাধুকে, ‘ওকে কেন মারতে চাইতে? কীসের রাগ তোমার ওর প্রতি? ও বড়ো বলে কি তোমার থেকে বেশি আদর পেত তোমাদের বাবা-মা’র থেকে? এর জন্যই কি ওকে তুমি হিংসা করতে? আমি যতটুকু দেখেছি তোমাদের, তাতে ও তোমাকে সব সময় ভয় পেয়ে চলত। তুমি ছোটো হওয়ার পরও ও তোমাকে আপু বলে ডাকত। কী করেছিল ও? যার জন্য ওকে খুন করতে চাও?’
-‘আমি আর তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি না। যাও এখান থেকে।’
-‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা এসে তোমার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি কি
এমনি এমনি?’
মাধু মুখ তুলে কৌতূহল দৃষ্টিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আমাকে আর মানকে কীভাবে আলাদা করতে?’
প্রশ্নটায় জায়িন হা হা শব্দে হেসে উঠল, ‘এতদিন বাদে অবশেষে জানার ইচ্ছা হলো তাহলে? আমার এই চোখদু’টোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পর্কে তুমি অনবগত। এমনি এমনি এই ডিপার্টমেন্টে আমার মূল্যায়ন তৈরি হয়নি।’
কথাগুলো বলেই একটু থেমে মাধুর কাছে এগিয়ে এসে ওর ঠোঁটের দিকে চেয়ে বলল, ‘মুচকি হাসলে আমার আয়মানের অধরের মাঝ বরাবর নয় ঠিক, তার থেকে একটু বাঁ পাশে খু্বই ছোটো আর সুন্দর একটা ডিম্পল তৈরি হয়। ওর সেই ছোটো থেকেই এই সৌন্দর্যটা আমার নজরে পড়েছিল। বড়ো হবার পর ওই ডিম্পলটা আরও স্পষ্ট হয় হাসলে। ভাগ্যবশত তোমার দু’বোনই আমার সামনে আসলে মুচকি হাসতে। আল্লাহ পাক তোমাকে আমার আয়মানের রূপটা দিলেও ভাগ্যিস ওই অসাধারণ ডিম্পলটা দেননি।’
-‘সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এত সুক্ষ্ম জিনিসও তোমার নজর এড়ায়নি?’
চেহারায় দাম্ভিকতা এনে জায়িন বলল, ‘এ জন্যই তো আমি জায়িন মাহতাব৷’
জায়িনের সুন্দর চোখদু’টোর দিকে চেয়ে মাধু নিশ্চুপ রইল তখন। তারপর হঠাৎ গম্ভীর স্বরে বলল, ‘আমি মুক্তি চাই না। পারো তো খুঁজে নাও তোমার আয়মানকে। সো কল্ড ভালোবাসার জন্যই তো আমাকে পেয়েও হেলা করলে। আমি আলিয়া বলছি, আয়মানকে দখল করতে পারলেও আয়মানের মনকে দখল করতে পারবে না। আর পারবেও না ওকে ধরে রাখতে। তুমি যত বড়ো শিকারিই হও, আয়মানকে ধরে রাখার ক্ষমতা তোমার নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি, শিকারি নিজেই শিকার হবে। আয়মানের হাতে তোমার নিশ্চিত মৃত্যু দেখতে পাচ্ছি আমি। যে সহজ সরল, বোকা আয়মানকে ভালোবেসে ওকে খুঁজতে যাচ্ছ, সেই বোকা, সহজ সরল আয়মান আর নেই। যেমনটা ও নিজেকে আমাদের সামনে দেখিয়েছে, ওটা ওর নাটক ছাড়া কিছু নয়। ওর সঙ্গে এতটা কাল থেকেও ওর নাটক আর ওর পরিকল্পনা ধরতে পারলাম না আমি। আমার সঙ্গেও গেম খেলে গেল ও। তবে আমি চাই, তোমার মৃত্যুটা ওর হাতেই হোক। আমি চাই, তুমি ওকে খুঁজে বের করো। আর ওর বিষয়ে খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা ইনফরমেশন দিই তোমাকে। শি হেটস ম্যারিটাল রিলেশনস। দ্য মোস্ট হেটেড সেক্স। আর তাই তুমি হবে ওর জীবনে ঘৃণার আরেক নাম জায়িন। আমি কিছুই বলব না। ওর কাছে গিয়েই না হয় ওকে জানো আর চেনো। সো বেস্ট অফ লাক, প্রিয়।’
মৃদু হেসে উঠল মাধু। জায়িন চুপচাপ ওর কথাগুলো শুনে এবার উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘চ্যালেঞ্জ ছোড়াছুড়ি আমার কাছে বাচ্চাদের খেলা ছাড়া কিছু মনে হয় না। তোমার লিটল সিস্টার আজও বোকাই আছে, ডিয়ার শালিকা! যার সঙ্গে প্রায় একটা বছর মিশেছি, তারপরও সে আমাকে চিনতে পারল না। অথচ, তুমি কত দ্রুতই আমাকে চিনে নিয়েছ।’
মাধু স্মিতহাস্যেই বলল, ‘এর যথাযোগ্য কারণও আছে। তা জানলেই বুঝতে পারবে, তোমার আয়মান তোমাকে কেন চিনতে পারেনি। আমার তো মনে হয় তোমাকে ও মনেও রাখেনি।’
__________