সরোবরে প্রেম পর্ব ৫+৬

0
868

সরোবরে প্রেম
লেখনীতেঃশ্যামকন্যা
পর্ব:০৫

বাইকে করে অর্ণব প্রিয়তাকে বাসায় দিয়ে আসলো। বাসায় পৌঁছাতেই সেলিনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

“ওর সাথে বেরিয়েছো কেন?”

প্রিয়তা হাতের সাথে হাত ঘষতে থাকলো। সে কি উত্তর দিবে?

সেলিনা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

“আর যেন এসব বেহায়াপনা না দেখি। যে সম্পর্ক নিজেই শেষ করেছো সেটা ফের আমি মানতে পারব না।”

প্রিয়তা হতাশ চোখে মায়ের দিকে তাকায়। মাত্র কয়েকটা দিন আগেও মা অর্ণব অন্ত প্রাণ ছিলেন। প্রিয়তার সামান্য ভুলের কারণে সবাই এখন মুখ ফিরিয়েছে। প্রিয়তা আগে পাছে না ভেবে মায়ের পা জড়িয়ে বসে পড়লো। কান্নার সুর তোলে বললো,

“আমি ওনাকেই বিয়ে করবো, মা। তুমি একটাবার আমার কথাটা শোন।”

সেলিনা বেগম মেয়ের এহেন কান্ড দেখে সব রাগ ভুলে গেলেন। তিনি মেয়েকে বললেন,

“যা, গা ধুয়ে আয়। বাইরে থেকে এসেছিস। তোর সব কথা আমি শুনবো। মা হয়ে তোর খারাপ চাইবো না।”

প্রিয়তা মায়ের কথামতো চলে যায়।

গোসল সেরে প্রিয়তা মায়ের সামনে আসে। সেলিনা বেগম চোখ তুলে মেয়ের দিকে তাকান। মেয়েটা একদম বাবার চেহারা পেয়েছে। গায়ের রঙটা শুধু ওনার। এই মেয়ের উপর তিনি রেগে থাকবেন কিভাবে? মেয়েটা তো ওনার কলিজার একটা অংশ।

প্রিয়তা অর্ণবের সাথে দেখা হওয়ার সমস্ত ঘটনা সেলিনা বেগমকে জানায়। সেলিনা বেগম খানিকক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন,

“কাল আমি তোকে নিয়ে অর্ণবদের বাসায় যাব। ওকেও সেখানে থাকতে বলবি।”

প্রিয়তা মাথা নেড়ে সায় জানায়।

বিকেল চারটা। চৌধুরী মেনশনে বসে আছে উৎসুক কয়েকজন। অর্ণব বারবার প্রিয়তার দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটা ভীষণ ভয় পাচ্ছে। সেলিনা বেগমের কোনো কথাই আসমা চৌধুরী কানে তুলছেন না। আমিন সাহেবও তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। অনিও বলে উঠে,

“মা, প্লিজ ভাবিকে মেনে নাও।”

আসমা চৌধুরী গর্জে উঠে বলেন,
“বড়দের মাঝে কথা বলবি না।”

অনি চুপ হয়ে যায়।

আসমা চৌধুরী সবাইকে সেদিনের রেকর্ডিং দেখান। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন,

“তুমি ঝগড়া না করলে আমার ছেলেটা ওতো জোরে বাইক চালাতো না আর ওর এতো কষ্টও হতো না।”

প্রিয়তা মাথা নিচু করে বসে থাকে। তার চোখভর্তি পানি। যেকোনো সময় উপচে পড়বে।

অর্ণব জবাব দেয়,

“মা, এখানে প্রিয়ুর কোনো দোষ নেই। এক্সিডেন্ট যেকোনো সময় হতে পারে। আর রইলো কথা বিয়ের। প্রিয়তা ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা আমার জন্য অসম্ভব। মা, তোমার ছেলের প্রাণ প্রিয়তা। তুমি যেমন নিজের সন্তানকে ছাড়া থাকতে পারবে না, তেমন আমিও প্রিয়তাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। তবে তোমার অমতে গিয়ে আমি প্রিয়তাকে বিয়েও করবো না। সারাটা জীবন আমার ভেতরে একটা চাপা কষ্ট থাকবে। প্রাণহীন হয়ে বেঁচে থাকবো আমি। তুমি কি এটাই চাও,মা?”

থমকে থাকেন আসমা চৌধুরী। আমিন চৌধুরী বলেন,

“প্রিয়তাকে ঘরের বউ করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।”

সেলিনা বেগম বলেন,

“আপা, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, যেদিন আমার মেয়ের জন্য আপনার ছেলের ক্ষতি হবে সেদিন আমি নিজে প্রিয়তাকে এই বাড়ি থেকে নিয়ে যাব।”

প্রিয়তা ছলছল চোখে আসমা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে,

“আমায় একটা সুযোগ দেবেন, আন্টি?”

আসমা চৌধুরী সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রিয়তাকে বুকে টেনে নেন। বলেন,

“আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি,মা। আমার ছেলে তোমাকে এতো ভালোবাসে। ওকে কখনো কষ্ট দিও না, মা।”

অর্ণবের মুখে বিজয়ের হাসি। বুকে প্রশান্তি।

অতিবাহিত হয় আরো কয়েকটা দিন। প্রিয়তা ভার্সিটি আজ অফ। সে যাবে জাবিরের বাসায়। জাবির ওর এসাইনমেন্ট লিখছে। সেটা নিয়ে আসতে হবে। জাবিরের বাসাটা একটু নির্জন জায়গায়। রিকশা থেকে নেমে অনেকটা হেঁটে যেতে হয়। প্রিয়তা বের হয়ে যায়।

রিকশা থেকে নেমে খানিকটা দূর যাওয়ার পর প্রিয়তার চোখে পড়ে তিনজোড়া পা। পেছন পেছন আসছে। প্রিয়তা আড়চোখে পেছনে তাকায়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা গলির মাস্তান। প্রিয়তা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। পেছন থেকে খাকাড়ি দিয়ে কেউ একজন বলে উঠে,

“আজ খাসা মাল পাইছি, মামা।”

প্রিয়তার গলা শুকিয়ে আসে৷ সে হাতের ব্যাগ, পায়ের জুতা খুলে ফেলে দেয়। সর্বশক্তি দিয়ে দৌড়াতে থাকে। পেছন পেছন আসতে থাকে তিনজন।

ভয়ে প্রিয়তার বুক কাঁপছে। এর আগেও সে জাবিরদের বাসায় এসেছে। তখন এমন হয়নি। আজ শুক্রবার বলে রাস্তা ও ফাঁকা। প্রিয়তা দৌড়ে গিয়ে একটা বাড়িতে প্রবেশ করে। মেইন গেইট খোলাই ছিল। ঘেমে জামা গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। প্রিয়তা দরজা ঝাঁকাতে থাকে। অবশেষে এক মধ্যবয়স্কা মহিলা দরজা খুলে দেয়। প্রিয়তা কিছু বলতে পারে না। হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কাঁপতে থাকে। মহিলা প্রিয়তাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে যায়। মাথায় পানি ঢালতে থাকে।

অর্ণব অনেকক্ষণ যাবত প্রিয়তাকে কল দিয়ে যাচ্ছে। কোনো রেসপন্স আসছে না। শেষমেশ সে সেলিনা বেগমকে কল দেয়। জানতে পারে প্রিয়তা জাবিরদের বাসায় গেছে। জাবিরকেও কল দেয় অর্ণব।

“আসসালামু আলাইকুল, দুলাভাই।”

“ওয়ালাইকুম সালাম, আমার বউ কই, ভাই?”

“প্রিয়তা তো এখানে আসেনি, ভাইয়া।”

অর্ণবের বুক ধ্বক করে উঠে।

রাত সাড়ে দশটার দিকে প্রিয়তাকে পাওয়া যায়। অর্ণবের ততোক্ষণে পাগলপ্রায় অবস্থা। চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। পরনের শার্টের ইন খুলে যাচ্ছেতাই অবস্থা। চুল উষ্কখুষ্ক। সে প্রিয়তার পালস চেক করে আঁতকে উঠে। ভয়ংকর গতিতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে শরীরে। মেয়েটা কোনো কারণে বেশ ভয় পেয়েছে। অর্ণব মধ্যবয়স্ক মহিলাকে ধন্যবাদ দিয়ে প্রিয়তাকে বাসায় নিয়ে আসে। জাবিরও যায় ওদের সাথে। তার নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হচ্ছে।

সেলিনা বেগম প্রিয়তার মাথার কাছে বসে আছে। কাব্য একটু দূরে দাঁড়িয়ে। আপুর এই অবস্থা দেখে অজান্তেই ওর ছোট চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। অর্ণব প্রিয়তাকে একটা ইনজেকশন দেয়। সেলিনা বেগমকে বলে,

“আপনারা ঘুমিয়ে পড়ুন, আন্টি। ওর জ্ঞান ফিরলে আমি জানাবো।”

সেলিনা বেগম দুজনকে একা ছেড়ে বসার ঘরে গিয়ে বসে। মেয়ের এই অবস্থায় তার চোখে ঘুম নামবে কি করে?

খানিকক্ষণ পর প্রিয়তা অনেক কষ্টে চোখ খোলে। মনে হচ্ছে চোখ ভারী হয়ে আছে।

অর্ণব জেগেই ছিল। উৎকন্ঠা মিশ্রিত স্বরে বলে,

“কি হয়েছে, প্রিয়ু?”

প্রিয়তা ঝাপিয়ে পরে অর্ণবের বুকে। সময় নিয়ে সবটা বলে।

অর্ণবের বুক কেঁপে উঠে। মেয়েটার কিছু হলে ও কিভাবে বাঁচতো?

চলবে?

সরোবরে প্রেম
লেখনীতেঃশ্যামকন্যা
পর্ব:০৬

অর্ণবের পরনে ধূসর রঙের চেইক শার্ট। হালকা পাতলা শরীরে শার্টটা ভীষণ মানিয়েছে। শ্যাম পুরুষদের জন্য পারফেক্ট কালার। সে প্রিয়তার দিকে অপলক তাকাচ্ছে। সামনের এগারো তারিখ ওদের বিয়ে। প্রিয়তার সাথে সেদিনের ঘটনার পর অর্ণব চোখ মেলাতে পারেনি। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছিল। সে একটু বেশি খেয়াল রাখলে মেয়েটার হয়তো এমন হতো না। প্রিয়তা এখন কিছুটা স্বাভাবিক। তবে রাস্তায় একা বের হতে খানিকটা অপ্রস্তুত।

সেলিনা বেগম সেদিনের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছেন। সম্মানের ভয় তার অনেক বেশি। মেয়েদের চরিত্রে একবার দাগ লাগলে তা কখনো মুছে ফেলা যায় না। সমাজ দেয় না। তিনি মেয়েকে নিয়ে আতংকে আছেন। তাই তাড়াহুড়ো করে অর্ণব আর প্রিয়তার বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে। আসমা চৌধুরী এখনো মৌন সম্মতি প্রদান করে যাচ্ছেন। তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। আবার ছেলের পছন্দকে ফেলেও দিতে পারছেন না।

মাঝরাতে ফোন আসে অর্ণবের। আজ ঘরোয়াভাবে প্রিয়তার হলুদ হয়েছে। খুব বেশি মানুষের সমাগম ছিল না। প্রিয়তার খালা,ফুপু আর মামারা এসেছিলেন।

অর্ণবের গলার স্বর শুনেই প্রিয়তার বুক কেঁপে উঠে। লোকটা এতো সুন্দর করে কথা বলে কেন! শুনতে শুনতে নেশা ধরে যায়। রেশ লেগে থাকে অনেকক্ষণ। অর্ণব বলে,

“তোমায় তো হলুদ ছোঁয়াতে পারলাম না। একটু ছাদে আসো তো।”

প্রিয়তা চমকে উঠে। এতো রাতে মানুষটা মিরপুর থেকে আগারগাঁও চলে এলো। প্রিয়তা কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

“এতো রাতে আসার কি দরকার ছিল?”

অর্ণব হেসে বলে,

“বাইক নিয়ে আসিনি তো। মেট্রোরেলে এসেছি। পাঁচ মিনিটও লাগেনি।”

ঝটপট গায়ে উড়না জড়িয়ে ছাদে যায় প্রিয়তা। রাত বারোটা বাজেনি বলে ফ্লাটের মেইন গেইট খোলাই ছিল। অর্ণবের অসুবিধা হয়নি। প্রিয়তাকে দেখতেই অর্ণব বুকে হাত দিয়ে বলে,

“তোমায় দেখার অসুখ আমার কখনোই সারবে না, প্রিয়ু।”

প্রিয়তার শরীর অসাড় হয়ে আসে। লোকটা এতো পাগলকরা কথা কোথা থেকে শিখে এসেছে? কি গভীর তার চোখ। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

অর্ণব রেলিঙে ঠেস দিয়ে বলে,

“তোমার কোনো চাওয়া আছে, প্রিয়ু?”

প্রিয়তা মাথা নেড়ে বলে,

“আমি শুধু আপনাকে চাই। এতোটা চাই যতটা পৃথিবীর কেউ পরিমাপ করতে পারবে না। যতটা চাইলে আপনি কখনো আর অন্য কাউকে আপন করার কথা ভাবতে পারবেন না।”

“আমি অন্য কারো কথা ভাববো, এটা বললে কেন?”

“দেখুন, অর্ণব। আমি অনেক সিঙেল মাদার দেখেছি কিন্তু সিঙেল ফাদার খুব নগন্যই দেখেছি। পুরুষ মানুষ হয়তো একা থাকতে পারে না অথবা শুধুমাত্র এক নারীতে আসক্ত হতে পারে না।”

“যে পুরুষ সত্যিকারের প্রেমে পড়ে, সে এক নারীতেই আসক্ত হয়।”

প্রিয়তা ছোট করে উত্তর দেয়,

“হু। আমি কিন্তু আপনাকে আর বিয়ে করতে দিব না। মরে গেলেও না। ভূত হয়ে ঘাড় মটকাতে আসব।”

অর্ণব ছাদ কাঁপিয়ে হাসে। বলে,

“তোমায় মরতে দিচ্ছি না।”

পকেট থেকে ছোট একটা প্যাকেট বের করে সামান্য হলুদ আলতো হাতে প্রিয়তার গালে ছোঁয়ায় অর্ণব। এইবার দুজনকে পরিপূর্ণ লাগছে।
অর্ণব নিজের ফোন বের করে প্রিয়তাকে আরো একটা জিনিস দেখায়। বাসার নতুন নেমপ্লেট। সেখানে লেখা,

“আমাদের বাবুই পাখির বাসা
Dr. Arnob
Mst.Priyota

খুশিতে প্রিয়তার চোখে পানি চলে আসে। সে গুটিসুটি মেরে অর্ণবের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সন্তপর্ণে হাতটা শক্তপোক্ত হাতের উপর রাখে। তারপর ঝরঝর করে কেঁদে বলে,

” আমার এতো সুখ কেন, ডাক্তার?”

কবুল বলার আগ মুহূর্তে বিয়ের আসরে উপস্থিত হয় অবনী। সে অর্ণবের কলার ধরে বলে,

“বিয়ে যদি প্রিয়তাকেই করতে হয় তবে আমার সাথে নাটক কেন করলেন?”

চলবে?

ছোট পার্ট হওয়ার জন্য দুঃখিত। কাটা হাত নিয়ে এর চেয়ে বেশি লেখা সম্ভব ছিল না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here