সংসার শেষপর্ব

0
1283

সংসার
শেষপর্ব
#WriterঃMousumi_Akter

আগে আমার চোখের পানি দেখলে আহনাফের চোখের পানি আটকাতে পারতো না আর আজ সেখানে আমার চোখের পানির একমাত্র কারণ আহনাফ।আমার ননদের বিয়ে ছিলো।বিয়েটা মিটে গেলে নোনাস এর সাথে আহমাফের বউ হিসাবে পরিচয় করানো হয় মিরাকে।এমন ভাবে পরিচয় করানো হয় যেনো আহনাফের একটাই বউ।ওদের ফ্যামিলি ফটোর কোথাও আমি নেই।আহনাফের ফোনে এখন আমার একটা ছবি ও নেই।আহনাফের ফোন গ্যালারি জুড়ে মিরা আর তার ছেলের ছবি।ঘরের যেখানে আগে আমার আর আহনাফের পিকচার ছিলো সেখানে আজ মিরা আহনাফ আর তার ছেলের ছবি।এ বাড়ির কোথাও আমার অস্তিত্ব নেই।ননদ আর শ্বাশুড়ি আমাকে প্রায় বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলে।আজ ছয় মাস হয়ে গিয়েছে আহনাফ ভুলেও একটা রাত ও আমার সাথে কাটাই নি।আহনাফের শূণ্যতায় আমার বুক ফেটে কাঁন্না আসে।

আহনাফের বউ প্রায় দিন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় আমাকে ডিভোর্স না দেওয়ার জন্য।আহনাফের বউ এর সাথে প্রায় আমার কথা কাটাকাটি হয়।আহনাফ আগে আমার পক্ষ নিয়েই কথা বলতো আর এখন কিছু বললে আমার গায়ে হাত তোলে।আজকাল প্রায় আহনাফ আমাকে মারে।শরীরের বিভিন্ন জায়গা আজ মারের দাগ।

দেখতে দেখতে দুইটা বছর কেটে গেলো।দুইটা বছরে আমার উপর দিয়ে যে মানসিক চাপ গিয়েছে সেটা ভোলার মতো নয়।ভালবাসার মানুষ টা বদলে গেলে তার থেকে ভয়ানক যন্ত্রণা আর কিছুতে নেই।

এখন আর আমার আর আহনাফের ম্যারেজ ডে পালন হয় না।আহনাফ আর মিরার ম্যারেজ ডে পালন হয়।আহনাফের আগের চেয়ে ভালো জায়গা জব হয়েছে তারা কেউ জানে না যে আহনাফের দুইটা বউ।আহনাফ আর মিরার ম্যারেজ ডে তে নতুন বসেরা বাড়িতে আসে।

আহনাফের একজন বস আমাকে বলে আপনি কে?আমি বলেছিলাম ওর বউ।আহনাফের বস বলেন উনি তো কখনো বলেন নি উনার দুইটা বিয়ে।আহনাফের বসের কাছে তার বউ এর পরিচয় দেওয়াতে আহনাফ আমাকে সেদিন প্রচুর মারে।ওর মাইর আমি সহ্য করতে না পেরে ওর পায়ে ধরে বলেছিলাম আহনাফ আমাকে আর মেরো না।আমি আর সহ্য করতে পারছি না।আমি আর কোনদিন কাউকে বলবো না আমি তোমার বউ আমাকে আর ব্যাথা দিও না।তবুও আহনাফ সেদিন নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমাকে মেরেছিলো।সমস্ত শরীর রক্তাক্ত করে ফেলেছিলো আমার।

সারারাত ব্যাথায় সেদিন কুকিয়েছিলাম।পাশে কাউকেই পাই নি।

এভাবেই চলতে থাকে আমার অবহেলিত জীবন।রাত দিন আমাকে মেরে মেরে বাসা থেকে বের করে দেই।ডিভোর্স দেওয়ার জন্য প্রেসার দেওয়া হয়।

আহনাফ কে সেদিন বলেছিলাম আমার কি দোষ আহমাফ।আমি তো শুধু তোমার জন্য সব ছেড়ে এসেছিলাম।সব পুরুষ জাতি কি এমন আহমাফ।আমার বাবা বিয়ে করে আমাকে অবহেলা করলো তুমি বিয়ে করেও আমাকে অবহেলা করছো।তুমি কি জানোনা আমার মা বাবা পরিবার কেউ নেই।তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই আহনাফ।আমার জীবনে আমি একাই। তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিলে আমি কোথায় যাবো। আর আমি তোমাকে ভীষণ ভালবাসি আহনাফ।অনেক বেশী ভালবাসি।তোমাকে ছাড়া আমার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।আহনাফ আমার কাঁন্না দেখে বলে আমার এখন পরিবার আছে সো প্লিজ আশা লিভ মি।তোমাকে নিয়ে রোজ অশান্তি।যেখানে ইচ্ছা যাও কিন্তু আমার জীবন থেকে প্লিজ যাও।তোমাকে বিয়ে করে সেদিন আমি ভুল করেছিলাম।তাহলে আমার জীবন থেকে এত গুলো দিন নষ্ট হতো না।

আহনাফের কথা গুল ধারালো ছুরির মতো আমার বুকে বিঁধলো।কথার আঘাতের চেয়ে বড় আঘাত এ দুনিয়াতে আর কিছুতে নেই।আমার ভালবাসার মানুষ আহনাফ যার জন্য বাঁচতে শিখেছিলাম সে ও আজ আমায় দূরে ঠেলে দিলো।

একটা সময় চূড়ান্ত অশান্তি হলো।এক কথায় আমাকে আর আহনাফ রাখবে না।আমি কাকুতি মিনতি করেছিলাম আমাকে কাজের মানুষ হিসাবে রাখো।আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারবো না আহনাফ।তোমাকে চোখের দেখা দেখলেও আমি নিঃশ্বাস নিতে পারবো।কিন্তু সেদিন আহনাফ যেনো আমাকে সহ্য ই করতে পারছিলো না।

সেদিন আমাকে একা রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছিলো আহনাফ।ডিভোর্স এর পরেও হাত পায়ে ধরেছিলাম কিন্তু ও আমার কাঁন্নার গুরুত্ব দেইনি।একটা বাচ্চার অপূর্ণতা আমার সংসার কেড়ে নিয়েছিলো।আমার ভালবাসা কে কেড়ে নিয়েছিলো।

বার বার মনে হচ্ছিলো এ পৃথিবী আমার জন্য নয়।

আমি একা একটা মেয়ে কোথায় যাবো জানিনা।আমার যাওয়ার কোনো জায়গা ই ছিলো না।রাস্তা ঘাটে অনেক ধরনের বিপদের সম্ভাবনা ছিল।সেদিন কেঁদেছিলাম অনেক কেঁদেছিলাম কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে পড়েছিলাম আমি।কেউ ছিলো না পাশে।কারো সাথে তেমন যোগাযোগ ও নেই।মা বাবা ফ্যামিলি কেউ নেই।পৃথিবী আমাকে বুঝিয়েছিলো একা জীবনে যুদ্ধ করা কত কষ্টের।।

সেদিন আমি সুইসাইড করার জন্য বিষ কেনার পয়সা ও পাই নি।কারণ আহনাফের থেকে একটা টাকা ও আমি নেই নি।

আসলে সৃষ্টিকর্তা আছেন তার বান্দার জন্য।যখন কেউ থাকে না তখন তিনি থাকেন তার বান্দার পাশে।বান্দার একমাত্র সহায়ক। রাস্তায় এলোমেলো ভাবে হাঁটছিলাম হঠাত বাচ্চা কোলে আমার বেষ্ট ফ্রেন্ডের সাথে দেখা।আমাকে দেখে বলে এই আশা এভাবে হাটছিস যে।চোখের নিচে এমন কালো দাগ কেনো?সেদিন একমাত্র আরিয়ান কে পেয়েছিয়াল আমার ভরসা করার মানুষ হিসাবে।আরিয়ান আমাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে বসে।কতদিন পরে খাবার খেলাম জানিনা।আরিয়ান আমাকে দেখেই বুঝেছিলো আমার সমস্যা। আরিয়ান আমার সব ঘটনা শুনে কেঁদেই দিলো।আরিয়ান কে সেদিন বলেছিলাম আমি সুইসাইড করতে চাই।ও আমার গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলে মেয়ে মানুষ হয়েছিস বলে কি পচে গিয়েছিস।তোর কি কোনো আত্মসম্মান নেই।তোর কি মনে হয় না যে তুই কেনো অন্যর দাসত্ব নিয়ে বাঁচবি।

চারদিকে তাকিয়ে দেখ আশা কত মেয়েরা আত্মনির্ভরশীল। তোকেও তেমন হতে হবে।যারা তোর অক্ষমতা কে তোর দূর্বলতা ভেবেছে তোর তাদের কে দেখিয়ে দিতে হবে মা হওয়ার জন্য শুধু সন্তান জন্ম দেওয়া লাগে না।অনেক অনাথ বাচ্চারা মা খুজছে মায়ের ভালবাসা খুজছে।তাদের বুকে আগলে নিয়ে কিন্তু ও মা হওয়া যায় আশা।তুই শিক্ষিত মেয়ে।তোকে চাকরি করতে হবে।মনে জিদ রাখ আশা।কেনো হেরে যাবি কার জন্য।তুই মরে গেলে কে তোর কথা মনে রাখবে।বেঁচে থেকে যুদ্ধ করতে হবে।

ওর কথায় যেনো আমার ভেতর থেকে কিছু একটা ধাক্কা দিলো।আমিও ভাবলাম আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

সেদিন আরিয়ান এর মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলো।আরিয়ান কে বললাম নাম কি ওর।

পুতুল।

ওর মা কোথায়।

ওকে জন্ম দেওয়ার সময় মারা গিয়েছে।

পুতুলের মতো বাচ্চাটা দেখে মন টা ভাল হয়ে গেলো।আরিয়ানের মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে যেনো সন্তান সুখ পেলাম।আরিয়ান আমাকে বলে তুই আলাদা বাসা নিয়েই থাকিস যদি আমার বাসায় থাকতে আপত্তি থাকে,,, আপাতত কিছুদিন আমার বাসায় থাক।আরিয়ানের বাসায় ওর মা বোন সবাই ছিলো তাই আর আপত্তি করি নি।

আরিয়ানের মেয়েয়ার মা নেই আমি দিন দিন ওর মায়ায় জড়িয়ে যায়।মাত্র এক বছরের মেয়েটা ছিলো।ও যেনো কেমন করে আমাকে আপন করে নিয়েছিলো।আরিয়ানের বাচ্চাটাই আমাকে আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছিলো।আমার জীবনে নতুন করে বাঁচতে শিখলাম।

আরিয়ানের অফিসেই আমাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেই আরিয়ান।আমি মন দিয়ে কাজ করছিলাম।দিন দিন কাজে আমি দক্ষ হতে থাকি।আমার প্রমোশন বাড়তে থাকে।এখন আমি একটা বড় কোম্পানির দায়িত্বে আছি।এমন কি নিজেও একটা কোম্পানী তৈরি করেছি।যার পেছনে আরিয়ানের হাত আছে।আমাকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আরিয়ান সব রকম ভাবে চেষ্টা করেছে।

পুতুল এর জন্য আরিয়ানের বাড়ি ছেড়ে আমি আর আসতে পারিনি।ওর মুখে কথা ফুটতেই ও আমাকে মাম্মি বলে ডাকে।ওর মাম্মি ডাকে আমার যেনো বুক ফেটে কাঁন্না আসে এই ডাকটার জন্য জীবন আমার থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে।আবার একটু পরেই ওর হাসিতে আমি পাগল হয়ে যায়।কারন পুতুল কে পেটে না ধরলেও ও আজ আমার মেয়ে।

একটা সময় আরিয়ানের ফ্যামিলি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেই।আপত্তি থাকলেও পুতুলের জন্য রাজি হয়েছিলাম।সত্যি বলতে আজ আমি আরেকবার ভালবেসেছি।সেটা আরিয়ান আর পুতুল।ওদের আমি ভীষণ ভালবেসে ফেলেছি।

আজ আমার অনেক টাকা পয়সা আছে।শুধু আহনাফ নেই পাশে।প্রায় ওর সাথে কাটানো বিষাক্ত দিন গুলো মনে পড়ে।হয়তো আহনাফ ও আজ অনেক ভাল আছে।

প্রায় পাঁচ বছর পরে আজ শ্বাশুড়ি আর ননদের সাথে দেখা।আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম ননদ কে বাচ্চা সহ খুব খারাপ অবস্থা। আমাকে দেখে এগিয়ে আসে কথা বলার জন্য।আমি মুখ ঘুরিয়ে চলে আসার চেষ্টা করলাম।ননদ আমার হাত চেপে ধরে ননদ আমাকে বলে তোমার বাচ্চা হয় নি বলে ভাইয়া ডিভোর্স দিয়েছিলো আর আমার বাচ্চা হওয়ার পরেও সংসার টিকে নি ভাবি।আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে।সংসার বড় কঠিন।আমাকে মাফ করে দাও ভাবি।আহনাফের মা বলে মা আশা আমি এখন আমার মেয়ের সাথে আলাদা থাকি মিরা রোজ আশান্তি করে সে আমার ভাত রান্না করতে পারবে না।আমি মুচকি হেসে বললাম আমি আশা তবে আপনার ছেলের বউ না।আর প্রকৃতি কাউকে ছাড় দেই না।

আমার দিন গুল আজ খুব ভালোই যাচ্ছে।

আজ সাত বছর পরে আহনাফের সাথে দেখা।আহনাফ এক্সিডেন্ট করে পা হারিয়েছে।চিকিৎসায় জায়গা জমি সব বেঁচে খরচ হয়ে গিয়েছে।জব ও নেই আজ।আমি যে ডুপ্লেক্স বাড়িতে থাকি তার নিচে একটা টিনের ঘরেই ভাড়া উঠেছে।মিরা দিন রাত খোটা দেই আহনাফের আয় ইনকাম নেই তার পক্ষে এভাবে আর থাকা সম্ভব নয়।আহনাফের সাথে মিরা যা তা ব্যবহার করে।এমন কি পরকিয়াতে জড়িয়েছে সে।হয়তো যেকোনো টাইমে মিরা আহনাফ কে ছেড়ে চলে যাবে।

আহনাফ একটা হুইল চেয়ারে বসা। আমাকে দেখেই চমকে যায়।সেদিনের আমি আর আজকের আমি অনেক টা বদলে গিয়েছি।আমাকে দেখে হু হু করে কেঁদে দিয়ে বলে অনেক খুজেছি তোমায়। কোথাও পাই নি।আমার ভুল আমাকে শাস্তি দিয়েছে আশা।আজ টাকার জন্য ওষুধ ও খেতে পারি না।তোমার পবিত্র ভালবাসা কে আমি অবহেলা করেছিলাম আমি ভুল করেছিলাম।

পুতুল কে দেখিয়ে বলেছিলাম এটা আমার মেয়ে।আমাকে মাম্মা বলে জড়িয়ে ধরে।ওর জন্য আজ আমার বেঁচে থাকা।আরিয়ান কে দেখিয়ে বলি এটা আমার স্বামি।আজ আমার ও সংসার হয়েছে আবার।আরিয়ান আমাকে ভীষণ ভালবাসে।তোমার দেওয়া মাইর এর দাগ গুলোর থেকে মনের আঘাত গুলো আজ ও ভুলিনি আমি।আমার সন্তান না হওয়ার অক্ষমতা ঢেকে দিয়েছে আমার মেয়ে পুতুল।আজ দেখো তোমার জীবন যাপন কেমন আর আমার কেমন।

তোমার এমন করূন পরিনতি আমি চাই নি।তবে প্রকৃতি কাউকে ছাড় দেই না।

সেই অসহায় মেয়ে আশা আজ আশালতা কোম্পানির মালিক।ভালো থেকো।গাড়িতে মেয়ে আর আরিয়ান অপেক্ষা করছে।

আজ আমি ভাল আছি সংসার নিয়ে।

সমাপ্ত।

(ভালবাসা সত্যি রং বদলায়।যে সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টি হয় সে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে স্বাবলম্বী করে নতুন করে সব শুরু করাই ভালো।গল্প টা লিখতে গেলে আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিলো এইজন্য দ্রুত শেষ করেছি।আমার আশে পাশে কত যে ভালবাসার বেঈমানি দেখেছি।পৃথিবীতে মনে হয় ভালবাসার মানুষের বদলে যাওয়ার মতো কষ্ট আর কিছুতে নেই।সবাই গঠন মূলক কমেন্ট করবা)

নিচে গ্রুপ লিংক দেওয়া হলো স্টোরি নিয়ে আলোচনা বা রিভিউ দেওয়ার জন্য।

https://www.facebook.com/groups/realityy/?ref=share

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here