#সমাপ্তির_শেষটা
#পর্ব_২
___________________________________________
যখন হসপিটালে পৌঁছালাম তখন রাত নেমে এসেছে ধরার বুকে । আদরকে কোলে নিয়ে রিসিপশনের কাছে গিয়ে বাবার কেবিন নাম্বার জেনে সেদিকে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়াতেই দূরে দাড়ানো একজনকে দেখতেই শিরদাড়া বেয়ে হিমশীতল রক্তের স্রোতধারা বয়ে গেল । সাথে সাথেই ঝাপসা হয়ে এলো নয়ন জোড়া। মনে হলো টাল সামলাতে না পেরে এই বুঝি পরে যাব । কিন্তু না । নিজেকে সামলে নিয়ে আমাকে দেখার আগেই আড়ালে সরে গেলাম । দূর থেকে তাকিয়ে দেখলাম মানুষটাকে । সেই একযুগ আগের নিয়ন আর এখনের নিয়নের মাঝে বিশাল তফাৎ । শেষ যেদিন নিয়নকে দেখেছিলাম সেদিন এইচ এস সি পরীক্ষার শেষ দিন ছিল । আর আজ যেই নিয়নকে দেখছি সে এপ্রোন পড়া একজন ডাক্তার । অনেক পরিবর্তন এসেছে ওর । হুট করে নিয়ন আমার এদিকেই তাকালো । সাথে সাথে হৃদপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে উঠলো । সেখান থেকে সরে গেলাম সাথে সাথে । দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম লিফটের দিকে । মাথার ঘোমটা’টা আরো ভালো করে টেনে দিই । লিফট খুলতেই তার ভেতর ঢুকে পড়লাম । হাত পা এখনো কাঁপছে আমার । আদর আমার গালে হাত দিয়ে বলে উঠল,
“আম্মু তোমার কি হয়েছে?”
এতক্ষণ আদরের দিকে খেয়াল ছিল না আমার । ওর কথায় নিজেকে খানিকটা স্বাভাবিক করে ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললাম,
“কিছু হয়নি বাবা। ”
“তুমি কাপছো কেন?”
“আমার কিছু হয়নি বাবা। ”
মুচকি হেসে উত্তর দিলাম । এরপর আর আদর কোনো প্রশ্ন করলো না । চুপ করে রইলো আমার কাঁধে মাথা এলিয়ে। আর আমি ডুবে গেলাম অতীতের সমুদ্রে ।
কৈশোরের শেষে আমার ছোট্ট মনটায়ও বসন্তের কোনো একদিনে ভালোবাসা নামক ফুল ফুটেছিল । কিন্তু লজ্জা, ভয়, সংশয় সবকিছুর সংমিশ্রণে গুটিয়ে রেখেছিলাম নিজেকে । নিয়ন আমার হৃদয়ের মনিকোঠায় ভালোলাগার ভালোবাসার রূপে প্রথম কড়া নেড়েছিল । কিন্তু দরজা খুলে তাকে সাদরে গ্রহণ করার সাহস কোনোদিন হয়নি আমার । তাই তো শুধু দূর থেকে লুকিয়ে দেখা, হঠাৎ সামনে পড়ে গেলে চমকে উঠা, কখনো বা লুকিয়ে ওকে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে নিজেকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা গুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল সবকিছু । মুখ ফুটে ভালোবাসি বলা হয়নি । একসাথে পথ চলা হয়নি । না বলা হাজারো কথা বন্দী রয়ে গেছে মনের ডায়েরিতেই । এর মাঝেই জীবনে পুরো অংশ জুড়ে দখল করে এসে পড়েছে সাদ্দাফ । তারপর আর কি! আমার অবেলায় দেখা সব স্বপ্ন ভেঙে ভেঙে গুড়িয়ে গিয়ে একসময় আমাকেও ভেঙেচুরে আবার সময়ের তালে তালে গড়েও দিয়েছে নতুন একরূপে । সেই আগের কিশোরী নূহা আমি নেই । বদলে গেছি কত! আজ আমি আদরের মা । হাজারো কথারমালা ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মনের মাঝে এলোমেলো হয়ে জেগে আছে । চাইছি গুছিয়ে গাঁথতে । কিন্তু একবার ছিড়ে যাওয়া মালা তো ফের গাঁথা যায় না । যেমনি বার বার ভেঙে যাওয়া বস্তু যে জোড়া লাগে না । আমি এভাবে বার বার ভেঙে গেছি । এলোমেলো আজ আমার কথারমালারা । তাই আর কিছুতেই কিছু মিলছে না । আজ রিক্ত আমি । শূণ্য আমার মন ।
ভাবনার ইতি ঘটে লিফটের দরজা খুলে যাওয়ায় । বের হওয়ার জন্য সামনে পা বাড়িয়ে মাথা উঁচু করে তাকাতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলাম আমি । দ্বিতীয়বারের মতো বুকের ভেতরে ছলকে উঠে স্পন্দনের গতি বেড়ে গেল । ঠোঁটের কোণে সেই চিরচেনা বাঁকা হাসি নিয়ে সামনে দাড়িয়ে নিয়ন । নড়তে ভুলে গেলাম । মনে হচ্ছিল যেন পাথরে পরিনত হয়েছি আমি । শ্বাসরুদ্ধ করে দাড়িয়ে ছিলাম শুধু । তখনই লিফটে দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল । তার মধ্যেই আমার বা হাত ধরে হালকা টান দিয়ে ভেতর থেকে বাহিরে নিয়ে এলো নিয়ন । সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেল লিফটের দরজা ।
হৃদয়ের কম্পন হয়তো বেড়ে গিয়েছিল বাড়াবাড়ি মাত্রায় । তাই সেই কম্পন দৃশ্যমান হয়ে ছড়িয়ে পড়লো সর্বাঙ্গে । কারণ তখনো আমার হাতকে আঁকড়ে ধরে আছে নিয়নের হাত । দেখলাম আদর অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । ওর চঞ্চল দৃষ্টি দৌড়ে যাচ্ছে একবার নিয়নের দিকে । আরেকবার আমার দিকে ।
নিজেকে লুকানোর বৃথা চেষ্টায় ব্যস্ত আমি কাঁপতে কাঁপতে হালকা মাথা উঁচিয়ে একটু তাকাই সামনে দাঁড়ানো চেনা তবুও অচেনা মানুষটার দিকে । একদৃষ্টিতে আমার তাকিয়ে আছে একজোড়া চোখ । ভারী, গম্ভীর, ঝংকারময়ী কণ্ঠে বেজে উঠলো তিনটা শব্দ….
“কেমন আছো নূহা? ”
_______________________________________
আমাকে দেখে দাভাইয়ের বিষ্ময়ের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে যেন এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল । কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে থেকে দৌড়ে এসে দাড়ায় আমার সামনে । দীর্ঘ এগারো বছর পর দেখা । সময়টা নেহাৎ-ই কম না । অশ্রুসিক্ত নয়নে আমার দিকে চেয়ে থাকে দাভাই । পরে তাকায় আদরের দিকে । দাভাইকে দেখে আদরের চিনতে সময় লাগেনি ।
“মামা…” বলে ডাক দিয়ে দু’হাত মেলে ধরে দাভাইয়ের দিকে । সাথে সাথেই আদরকে আমার থেকে কোল থেকে নেয় দাভাই । মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দেয় । সেই সাথে আমাকেও জড়িয়ে ধরে দাভাই । স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম আমি দাভাই চেয়েও কথা বলতে পারছে না । হয়তো এতবছর পর দেখায় সব কথা আটকে গেছে । মৃদু হাসলাম আমি ।
আসার পর থেকে বাবাকে দেখতে পারিনি । যতবারই যেতে চাইছি বাবার কাছে ততবারই কোনো না কোনো বাহানায় আমাকে আটকে রাখছে দাভাই । মনটা ছটফট করছিল বাবাকে একটু দেখার দেখার জন্য । কিন্তু পারলাম আর কই? সেই সুদূর কুয়েত থেকে পালিয়ে এসেও এখন নানা বাহানা বেড়াজাল পেরিয়ে বাবার কাছে যেতে পারলাম না ।
হাসপাতালের করিডোরে মাথা নিচু করে বসে ছিলাম আমি । আদরকে বাসায় নিয়ে গেছে ভাবী এসে । আমাকেও বাসায় পাঠাতে চেয়েছিল দাভাই । কিন্তু যাইনি আমি । বাবাকে না দেখা অবধি কোথাও একটু নড়বোও না আমি । একপ্রকার জিদ নিয়েই বসে ছিলাম । প্রচুর ক্লান্ত লাগছে । একটু বিশ্রাম চাইছে শরীর । এতটা পথ একটানা জার্নি করে এসে যে কেউই ক্লান্ত হয়ে পড়বে ।
আমি চুপ করে বসে থাকলেও আমার মস্তিষ্ক চুপ করে ছিল না । মাথায় ঘুরছিল কুয়েত থেকে ফিরে আসার কয়েকদিনের আগের কথা ।
সাদ্দাফের ড্রয়ার থেকে ওর বলা একটা ফাইল নিতে গিয়ে কিছু ফটো সামনে পড়ে যায় । একটা মেয়ের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ কিছু ছবি সাদ্দাফের । মেয়েটাকে আমি চিনি । সাদ্দাফের অফিস কলিগ । নাম ফ্লোরা । কিছুসময়ের জন্য থমকে ছিলাম । আসলে আমার তখন ঠিক কি রিয়েক্ট করা উচিত তাই বুঝতে পারছিলাম না । একটা ঘোরের মাঝে পড়ে গিয়েছিলাম যেন । তাই সেদিন চুপ করে ছিলাম । এর কিছুদিন পর থেকে ফলো করা শুরু করি সাদ্দাফকে । আস্তে আস্তে সব দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায় । মিলে যায় সেই প্রশ্নের উত্তরগুলো যা অজানা ছিল আমার । যেই প্রশ্নগুলোর উত্তর আগে জানা থাকলে হয়তো আজ আমার এমন পরিস্থিতি হতো না । আর কোনো আশা ছিল না জীবন নিয়ে । ছিল না কোনো আশা এই মিথ্যে মায়ার সংসার নিয়ে । তাই আমার ছেলেটাকে নিয়ে সব বন্ধন ছিন্ন করে চলে আসি । আমার সংসারের সমাপ্তির শেষটা হয়তো এমনই লিখা ছিল ।
আমার পরিবারের সবাই জানে আমি অনেক সুখে আছি । কি সুন্দর ছোট একটা সোনার সংসার আমার । ভীনদেশে থাকি । অট্টালিকা বাড়ি । রাজপুত্রর মতো একজন স্বামী । সুখের চাদরে মোড়ানো আমি । কিন্তু সবাই শুধু বাহিরটাই দেখে । ভেতরের খবর তো আর কেউ জানে না । সবসময় আমরা যা ভাবি তা সঠিক হয় না । আমাদের দৃষ্টির অগোচরেও থেকে যায় অনেক কিছুই । সবার নজরে বাহিরের চাকচিক্যই ধরা পড়ে । কিন্তু চকচক করলেই যে সোনা হয় না এটা ভুলে যায় সবাই । আমি ভীনদেশে অট্টালিকায় বিলাসিতায় মুড়ে ছিলাম ঠিকই । তবে ভালোবাসার অভাবে প্রতিনিয়ত কষ্টে ছিলাম । সাদ্দাফের বাহিরটা দেখে যদি ওর সাথে আমাকে বিয়ে না দিয়ে যে সত্যি আমায় ভালোবাসত তার সাথে আমার জীবনটা জুড়ে দিত আমার পরিবার তাহলে হয়তো আমি আজ সত্যিই পৃথিবীর সুখী মানুষদের একজন হতাম । কিন্তু কি করার? নিয়তি যে বাঁধা ছিল অন্য দ্বারে…..
.
.
.
চলবে?
Anamika Shikdar Moon-অনামিকা সিকদার মুন
(বিঃদ্রঃ অনেক দেরি করে দিলাম ?। সরি?।
ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং ভুলগুলো ধরিয়ে দিবেন)