শ্রেয়সী পর্ব ২

0
836

#শ্রেয়সী
#লেখাঃKhyrun Nesa Ripa
#পর্বঃ২

বারবার ফোনটা হাতে নিয়ে শিহাবের সেভ করা নাম্বারটায় চোখ বুলাচ্ছে বিন্দু। একবার ভাবছে কল দিবে পরক্ষণেই একরাশ লজ্জায় বুকটা কেমন ভারি ভারি হয়ে উঠছে। ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি দিচ্ছে। বিধু বিষয়টা খেয়াল করতেই গলা উঁচু করে বললো,
–সমস্যাটা কী তোর? এভাবে পাগলের মতো ফোনের দিকে তাকিয়ে হাসছিস কেন? ঘড়িতে কয়টা বাজে খেয়াল আছে তোর? এবার ক্ষেমা দে বইন। তোর এসব পাগলামী জাস্ট অসহ্য লাগছে আমার। তুইও একটু ঘুমা আর এমাকেও একটু ঘুমাতে দে।”
–ঘুমাবি তুই, তোর ঘুম কী আমি ধরে রাখছি নাকি?”
–তা নয়তো কী? বারবার ফোন টিপছিস, ফোনের আলো চোখে লাগছে। যার কারণে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। এবার আশা করি আপনে ব্যাপারখান বুঝছেন বড় আফা।”
বলেই বিধু ওপর পাশ ফিরে শুয়ে রইলো বিন্দুও ভেংচি কেটে অন্য পাশ ফিরে ফোন টিপতে লাগলো।

দুই-বোন সারাক্ষণ এটাসেটা নিয়ে লেগেই থাকে। কিন্তু তাই বলে কেউ কাউকে ভালোবাসে না এমনটা না।

অন্যদিকে শিহাবেরও চোখে ঘুম নেই। খালি বিছানার এপাশ-ওপাশ করছে। কখন যে বিন্দু ফোন করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। বাড়িতে পা রাখার পর থেকে মনে হয় এ পর্যন্ত শতবার ফোনটা হাতে নিয়েছে। আর প্রতিবারই হতাশ হয়ে ফোন রাখতে হয়েছে। কী আর করা।

সবাই ঘুমাচ্ছে মাথার ওপর ফ্যানটা শো শো শব্দ করে ঘুরছে। ঘরের জানালা-দরজা সব বন্ধ। শিশির খাটের মাঝখানে বসে গিটারে সুর তোলার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হাজারবার চেষ্টা করেও আজ কোনোভাবে সুর তুলতে পারছে না। গানের প্রতিটা সুর বারবার কেটে যাচ্ছে। কেন যে আজ এমন হচ্ছে জানা নেই শিশিরের। মনটা এক অজানা কারণে অস্থির হয়ে আছে। আর সেজন্যই গান গেয়ে মনটা ভালো করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু সে চেষ্টাতেও সফল হতে পারলো না সে। বারবার গানের মাঝখানে এসেই সব সুর এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মাথাটাও কেমন ঝিমঝিম করছে। কারো একটু হাতের পরশ পেলে বোধহয় অনেকটা ভালো লাগতো।
এই প্রচেষ্টার মাঝেই হঠাৎ দরজায় টোকা পড়লো। শিশির ক্লান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
–কে?”
–ভাইয়া আমি। দরজাটা খোল।”(ছোট বোন রিদি)
শিশির উঠে গিয়ে দরজা খুললো। হাই তুলতে তুলতে বললো,
–এত রাতে এখনো জেগে আছিস কেন?”
–আগে বল তুই জেগে আছিস কেন? এভাবে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকলে ভেতরে ঢুকবো কিভাবে?”
শিশির দরজা ছেড়ে এসে বিছানার ওপর বসতে বসতে বললো,
–সমস্যা কী তোর? ঘুমাসনি কেন?”
রিদি মোলায়েম গলায় বললো,
–তুই ভালো না থাকলে কী করে ঘুমাবো?”
শিশির ঘর কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে বললো,
–তোকে কে বলেছে আমি ভালো নেই?”
–দেখ একদম নেকামি করবি না। আমি সব বুঝি।”
শিশির আলতো করে বোনের নাক টিপে দিয়ে বললো,
–আমাদের পাকা বুড়ি একটা। এখন যা ঘুমা। সকালে আবার প্রাইভেটে যেতে হবে তো।”
–তোকেও তো সকালেই স্কুলে যেতে হবে।তাহলে?”
–আরেহ আমার সমস্যা হবে না। যা তুই।”
–ভাইয়া প্লিজ বল না কী হয়েছে তোর? বিয়ে বাড়ি থেকে আসার পর থেকেই কেমন গম্ভীর হয়ে আছিস। তোকে এমন দেখলে আমার মোটেও ভালো লাগে না।”
–আরেহ পাগলটা কিচ্ছু হয়নি। সামনেই তো তোর পরীক্ষা অযথা টেনশন না নিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমি একদম বিন্দাস আছি। একটুবাদেই ঘুমিয়ে পড়বো। তুইও গিয়ে ঘুমিয়ে পর।”
–তুই শুয়ে পর আমি চুলে বিলি কেটে দেই তাহলে তোর ঘুম চলে আসবে।”

শিশির আর দ্বিরুক্তি করলো না রিদির কোলের ওপর শুয়ে পড়লো। রিদি আলতো করে ভাইয়ের চুলে হাত বুলাতে লাগলো। একসময় চোখ জোড়া ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে উঠলো। রিদি বুঝতে পেরে বালিসের ওপর ভাইয়ের মাথা রেখে মশারি টানিয়ে দিয়ে দরজাটা চাপিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।

মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে শিশির। বাবা সেই ছোটবেলা থেকেই বিশাল দায়িত্ব শিশিরের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে চিরবিদায় নিয়েছে। মা আর বোন নিয়েই শিশিরের এই ছোট্ট একটা পৃথিবী। যেই পৃথিবীতে নতুন কেউই এখনো অংশ নিতে পারেনি। রিদি এবার ক্লাস টুয়েলভে পড়ে। সারাক্ষণ ভাইয়ের ঘা ঘেঁষেই থাকে। একটু জ্বর,সর্দি লাগলে জীবন দিয়ে ভাইয়ের সেবা করে। কারণ ভাইটা যে মায়ের আর তার একমাত্র প্রাণ। সেই প্রাণের যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে দু’জন মানুষ বাঁচবে কী করে। শিশিরের মা (শিরিনা বেগম) ওয়াডারি কাথা সেলাই করে শিশিরকে অনেকটা উপকার করে। শিশির অবশ্য এই বাড়তি আয়ের কথা কিছুই জানে না। তাহলে না জানি কী কাণ্ড বাঁধিয়ে বসবে। রিদিকে ওর মা কসম দিয়েছে শিশিরকে এ ব্যাপারে কিছু জানাতে না। শিশির যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ কাথা সেলাই করেন না শিশির কাজে গেলেই কাজে লেগে পড়েন। ইদানিং চোখে খুব সমস্যা দেখা দিচ্ছে। চোখজোড়া কেমন ঝাপসা হয়ে উঠছে আবার পানিও পড়ছে। শিশির ব্যাপারটা লক্ষ্য করেই মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল। ভাগ্যিস সত্যিটা জানতে পারেনি শিশির। ডাক্তার জিজ্ঞেসও করেছিল,” আপনি সেলাই করেন?”
শিরিনা বেগম সোজামিথ্যে বলে বসলেন,
–না।”

শিহাব অনেক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন দেখলো কোনো কল আসলো না অগত্যা শিশিরের ফোনে কল করলো। শিশির ঘুমের মধ্যে বারবার ফোন কেটে দিচ্ছে। শিহাবও কম যায় না সঙ্গে সঙ্গেই আবার কল ব্যাক করছে। বাধ্য হয়ে ফোন রিসিভ করলো শিশির। ঘুম ঘুম গলায় বললো,
–কে?”
–শালা পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস। আর আমি ঘুমাতে পারছি না।”
–তোকে ঘুমাতে না বলছে কে। তুইও ঘুমা আর আমাকেও ঘুমাতে দে। বলেই ফোনের লাইন কেটে বালিসের নিচে ফোনটা চাপা দিয়ে দিলো শিশির।

বিন্দুর কিছুতেই ঘুম আসছে না। আস্তে আস্তে পা ফেলে বিধুর চোখের আড়ালে রুমের বাহিরে চলে এলো বিন্দু। তারপর সোজা বাড়ির ছাঁদে চলে গেল। আকাশে একটা পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। চারদিকে জ্যোৎস্নার আলোতে ধবধবে সাদা দেখাচ্ছে। বেশ ভালোই লাগছে সাথে মৃদু বাতাস শরীরের ভেতরে ঢুকে প্রাণটা ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে। এখানে অবশ্য কথা বলাই যায়। কেউই এত রাতে এখানে আসবে না।

সহসাই শিহাবের ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। সবেমাত্র চোখটা একটু লেগে এসেছে। এর মধ্যে কে যে বিরক্ত শুরু করেছে ভেবেই ফোনের লাইন কেটে দিলো শিহাব।

মনটা খারাপ হয়ে গেল বিন্দুর। বুকের মধ্যে এখনো দরফর করছে। কতটা সাহস করে কল করলো আর ও কিনা ফোনটা কেটে দিলো। একটু অভিমান হয়েছে বিন্দুর। মনে মনে ভাবলো আর কখনো কল দেবে না। কিন্তু নিজেকে বেশিক্ষণ দমিয়ে রাখতে পারলো না সে। আবারও কল করে বসলো। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো যেন ফোনটা না কাটে। হাতটা কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। বুকের ভেতর মৃদু কম্পন হচ্ছে। সহসাই ওপাশ থেকে কারো ঘুম জড়ানো কণ্ঠ কানে ভেসে আসলো।
–হ্যালো কে?”
–বিন্দু!”
বিন্দু নাম শুনেই শোয়া থেকে এক লাফে উঠে বসলো শিহাব। ঘুম যেন চোখ থেকে পালিয়েছি। ফোনটা হাতে নিয়ে একবার স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে আবারও কানের কাছে নিয়ে বললো,
–এতক্ষণে মেডামের কল দেওয়ার সময় হলো বুঝি?”
বিন্দু একটু মলিন স্বরে বললো,
–ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তাই না?”
–আসলে সবেমাত্র চোখটা লেগে এসেছিল।”
–তাহলে ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল কথা হবে।”
— না না একদম না। কথা না বলতে পারলে আমার এখন আর ঘুম হবে না। তুমি একটু ওয়েট করো। আমি কল ব্যাক করছি।

ফোন কেটে দিয়ে শিহাব আবার কল ব্যাক করলো। দু’জনেই চুপচাপ নিরবতা পালন করছে কেউই কোনো কথা বলছে না। শুধু ফোনের এপাশ থেকে ওপাশে দু’জনের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। খানিকটা সময় এভাবে চলার পর মুখ খুললো শিহাব।
–কেমন আছো?”
বিন্দু হালকা হেসে জবাব দিলো,
–ভালো। আপনি?”
–ভালো। তুমি করে বললাম। কোনো সমস্যা আছে?”
–উঁহু সমস্যা হবে কেন!”
আবারও দু’জনে চুপ হয়ে গেল। এবারও কিছু সময় পর শিহাব বললো,
–বিন্দু! ”
–হু!
–ভালোবাসি!
খুশিতে বিন্দুর নাচতে ইচ্ছে করছে। এত কেন ভালো লাগছে জানা নেই তার। যদিও এ যাবৎ বহু প্রেমের আবেদন পেয়েছিল সে। কিন্তু কাউকেই কখনো মন থেকে ভালো লাগেনি । প্রথম কাউকে এতটা ভালো লাগছে। শিহাবের সব কিছুই চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে তাকে! খানিকটা সময় চুপ থেকে বিন্দু মৃদু গলায় বললো,
–ভালোবাসি আমিও!”
এরপর ফোনের ওপাশে টুট টুট শব্দ শোনা গেল!

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here