সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ২+৩

0
2213

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব_২_৩

‘ এটা কি করলেন আপনি?চোখে দেখেন নি?’- রাগান্বিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল ছেলে টা।

শ্রেয়া থতমত খেয়ে গেল। সাফাই দেওয়ার ভঙ্গিতে আওড়ালো,
‘ আ’ম স্যরি। আমি খেয়াল করি নি যে আপনি এখানে ছিলেন। সত্যি একদম দেখতে পাই নি। ‘

ভেতরে ভেতরে ভীষণ অনুতপ্ত শ্রেয়া। কোন বেখেয়ালে যে কোনোদিকে না চেয়ে অমন করে কাপড় মেলতে গেল,যার দরুন পানি ছিটকে গিয়ে পড়ল লোক টার চোখে মুখে। এতে নিঃসন্দেহে যে কেউ ক্রুদ্ধ হবে। লোকটাও হলো। শ্রেয়া আবারও নিচু স্বরে মিনমিন করে বললো,

‘ আমি সত্যিই দেখতে পাই নি। ‘
‘ দেখবেন কি করে?চোখ আছে?দিন দুপুরে কানা। এক তো অন্যায় করেছে আবার অভিনয়ও করছে বেঁচে যাওয়ার জন্য। স্বা’র্থ’পর একটা। ‘

দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলে উঠল লোক টা। শ্রেয়ার মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল। স্বার্থপর?সে কখন স্বার্থপর হলো?এত বড় মিথ্যে অপবাদ? অপ’রা’ধ করেছে বলে নত হলো অথচ লোকটা কি-না ওকে স্বার্থপর বলল?কিছু কড়া শব্দ শোনাতে চায় মন। তবুও নিজেকে সামলে যথেষ্ট নম্র গলায় বললো,
‘ দেখুন আমি অভিনয় করছি না। সত্যি বলতে আমি অনুতপ্ত। আপনিই কথাটা বেশি ঘুরাচ্ছেন৷ সামান্য পানিই তো পড়েছে। মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় নি। এত রিয়েক্ট করারও কিছু নেই। ‘

শেষের বাক্য গুলো নিচু স্বরে বলতে গেলেও ভিতরে ভিতরে জন্মানো রাগের কারণে কিছুটা উঁচু হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ছেলেটার।

‘ বেয়াদব মেয়ে। এখনই কমপ্লেইন করবো আমি এপার্টমেন্টের মালিকের কাছে। এত ভদ্র একটা লোক আপনার মতোন বেয়া/দব, অভ’দ্র মেয়েকে বাসা কেমন করে ভাড়া দিল!বড়দের সঙ্গে কি করে ব্যবহার করতে হয় সেই শিক্ষা টুকু হয়ত আপনার মাঝে বিদ্যমান নেই। ‘

‘ আমি বেয়া/দব? আপনার মধ্যে শিক্ষার অভাব মনে হচ্ছে আমার। তাই তো ঝগড়া লেগে গেলেন। ‘

‘ কি?আমি ঝগড়া করছি?মুখে মুখে তর্ক?’

হাত মুঠো করে ফেলল ছেলেটা, তা শ্রেয়ার দৃষ্টি এড়ালো না। ভয়ে শুষ্ক ঢোক গিলে সে। মেরে দেবে না তো আবার?ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ছেলে টা ওকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে দ্রুত বেগে প্রস্থান করলো। দুই অধর আপনা আপনি কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে গেল ওর। নিশ্চুপে লোকটা কি অপমান করে গেল ওকে?হুট করেই শ্রেয়ার মস্তিষ্কে উদয় হলো এই গম্ভীরমুখো ছেলে টা কে?গত তিন বছরে ধরে এখানে থাকছে কই কখনও তো দেখে নি আগে। আচ্ছা প্রিয়ু যে বলল ক্ষীণ সময় পূর্বে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে ইনিই কি?ইউনিভার্সিটির একজন লেকচারার এত বদ’মে’জাজি, উগ্র হতে পারে?মনে মনে গালি দেওয়ার স্পৃহা জাগলেও তা দমিয়ে ফেলল শ্রেয়া।

সবগুলো কাপড় মেলে তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে এল। অচেনা লোক টার সঙ্গে তর্কে তর্কে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। এখন আবার নাস্তা বানাতে হবে৷ নয়ত না খেয়ে যেতে হবে ভার্সিটিতে। দরজা ভেজিয়ে গিয়েছিল যাওয়ার সময়। নরম হাতে ঠেলে ভিতরে ঢুকল। বালতিটা এক পাশে রেখে উঁকি দেয় প্রিয়ুর রুমে। মেয়েটা দিব্যি ফোনে হেসে হেসে কথা বলে চলেছে। দু’গালে লালের আস্তরণ স্পষ্ট লেপ্টে আছে এবং ঈষৎ গাঢ়। শ্রেয়সীর বুকটা ধ্বক করে উঠল। প্রেমের কি এত শক্তি? নিমিষেই মন টা ভালো করে দেয়। গালে লজ্জা মাখিয়ে দেয়। প্রিয়ুর এই সুখী সুখী চেহারা টা দেখলে হৃদয়ে অনাবিল প্রশান্তির ঢেউ খেলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে কোথাও শূণ্যতায় কুঁকড়ে উঠে হৃদপিণ্ড। ঠিক তিনটা বছর আগে এমন করেই তো কারো জন্য নিজেকে লজ্জায় রাঙানোর স্বপ্ন দেখেছিল। কতশত আশায় বেঁধে ছিল নিজেকে। সুস্থ মস্তিষ্কের একজন জীবনসঙ্গী চাইল, কিন্তু নিয়তি!বিনিময়ে তচনচ করে দিল সব আশা,ভেঙে দিল ভালোবাসা পাওয়ার স্বপ্ন।

শ্রেয়া একবার ভাবল প্রিয়ুকে ডাকবে না কিন্তু পরমুহূর্তে প্রাচীরে সজ্জিত ঘড়ির কাটায় দৃষ্টি পড়তেই চক্ষু চড়কগাছ। হাতে আর মাত্র আধাঘন্টা সময় আছে। কখন কি করবে?ভার্সিটি পৌঁছাতেই সময় লেগে যাবে পনেরো মিনিট। উপায় না পেয়ে ডেকে উঠল রিনঝিনে স্বরে,

‘ প্রিয়ু!’
প্রিয়ু কানে মোবাইল ধরে রেখেই হাতের ইশারায় প্রশ্ন করলো। জবাবে অস্থির কন্ঠে বলে উঠল শ্রেয়া,
‘ আর মাত্র ২৯ মিনিট সময় আছে। কল টা কি এখন রাখা যাবে?তোর লেকচারার সাহেব কি আজ ভার্সিটি যাবেন না?’
শ্রেয়ার কথায় টনক নড়ল প্রিয়ুর। উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল,
‘ আচ্ছা রাখছি। তুৃমিও ক্লাসে যাও,আমারও যেতে হবে।’
‘ শুনো,,!’– মোলায়েম স্বরে ডাকল ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি টা। প্রিয়ু সম্মতি দিয়ে শুধালো,
‘ বলো। ‘
‘ নিজের খেয়াল রেখো। সাথের মানুষ টারও। ‘
‘ এখন ও,,’
বলতে গিয়ে শ্রেয়ার উপস্থিতিতে বাক্যটা অসমাপ্ত থেকে গেল। শব্দ আঁটকে গেল কন্ঠনালিতে। শ্রেয়ার দিকে চেয়ে আমতা আমতা করে বললো,
‘ আমি আসছি, তুই যা। ‘
মৃদু হাসল শ্রেয়া। রুম ছেড়ে কিচেনে আসল। কম সময়ে যা বানানো যায়, তা-ই বানাবে। কোনোরকমে পেট ভরলেই হলো। হাতে নুডলস প্যাকেট নিয়ে অন্য হাতে একটা পেঁয়াজ তুলে নেয়। চপিং বোর্ডে রেখে মগ্ন হয়ে পড়ে কাটতে।
প্রিয়ু কিছুটা সময় নিল। ফোনের অপর পাশের ব্যক্তি এখনও তার অর্ধসমাপ্ত বাক্য খানা পূর্ণ শোনার অপেক্ষায়। আশেপাশে চোরা দৃষ্টি মেলে বললো,
‘ ও এখন শুধু আপনার দেওয়া দ্বায়িত্ব না আয়ুশ,আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের চেয়েও বেশি। ধন্যবাদ আপনাকে এই মেয়েটার সন্ধান আমাকে দেওয়ার জন্য। নয়ত কখনও এমন বন্ধু পেতাম না। ‘

আয়ুশ ঠোঁট ছড়িয়ে বললো,
‘ ধন্যবাদের মতো শুকনো শব্দ নট একসেপ্টেড মিস প্রিয়ু। ভিন্ন কিছু ট্রাই করুন। ‘
প্রিয়ুর সমগ্র ওষ্ঠ জুড়ে লজ্জালু রেখা দেখা দেয়। বললো,
‘ আপনি এখানে প্রেমের ক্লাসে ব্যস্ত থাকবেন নাকি স্টুডেন্টও পড়াবেন লেকচারার আয়ুশ চৌধুরী? রাখলাম। ‘

আয়ুশকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রিয়ু ঝটপট পা বাড়ালো কিচেনের দিকে। এই ফ্ল্যাটে ওরা দু’জন একা থাকে বিধায় দু’জনে মিলেমিশেই সব করে। অবশ্য কাজের বুয়া আসে,টুকটাক কাজ করে দিয়ে যায় কিন্তু তার হাতের রান্নার পানসে স্বাদ নিতে ইচ্ছুক নয় দু’জন।

প্রিয়ুকে আসতে দেখে শ্রেয়া তাড়াতাড়ি করে একটা বাটিতে নুডলস নিল। গরম গরম খাবার খেতে পারে না মেয়েটা। যেই মেয়েটা ওকে সুন্দরভাবে বাঁচতে পাশে এসে দাড়িয়েছে,রাস্তা থেকে এনে এই বিশাল ফ্ল্যাটে ঠাঁই দিয়েছে অবলীলায় তার একটু আকটু খেয়াল রাখা যায় ও যত্ন নেওয়া দোষের নয়। প্রিয়ুকে লেট লতিফ নামে সংজ্ঞায়িত করলে ভুল হবে না। মেয়েটার সবকিছুতে দেরী। তার প্রেমিক পুরুষ ঠিক যতটা পাংচুয়াল সে ঠিক ততটা এলোমেলো। একে অপরের বিপরীত। দুই মেরুর অধিবাসী। শ্রেয়ার সাক্ষাৎ হয়েছিল আয়ুশের সাথে প্রায় বছর দেড়েক পূর্বে। প্রিয়ু ও আয়ুশের সম্পর্ক টা সম্পর্কে উভয় পরিবারই অবগত। বরং পারিবারিকভাবেই ওদের বিয়ে ঠিক। অতঃপর কথা হতে হতে প্রণয়,দু’টো হৃদয়ের সন্ধি। এসব প্রিয়ুর কাছেই শুনেছে ও। প্রিয়ুর তরফ থেকে ভালোবাসার সূচনা টা প্রথম হলেও আয়ুশের পক্ষ থেকে এক বছর আগে প্রকাশ পেয়েছে। শ্রেয়া নিজ চক্ষে অনুভব করেছে মেয়েটার ছটফটানি আয়ুশ নামের মানুষ টার ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে।

এখনও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হতে হতে বাঁচে যখনই মনে পড়ে চট্টগ্রাম শহরে আসার প্রথম রাত টার কথা। প্রিয়ু না থাকলে জীবন টা বোধহয় আজ কোনো পতি/তা পল্লীতে কাটত নয়ত চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যেত। প্রতিনিয়ত জীবনের একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে বিয়ে নামক সেই সম্পর্ক। এই সম্পর্কের জন্যই ঢাকা শহর ছাড়তে হয়,বেছে নিতে হলো অন্য এক কোলাহল মিশ্রিত শহর। শ্রেয়া চোখ বুঁজে সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ফেলে,মনের সাথে যুদ্ধ চালাল,

‘ অতীত কেন মনে করছিস শ্রেয়া?পিছুটান কেন?কেন এত দরদ উতলে উঠে মাঝে মাঝে ওই না দেখা পাগ/ল স্বামীর জন্য?তিনটা বছর শেষ। সেই সাথে অতীতে পড়ে আছে সেই মুহুর্ত টা,চাইলেও আর ফিরে আসবে না জীবনে। সঠিক পথে এগিয়েছিস তুই, ঘাড় বাঁকিয়ে চাস না আর। ‘
______________

রাস্তায় আজ অটো রিকশার কমতি,অনটন দেখা দিয়েছে। মাঝে মাঝে এক দু’টো আসছে তাও লোকে পরিপূর্ণ। শ্রেয়া ও প্রিয়ু বেজায় বিরক্ত। কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। এত তাড়াহুড়ো করে লাভ হলো না। রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে প্রায় দশ মিনিট চলে গেল। হাতে অবিশষ্ট আছে শুধু মিনিট খানেক সময়। প্রিয়ু আর স্থির থাকতে পারল না। একটু সরে আবারও কয়েক কদম এগিয়ে গেল রিকশা খোঁজার জন্য। শ্রেয়া ভ্রুঁ যুগল কুঁচকে তাকাল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও দূর হতে রিকশা আসলে চোখে পড়বে,কিছুদূর হেঁটে গিয়ে শরীর বাঁকা করে এক দৃষ্টে চেয়ে থাকলেও রিকশা এদিক দিয়েই যাবে। এত কষ্ট করে উঁকি দিয়ে দেখার মানে হয়?প্রিয়ুর বোকামিতে ভীষণ হাসি পাচ্ছে ওর। তবুও তা চেপে বললো,
‘ চল হেঁটে যাই। ‘
প্রিয়ু হাল ছেড়ে সায় দিয়ে প্রতি উত্তর করলো,
‘ চল। ‘

দু’জনে কয়েক পা ফেলে সম্মুখে এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে রিকশার টিংটিং আওয়াজে পরবর্তী কদম থমকে গেল মুহুর্তেই। শ্রেয়া বাড়ানো পা টা পিছিয়ে এনে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। এক আধবয়স্ক চাচা লাল লাল দাঁত দেখিয়ে মনের সুখে প্যাডেল ঘুরিয়ে এদিকেই আসছে। তৎক্ষনাৎ প্রিয়ু ব্যস্ত হাতে রিকশা থামানোর জন্য ইশারা করল। থেমে গেল রিকশা। চাচা হাসিমুখে বলে উঠলেন,
‘ আম্মারা যাইবেন?’
‘ হু,চাচা। ‘
‘ উইঠা পড়েন। ‘
প্রিয়ু রিকশায় উঠে দুই অধর প্রশস্ত করে প্রশ্ন করল,
‘ চাচা মনে হয় অনেক খুশি?’
নিমিষেই রিকশাওয়ালা চাচা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলেন। পুনর্বার সামনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধরা গলায় বললেন,
‘ মনের দুঃখে হাসি পায় আম্মা। ‘

শ্রেয়া,প্রিয়ু থতমত খেয়ে যায় তাৎক্ষণিক। একটা মানুষের জীবনে ঠিক কতটা কষ্ট থাকলে এমনটা বলা যায়?শ্রেয়া ক্লান্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ কি হয়েছে চাচা?’
‘ কি হয় নাই আম্মা?মাইডার লাইগ্গা শরীলডা পু’ড়ে। বিয়া দিলাম এক বছর হইলো। জামাইডা পাগল আছিল। গরীব মানুষ বিয়া দিয়া লাইছি। কাইলকা শুনি জামাইরে পায় না। পাগলের কি ঠিক ঠিকানা আছে?চইলা গেছে কই জানি!’

শ্রেয়ার অন্তঃকরণে দূর হতে একটা তীর এসে বিঁধে আকস্মিক। শিরা উপশিরায় কাঁপুনি ছুটে যায়। দেহটা অচল হয়ে পড়ে যেতে নেয় রিকশা থেকে। সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়ু সামলে নেয়। ভয়ার্ত,বিচলিত স্বরে বলতে থাকে,
‘ কি হলো শ্রেয়া?শরীর খারাপ লাগছে তোর?’

শ্রেয়া জবাব দিতে বরাবরই ব্যর্থ হলো। অভ্যন্তরে চলা যুদ্ধ বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করতে চাইছে না সে। আজও তো প্রিয়ুকে বলা হয় নি তিন বছর আগের সেই সত্য। বলতে চায় না ও। চায় না ওই ধোঁ-কা মনে রাখতে। না চাইলেও মনের কোণে যেন কেউ ঘাপটি মেরে বসে আছে অদৃশ্য হয়ে। প্রতিনিয়ত চিৎকার করে জানায় সেই অচেনা কেউ –‘ তুমি কারো অর্ধাঙ্গিনী শ্রেয়া,সেই সাথে স্বা*র্থপর একটা মেয়ে তুমি। ‘ শরীর টা ঝাড়া দিয়ে উঠল তার। প্রিয়ু ফিরে যেতে চাইলে তাতে ঘোর আপত্তি জানায়।
.
.
ক্লাসের প্রায় অর্ধেক সময় অতিক্রম হয়ে গিয়েছে। শ্রেয়া ও প্রিয়ু দৌড়ে এলো। কোনোমতেই আজ ক্লাস মিস করা যাবে না। গত কয়েকদিন ধরে মিস হচ্ছে। সামনে পরীক্ষা। রিটেকের ঝামেলা পোহাতে সম্মতি নেই দু’জনের মধ্যে কারোই। তাই দু’জনেই ক্লাসের সামনে এসে উপস্থিত হলো। এখন যেই স্যারের ক্লাস তিনি আগে থেকেই বলে দিয়েছেন কেউ লেট আসলেও যেন পিছনের দরজা দিয়ে নিরবে,নিঃশব্দে প্রবেশ করে। অনুমতি ও নির্দেশনা থাকায় শ্রেয়া ও প্রিয়ু ঢুকতে গেল,তখনই হুড়মুড় করে শ্রবণগ্রন্থিতে পৌঁছাল ক্রুদ্ধ, ঝাঁঝালো,কাঠ কাঠ কন্ঠস্বর,

‘ স্টপ দেয়ার। ডোন্ট ট্রাই টু গেট ইনসাইড। ‘

কারো রোষপূর্ণ কন্ঠে দু’জনে ভ’য় পেল না। দেহ কাঁপল না। আপাতত দু’জনের মুখশ্রীতে কিঞ্চিৎ বিস্ময় এটা ভেবে তাদের বুড়ো স্যারের কন্ঠে এত তেজ এলো কেমন করে?এত ধারালো!তড়িৎ গতিতে সামনে তাকালো শ্রেয়া। সেই সাথে চেহারায় দৃশ্যমান হয় আকাশচুম্বী অবাকতা। এ যেন অবিশ্বাস্য! সকালে যার সঙ্গে কোমর বেঁধে ঝগ’ড়া করলো সেই কি-না ওদের লেকচারার। কেমনে?কি করে সম্ভব? শ্রেয়ার মাথা ঘুরছে।

‘ দুজনেই বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকুন ক্লাস শেষ হওয়া অবধি। ‘

শক্ত গলায় আদেশ প্রদান করে লোকটা আবারও অন্যান্য স্টুডেন্টের সাথে কথা বলতে লাগলেন। প্রিয়ু ও শ্রেয়া দাঁড়িয়ে রইল। স্থির থাকল ক্লাসের সমাপ্তি টানা পর্যন্ত। কিন্তু প্রিয়ু যেন ফুড়ফুড়ে মেজাজে আছে। তন্মধ্যে ক্লাস থেকে বেরিয়ে নতুন লেকচারার ওদের দিকে এগিয়ে আসে। কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বললো,

‘ নাম?’
প্রিয়ু তড়তড় করে ব্যগ্র কন্ঠে প্রতুত্তর করলো,
‘ ও শ্রেয়সী,আমি প্রিয়ু। ‘
‘ আপনাকে ওনার নাম জিজ্ঞেস করেছি?’– বিরক্ত মিশ্রিত স্বরে বলে উঠল।
‘ না স্যার। ‘
‘ ক্লাসে যান। ফারদার লেট আসবেন না। ‘

পুনরায় আদেশ পেয়ে দু’জনে হাফ ছেড়ে যেতে নিলে আবারও ডেকে উঠে লোকটা,

‘ মিস শ্রেয়সী?’
কন্ঠ টা বড্ড গাঢ় শোনাল। হৃদযন্ত্র ক্ষীণ সময়ের জন্য স্পন্দনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। প্রিয়ুর কাছ থেকে সরে এসে শ্রেয়া আনতস্বরে বলে,

‘ জ্বী স্যার?’
‘ লক্ষ্মী মেয়ে হবেন বেয়া*দবি ছেড়ে। ভবিষ্যতে কাজে আসবে। বুঝেছেন?’
বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো শ্রেয়া। দিব্যি ঠাহর করতে পারে সকালের ঘটনার রেশ ধরেই এই বাক্যের উৎপত্তি। মাথা নাড়ালো ও। মুখে আওড়ালো,
‘ হু!’
‘ গুড। ‘
স্মিত হেসে ছোট্ট এই শব্দটি উচ্চারণ করে চলে গেল সেই মানুষ টা । নিস্তব্ধ রেখে যায় শ্রেয়াকে। প্রিয়ু পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ নতুন লেকচারার এর নাম জানিস শ্রেয়া?’
শ্রেয়া আনমনে,মিহি স্বরে বললো,
‘ আমি কোত্থেকে জানব?’
‘ তূর্য চৌধুরী। ‘

#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। বড় পর্ব দিলাম। তাই লিখতে সময় লেগে গেল।)

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৩

পৃথিবীতে কি এক নামের একটা মানুষই হয়?উঁহু!নাম এক হতে পারে তবে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন। কখনও এক হয় না৷ কি করে সম্ভব! জমজ ভাই কিংবা বোনদেরও এক নাম হয় না৷ তেমনই তূর্য চৌধুরী নামটা ওই ব্যক্তির না কেবল,আরো অনেকের হতে পারে। তাই নামটা শুনে তাকে নিজের স্বামী মনে করা বোকামি শ্রেয়া। চরম বোকামি। তিনি তো পা’গল ছিলেন,আর ইনি তোর ইউনিভার্সিটির লেকচারার, স্যার। কারো সঙ্গে কাউকে গুলিয়ে ফেলার মতোন মূর্খতা তুই করিস না। তোর পাশের ফ্ল্যাটের তূর্য লেকচারার, ওনি কোনো কালেই এমন পেশায় ছিলেন না৷ তোর জানামতে তিনি বাবার ব্যবসা সামলাতেন। এটাই তো বলেছিলেন মাদার বিয়ের আগের রজনীতে। শান্ত হো,অস্থির মনটা শীতল কর শ্রেয়া।

আপনমনে এসব বিড়বিড় করে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল শ্রেয়া। ভালো লাগছে না। কিছুতেই মিলছে না স্বস্তি। ‘ তূর্য চৌধুরী ‘ নামটা অভ্যন্তর এলোমেলো করে দিয়েছে। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। তিন বছর পূর্বের বিয়ের আগের দিনের স্মৃতি হতে সবকিছু চক্ষুদ্বয়ে স্পষ্ট, স্বচ্ছ কাঁচের ন্যায় ভেসে উঠছে।

ঠিক তিন বছর পূর্বে এতিমখানার বড় কদম গাছটার নিচে বসে সবার সঙ্গে আড্ডায় মত্ত ছিল শ্রেয়া। তখনই জাহানারা খাতুন এলেন। সকলে তাকে দেখে নিশ্চুপ, স্থবির হয়ে পড়ল। এতিমখানার সবাই ওনাকে ভয় পায় তা না। সম্মান করে খুব৷ ভালোবেসে মাদার বলে সম্বোধন করে তাকে। মাদার সকলের মাঝ থেকে শ্রেয়াকে ডেকে নিয়ে আসলেন একান্তে। সবার উৎসুক চাহনি তখন শ্রেয়াতেই নিবদ্ধ। কেউ কেউ আন্দাজ করে ফেলল কি বলবে তাকে। ভেবেই ছোটদের মনটা বিষন্নতায় ছেঁয়ে যায়। বর্তমানে এতিমখানায় বয়সে সবচেয়ে বড় বলতে শ্রেয়া-ই। শ্রেয়া ও মাদার কিছুদূর যেতেই সবার মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে যায় উক্ত বিষয়ে।

হাঁটার এক পর্যায়ে মাদার থামলেন এতিমখানার পিছন খনন করা বড় পুকুর পাড়ের কাছ টায়। এত সময় কন্ঠ টা ভরাট শোনালেও মোলায়েম করলেন এ মুহুর্তে,
‘ তুই তো জানিস এখানকার নিয়ম অনুযায়ী আঠারো বছর হলে, সাবলম্বী হলে নিজের রাস্তা নিজে মাপতে হয়?’

শ্রেয়ার মনটা কেঁদে উঠল। গলা ধরে এলো। কন্ঠে কম্পনের ছাপ,
‘ জানি মাদার। আমি কি আর এখানে থাকতে পারব না?চলে যেতে হবে?’
প্রকট অসহায়ত্ব মেয়েটার কন্ঠে। মাদার অতি সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘ যেতে হবে তোর। কোথায় যাবি?এতিমখানা টা আমার মালিকানায় হলে আমি তোকে সত্যি রেখে দিতাম । তবে তোর কর্মসংস্থানের একটা সুযোগ করে দিব। ‘
শ্রেয়া মাথা দুলিয়ে বলে,
‘ সমস্যা নেই মাদার। এত বড় পৃথিবীতে নিশ্চিত কোথাও না কোথাও ঠাঁই হবে আমার। যেমন করে বাবা-মার মৃ*ত্যুর পর এইখানে জায়গা পেয়েছিলাম। ‘
জাহানারা খাতুন কিয়ৎপরিমাণ ভাবলেন। ইতস্তত করে বলে উঠলেন,
‘ তোর জন্য একটা প্রস্তাব এসেছে শ্রেয়সী। ‘
‘ কেমন প্রস্তাব মাদার?’– শ্রেয়ার চমকিত স্বর।
‘ এই এতিমখানার মালিক চৌধুরী পরিবার এটা জানিস তো?’
‘ হ্যাঁ। ‘
‘ ক’দিন আগে ফাতেমা চৌধুরী এলেন না?’
‘ বয়স্ক মহিলা টা?’
‘ হুম। সেদিন তোকে বেশ চোখে লাগে ওনার। পরের দিন ফোন দিয়ে জানান,ওনি তোকে চৌধুরী বাড়ির পুত্রবধূ রূপে নিয়ে যেতে চান। ওনার নাতির বউ হিসেবে। তুই কি বলিস?এটা তোর জীবনের ব্যাপার। তাই তোর মর্জিই প্রাধান্য পাবে। ‘

শ্রেয়া তৎক্ষনাৎ কিছু বলতে সক্ষম হলো না। মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল। চৌধুরী বাড়ি সম্পর্কে ব্যাপক শুনেছে এই এতিমখানায়। রোজই চর্চা হয় তাদের। সনামধন্য পরিবার। এই পরিবারের বউ হয়ে যাওয়া তাও একটা পরিবার হীন এতিম মেয়ের জন্য খুবই অদ্ভুত, আশ্চর্যজনক। শ্রেয়া শঙ্কিত নয়নে চাইল মাদারের দিকে। মাদার ওর নজর যেন পড়ে নিলেন,

‘ তুই ভাবছিস ছেলেকে দেখিস নি। এত বড় বাড়িতে বিয়ে কিভাবে কি?ছেলেটাকে আমি দেখেছি প্রায় দুই বছর আগে। ফাতেমা চৌধুরীর সাথেই এসেছিলেন এখানে। খুবই ভালো। এখন সিদ্ধান্ত তোর উপর। ‘
শ্রেয়া সময় নিল না। অনতিবিলম্বে লাজুক স্বরে জানালো,
‘ আমার জন্য যেটা ভালো হবে সেটাই করবেন মাদার। আমি রাজি। ‘

কেউ যদি জিজ্ঞেস করত এতিমদের জীবনে কিসের অভাব?তাহলে শ্রেয়া নির্দ্বিধায় বলতো– ‘ ভালোবাসার অভাব। ‘
একটা পরিবার, কারো ভালোবাসা পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর ব্যাকুল শ্রেয়া। মাদারের এই প্রস্তাব যেন ওর খাঁ খাঁ করা হৃদয়স্থলে হিমের স্পর্শ মাখিয়ে দিল। স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করে শ্রেয়া। ভালোবাসা পাওয়ার স্বপ্ন। কারো অন্তরের অধিবাসী হবার শত কল্পনা জল্পনার সূচনা করে বসে। চৌধুরী বাড়ি থেকে ফাতেমা ও ত্রিহা চৌধুরী এসে পরদিনই আন্টি পড়িয়ে যায়। বলে যায় আগামীকাল গোধূলি শেষে বিয়ে হবে। সেই বিভাবরী নির্ঘুম কাটে শ্রেয়ার। ভাবতে থাকে সারাজীবনের জন্য যেই মানুষটার বক্ষে বসবাস করবে সে ঠিক কেমন হবে?লজ্জায় মুখ ফুটে কাউকে বলতে অব্দি পারে নি। মানুষটাকে এক পলক দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করতে গেলেই বুকে দ্রিমদ্রিম শব্দ হতো, রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ বয়ে যেত,মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠত। মাত্র দু’দিনে প্রেম হয়?অনুরাগ জাগে হৃদয়ে?হয়ত!নয়ত কেন শ্রেয়া অচেনা,অদেখা,অজানা মানুষটাকে স্বামী ভেবে মন দিয়ে বসল?শুধু দু’টো দিন। এই দু’দিনে শ্রেয়ার হৃদয়ের রাস্তায় হাজারো,লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি অনুভূতিরা চলাচলে ব্যস্ত। সমস্ত অনুভূতি মিলে মানসপটে বারংবার লিখছিল ‘তূর্য ‘ নামটা। হ্যাঁ শ্রেয়া মাদারের মুখে শুনেছে ওর হবু স্বামীর নাম তূর্য,তূর্য চৌধুরী। ব্যাস,এখানেই জানা শোনার সীমারেখা টেনেছিল। আর জিজ্ঞেস করে নি কিছুই। লজ্জায় যে অতীব আড়ষ্ট ছিল মেয়েটা।

কথামতো পরেরদিন মাগরিবের নামাজের পরমুহূর্তে বিয়ের আয়োজন শুরু হয়। বিশেষ কিছু নয়,এতিমখানার মানুষজনদের জন্য বিভিন্ন পদের খাবারের ও সিধে সাধাভাবে বিয়ে। চৌধুরী পরিবারের সব মানুষ আসে নি। বিয়ের দিন ফাতেমা চৌধুরী, আয়ুশী ও ত্রিহা চৌধুরীই এসেছিলেন। সাথে এসেছিলেন সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষ টা। কিন্তু শ্রেয়া তাকে দেখে নি। কেউ কেউ বললো কবুল বলেই নাকি তূর্য চলে গিয়েছে। বউ রেখে কবুল বলে চলে গেল,না দেখল বউয়ের চেহারা,আর না এলো নিজে সম্মুখে। এসব ভেবে প্রচন্ড খটকা জাগে শ্রেয়ার মনে। অভিলাষ হয় মাদারকে জিজ্ঞেস করার৷ কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে চৌধুরী বাড়িতে তো দেখা হবে তার স্বামীর সঙ্গে। মিনিট খানেকের মধ্যেই আবারও সহস্র আশা বুনে।

ক্রমাগত কলিংবেলের আওয়াজ কর্ণে পৌঁছাতেই পুরোনো স্মৃতিচারণ হতে ঝক্কি খেয়ে বেরিয়ে এলো শ্রেয়া। এ সময় কলিং বেল কে বাজাচ্ছে? বুয়া না তো?প্রিয়ু গোসলে গিয়েছে। তাই শ্রেয়া দরজা খোলার জন্য উঠে এলো। ধীর গতিতে হেঁটে এসে দরজা মেলতেই চোখ ছানাবড়া ওর। কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবার উপক্রম। অপর পাশের মানুষটারও একইরকম দশা। দু’জনেই অবাকতার সমুদ্রে ডুবো ডুবো। অপর পাশের মানুষটার এর চেয়েও বেশি কিছু অনুভূত হলো কি-না তাতে সন্দিহান শ্রেয়া, তবে ওর বক্ষস্পন্দন ক্রিয়া প্রায় বন্ধ হবার জোগাড়। পুনরায় ওই তূর্যর কথা মাথা চারা দিয়ে উঠল। তূর্য এতক্ষণ চমকপ্রদ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেও এখন দৃষ্টি স্বাভাবিক করলো। উজ্জ্বল ফর্সা চেহারায় জ্যোতি খেলে গেল তার। ঠোঁটের কোণে সুপ্ত হাসি নিয়ে বললো,

‘ তুমি আর আমি দেখি একই ঘাটের মাঝি। ‘
শ্রেয়ার মুখ হা হয়ে গেল। সোজা প্রশ্ন ওর,
‘ মানে?’
তূর্য হাত দিয়ে নিজের ফ্ল্যাট টা দেখিয়ে বলে,
‘ এই যে পাশাপাশি থাকি দু’জনে। ‘

শ্রেয়ার কপালে ভাঁজ পড়ল। আগ্রহহীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠল,
‘ আপনি এখানে কেন স্যার?’
তূর্য ক্লান্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল। অতঃপর লহু স্বরে বললো,
‘ আদা হবে?একটু হলেই চলবে। ‘
‘ আমি কি আদা ব্যাপারী?’– শ্রেয়ার উল্টো প্রশ্ন।
মনে মনে ভীষণ রাগ আছে ওর তূর্যর প্রতি। কতটা নির্ম’ম,নির্দয় এই লোক!পুরোটা ক্লাস বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখল আজ। লজ্জায় ওর মাথা কাটা যাচ্ছিল। সেই জেদ টায় ব্যক্ত করে ক্ষান্ত হলো এখন।

তূর্যর চোখ লাল হয়ে এলো রাগের দাপটে। কত বড় বেয়া’দব মেয়ে!স্যারের সাথে এমন ব্যবহার। তাছাড়া প্রতিবেশী কিছু চাইলে এমন করে কেউ? ক্রোধান্বিত চাউনি নিক্ষেপ করে দৈবাৎ বলে উঠল,

‘ না। তুমি আদা ব্যাপারী হতে যাবে কেন?তুমি বেয়াদবের ওস্তাদ। বেয়াদব মেয়ে। ‘

কথাটা বলে হনহন করে নিজের ফ্ল্যাটে চলে গেল তূর্য। শ্রেয়া ভয়ার্ত চোখে নিষ্পলক চেয়ে রইল। এত ঝাঁঝ!এখন মনে হচ্ছে ভুল করে ফেলল ও। এমন করা ঠিক হয় নি। দৌড়ে গিয়ে কিচেন রুম থেকে কয়েকটা আদা নিয়ে এলো। সময়ের কি পরিহাস!এতক্ষণ তূর্য ছিল ওর দুয়ারে,এখন ও সম্মানিত লেকচারার সাহেবের দরজার অভিমুখে দাঁড়িয়ে। একবার কলিংবেল চাপল,খুলল না। দ্বিতীয় বার চাপতে নিলে দরজাটা মেলে গেল। তূর্য গলায় তোয়ালে পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নির্বিকার অভিব্যক্তি তার। যেন শ্রেয়াকে দেখে চমকায় নি। দুর্বোধ্য হেসে বলে,

‘ আদা দিতে এসেছেন আদা ব্যাপারী?আসুন ভিতরে আসুন। ‘

শ্রেয়া ভড়কালো,স্তব্ধ হয়ে গেল। সতর্ক দৃষ্টি মেলে ভিতরে উঁকি দিয়ে চাইল। না,যাবে না। এই লোক কেমন করে বুঝল,ও আদা দিতে এসেছে?

‘ তোমার হাতে আদা দেখে বুঝেছি। মনে মনে কষ্ট করে এত গবেষণার প্রয়োজন নেই। কত গ্রাম আদা এনেছো?বেশি দরকার নাহলে নিতাম না। পরিমাণ টা বলে দাও পেমেন্ট করে দিব। ‘

শ্রেয়ার মনে হচ্ছে কেউ ওর মাথায় হাতুড়ি দ্বারা আঘাত করছে। মস্তিষ্ক অচল হয়ে পরছে। কন্ঠে একরাশ বিস্ময় ঢেলে বললো,
‘ পেমেন্ট?’
তূর্যর নিরলস জবাব,
‘ কখনও শুনো নি শব্দটা?’
শ্রেয়া থমকালো। কিছু সেকেন্ডের স্তব্ধতা কাটিয়ে প্রতিবাদী কন্ঠে বলে উঠল,
‘ কেন শুনবো না?আর আদা নিয়ে এসেছি বলে আপনার ভাব বেড়ে গিয়েছে?’
‘ ভাব বেড়েছে এটা বুঝতে পেরে যে, আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার কারণে তোমার পরীক্ষার খাতায় নাম্বার কমতে পারে সেই ভয়ে আদা নিয়ে দৌড়ে এলে। ‘
‘ কি আমি?আপনি ভাবলেন কি করে?আর নাম্বার কাটার থ্রে’ট দিচ্ছেন আপনি?আপনি খুবই খারাপ, জ-ঘন্য শিক্ষক। ‘

তূর্য বাঁকা হেসে দুই পা এগিয়ে আসল। হতবাক হয়ে যায় শ্রেয়া। হৃদয়ের গতি নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে পড়ে। শরীর হেলিয়ে একটুখানি পিছিয়ে যেতেই তূর্য ঝুঁকে এলো। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুখ খিঁচে ফেলল শ্রেয়া। তূর্য ওর ভয়মিশ্রিত মুখশ্রীতে দৃষ্টি বুলিয়ে হাতের আদাগুলো নিয়ে গলা ঝেড়ে বললো,

‘ ধন্যবাদ মিস,,।’
এতটুকু বলে থেমে গেল৷ জিজ্ঞেস করলো,
‘ মিস অর মিসেস?’

শ্রেয়া উত্তরে নিরব থেকে কয়েক পলক চাইল। শব্দহীন দৌড়ে চলে গেল নিজের ফ্ল্যাটে। তূর্য এক হাতে মাথার চুল টেনে আনন্দপূর্ণ মেজাজে ঘরে ঢুকল। অত্যন্ত শান্তি লাগছে এখন মেয়েটাকে বিব্রত করতে পেরে। তখন দরজার সামনে সুযোগ পেয়ে মেয়েটা যাচ্ছে তাই ব্যবহার করলো। এবার বুঝবে তূর্য চৌধুরী কি জিনিস এবং কত ধানে কত চাল।
___________

বসার ঘরে ফোন বেজে চলেছে লাগাতার। তূর্য চা টা নামিয়ে ছেঁকে কাপে ঢেলে নিল। মাথা ব্যাথা টা তীব্র বেড়ে গিয়েছিল। এক কাপ রং চা দরকার ছিল খুব। নতুন আসায় সব ধরনের মশলা কেনা হয় নি। চা বানাতে গিয়ে দেখল আদা নেই। আদা কুচি বিহীন রং চা’য়ের স্বাদ যেন পানসে তার নিকট। চা’য়ের কাপে এক চুমুক বসিয়ে বসার ঘরে এলো। অনবরত বাজতে থাকা মোবাইলটা হাতে তুলে কলটা রিসিভ করলো। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠল,

‘ বল আয়ুশ। ‘
‘ কি করছিস ভাই?কখন ধরে কল করে যাচ্ছি। বড় চাচিও না-কি ফোন দিয়েছে। না পেয়ে আমাকে বলল ট্রাই করতে। ‘

তূর্য মোবাইল চেক করে দেখে মা নামে সেভ নাম্বার টা থেকে পাঁচটা কল এসেছে।

‘ চা বানাচ্ছিলাম। ‘
‘ তোর একা একা কষ্ট হচ্ছে না ভাই?একটা বুয়া রেখে দিস। রান্না বান্না করে যাবে। ‘
তৎক্ষনাৎ তূর্য তাচ্ছিল্যের সহিত বলে উঠল,
‘ বউ থেকেও আমি একা। নিজেকে ব্যাচেলর দাবি করতে হয়। স্ট্রেঞ্জ না আয়ুশ?’
অপর পাশ থেকে একটা শব্দও এলো না আর। মানুষটা হয়ত কিছুসময়ের জন্য থমকে গিয়েছে। তা বুঝতে পেরে তূর্য রাশভারি গলায় বললো,
‘ কিভাবে জেনেছি অবাক হচ্ছিস?তোরা কি ভেবেছিস আমার কাছে সব লুকিয়ে যাবি?আমার বউ কোথায় আয়ুশ?কে সে?কেন লুকিয়েছিস আমার কাছে যে আমি বিবাহিত?আমার পাগল হওয়ার সুযোগ নিলি তোরা?’
তূর্যর কন্ঠস্বর বদলে গেল। ক্রোধ স্পষ্ট। নিমেষে দুই নেত্র রক্তিম হয়ে উঠেছে তার।

#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here