সিন্ধু ইগল, পর্ব:১৩+১৪

0
617

সিন্ধু ইগল – (১৩)
ইসরাত জাহান দ্যুতি

৩৩
বিরক্তিকর আওয়াজ বেজে চলেছে কানের কাছে অনর্গল। থামাথামির কোনো লক্ষণ নেই। এদিকে আবার মনে হচ্ছে গালের ওপর কারও গরম নিঃশ্বাস পড়ছে৷ চোখ বন্ধ অবস্থাতেই মাধু চেহারা কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করে খেঁকিয়ে উঠল জাদুর ওপর, ‘স্টপ ইট ক্রাম্মি গার্ল!’
তাতে যেন এবার আওয়াজটা মাধুর আরও কাছে এসে বাজতে লাগল। চোখদু’টো খুলতে বাধ্য হলো সে। বুবন তার কাছেই তার মুখের পাশে ফ্লোরে মুখটা পেতে চেয়ে আছে তার দিকে। অ্যালার্ম ঘড়িটা পা দিয়ে টেনে তার আরও কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। মাধুর আর বুঝতে বাকি নেই, জাদু বুবনকে এমনটা করতে শিখিয়ে দিয়ে গেছে। রাগ আর বিরক্তি নিয়ে ফ্লোর থেকে উঠে বসল সে। কাল রাতে বরফ কুচি আর পানি ছাড়া ড্রিঙ্কস গলায় ঢেলে আর বসে থাকতে পারেনি৷ গলা, বুক জ্বলতে জ্বলতে পেটের ভেতর যেন নেমে যাচ্ছিল মদটুকু। শুয়ে পড়ার পর কখন যে ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল, তা টেরও পায়নি। মাথা ভার হয়ে আছে তার এখনো। থম ধরে কিছুক্ষণ মাথা নত করে বসে থেকে তারপর দৃষ্টি ঘরের চারপাশে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বুঝল, সবে মাত্র ভোর হয়েছে। এত জলদি জাদু রোজ কীভাবে যে ওঠে, তা সে কোনোভাবেই ভেবে পায় না। অথচ, নেশাটা জাদু তার চেয়ে বেশি করে। শারীরিকভাবে প্রচুর খাটাখাটুনিও জাদুই বেশি করতে পারে তার থেকে৷ বলা যায় মানসিক আর শারীরিক দু’ভাবেই জাদু তার থেকে বেশি শক্তপোক্ত৷

নেশার ভাব তো পুরোপুরি কাটেইনি। শরীরটাও বড্ড দুর্বল লাগছে। আজ কীভাবে দিন শুরু করবে সে কে জানে! মনে হলো ঘরে জাদু ঢুকেছে। মাথা তুলে দেখতে পেল, জগিং স্যুট পরে জাদু হাতে করে গ্লাস আর মগ নিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। দাঁড়িয়ে পড়ল সে। জাদু তার কাছে এসে প্রথমে এক গ্লাস লেবু পানি দিলো। কোনো প্রশ্ন না করেই মাধু তা ঢকঢক করে গিলে ফেলল। টি-টেবিলে কফির মগটা ঢেকে রেখে জাদু বলল, ‘তুই দিন দিন ফুলে যাচ্ছিস।’
কথাটা শুনে মাধু মাথা চুলকাতে চুলকাতে চেহারায় বিরক্তিভাবটা ফুটিয়ে রেখেই জানালার বাইরে চেয়ে বলে উঠল, ‘আমার ফিটনেস ঠিক করতে রোজ রোজ এক্সারসাইজের প্রয়োজন নেই। এত ভোরে ডেকে তুললি কী কারণে?’
-‘মনে হলো আজ থেকে তোরও দৌড়াতে যাওয়া উচিত।’
অসহ্য বিরক্তিভরা চাউনিতে মাধু তাকাল জাদুর দিকে। আর তারপরই জাদুর স্নেহপূর্ণ মুখটা দেখে কপালের ভাঁজটা মসৃণ হলো তার। কতটা উজ্জ্বল আর আনকোরা দেখাচ্ছে জাদুর মুখটা! কে বুঝবে, কাল এই মেয়েই নেশায় বিভোর ছিল? হঠাৎ মাধুর চোখ পড়ল জাদুর ঠোঁটের ওপর। এই তিনদিনে আবার কোনোভাবে আহত হয়েছিল না কি ও? জিজ্ঞেস করল, ‘তোর ঠোঁটে কী হয়েছে? আবারও কি কোনো ঝামেলা হয়েছিল?’
জাদু কথাটাকে গুরুত্বহীন ভাবে নিয়ে বলল, ‘নাহঃ!’
-‘তাহলে ঠোঁটের ভেতর রক্ত জমে অমন কালো হয়ে আছে কেন?’
ট্রাওজারের পকেট থেকে ফোনটা বের করে সময় দেখতে দেখতে সে বলল, ‘আরে ধুরঃ! কী নিয়ে পড়লি? গত পরশু রাতের পর থেকে দেখছি এই অবস্থা ঠোঁটের।’
তারপর ফোন থেকে নজর তুলে সেটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে নিতে নিতে বলল, ‘আমি বের হচ্ছি। চাইলে আসতে পারিস।’
বলেই এগিয়ে গেল দরজার দিকে। মাধু ঠিক জাদুর মতো অত সহজ করে নিতে পারল না ঠোঁটে রক্ত জমাট হওয়ার বিষয়টা। পেছন থেকেই ওকে ডেকে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘গত পরশু রাতে তুই বাসায় ছিলি?’
-‘হুঁ, একটু রাত করে ফিরেছিলাম।’
-‘তারপর কী করেছিলি?’
জাদু দরজার মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মাধুর দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে ভার কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’
-‘কিছু না। এমনিই জিজ্ঞেস করছি।’
-‘গলা ভেজাতে ভেজাতে বুবনকে নিয়ে কখন যেন লনেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম ঘাসের ওপর।’
-‘আমি যাওয়ার পর তুই আর বাংলোর কোথাও লাইট জ্বালিয়ে রাখিসনি, তাই না?’
-‘অত আমার খেয়াল থাকে না। এত জেরা করছিস কেন হঠাৎ? বিরক্ত লাগছে।’
বলে চলে গেল সে৷ মাধু চিন্তিত চেহারায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফ্রেশ হতে চলে গেল। নেশা ভাবটা যেন পুরোপুরি কেটে গেছে এইটুকু সময়ে।

আজ সেও দৌড়ানোর জন্য রেডি হয়ে বাইরে চলে এল। বাংলোর মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে মেইন রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই দেখতে পেল জায়িনকে। কালো টি শার্ট আর ট্রাওজারে জায়িনকে দিনের আলোয় যেন নতুন রূপে আবিষ্কার করল সে। দৌড়ে আসছে জায়িন তার বাসার দিক থেকে। সে নজর সরাতে ভুলে গেল কী করে? কারণ, এর মাঝেই জায়িন তাকে দেখে তার কাছে চলে এসেছে। তার সুন্দর হাসিটা দিয়ে বলে উঠল, ‘সুপ্রভাত সুন্দরী দুই।’
মুগ্ধতা থেকে বেরিয়ে মাধু হালকা হেসে বলল, ‘সুপ্রভাত।’ তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘সুন্দরী দুই কী?’
জায়িন মাধুর মৃদুহাস্য ঠোঁটটার দিকে এক ঝলক চেয়ে বলল, ‘মাধু। এবার নিশ্চয়ই ভুল নই?’
মাধু উত্তরে হাসল আরও বেশি করে। উত্তর দিলো, ‘একদম সঠিক। কিন্তু ওই যে আগের সম্বোধনটা কী ছিল?’
-‘দুইবোনই সুন্দরী। তাই একজন এক, আরেকজন দুই। তো প্রথমে সুন্দরী দুই সম্বোধনটাই চলে এলো মুখে।’
মাধুর ঠোঁটের কোণ থেকে আজ হাসি সরছে না। আবার জায়িনের ওপর থেকেও আজ নজর সরছে না।

জায়িন মাধুর দৃষ্টি লক্ষ করে জিজ্ঞেস করল, ‘আজ কি খুব হ্যান্ডসাম লাগছে আমাকে?’
-‘হ্যাঁ, স্বরূপে এসেছ আজ নির্দ্বিধায়। তাহলে আমার সন্দেহটাই ঠিক ছিল, তাই তো?’
জায়িন মিটিমিটি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, ‘প্রেমে পড়ে যাওনি তো আবার?’
এ কথাতেও মাধুর ঠোঁটে হাসি লেগে থাকল, ‘সুন্দরের দিকে নজর আটকাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। ধন্যবাদ, স্বরূপে এসে দেখা দেওয়ার জন্য।’
জায়িন উত্তর দিলো না। মৃদুহাস্য চেহারায় চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করল দৌড়াতে যাবার জন্য।

৩৪
বাসায় ফিরেই জায়িন সকালের নাশতা করে ঢাকায় উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দেয়। সারা বাড়িতে সিসি ক্যামেরা জুড়ে দিয়েছে এ ক’দিনে। গার্ডের সংখ্যাও বাড়িয়ে দিয়েছে। সে বাড়া থাকাকালীন রেজা তার কাজ সামান্য কিছুটা এগিয়ে রেখেছে। রাজিয়ার মৃত্যুর পেছনের কারণ নিয়ে এখনো তদন্ত চলছে। জায়িনের সে নিয়ে অবশ্য একটুও মাথাব্যথা নেই। মৌপ্রিয়ার মৃত্যুর পর সেই খবর যখন তার বাড়ি এসেছিল, জান্নাতি বেগম তা শুনে মৌপ্রিয়াকে দেখার জন্য যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জায়িন তাও যেতে দেননি তাকে। সে যেমন নির্বিকার রূপ দেখিয়েছিল, মা’কেও তেমনই থাকতে বলেছিল।

রেজা জায়িনের পাশে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন তথ্য জানিয়ে যাচ্ছে ল্যাপটপে দেখিয়ে দেখিয়ে। জায়িনের পুরো টিম এক রকম পরিকল্পনা করে রেখেছে টেরোরিস্ট চক্রটাকে ধরার জন্য। আর রেজা এবং সে ভেতরে ভেতরে আরেকরকম পরিকল্পনা সাজিয়ে নিচ্ছে এর মাঝে। দু’টো পরিকল্পনা নিয়ে তারা অতি শীঘ্রই নেমে পড়বে। ওদের কাজের মাঝে সিফাত একবার জায়িনের কেবিনে এসে কয়েক মিনিটের জন্য দেখা করে গেছে। কাজ শেষে রেজা দু’মগ কফি নিয়ে এল। জায়িনকে এক মগ এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘রাজিয়া ম্যামের মৃত্যুর সম্পূর্ণ দায়ভার তো হাফিজ স্যারের শত্রুপক্ষের ওপর যাচ্ছে।’
জায়িন কফির মগে চুমুক দিতে দিতে জবাব দিলো, ‘স্বাভাবিক, সন্দেহের তিরটা ওদিকেই যাবে।’
-‘রাজিয়াকে খুন করার প্রধান কারণটা কী ওদের দু’বোনের? শুধু কি এটাই, যে আপনাকে আপনার মিশন থেকে ইনঅ্যাটান্টিভ করার জন্য আর ভয় দেখানোর জন্য?’
জায়িন হালকা কাশি দিয়ে গলাটা ঝেরে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। এক হাতের আঙুলের ফাঁকের আরেক হাতের আঙুল গুঁজে আঙুলগুলো নাড়াতে নাড়াতে জবাব দিলো, ‘সেদিন সকাল থেকেই লক্ষ করেছিলাম দু’তিনজন লোক আমার গাড়ির আশেপাশেই ঘুরছে। আমি ব্যাপারটা হাতেনাতে ধরার জন্য না বোঝার ভান করেছিলাম। এর মাঝেই রায়হান স্যার এসে ডাকতেই ওনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে দূরে গিয়ে দাঁড়াই। তখন একজন এসে আমার গাড়ির জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল৷ আমি চোখের পলক দু’মিনিটের জন্য সরাতেই দেখি সে আর নেই। তারপর গাড়িটা দু’জন কনস্টেবলকে দিয়ে ভালোভাবে চেক করাই। ওরা সন্দেহজনক কিছুই পায় না। আমি নিজেও গাড়ির ভেতর ভালোভাবে চেক করি। তেমন কিছুই চোখে পড়ল না। বুঝতে পারলাম, ওরা আমাকে নজরে নজরে রাখছিল শুধু। রাজিয়ার সঙ্গে দেখা হবার পর ও যখন এসে আমার কোলে বসে রোম্যান্সে ব্যস্ত তখন আমার নজর গাঁথল ওর শাড়ির আঁচলে। শাড়িটাও ছিল কালো। স্পাই ক্যামেরা কী করে যেন ফিট করে রাখা ছিল, তা সহজে বোঝা যাচ্ছিল না। যতক্ষণে ওটা টান দিয়ে খুলে নিই, ততক্ষণে সিনেমা ওদিকে দেখা শুরু হয়ে গেছে।’
-‘তার মানে ওরা আপনার ওপর কতজন মিলে নজরদারি করছে তা আমরা চাইলেও জানতে পারব না আর বুঝতে পারব না?’
-‘উহুঁ, আমার ওপর নজরদারি করে বিশেষ ফায়দা পাবে না। সমস্যাটা হয়েছে এই স্লাটগুলোকে নিয়ে। যখন তখন যেখানে সেখানে দেখলে গায়ের ওপর হামলে পড়ে। রাজিয়াকে সন্দেহ করার কারণ ছিল। এর মাঝে যতবারই ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে আনফরচুনেটলি, ততবারই ডানে বামে না দেখে এসে জাপটে ধরেছে। এটাই ওদের চোখে পড়েছে। আর আমি শিওর। সিফাত, ফারজানা, এদের ব্যাপারেও অলমোস্ট জেনে গেছে ওরা। আমার এখন ভাবনা হচ্ছে, ওরা এরপর কী করতে পারে? রাজিয়া আজ কিংবা কাল হলেও আমার হাতেই মরত। তাই এভাবে ওর মৃত্যু হওয়াতে আমারই হাত নোংরা হওয়া থেকে রেহাই পেলো।’
-‘তাহলে এবার গেমটা খেলা হবে কী করে ওদের সঙ্গে? অন্য মেয়ের সঙ্গে দেখার পর নিশ্চয়ই আপনার হবুবউ সিন ক্রিয়েট করবে?’
জায়িন রেজার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে স্মিতহাস্য চেহারা করে বলল, ‘এই গেমের সব থেকে মজার ব্যাপারটা এখনো বুঝলে না? আমিও জানি ওরা ক্রিমিনাল। আর ওরাও জানে আমি ডিটেক্টিভ এজেন্ট। কিন্তু তারপরও আমরা কেউ কারও থেকে দূরে থাকতে পারছি না। কারণ হলো, আমি আমার প্রেমের ফাঁদে অলমোস্ট একজনকে আটকে ফেলেছি। তবে অন্যজন ভীষণ চতুর। দেখতে হবে না? সে জায়িন মাহতাবের রানি বলে কথা! আমার সমকক্ষ না হলে কি হয়?’
-‘শেষ পর্যন্ত কে যে কট খাবে আল্লাহ পাক জানেন।’
অনিশ্চিত চিন্তাধারা প্রকাশ পেল রেজার কণ্ঠে।
জায়িন তাগিদ দিয়ে উঠে পড়ল, ‘ওদের নেক্সট প্ল্যানটা সম্পর্কে আইডিয়া করতে হবে। প্রচুর কাজ আছে। সবাইকে কনফারেন্স হলে চলে আসতে বলো তো।’

৩৫
কাজ শেষে রাত করে হলেও জায়িন ঢাকাতে থাকে না। চলে আসে গাজীপুর। ভোরের দিকে আজ বাড়ি পৌঁছল সে। তবে তার শরীর আর মন দুটোই ভীষণ করে পাশের বাংলোর সুন্দরী মেয়েটাকে পেতে চাইছে আর দেখতেও ইচ্ছা করছে। জামা কাপড় পালটে ফ্রেশ হয়েই অতি দ্রুত সে জাদু মাধুর বাংলোতে গিয়ে হাজির হলো। কলিংবেল চেপে ভেতরে ঢোকার জন্য ধৈর্য নেই তার একেবারেই। জাদুর ঘরের জানালাটা সব সময়ই খোলা থাকে। খুব সহজেই সেই জানালা টপকে ঘরে চলে আসা যায়। তা মাথায় আসতেই দেরি না করে জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল সে। আলো আঁধারি ঘরটাতে দেখতে পেল বিছানার এক কোণে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে জাদু। মাথার কাছেই বুবন শুয়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল সে, জাদুর মুখোমুখি। স্লিভলেস লেডিস টি-শার্ট পরনে বলে ফর্সা গলা, ঘাড়, বাহু সবই দেখতে পাচ্ছে জায়িন। আজ ভালো করে সে এটাও দেখতে পেল, জাদুর বাম বাহুতে গুলি লাগার শুকিয়ে যাওয়া কালো একটি ক্ষত৷ কত সময় ধরে চেয়ে রইল ওই ক্ষতের দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই ক্ষতের জায়গায় স্পর্শ করল সে।

প্রতিদিন এই সময়েই জাদুর ঘুম আপনাআপনি ভেঙে যায়। আজও তাই হলো৷ তবে সেটা গায়ে কারও স্পর্শ পেয়েই। ঘুম ঘুম চোখে হঠাৎ করে কোনো ছেলেকে দেখেই চমকে উঠল সে। চমকে ওঠার ফলাফলস্বরূপ নিচে পড়ে যেতে চাইল তখন। বিছানার এক কোণায় ছিল বলেই জায়িন চট করেই ওকে ধরে ফেলল। আর বলল, ‘এত বড়ো বিছানার এই এক কোণটায় বেশি পছন্দ না কি?’

এমন মুহূর্তে জায়িনকে দেখে আর তার এত সহজ স্বাভাবিক চেহারায় কথাটা শুনে বিস্ময় ক্ষণ কাটিয়ে উঠতে পারল না। জায়িনও নিষ্পলক চেয়ে রইল ওর দিকে। তারপরই আরেক বিস্ময়কর কাণ্ড ঘটাল সে। জাদুর হতবাক মুহূর্তের সুযোগ নিয়ে টুপ করে ওর গালে চুমু খেয়ে ছোটো করে একটা কামড়ও বসিয়ে দিলো। তারপর বলল, ‘কামড়টা ছিল রাতে আমার ভিডিয়ো কল পিক না করার জন্য।’

_______

সিন্ধু ইগল – (১৪)
ইসরাত জাহান দ্যুতি

চেহারায় কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা প্রকাশিত ছিল জাদুর। পরক্ষণেই তা বদলে গিয়ে হালকা লাজুকতা ভীড় করল তার ঘুমুঘুমু মুখটাতে। জায়িন নিশ্চুপ রয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকল সেই মুখখানা। মুখের ওপর ছড়ানো ছিটানো চুলগুলো জানালা দিয়ে বয়ে আসা বাতাসে হালকা উড়ে চলেছে মাঝে মাঝে। আর চোখদু’টো যেন বেলুনের মতো ফুলে আছে। তবে সেই চোখজোড়া দেখেই জায়িন বুঝে গেল, মেয়েটা মাত্রাতিরিক্ত নেশায় আসক্ত। ব্যাপারটাতে সে খুবই খারাপ বোধ করল। হালকা গোলাপি বর্ণ ঠোঁটটা কেমন শুকিয়ে আছে। তা দেখে জায়িন হঠাৎ একটু হাসল। জাদু তার নিবদ্ধ দৃষ্টি দেখেই ঠোঁটদু’টো আপনা-আপনি চেপে ধরে ভেতরে নিয়ে নিলো৷ জায়িন তখন জাদুর চোখে দৃষ্টি রেখে হেসেই বলল, ‘বসন্ত এসে গেছে।’
-‘তা তো জানি না।’
সবে ঘুম ভেঙেছে বলে কণ্ঠে একটু জড়তা জাদুর৷ জায়িন ওকে ছেড়ে দিয়ে ওর জায়গাটাতে গিয়ে শুয়ে পড়ল। জাদুর চেহারাটা তখন যেন কেমন দেখাল! জায়িন তা বুঝতে চাইল না৷ মাথার নিচে দু’হাত পেতে জাদুর দিকে চেয়েই বলল, ‘আমিও জানতাম না। হয়তো বসন্তের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে হতে পারে এখন।’
জাদু উঠে পড়ল জায়িনের কাছ থেকে। সোফার ওপর মাধুর ফেলে রাখা সাদা ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে সেখানেই বসল, জিজ্ঞেস করল, ‘এটাই জানাতে এসেছ?’
হাসল না জায়িন। তবে তার মুখটা কেমন হাসিহাসিই লাগছে। জবাব দিলো, ‘এটা তো জানা হতো না, যদি না তোমার শুষ্ক ঠোঁট কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেতাম।’
জাদু মিষ্টি হেসে বলল, ‘মাধু তো এখনো জাগেনি।’
-‘জানি।’
জায়িনের উত্তরটা শুনে সস্মিত চেহারায় জিজ্ঞেস করল, ‘আর কী জানো?’
নির্বিকার ভঙ্গিতেই জায়িন উত্তর দিলো, ‘সকালের ব্রেকফাস্ট ও-ই রেডি করে। এখন যেহেতু ও ঘুমে, তাই তোমাকেই কফি করতে যেতে হবে। আমি তোমার হাতের কফি খেতে পারব কিনা সেটাই জিজ্ঞেস করতে চাইছ তুমি।’
জাদু তার নিজস্ব কায়দায় চেহারায় মুগ্ধতা প্রকাশ করে বলল, ‘সো ইনটেলিজেন্ট। তাহলে থাকো, আমি আসছি।’
জায়িন কোনো উত্তর দিলো না। জাদুর যাবার পথে চেয়ে রইল। কফি তৈরি করে ফিরতে ফিরতে জাদু এসে দেখল জায়িন চোখ বুঁজে পড়ে আছে৷ তবে সে জাদুর আগমন টের পেয়েছে। অপেক্ষায় আছে কখন জাদু ডাকবে।
একটু হেসে জাদু এগিয়ে এসে জায়িনের গালে গরম কফির মগটা ছুঁইয়ে দিলো। আর অমনি লাফিয়ে উঠল জায়িন। মিটিমিটি হেসে জাদু কফির মগটা দেখিয়ে ইশারা করছে সেটা হাতে নিতে। জায়িন নিশ্চুপ ভঙ্গিতে চেয়ে দেখছে আজ জাদুর অন্য এক অভিব্যক্তি। চেহারায় যেন দুষ্টুমি খেলা করছে ওরর। এর আগে এমনটা দেখেনি সে। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে জাদু জিজ্ঞেস করল, ‘খারাপ ছেলেরা তাহলে প্রাচীর টপকে পড়শিদের বাড়ি এসে পড়শির বেডরুমে ঢুকে পড়ে?’
ততক্ষণে জায়িন মগটা নিয়ে নিয়েছে হাতে৷
জাদুর কথা শুনে তা পাশের সেন্টারটেবিলে রাখল। তারপর ওকেও মগটা রাখতে বলল। জাদু তার কথায় প্রশ্নচোখে তাকাতেই জায়িন আবারও তাকে ইশারা করল রাখতে। আর তার কথামতো জাদু মগটা রাখতেই আচমকা ওকে টেনে এনে বিছানাতে ফেলল জায়িন। তখন বুবন জেগে গিয়ে সরে পড়ল। ওদের দু’জনের দিকে শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইল দূরে গিয়ে। জায়িন ফেলে দিয়েই ক্ষান্ত হলো না। ওকে বুকের সাথে চেপে ধরে শুয়ে পড়ল সেও। জাদু হতবাক চোখে চেয়ে কিছু বলবার আগেই জায়িন বলে উঠল, ‘প্রাচীর টপকে পড়শিদের বাড়ি আসিনি। হবুবউয়ের কাছে এসেছি। ভেবেছিলাম এসে তোমাকে পাবো না। ভাগ্যক্রমে পেয়েই যখন গিয়েছি তখন পুরো ঘুমটা শেষ করেই তারপর তোমাকে ছাড়ব।’
কথাগুলো বলে জাদুর মুখের দিকে তাকাল জায়িন। জাদুর চেহারাতে প্রকাশ পাচ্ছে, তার এমন আকস্মিক কাণ্ডে না পারছে সে দূরে সরতে আর না পারছে কাছে থাকতে। আর সেটাই যেন জায়িন উপভোগ করছে।
_________

আজ রেজার দিনটাই শুরু হয়েছে বিশ্রীভাবে। চারদিকে বিপদ, সমস্যার অন্ত নেই। এর মাঝে নতুন করে আরেক ঝামেলা সামলাতে হবে। এত সমস্যা নিয়ে কি জীবন পার করা যায়? কবে মুক্তি পাবে সে এই জীবন থেকে? নিজের জীবনের প্রতি সে খুবই তিক্ত। মরে গেলেও অন্তত এই সমাপ্তহীন সমস্যাগুলো থেকে বেঁচে যেত। বিরক্তির সঙ্গে রাগটাও হাজার গুণ বেড়ে চলেছে তার৷

গাড়িটা এসে থামাল কল্যাণপুরের খুব ভেতরের দিকে একটা দো’তলা বিল্ডিংয়ের সামনে। গাড়ি থেকে নেমেই দ্রুত পায়ে চলে এল বিল্ডিংয়ের ভেতরে। তাকে দেখে দু’তিন জন ছেলে সালাম দিলেও সে ওদের সালাম শুনতে পেল না বোধ হয়। রাগের চোটে মাথা টনটনে হয়ে আছে তার। ঘরে ঢোকা মাত্রই একটা মুহূর্ত দেরি না করে ফ্লোরে হাত, পা, মুখ বেঁধে ফেলে রাখা লোকটাকে বেধড়ক মারতে শুরু করল। প্রথম পর্যায়ে হাত, পা দিয়ে ঘুষি, লাথি মারল। কিন্তু তাতেও রাগটা নামল না। লোকটার গোঙানির আওয়াজে আরও বৃদ্ধি পেল। পায়ের কাছে রডটা পেয়ে সেটা উঠিয়েই গায়ের সর্ব শক্তি দিয়ে বিরতিহীন মারতে থাকল। শেষ আঘাত মাথায় লাগার কিছু সময় পরই মুখ বাঁধা অবস্থাতে বমি করে ফেলল লোকটা। জায়িনও ততক্ষণে এসে পৌঁছে গেছে। ঘরে ঢুকে রেজাকে ভয়ঙ্কর রাগান্বিত অবস্থায় লোকটাকে মারতে দেখে বৃদ্ধা আঙুলে কপাল ঘঁষতে ঘঁষতে এসে বাইরে দাঁড়াল৷ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোর দিকে তাকাতেই ওদের মধ্যে একজন বলতে শুরু করল, ‘নজরে নজরেই রাখছিলাম স্যার। যার জন্য পালায় যাইতে পারে নাই।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জায়িন। মৌপ্রিয়াকে বাস চাপা দেওয়ার বিষয়ে বাসের এই ড্রাইভারটার সঙ্গে ডিল করার সময়ই জায়িনের মনে হয়েছিল, বেইমানি করে বসতে পারে লোকটা। শুধু রেজার অনুরোধে কাজ শেষে ওকে ছেড়ে রেখেছিল। তার মনেও মায়া, ভালোবাসা কাজ করে। তবে তা মানুষ চিনে আর বুঝে। কিন্তু রেজা এতগুলো বছর তার সঙ্গে থেকেও খুব সহজে মানুষ চিনতে পারা শিখল না। সেটাই আফসোস!

ঘরের ভেতর তাকিয়ে একবার দেখে যা বুঝল, রেজা আজ পিটিয়েই ড্রাইভারটাকে মারবে বলে পণ করেছে হয়তো। অকাজে এত এনার্জি এবং সময় নষ্ট করা জায়িনের একদমই অপছন্দ। অতি মাত্রায় বিরক্ত হচ্ছে সে রেজার ওপর। দরজার গায়ে টোকা দিয়ে সে ডেকে উঠল ওকে। তখন রেজা জায়িনের উপস্থিতি টের পেয়ে থামল৷ রড ছুঁড়ে ফেলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়াল ওর সামনে, ‘কাল রাতে এই শুয়োরটা যে কী প্যারা দিয়েছে! দূরে না থাকলে কালই ওকে আজরাইলের মুখ দেখাতাম।’
-‘রিল্যাক্স! তোমার হাইপার লুক থেকে ইনোসেন্ট লুকটাই ভালো।’
জায়িনের মশকরায় আজ রেজা কিছুই বোধ করছে না। শরীরে রাগ ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছু বোধ হচ্ছেও না তার। কানের কাছে আবার ড্রাইভার লোকটার আর্তনাদ আসতেই এবার সে রাগের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রডটা উঠিয়েই সজোরে মাথায় বাড়ি মেরে দিলো ওর। তিরের বেগে রক্ত ছুটে ভরে গেল ড্রাইভারের চেহারাটা। শেষ নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়েছে তার মাঝেই। রক্ত ভেসে যাওয়া লোকটাকে দেখতে দেখতে পেছন থেকে বিড়বিড় করে জায়িন তখন বলে উঠল, ‘আই হেট বিট্রেয়ার।’
ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে রেজা চেঁচিয়ে উঠে বাইরের ছেলেগুলোর মধ্যে মানিক বলে কাউকে ডেকে উঠল। পানি চাইল তার কাছে। মাথাটা এপাশ ওপাশ দু’বার ঝাঁকিয়ে লাশটার দিকে চেয়ে বলতে থাকল, ‘সুখে থাকতে তো কুত্তায় কামড়াচ্ছিল! লাখ টাকা নগদ পেয়েও আরও চাই! আরও চাই! কবরে গিয়ে চাস এবার।’
রাগটা তবুও নামেনি রেজার। ফিরে তাকিয়ে জায়িনকে বলল, ‘বলে কিনা “আমি থানার সামনে দাঁড়াই আছি কিন্তু! বাঁচবার চাইলে জলদি জলদি পঞ্চাশ হাজারের ব্যবস্থা করেন।” কত বড়ো বুকের পাটা ওর! আমাকে ব্ল্যাকমেইল!’
মানিক বহু আগেই পানি নিয়ে জায়িনের পিছে দাঁড়িয়ে ছিল। রেজা একটু শান্ত হতেই পানিটা এগিয়ে দেয় ওকে। জায়িন হাত ঘড়িতে সময় দেখে ছেলেগুলোকে বলে, ‘ডোম এনে লাশ পিস করার ব্যবস্থা কর।’
বলেই সে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে। তারপরই রেজাও এলোমেলো, ঘর্মাক্ত চেহারা নিয়ে বেরিয়ে আসে৷ জায়িনের সাথে কিছু কথা বলে যার যার গাড়ি করে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে।

কেবিনে এসে ঢুকতেই জায়িন পিছু ডাকে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে। ফিরে তাকিয়ে দেখে সিফাত ক্লান্ত চেহারা নিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। আজ মনে পড়ল জায়িনের, বেশ অনেকদিনই হলো সিফাতের সাথে একাকী সময়টা কাটানো হয় না। আজ সিফাতের চেহারা দেখেই সে নিশ্চিত হয়ে গেছে, একটু বাদে সিফাত কী চাইবে তার কাছে। কিন্তু এমন মুহূর্তে সে আপাতত নিজের কাজ আর জাদু, মাধু ছাড়া অন্য কিছুতে খামোখা সময় ব্যয় করতে রাজি নয়।

সিফাত তার কাছে এসেই বলল, ‘মাত্র তিন ঘণ্টার জন্য ফ্রি আছি, জায়িন৷ অনেকদিন হলো তোমার সঙ্গে বসে দীর্ঘ সময় কথাও হয় না আমার। এই তিনটা ঘণ্টার আবদার ফেলবে না প্লিজ। চলো না আমার সঙ্গে!’
-‘আমি তো ব্যস্তই। তুমি নিজেও ব্যস্ত। তার জন্যই একটু সময় দূরে দূরে আমরা। নয়তো এভাবে এসে আমার কাছে তোমাকে আবদার ধরতে হতো না, সিফাত। আর আমাদের কাজগুলোর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বাইরে দেখা করার রিস্ক তো নেওয়াই যাবে না।’
-‘বাইরে দেখা করতে চাইছে কে? আমার ফ্লাটে যাব।’
-‘আচ্ছা, তিন ঘণ্টা সময় তো? আমার হাতে এখন একটু কাজ আছে। কাজটা এগোতে পারলে কল করব তোমাকে।’
মুখ ভার করে সিফাত চলে গেল। জায়িন কাজ শেষ করলেও ভুলে গেল সিফাতের কথা। বাইরে এসে ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়িতে উঠল সে। পাশে ড্রাইভার ফ্রন্ট মিররে বারবার দেখতে থাকল পেছনের সিটে বসা সিফাতকে। সিফাত ড্রাইভারকে নিষেধ করে রেখেছে, যেন তার উপস্থিতি জায়িনকে না বলে। কিন্তু জায়িনের দৃষ্টির সীমানা সম্পর্কে হয়তো সিফাতের এখনো সমুদয় ধারণা হতে বাকি। কথা শেষ করেই জায়িন ড্রাইভারকে বলল গাড়ি থেকে নেমে যেতে। রেজা ছাড়া এমনিতেও তার অন্য কাউকে দিয়ে গাড়ি ড্রাইভিং করাতে ভালো লাগে না। ড্রাইভারটি তার কথামতো নামতেই সিফাতকে উদ্দেশ্য করে জায়িন বলল, ‘স্টিয়ারিংটা এসে ধরো সিফাত।’
প্রচণ্ড খুশি নিয়ে সিফাত বেরিয়ে এসে ড্রাইভিং সিটে এসে বসল। তারপর বেরিয়ে পড়ল তাদের গন্তব্যে।
_________

জায়িনের থেকে রাত ন’টায় বিদায় নিয়ে সিফাত সেদিন আবার রওনা দিয়েছিল চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। তবে তার ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে। ওখানের কাজ আপাতত শেষ করে মনটাকে সতেজ রাখতে পরদিন দিনের বেলা সে তার সহকর্মীদের সাথে সমুদ্র সৈকত, পাহাড় ঘুরে বেড়িয়েছিল কিছু সময়। ফেরার পথেই ঘটে যায় চরম দুর্ঘটনা। কে জানত, তার মৃত্যুটাও হবে রাজিয়ার মতোই? তবে পরিকল্পিত উপায়ে তার গাড়ির বিস্ফোরণটা হয়েছিল, এ নিয়ে আর কারও কোনো সন্দেহ হয়নি। পুরো ডিপার্টমেন্ট এবার আরও জোরালোভাবে নড়েচড়ে বসলেও জায়িন থাকে ঠান্ডা। এরপর সে যা আবিষ্কার করে তা রেজাকে জানায়, ‘এই ঘটনার উদ্দেশ্যগুলো এতটা গভীরে নিয়ে ভাবা হয়নি, রেজা৷ আমাকে আমার কাজ থেকে অমনোযোগী করায় শুধু উদ্দেশ্য নয়। রাজিয়ার পর সিফাতের মৃত্যু প্রমাণ করে, আমার প্রেমিকা হওয়া মানেই তার মৃত্যু।’
রেজা ভীষণরকম বিস্মিত না হলেও একটু বিস্ময় ঘিরে ধরে তাকে।
-‘একটা কথায় এখন কানে বাজছে স্যার। শি ইজ আ সাইকো।’
জায়িন গাড়ির হুডের সঙ্গে হেলে দাঁড়াল, ঠোঁট কামড়ে কী যেন ভাবছে সে। রেজা তখন বলল, ‘ফারজানা ম্যাম তাহলে এখন লাইফ রিস্কে আছে।’
-‘ওর কথায় ভাবছি।’
-‘উনি এখন শ্যুটিঙের কাজে মালয়েশিয়া না? ওনাকে আপাতক ফিরতে বারণ করলে ভালো হয়।’
-‘শ্যুটিং শেষে ওখান থেকে ওকে দেশে ফিরতেই হবে। পরবর্তী শ্যুট দেশে হবে যে। কিছু তো একটা করতে হবে।’
-‘ফিরবে কবে?’
প্রশ্নটা শুনতেই জায়িনের টনক নড়ে, ‘মাই গড! আজ রাতেই ওর দেশে ফেরার কথা।’
কথাটা বলেই হাত ঘড়িতে সময় দেখল সে। রেজা তখন বলল, ‘আমাদের এয়ারপোর্ট যাওয়া উচিত। আর আজ আমাদের গাড়িতেই ওনাকে সঙ্গে আনতে হবে।’
-‘হুঁ, ঠিকই বলেছ। কিন্তু এর মাঝেও আমার সুন্দরী টুইনের প্রশংসা করতে ইচ্ছা করছে, বুঝলে? একটু হলেও চাপে ফেলেছে তারা আমাকে।’
মৃদুহাস্য চেহারায় বলতে বলতে জায়িন গাড়িতে উঠে বসল। ফারাজানা সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে জায়িনকে দেখেই খুশিতে বাকরুদ্ধ। বলা বাহুল্য, জায়িনের প্রেমিকারা তার পেশা এবং তার স্বরূপ, সব বিষয়েই অবগত। আর সকল প্রেমিকের মতো যখন ইচ্ছা তখন প্রেমিকাদের সাথে বাইরে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় না জায়িনকে কখনোই। বলা যায়, সেইসব প্রেমিকাদের কাছের বন্ধু এমনকি পরিবারও জায়িনের সাথে তাদের প্রণয় সম্পর্ক বিষয়ে জানায়ও না তারা। আর আজ সেই জায়িনকে হঠাৎ করে সকলের সামনে দেখে আশেপাশের সব কিছু ভুলে ফারজানা ঝাঁপিয়ে পড়ে জায়িনের বুকে। এবং সেই রাত থেকেই ফারজানার জন্য সিকিউরিটির ব্যবস্থা করে ফেলে জায়িন। তার এতটা খেয়াল রাখার একটাই মাত্র কারণ, ফারজানার মৃত্যু হোক তা সে চায় না। প্রেমিকাদের সে নিজের শিকারের চোখে দেখলেও সব শিকারকে সে মৃত্যু দেয় না। তবে তার সঙ্গে পরকীয়াতে যে নারীগুলো লিপ্ত ছিল, তাদের মৃত্যু ছিল অবধারিত৷
_________

দু’দিন হলো জায়িন বাড়িতে ফেরেনি। বাসার সকলের জানামতে সে হয়তো মাসখানিক পরেও ফিরতে পারে, আবার চাইলে এক সপ্তাহ পরেও ফিরতে পারে৷ হুটহাট তার বাসায় না ফেরা নিয়ে এখন আর কারও মাঝে চিন্তা প্রকাশ পায় না। অভ্যাস হয়ে গেছে তাদের৷

গতকাল জাহিদ ব্যবসায়ের কাজে গেছে ইন্ডিয়া, মাহতাব সাহেব গেছেন এলাকার মসজিদ থেকে তাবলীগে। বাড়িতে পুরুষ বলতে শুধু বাড়ির চারপাশের গার্ডগুলো৷ তাছাড়া সারা বাসায় জান্নাতি বেগম, জাহিদের বউ এশা আর কাজের দু’টো মেয়ে ছাড়া কেউ নেই।

সময়টা চলছিল বিকাল৷ কিছুদিন হলো জাদু আর মাধু কেউ-ই এ বাড়িতে আসে না। এখানে আত্মীয় স্বজন বলতে মেয়েদু’টোর কেউ নেই। বড্ড মায়া হয় জান্নাতি বেগমের, ওদের জন্য। ভাবলেন নিজেই গিয়ে দেখা করে আসবেন ওদের সঙ্গে। তাই কাজের মেয়েটাকে সাথে করে ওদের বাংলোতে এসে দু’বোনের মাঝে একজনকে দেখেই আঁতকে ওঠেন। বিছানাতে যেন নির্জীব হয়ে পড়ে আছে সে। আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসছে ওর কণ্ঠ থেকে। দ্রুত ওর কাছে এসে দেখেন গায়ে ভীষণ জ্বর ওর৷ আরও দেখতে পান, হাতে পায়ে জখমের দাগ। জান্নাতি বেগম একটু বিভ্রান্তে পড়ে যান এই নিয়েই, যে মেয়েটি মাধু না জাদু? মাধু তা বুঝতে পেরে নিজেই নাম জানিয়ে ব্যথায় জর্জরিত শরীরটাকে টেনে তুলে উঠে বসে। কিন্তু তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে, বসে থাকার শক্তিটুকুও নেই ওর শরীরে। এমন অবস্থা কী করে হলো তা জান্নাতি বেগম জানতে চাইলে মাধু জানায়, ছোটোখাটো একটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল সে কাল রাতে। কিন্তু শরীরের জখমগুলো দেখে জান্নাতি বেগমের মনে হলো, এগুলো কারও করা আঘাতের দাগ। নিজের ভাবনা নিজের কাছেই রেখে মাধুকে উপদেশ দিলেন হাসপাতাল যাবার জন্য। কিন্তু মাধু কোনোভাবেই হাসপাতাল যেতে রাজি নয়। জিজ্ঞেস করলেন ওকে, ‘জাদু কোথায়? এ অবস্থায় একা একা পড়ে আছ ঘরে৷ আমাকেও তো ফোন করে জানালে পারতে।’
মাধু কোনোরকমে উত্তর দেয়, ‘জাদু গতকাল রাতে সিলেট গেছে জরুরি প্রয়োজনে। ওর ফিরতে ফিরতে অন্তত তিন চারদিন লাগবে। আমি নিজেই খেয়াল রাখতে পারব আন্টি। আপনি টেনশন করবেন না। আপনি এসেছেন, এতে ভীষণ ভালো লাগছে।’
জান্নাতি বেগম এমন অবস্থায় মাধুর একা থাকাটা ঠিক মনে করছেন না। জখমগুলোতে ওষুধ লাগানো হলেও মনে হচ্ছে ক্ষতগুলো এখনো তাজা। আর গায়ে জ্বর তো সাংঘাতিক। এইভাবে নিজের খেয়াল নিজে রাখা কী করে সম্ভব? এতটা অনুদার মনের নন তিনি। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন, জাদু না ফেরা অবধি মাধু তাদের বাসাতেই থাকবে। তা শুনে মাধু প্রথম দু’বার অমত করলেও পরে আর না করতে পারল না। জান্নাতি বেগম আর তার কাজের মেয়েটির সহায়তায় চলে এল শেখ বাড়ি। সময় যত যেতে থাকল, মাধুর অবস্থা তত খারাপ হতে থাকল। তবু সে জিদ ধরে বসে আছে, হাসপাতাল কোনোক্রমেই যাবে না। তার একটাই কারণ জানায় সে, হাসপাতাল জায়গাটা সে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে না৷ এই অবস্থায় একজন ডাক্তারের দরকার খুবই। উপায় না পেয়ে জান্নাতি বেগম মাধুর অবস্থা জায়িনকে ফোন করে জানায়। যাতে সে যেন কোনো ব্যবস্থা করে দেয় মাধুর চিকিৎসা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। তা শোনার পর জায়িন সে রাতে নিজেই ছুটে আসে গাজীপুর। যা জান্নাতি বেগম কোনোভাবেই আশা করেননি।
____________________________________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here