#সন্ধ্যে_নামার_আগে(পর্ব_৩)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
“সবকিছু ঠিক আছে তো?” চাপা স্বরে বলল স্মিতা।
“আমি জানতে চেয়েছি কিছু?” অলিকে ভাঁজ ফেলে সরু চোখে তাকিয়ে বলল সায়ন্তন।
“উঁহু তেমন কিছু না।”
“তাহলে কেমন কিছু?”
“ওয়ালেটের ছবি হয়তো রাস্তায় হারিয়ে গেছে। এটাই ঠিক নেই শুধু।” কথাটি বলেই নিজেকে নিজে মনে মনে হাজারো বকাঝকা করলো স্মিতা৷ কী দরকার ছিল এটা বলার! জানতে চায়নি তো। তাহলে বলার কী দরকার ছিল! এখন কী ভাববে সায়ন্তন! যা ভাবে ভাবুক। ওয়ালেট পেয়েছে এটাই অনেক।
স্মিতার মুখপানে তাকাল সায়ন্তন। শান্ত ভাবে বলল, “ওয়ালেটে তো কোনো ছবিই ছিল না। হারিয়ে যাবে কীভাবে!”
অকস্মাৎ স্মিতার মুখমণ্ডল দেখার মত হল। তবুও বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বলল,”ওয়ালেট তো তাই ছবি থাকতেই পারে৷ তাই বললাম।”
“হুঁহ। থাকতেই পারে।” সাবলীলভাবে বলে ডান হাত দিয়ে নিজের চুল নিজে মুঠো করলো সায়ন্তন।
স্মিতা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। এক মুহূর্তও থাকবে না এখানে। তাহলে চোখদুটো বেহায়া হয়ে যাবে। তাছাড়া সত্যিটা যদি মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়! তখন কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এটা ভাবতে ভাবতে দরজা অবধি গেল স্মিতা। তারপরে পিছু ফিরে সায়ন্তনকে পরখ করলো একবার। এখনও চুলের ভাঁজে হাত রেখে আছে। আশ্চর্য! এভাবে চুল টানার অধিকার তো স্মিতা নিজেই ভেবে রেখেছে। সায়ন্তন কথা না শুনলেই এই চুলগুলোতে হাত দিয়ে ভালোভাবে বুঝাবে। তারপরেও না শুনলে মাথা থেকে আলাদা করে ফেলবে। এসব ভেবে এক কদম আগালো। পরক্ষণেই সায়ন্তন পিছু ফিরে তাকিয়ে বলল,”কিছু বলবা?”
স্মিতা অপ্রতিভ হয়ে চোখমুখ খিঁচিয়ে দাঁড়াল। কাঁপা কণ্ঠে বলল,”ঘুরতে এসে বিপদে পরে গেলেন, তাই না?”
“হ্যাঁ। হয়তো বিপদে পরেছিলাম। এবং তোমাকে কানে কানে বলেছিলাম।”
স্মিতার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভাবে বলল সায়ন্তন।
স্মিতা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। এই মাত্র সায়ন্তনের বলা কথাটি কানে বাজছে। কল্পনাও করে ফেলেছে সে, সে মুহূর্তটিকে। শরীরে কাঁপুনি দিল। নাহ! এখন আর এক মুহূর্তও থাকা যাবে না। দ্রুত পা ফেলে চলে গেল সে। সায়ন্তন নিঃশব্দে হেসে ফেলল।
আবারও ছুটে চলে গেল রান্নাঘরে। নিজ হাতে রাঁধতে ইচ্ছে করছে। রান্নার গুণ দেখাতে ইচ্ছে করছে সায়ন্তনকে। কিন্তু সেলিনা বেগম ধমক দিলেন স্মিতাকে।
“নাত জামাইয়ের সাথে আলাপ কর। আমি তো রান্না করছি। দেখ কিছু লাগে কি-না! না হলে কিন্তু তোমারই কথা শুনতে হবে গো নাতনি।”
মুহূর্তমধ্যেই হতবুদ্ধি হয়ে গেল স্মিতা। যদি ভুলক্রমে সায়ন্তনের সামনে বসে এসব বলে তখন! ব্যপারটা অন্যরকম হয়ে যাবে। তাই নিজেকে ঠিক রেখে বলল,” উঁহু। তোমার কোন নাতনিকে বিয়ে দিয়েছ তার কাছে? সে আমার ক্লাসমেট। আসার সময়ে দেখা হয় এবং রাস্তাতে ওয়ালেট পরে থাকায় আমি তুলে নেই। ব্যস! এতটুকুই। আর কিছুই নেই আমাদের মধ্যে নানু।”
স্মিতার কথা শুনে মৃদু হাসলেন সেলিনা বেগম। শান্ত ভাবে বললেন,” নে রান্না কর। আমি অতিথিদের কাছে যাচ্ছি।”
স্মিতাও বেশ আরাম-আয়েশে রান্না শুরু করল। সেলিনা বেগম মৃদু হেসে চলে গেলেন।
.
“অতিথিদের কোনো অসুবিধে হচ্ছে?” রোয়াকে আসতে আসতে সেলিনা বেগম বললেন।
সায়ন্তন নড়েচড়ে বসল। তারপরে বলল,” না না কী হবে! আসলে কাজ ছিল একটা। আজকে আসি, আরেকদিন আসবো নানী।”
” উঁহু। আজকে দুমুঠো ডাল-ভাত খেতে হবে। এমনিতেও আমার স্মিতার ক্লাসের বন্ধু। এখন তো আত্নীয়ই হয়ে গেলা৷” শক্ত গলায় বললেন সেলিনা বেগম।
” আরেকদিন আসবো নানী। এখন আপনি না আসলেও আপনার কাছে যেতাম। আমাদের উঠতে হবে এখন। বাবা একটু ব্যস্ত আছে। অফিসে ভিডিও কনফারেন্সে মিটিংয়ে জয়েন করতে হবে। মাত্রই জানালো।” নিম্ন স্বরে বলল সায়ন্তন।
সেলিনা বেগম সম্মতি দিলেন৷ কাজের থেকে তো এখানে থাকা জরুরি নয়। তাছাড়া শক্তপোক্ত আত্নীয়তা থাকলে রাখা যায় কিন্তু এখানে তেমনভাবে তো কিছুই নেই। তিনি নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সায়ন্তন, স্পন্দনকে বিদায় দিয়ে রান্নাঘরে গেল। স্মিতা রাঁধছে। মনের ছন্দ মিলিয়ে। সেলিনা বেগম কাঁধে হাত রেখে বললেন,” তাড়াহুড়ো করতে হবে না। ওরা চলে গেছে।”
স্মিতা কিছুক্ষণের জন্য থ হয়ে গেল। পরক্ষণে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,” আচ্ছা। ”
সেলিনা বেগম নাতনীর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না। বয়স তো আর এমনি এমনিই হয়নি! একটু হলে অনেককিছুই ঠাওরে আনতে পারে। তিনি রান্নায় মনোযোগ দিলেন আর ভাবলেন। স্মিতার মনের অবস্থাটা। তবে কিছুই করার নেই তার।
স্মিতা রোয়াক পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। কয়েক পা এগিয়ে দেখলো। নাহ! ওদের দেখা যাচ্ছে না। ছেলেমানুষ তাই খুব দ্রুতই হেঁটে চলে যেতে পারে। স্মিতা পাশে থাকলে হয়তো নিশ্চয়ই ধীর গতিতে হাঁটতো। কখন হাঁটবে পাশাপাশি! সে ভাগ্য কি আদৌও হবে! আবারও দীর্ঘশ্বাস স্মিতার। কীসব ভাবছে ও। চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। এক পাক্ষিক ভালোবাসা হয়তো এমনই হয়। মনের দিক দিয়ে যদি সায়ন্তনও ওর মতো থাকতো, তাহলে হয়তো এভাবে যেত না। কোনো না কোনো ভাবে ঠিকই সবকিছু সামলে নিতো।
ওদের ভাসমান ঘরের নিচেতেই কত সুন্দর ভাবে সজ্জিত রয়েছে কয়েকটা শাপলা। কোনো চাহিদা ছাড়াই নিজেদের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিয়েছে। কষ্টের মাঝেও এসব ভাবছে স্মিতা৷ এমতাবস্থায় হয়তো সবথেকে যুক্তিহীন কিছুর মধ্যে দিয়েও ভালোকিছু খুঁজে বের করতে পারবে। এক আকাশ-পাতাল ভাবনা নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল শাপলার দিকে।
সেলিমা বেগম কাঁধে হাত রাখলেন। ধড়ফড়িয়ে উঠল স্মিতা। কিছু না বলে হেসে নানুকে জড়িয়ে ধরল। বলল,” রান্না কতদূর বুড়ী? বাকিটা কিন্তু আমিই করব।”
সেলিনা বেগমও হেসে সম্মতি দিল। স্মিতা মৃদু হেসে চলে গেল। এই পৃথিবীতে নিখুঁত সম্পর্কের সংখ্যা খুবই কম। কোনো না কোনো কারণে একটু-আধটু খুঁত তো থাকবেই। এর জন্যই সম্পর্কে ফাটল ধরবে। যাদের মনের টান শক্তপোক্ত থাকবে তারাই কেবল জিততে পারে। তাছাড়া সব ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। লোকসমাজে ঠিক থাকার চেষ্টা করলেও সত্যিকার অর্থে তারা তেমন ঠিক থাকে না। যেমন সেলিনা বেগমের বেলাতেও হয়েছে। এসব ভাবলেই গায়ে কাঁপুনি দেয় সেলিনা বেগমের। তারমতো সাজানো সংসার যেন কোনো খুঁতের জন্য ছেড়ে না দিতে হয় কারো। তাহলে বেঁচে থেকেও মরে যাবার অবস্থা হবে।
#চলবে