#সন্ধ্যে_নামার_আগে (পর্ব_২)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
বৃদ্ধা আবারও স্মিতাকে ডাকল।
‘ অতিথি আপ্যায়ন কর গো নাতনি। অতিথিরা না নিয়ে আসলে তো ওই রাস্তাতেই পরে থাকতাম।’
স্মিতা একটু ইতস্তত হয়ে মাথায় এক হাত কাপড় টেনে রোয়াকে আসলো। তখন স্মিতার নানী মৃদু হেসে বললেন,’ আলাপ কর। আমি রাঁধতে গেলাম। আর তোমরা কিন্তু দুপুরে ডাল-ভাত খেয়েই যাবে। আত্নীয়তা হলে তো এই গরীব নানীর ঘরে আসতেই হবে। ‘ কথাটি মৃদু হেসেই বলল সেলিনা বেগম। তারপরে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ঘরের দিকে গেল। সায়ন্তনের কোনো জবাব না শুনেই।
সায়ন্তন নিজের চুল নিজের মুঠোয় করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। স্মিতা অপ্রতিভ। সায়ন্তন নিজ থেকে শুধালো,’ তুমি এখানে কী করছো?’
হতবুদ্ধি হয়ে স্মিতা জবাব দিল, ‘ঢাকা থেকে সিলেটে আসছি। বেড়ানোর জন্যই তো। ‘
‘ নানী?’ হেসে বলল সায়ন্তন৷
‘হু।’
‘সকালে খালি পায়ে বের হয়েছে, পা অনেকখানি কেটেও গেছে। একটু খেয়াল রাখবে না?’
‘ খালি পায়েই হাঁটতে বের হয়। ‘
‘আর কেউ নেই, বাড়িতে?’ বলেই স্মিতার মুখপানে তাকাল সায়ন্তন। মুহূর্তমধ্যেই স্মিতার মুখ শুকিয়ে গেল৷ তবুও চাপা স্বরে বলল,’ নানু একাই থাকে। ‘
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সায়ন্তন বলল, ‘আচ্ছা।’
স্পন্দন বেশ চুপচাপ হয়ে কথা শুনছিল। কোনো কিছুই ঠাওর করতে পারছে না। তবে স্মিতা নিজেও চুপচাপ হয়ে সঙ সেজে বসে রইল। এখান থেকে উঠে ঘরের ভেতরে গেলে ওর নানী আবারও অতিথির কাছেই পাঠাবে। তাছাড়া সায়ন্তন ওর ক্লাসমেট। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই যদি উঠে যায় তাহলেও ব্যপারটা অন্যরকম লাগে৷ কিন্তু ওর নানীর কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আত্নীয়তা হলে এই গরীব নানীর ঘরে আসতে হবে। এর মানে বুঝল না স্মিতা।
স্মিতাকে চিন্তিত দেখে সায়ন্তক বলল,’ পরীক্ষা কেমন হয়েছিল?’
‘ ভালো।’
‘ মেয়েদের তো ভালো হবেই। সবসময় বই নিয়ে বসে থাকে। আর তো কোনো কাজ নেই। আমাদের তো কত কাজ।’ কথাটি বলেই ফিকলে হাসি দিল সায়ন্তন। স্মিতা ওর হাসির দিকে তাকিয়ে রইল। সায়ন্তন তাকানো মাত্রই অপ্রতিভ হয়ে চোখ নামিয়ে নিল।
চা এতক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গেছে। পরিস্থিতি সামলে আনতে নতুনভাবে চা করে আনবে, এটি বলেই জায়গা ত্যাগ করল স্মিতা। সায়ন্তন হাসলো।
স্মিতাকে এভাবে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে ওর নানী বলল, ‘চা খায়নি?’
‘ ঠান্ডা হয়ে গেছে। নতুনভাবে করে দিতে হবে। ‘
‘ সে কি! আচ্ছা কর। যেন কোনো অযত্ন না হয়। ‘
‘তুমি হঠাৎ ওরে নিয়ে পরলে কেন?’ তীক্ষ্ণ চোখ করে কথাটি বলল স্মিতা। ওর মাথায় এখনও নানীর বলা কথাটি ঘুরছে। আত্নীয়তা হলে এখানে এমনিতেই আসতে হবে৷ কিন্তু ওর চিন্তাভাবনা দ্বিগুণ করে সেলিনা বেগম বললেন,
‘ নাত জামাইয়ের মানিব্যাগ যে তোর কাছে, আমি কী জানি না কিছু! প্রথমে বুঝতে পারিনি। তারপরে যখন বাসায় আসার পরে পায়ে ঔষধ লাগানোর জন্য ঔষধ খুঁজতে আসলাম তখন টেবিলে ঔষধের পাশেই তো দেখলাম। ছবিও আছে তাতে। এখন আদরযত্ন কর।’
সেলিনা বেগমের কথা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হল স্মিতা। মূখমণ্ডলে লাল, নীল বর্ণ ধারণ করতে লাগল। সেলিনা বেগম চা দিয়ে বলল,’ যা গল্পগুজব কর।’
স্মিতা চুপচাপ কাঁপা কাঁপা হাতে নিল। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকলেই ওর নানী কত কী বলবে কে জানে!
সায়ন্তন স্ক্রল করছিল। স্মিতা চা এগিয়ে দিলে মোবাইল রেখে চায়ের কাপ ধরে। হাত কাঁপছে স্মিতার। মনে হচ্ছে, এখান থেকে পালালেই সে হাফ ছেড়ে বাঁচে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে স্মিতার মুখমণ্ডলের দিকে তাকাল সায়ন্তন। স্মিতা চোখমুখ খিঁচিয়ে আছে। কিছু বুঝতে পারল না সায়ন্তন। ভ্রু কুঁচকে স্মিতাকে শুধালো,’ আর ইউ ওকে?’
ধড়ফড়িয়ে স্মিতা বলল,’ ইয়েস ইয়েস।’ বলেই কাজের বাহানা দিয়ে চলে গেল স্মিতা। সায়ন্তন অলিকে ভাঁজ ফেলে চিবুকে হাত রাখল। পরমুহূর্তেই পাশে থাকা স্পন্দনের দিকে চোখ গেল। গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে আছে৷ সায়ন্তন অলিক কুঁচকে তাকাল। স্পন্দন ছোট করে বলল,’ তোমার চা আবারও ঠান্ডা হয়ে যাবে ভাইয়া।’
স্পন্দনের কথা শুনে চায়ে চুমুক দিয়ে দেখে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তখন শরবতের মত একসাথে সম্পূর্ণ চা খেয়ে নিল। সায়ন্তনের অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসে স্পন্দন।
__________
সায়ন্তন ও স্মিতা একই ভার্সিটিতে পড়ে। দুজনেই ক্লাসমেট। তবে তেমনভাবে বন্ধুত্ব নেই। কারণ সায়ন্তন বরাবরই মেয়েদের এড়িয়ে চলে। এমনিতেই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে সে। বাবার ব্যবসা দেখে। পাশাপাশি খেলাধুলা , ভাইকে নিয়ে ঘুরাঘুরি এসবেই ব্যস্ত। যখন ক্যাম্পাসে আসে ততক্ষণই বন্ধুদের সাথে আড্ডা। ব্যস! এর বাইরে আর কিছু নেই তার কর্মজীবনে। মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করবে কখন! তারমধ্যে কিছুদিন আগেই ওর একটা ফ্রেন্ডের প্রায় যায় যায় অবস্থা হল। প্রেমের সম্পর্কের যখন ইতি ঘটলো তখনই ধর্ষণের কেসে বাজিয়ে দিছে। এসব কাহিনী দেখার পরে প্রেম ট্রেমেও বিশ্বাসী নয় সায়ন্তন। আজ আছে তো কাল নেই। যে কপালে আছে সে এমনিতেই আসবে, থাকবে। শুধু শুধু এই সময়টা নষ্ট করতে চায় না। সানন্দে কাটাতে চায়।
তবে স্মিতা, সায়ন্তন ক্লাসের মেধা তালিকায় প্রথম সাড়িতেই রয়েছে। এরজন্য চেনা আছে মোটামুটি। শুধু কথা বলা নেই তেমন।
সেদিন স্পন্দনকে নিয়ে বাবা-মা সকালে আসে। সায়ন্তন রাতের ট্রেনে আসে। ওর রাতের বেলা ছাড়া ট্রেনে উঠতে ভালো লাগে না। সেদিন বগিতে মুখোমুখি হয় দুজনেই। ভদ্রতার খাতিরে সায়ন্তন নিজের সিট ছেড়ে জানালার পাশে বসতে দেয় স্মিতাকে। এবং নিজে স্মিতার পাশেই বসে। দুজনে ক্লাসমেট। তবে মনে হচ্ছিল কেউ কাউকে চিনে না। যে যার মত আছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে স্মিতা পিঠা সামনে ধরে শুধালো, ‘পিঠা খাবেন? মায়ের হাতের পুলি পিঠা। ‘
সায়ন্তন অপ্রতিভ হয়ে তাকিয়ে রইল। স্মিতা পিঠা এগিয়ে দিল। মুখে মৃদু হাসি। হাতে একটা পিঠা নিয়ে সায়ন্তনও মৃদু হাসলো। ব্যস! ততটুকুই কথা হল। তারপরে বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইল দুজনেই। পাড়াপড়শি হলেও এতক্ষণে কথার পাহাড় বয়ে যেত। সেখানে ক্লাসমেট দুজনেই। চুলের মোটা বিনুনি এক পাশে এনে জানালার দিকে তাকিয়ে রইল স্মিতা। কিছু ভাবছে সে। এই ভাবনা বেশ গভীর। তখন না চাইতেও বেহায়া চোখদুটো চলে যায় সেখানে। পরক্ষণেই স্মিতা তাকালে অপ্রতিভ হয়ে পরে সায়ন্তন। নিজেকে ঠিক করে বলল,’ বাইরে এভাবে তাকিয়ে আছো। বাতাস খাচ্ছো না-কি?’ কথাটি বলেই হাসলো সায়ন্তন। সে হাসি প্রশস্ত ছিল। ঠোঁটের সাথে লেগে থাকা তিলটিও যেন হাসছে। আর থুতনিতে তো পরপর দুটো তিল। স্মিতাকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। এর আগেও বহুবার মরেছে সে। আজকেও মারতে চাইছে ছেলেটি। ভেবেই সারা অঙ্গে কাঁপুনি উঠে গেল।
‘আর ইউ ওকে? এমন চোখমুখ খিঁচিয়ে আছো কেন?’ চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করল সায়ন্তন।
স্মিতা অপ্রতিভ হয়ে বলল, ‘ জি। ‘ পরক্ষণেই আবারও জানালার দিকে তাকাল। আজ জানালাই যেন সঙ্গী। সায়ন্তন অলিকে ভাঁজ ফেলে মিনিট দুয়েক তাকিয়ে রইল। পরক্ষণেই মৃদু হেসে মোবাইলে মনোযোগ দিল।
ভাঙা ভাঙা ঘুমে রাতটা পাড় হল দুজনের। কারো নিত্যদিনের পেশাই রাত জাগা। কারো লজ্জা, ভয়, জড়তার জন্য৷ সকালে স্টেশনে নামার পরে সায়ন্তন শুধালো,’ কেউ নিতে আসবে না?’
স্মিতা ম্লান হেসে আওড়াল,’ উঁহু। একাই পারবো।’
সায়ন্তন গাড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে বলল,’কতদূর?’
ছোট করে স্মিতার জবাব,’পাশেই।’
‘সায়ন্তন এগিয়ে গাড়ি ঠিক করে বলল। যাও। ভাড়া মিটিয়েই হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল সায়ন্তন। তাড়াহুড়োতে ওয়ালেট ঠিক ভাবে রাখা হল না। রাস্তাতেই পরে গেল। স্মিতা গাড়ি থেকে নেমে ওয়ালেট হাতে নিয়ে সায়ন্তনকে ডাকল। কিন্তু ততক্ষণে সায়ন্তন চলে গেছে। তারপরে একটা হতাশা নিয়ে গাড়িতে উঠল স্মিতা। মুহূর্তেই হতাশা ছেড়ে লাজুকতায় পরিণত হল। ওয়ালেটের পাশে সায়ন্তনের ছবি রাখা আছে। স্থির দৃষ্টি। মুখে মৃদু হাসি। ঠোঁটের সাথে লেগে থাকা তিল৷ থুতনিতে তিল। স্পষ্টভাবে ছবিতে বুঝা যাচ্ছে। মুহূর্তেই হৃৎপিণ্ড দ্বিগুণ বেগে বেড়ে গেল।
অস্পষ্ট ভাবে স্মিতা আওড়াল, ‘মরে যাব। ‘
______________
‘আপনার ওয়ালেট ফেলে গেছিলেন সেদিন।’ সায়ন্তনের সামনে ধরে বলল স্মিতা।
‘ তুমি পেয়েছো! আমি তো ভাবছিলাম রাস্তাতেই পরলোকগমন ঘটল।’ হেসে বলল সায়ন্তন।
‘ আমি না থাকলে ঘটতো। এভাবে তাড়াহুড়ো করে ছুটে কেউ?’
জবাবে সায়ন্তন কিছু বলল না। হাসলো।
স্মিতা ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছে। কিছু একটা ভাববে নিশ্চয়ই। টাকাসহ ওয়ালেট ফেরত পেলেও ছবিটি তো রেখেই দিয়েছে সে। হয়তো সায়ন্তন ভাববে রাস্তাতেই তার ছবিটি হারিয়ে গেছে। যেহেতু পাশেই ছিল। এটা ভেবেই মনে মনে বিশ্বজয়ের হাসি হাসলো স্মিতা।
#চলবে
( এই গল্পটি কিছুদিন আগে দুই পর্ব দিয়েছিলাম। তারপরে অনেক গ্যাপ যায়, তাই নতুন থিমে নতুনভাবেই শুরু করেছি। বিভ্রান্ত হবেন না কেউ। আগেও আমি ছিলাম, এখনও আমিই আছি।
ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। লেখার পরে আর পড়া হয়নি।)