#শ্রেয়সী
#পর্ব_২০
#লেখনীতে_নাদিয়া_সিনহা
রোদ্দু ঘরে প্রবেশ করার পূর্বেই আমার কর্ণপাত হয় রোদ্দুর লাজুক স্বরে মৃদু কন্ঠে বলা কথা। কিন্তু আমি এতটাই উত্তেজনায় ছিলাম যে কি কথা বলছে তা আমার মস্তিষ্কে ধারণ করিনি৷ সোজা ঘরে ঢুকে চিৎকার করে ‘ভাবি’ ডাকি। আমার অনাকাঙ্ক্ষিত আগমনে রোদ্দু বেশ বেসামাল হয়ে পরে। কানে ধরে রাখা ফোনটা হাত থেকে পরে যায়। ভূত দেখার মতে চমকে আমার পানে তাকিয়ে আচমকা হাতের পাশে থাকা গোলাকৃতি একটা বক্স আমার দিকে ছুঁড়ে মা’রে। আমি তাৎক্ষণিক নিচু হয়ে নিজেকে রক্ষা করি। বুকে হাত দিয়ে বুক ভরা নিশ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে রোদ্দু কে কিছু বলতে যাব ওমনি সে চিৎকার করে বলে,
-“অ’স’ভ্য, বে’য়া’দ’ব, ম্যানারলেস কারো ঘরে ঢোকার আগে নক করতে হয় তা শিখিসনি?”
-“বাব্বাহ্! রোদ্দু তুই তো দেখি একদম ম্যানার ওমেন হয়ে গেছিস। কি ব্যাপার বল তো?”
-“ফা’জি’ল…..”
আমি নাক, মুখ কুঁচকে বলি,
-“এ্যাঁই! চুপ কর তো। আজ বাদে কাল বিয়ে সে তার হবু ননদ কে ফা’জি’ল, বে’য়া’দ’ব, অ’স’ভ্য না জানি আর কি কি বলছে। নববধূর মুখে ওসব অশ্লীল কথা মানায় নাকি?”
রোদ্দু দু হাত আড়াআড়ি ভাজ করে বলে,
-“তোর থেকে আমাকে শিখতে হবে কিভাবে কথা বলতে হয়?”
-“অবশ্যই! আফটার অল আমি তোর ননদ বলে কথা। তাও এক মাত্র।”
-“তোকে আমি জুতা দিয়ে পে’টা’ব। তোর ভাই কে আমি বিয়ে করব না। না মানে নাই তোর বাপ কে গিয়ে বলে দে।”
-“এতই যখন বিয়ে না করার ইচ্ছে তাহলে যা না তোর বাপ কে গিয়ে বল, ‘বাবা আমি বিয়ে করব না।’
রোদ্দু রাগে ফুসফুস করছে। আমি রোদ্দু কে আরও জ্বালাতে ওর কাছে ঘেষে বসি। ওর হাতটা শক্ত করে টেনে ধরি। রোদ্দু ছুটার জন্য বার বার আমার হাতে ধাক্কাচ্ছে। আমিও পণ নিয়ে নিয়েছে যতক্ষণ না একে আগুনের উত্তাপে জ্বালিয়ে না দিয়েছি ততক্ষণ নো ছাড়াছাড়ি। কথা বলা প্রতিটা বাক্য খানিকটা সুরের মতো করে টেনে বলি,
-“ভাবিইইইই! শোনো না প্লিজজজ।”
রোদ্দু নিজের রাগ সংযত করে বলে,
-“শ্রেয়ু প্লিজ আমার সাথে এখন মজা করবি না। মেজাজ খারাপ।”
-“কেনো গো ভাবিইই? ভাইয়া বুঝি আর ভালোবেসে চুম্বন প্রদান করেনি।”
-“তোকে না কসিয়ে একটা চ’ড় দিব। কি সব অশ্লীল কথা বলছিস?”
-“এ্যামা! সে কি গো? আমি তোমার দশটা না পাঁচটা না এমনকি দুটো না একটা মাত্র ননদ আমাকে তুমি মা’র’বে?”
-“এ্যাহ! আসছে আমার ননদী। তা বলি তুই কি তিন চার বছরের বাচ্চা যে কোলে নিয়ে বসে থাকতে হবে?”
-“তা নয়তো কি। চাইলে কাঁধেও নিতে পারো। উঠবো?”
-“শ্রেয়ু আগেই বলেছি মেজাজ খারাপ আছে আমাকে জ্বালাস না।”
রোদ্দু বার বার একই কথা বলছি কিন্তু আমি তো আমিই। ইচ্ছে মতো রোদ্দু কে জ্বালাচ্ছি। কখনও ভাবি বলে, কখনও ভাইয়ার কথা তুলে আমার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে রোদ্দু বলে,
-“এ্যানাফ শ্রেয়ু। তোদের ভাই-বোনের সমস্যা কি? তোর ভাই বলেছে অন্তত ভার্সিটির পড়া শেষ হলে বিয়ে হবে। কিন্তু না তার কি এমন তাড়া যে তাকে এখনই বিয়ে করতে হবে? সামনে আমার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পরিক্ষা আর সে আমাকে বিয়ে সাদির মতো ঝামেলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে। আর তুই এখন সেটার মজা নিচ্ছিস।”
রোদ্দু রাগের মাথায় কি বলতে কি বলে ফেলেছে নিজেও বুঝেনি। আমি ড্যাবড্যাব করে তকািয়ে আছি রোদ্দুর পানে। ভাইয়া আর রোদ্দুর যে আগেই প্রেমাদান প্রদান চলছে তা বেশ বুঝতে পারছি। তাই তো চুপ করে রোদ্দুর সব গুলো কথা শুনছি। রোদ্দু এক পর্যায়ে কথা থামিয়ে আমার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে বলে,
-“সব বলে ফেললাম?”
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝাই। রোদ্দু মাথায় হাত দিয়ে আমার পাশে বসে পরে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,
-“কত দিন ধরে চলছে?”
-“দুবছর।”
আমি বড় বড় চোখ করে রোদ্দুর দিকে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে বলি,
-“কিহ! দুবছর? আর আমি কিচ্ছু টের পাইনি।”
-“আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিলো না। দেখা হলেই কথা হতো কেবল৷ শুধু জানতাম সে আমাকে পছন্দ করে। পৃথিবী এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে গেলেও সে আমাকে তার করেই ছাড়বে।”
-“উমমম…সে শুনতে তো বেশ ভালোই লাগলো।”
রোদ্দু আমার দিকে একবারের জন্যও তাকাচ্ছে না। এক নজর নিচের দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে আছে। আমি রোদ্দুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি,
-“তা ভাবি আমার দিকে না তাকিয়ে নিচে কেনো তাকিয়ে আছেন? আমি দেখতে সুন্দর না নাকি আপনার বরের কথা মনে পরছে?”
রোদ্দু আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিচে দৃষ্টি আবদ্ধ করে। আমি রোদ্দুর হাতটা টেনে এনে শক্ত করে ধরে বলি,
-“ভাবিস না যে তুই কেমন ফ্রেন্ড যে ফ্রেন্ডের বড় ভাইয়ের সাথে চুপিচুপি লুকিয়ে প্রেম করেছে অথচ টেরও পেতে দেয়নি। মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে আল্লাহ। তা ভালো হোক কিংবা মন্দ তা আমরা কখনও পাল্টাতে পারি না। আর কি ভাবছিস যে আমাকে না বলায় তোর উপর রেগে আছি? উঁহু! একদমই না। আমি জানি আমার ভাই বলে তুই বলতে দ্বিধা বোধ করতি। তুই মনে করেছিস আমি তোকে ভুল বুঝবো তাই তো?”
রোদ্দু আবারও মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বোঝায়। আমি রোদ্দুর কাঁধ আমার কাঁধে সাথে ধাক্কা লাগিয়ে বলি,
-“আর তুই কি ভাবিস আমি কিছু বুঝি না? ভাইয়া যে তোকে এত কেয়ার করতো, তোকে বকা দিতো সে কেনো এসব করতো তা সব আমার বোঝা হয়ে গেছিলো সেই কবেই। আমিও ভেবেছি ভাইয়ার বিয়ের জন্য পাত্রী দেখলে সবার আগে তোর নাম বলব।”
রোদ্দু আমার দিকে তাকিয়ে আছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি রোদ্দুর চোখ টলমল করছে। আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। আমি মুচকি হেসে রোদ্দু পিঠে হাত বুলিয়ে দেই। রোদ্দু কান্না করতে করতে অস্পষ্ট স্বরে বলে,
-“থ্যাংকিউ শ্রেয়ু আমাকে এতটা বোঝার জন্য। আমি সত্যি ভাগ্যবান তোর মতো বেস্টফ্রেন্ড পেয়ে।”
আমি রোদ্দুর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলি,
-“তা আমার ভাই কে পেয়ে ভাগ্যবান না তুই?”
ধুম করে কি’ল বসিয়ে দেয় আমার পিঠে। আমি ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেই রোদ্দু কে। রোদ্দু আমার দিকে তাকিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
-“তোর মতো হা’রা’মি যেনো আর কেনো মানুষের বন্ধু না হয়। আমিন আমিন!”
রোদ্দুর সাথে তাল মিলিয়ে আমিও বলি,
-“আমিন আমিন।”
রোদ্দু চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
-“এখনই আমার সামনে থেকে দূর হো।”
বলতে বলতেই হাত টেনে দরজার বাইরে ধাক্কা দিয়ে দেয়। আমি রোদ্দুর দিকে তাকিয়ে বলি,
-“যত ইচ্ছে মজা করে নে। আমাদের বাড়িতে আয় তারপর তোকে অত্যাচার কি আর কয় প্রকার তা হাতে কলমে শিখিয়ে দিব হ্যাঁ।”
-“আরে যা যা তোর মতো ভিজে বেড়াল আমার কিচ্ছুই করতে পারবে না।”
রোদ্দুকে পাল্টা জবাব দিতে যাব ওমনি আমার ফোন বেজে উঠে। ফোনে দিকে তাকিয়ে দেখি মা কল দিয়েছে। ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই কর্ণপাত হয় মায়ের কঠিন বাক্য,
-“গয়না দিতে গিয়েছিস নাকি খেজুর আলাপ করতে?”
-“রেগে যাচ্ছো কেনো?”
-“তা বলি কাল যে ভাইয়ের বিয়ে তা কি খেয়াল আছে? কত কাজ পরে আছে সে সব করবে কে?”
বিরক্ত হয়ে বলি,
-“আসছি দশমিনিট।”
-“হ্যাঁ হ্যাঁ মহারাণী জলদি এসে আমাকে উদ্ধার করুন।”
-“হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি পুরোনো জামানার ডায়লগই দিও। নতুন কিছু বলতে পারো না?”
কথাটা শোনার আগেই মা কল কেটে দেয়। আমি রোদ্দুর দিকে তাকিয়ে বলি,
-“সি ইউ ইন আমার বাড়ি।”
রোদ্দু মুখে ভ্যাঞ্চি কেটে ভেতরে চলে যায়। চলে যেতে উদ্যত হতেই শুনতে পাই পূর্বে সেই কথপোকথন। যা রোদ্দুর ঘরে প্রবেশ কালে খানিক কর্ণপাত হয়েছিলো। এবার আর আগের মতো না শুনেই চলে যাই না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করছি রোদ্দুর বলা কথাগুলো। রোদ্দুর ওষ্ঠে লাজুক হাসি। এই হাসিটা তৃপ্তির। প্রিয় মানুষকে পাওয়ার মতে তৃপ্তি বোধ হয় আর হতেই পারে না। রোদ্দুরও হয়তো তাই হচ্ছে। লাজুক হেসে রোদ্দু বলছে,
-“আমি কথা বলব না।”
-“……”
-“আপনি কি অবুঝ? বুঝতে পারছেন না আমি লজ্জা পাচ্ছি?”
-“……”
-“আপনি আর আপনার জল্লাদ বোন শুধু আমাকে জ্বালানোর জন্যই আছেন। এই আপনাদের দুজনের জন্য বিয়েতে আমার এত অমত।”
আমি ফিক করে হেসে বলি,
-“তাই তো দুবছর ধরে প্রেমের জ্বালে নাকানিচুবানি খাচ্ছিস।”
রোদ্দু চিৎকার করে শ্রেয়ু বলে উঠে। আমি দৌড়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসি। আসার পথে রোদ্দু মার সাথে দেখা হয় আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ক্ষমা করবি না আমায়?”
-“কি বলছো আন্টি। তুমি বড় তোমাকে আমার কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে হবে না।”
-“আমি না বুঝে তোর সাথে কথা কথা বলে ফেলেছি। বুঝিনি রে শ্রেয়ু মাফ করে দিস।”
-“কি যে বলো। তোমার জায়্গায় যে কেউ হলে তেমটাই ভাবতো৷ তুমি টেনশন নিও না এ নিয়ে। কাল বিয়ে সো চিল।”
আমার কথায় আন্টি হেসে দেয়। আমি আন্টিকে বিদায় দিয়ে বাড়ি চলে আসি৷ বিয়ে এমনটা একটা উৎসব যেখানে শত কষ্টের মাঝেও প্রিয়জনরা আনন্দ করে। সবাই এক সাথে হয়। কত মজা করে। আমার বিয়েতেও তো তাই হবে। কত মজা হবে তখন। আমি বউ সেজে আরাবী জন্য অপেক্ষা করব। সে এসে প্রথমেই মুগ্ধ নয়ন আমার দিকে তাকিয়ে বলবে ‘প্রেয়সী’ ব্যাস জীবনের আর কি চাই? শুধু আরাবী আমার হোক আর কারো না। কখনও না।”
__________________
মায়ের তীব্র গর্জনে সকালে ঘুম ভেঙ্গে যায়। উঠে তাড়া দেওয়া শুরু করে রেডি হতে। গত রাতে প্রায় তিনটা পর্যন্ত জেগে কাজিনদের সাথে আড্ডা দিয়েছি। তাই ঘুম থেকে উঠেই দেখি ১২ টার ঘরে অর্ধেক কাটা অতিক্রম করে ফেলেছে। এ নিয়ে মায়ের কত শত বকাঝকা৷ আমার মাথাটা পারছে না কথা দিয়ে খেয়ে ফেলতে। আমি দ্রুত উঠে গোসল করে রেডি হয়ে বের হই। ভেবেছিলাম একটু সাজগোজ করব। তা আর হলো কই। মা আমারকে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসি বলে,
-“তোর জন্য এক ঘন্টা ধরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে তনুফ। যত দ্রুত বিয়ে সম্পন্ন করে ঘরে ফেরা যায় ততোই মঙ্গল।”
গাড়িতে উঠে দেখে আমাদের গাড়িতে প্রায় তিনজন বডিগার্ড বসে আছে। আমি ভাইয়ার দিকে তাকাতেই চোখের ইশারায় চুপ করে বসে থাকতে বলে। শান ভাইয়া আমার মাথায় ধাক্কা দিয়ে বলে,
-“কিরে বুচি? তোকে তো আজ পুরোই পেত্নীর রাণী মনে হচ্ছে। মুখে কি কিছু মাখিসনি নাকি?”
আমি চোখ রাঙ্গিয়ে শান ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ভাইয়া বলে,
-“উরি বাবা! ভয় পাইছি। আসলে পেত্নীরা তাকালে অনেক ভয় হয় তো তাই।”
-“তুমি কি প্লিজ তোমার মুখটা বন্ধ রাখবে? সব সময় শুধু আজাইরা কথা।”
-“সামনে একটা পেত্নী থাকলে আজাইরা কথা মুখ দিয়ে এমনি বেরিয়ে যায়।”
আমি আর কথা না বলে স্বাভাবিক হয়ে বসে পরি। জানি এখন কথা বাড়ালে বড়সড় একটা ঝগড়া হয়ে যাবে। আমার মনটাও খারাপ একদমই করতে চাই না তাই চুপ করে বসে আছি। কিন্তু সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যপার ঘটলো আমার সাথে। আমার গাড়িতে ওয়ালিদ উঠেছে। সামনের সিটে বসেছে। আয়না দিয়ে বার বার আমার দিলেই তাকাচ্ছে। তনুফ ভাইয়া শান ভাইয়ার সাথে টুকটাক কথাও বলছে। তার এমন দৃষ্টিতে আমি মুখ ঘুরিয়ে বাইরে দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করি। কেউ বার বার তাকালে বিষয়টা সত্যি খুব অসহ্যকর লাগে। পুরো রাস্তা সে চোখ ঘুরিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। ভেবেও পাই না তাকানোর রহস্য টা কি? সাজগোজ তো করিনি। তাহলে কোন দুঃখে তাকিয়ে আছে? আল্লাহই ভালো জানে। সেদিকে আর পাত্তা না দিয়ে আমি বাইরে তাকিয়ে থাকি পুরো রাস্তা।
রোদ্দুর বাড়ি গিয়েই আমি প্রথমে রোদ্দুর কাছে চলে যাই। রোদ্দুকে আজ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। মিষ্টি রঙ্গের একটা লেহেঙ্গা পরেছে। সর্ব’গা ভর্তি গয়না। আজ রোদ্দুর মুখে কিশোরী আভাটা নেই। যেনো পরিপূর্ণ নারী! যে নিজে একা হাতে সবটা সামলানোর ক্ষমতা রাখে। যাকে ভরসা করে নিজের সবটুকু বিশ্বাস করা যাবে। আচ্ছা নববধূরা কি এমনই হয়। বিয়ের প্রথম দিন থেকেই এতটা দ্বায়িত্বশীল হয়ে যায়? আমিও কি বিয়ের পর আরাবীর সব দ্বায়িত্ব পালন করতে পারব? রোদ্দু বিয়ের কথা ভাবতেই আরাবী আর আমার রঙ্গিন সংসার বুনবার স্বপ্ন চোখে ভেসে উঠে। আমার আর আরাবীর সংসার।
আশেপাশের চিৎকার চেঁচামেচিতে আমার স্বপ্নের সংসার ভেঙ্গে যায়। আমি গিয়ে রোদ্দু পাশে বসে নানা কথা বলছি। রোদ্দু আজ কোনো কথাই বলছে না। চুপচাপ বসে শুধু লাজুক হাসছে।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হওয়ার পরপরই কাজি এসে বিয়ে পড়ানো শুরু করে দেয়। রোদ্দু চুপ করে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। মনটা অজান্তেই খারাপ হয়ে গেলো। জীবনের এই মুহুর্তে বোধ হয় মেয়েদের একটু বেশিই কষ্ট অনুভব হয়। কান্না করার এক প্রায় রোদ্দু কবুলও বলে দেয়। আমি রোদ্দুর কাঁধে হাত বুলিয়ে শান্তনা দিচ্ছি। কিছুক্ষণ পর শান ভাইয়া এসে বলে রোদ্দু কে নিয়ে গাড়তে যেতে। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরতে হবে। বাবা বলেছে সন্ধ্যা নেমে পরলেই সমস্যা। আমি রোদ্দু কে ধরে উঠে দাঁড় করাই। কান্না করতে করতে রোদ্দু বেহাল দশা। চোখ, মুখ ফোলো। চোখ দুটোও অসম্ভব রকম লাল হয়ে আছে। মুখের সব সাজ কেমন ভেস্তে গেছে। রোদ্দুর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি।
গাড়িতে সকলের মাঝেই পিনপতন নীরবতা। রোদ্দু চুপটি করে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। আমিও রোদ্দুর পাশে বসে থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছি। আমি রোদ্দু কে জিজ্ঞেস করি,
-“কাঁদছিস কেনো?”
পেছন থেকে শান ভাইয়া উত্তর দেয়,
-“কাঁদবে না কেনো বল। জীবনের মতো কপাল পুড়লো।”
কপট রাগ দেখিয়ে শান ভাইয়া কে বলি,
-“কেনো কেনো? কপাল পুড়বে কেনো? আমার ভাই কি কম সুখে রাখবে?”
শান ভাইয়া আফসোসের স্বরে বলে,
-“ভাইয়া তো সুখের অভাব হতে দিবে না কিন্তু বেচারি রোদ্দুর এমন একটা দজ্জাল ননদ জুটলো তা ভেবেই আমার গভীর কষ্ট হচ্ছে।”
শান ভাইয়ার কথায় গাড়িতে থাকা সকলে শব্দ করে হেসে দেয়। রোদ্দু কে দেখলাম মুচকি হাসছে। আমি জানি নিশ্চয়ই রোদ্দুর কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু বলতে পারছে না রোদ্দু খুশি তাই আমি আর কথা না বাড়িয়ে সামনে তাকিয়ে বসে পরে। এখন একটু স্বস্তি পাচ্ছি। কারণ সামনে ওয়ালিদ নামক ব্যক্তিটা নেই তাই। সিটে গা এলিয়ে দিয়ে সহসা চোখ বুঁজে নেই।
বাড়ি এসেই বাসর ঘরের সামনে বড় সড় এক যুদ্ধ বেঁধে যায়। আমি, শান ভাইয়া মিলে তনুফ ভাইয়ার মাথা নষ্ট করে দিচ্ছি এক প্রকার। তনুফ ভাইয়া রুমের সামনে আসতেই আমি সুর টেনে বলি,
-“দুলাভাইইইই।”
আমার ডাকে ভাইয়া বেশ চমকে যায়। সামনে পেছনে তাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“দুলাভাই কে?”
-“কে আবার আপনি।”
-“তোর কি মাথা টাথা গেছে রোদ্দু? আমি তোর দুলাভাই হবো কি করে? আর আপনি আপনি করছিস কেনো?”
-” এ্যামা! আপনি আমার বান্ধবীর বর তাহলে আপনি আমার দুলাভাই হয়। আর দুলাভাই কে তো আপনি করেই বলতে হয়। তাই না বেয়াই সাহেব।”
শান ভাইয়া কে খোঁচা দিয়ে বলি। শান ভাইয়া আমার দিকে তেড়ে এসে বলে,
-“বেয়াই কাকে বলিস? রোদ্দুও আমার বোন হয়। সো তনুফ ভাইয়া তোকে এবং আমাকে সমান সমান এমাউন্ট দিতে হবে।”
তনুফ ভাইয়া অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোরা টাকার জন্য এসব করছিস?”
আমি আর শান ভাইয়া এক সাথে বলে উঠি,
-“জ্বী দুলাভাই।”
এই নিয়ে বেঁধে যায় যুদ্ধ। আমি, শান ভাইয়া কে যুক্তি দিচ্ছি শান ভাইয়া আমাকে। মাঝ খানে তনুফ ভাইয়া ফেঁসে গেছে। আমাদের যুদ্ধের মাঝেই ভাবি রোদ্দু কে নিয়ে দরজার সামনে আসে। রোদ্দু কে দেখে শান ভাইয়া বলে,
-“খরা দ্যা রৌদ্রসী চল টাকা বের কর। না হয় আজ ঘরে যেতে দিব না।”
তনুফ ভাইয়া বলে,
-“টাকা আমি দিব বলেছি তাহলে রৌদ্রসীর কাছ থেকে চাইছিস কেনো?”
-“তুমি দিবে কারণ তুমি দুলাভাই। আর রোদ্দু দিবে কারণ রোদ্দু ভাবি।”
তনুফ ভাইয়া হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
-“তোরা কি আমার ভাই-বোন?
আমি জামার হাতা গোটাতে গোটাতে ভাব দেখিয়ে বলি,
-“অবশ্যই! এবং শালা-শালিও।”
অনেক ঝগড়ার পর ভাইয়া টাকা দিয়ে দিলো। সেই টাকা নিয়ে আরেক দফা যুদ্ধ হলো আমার আর শান ভাইয়ার মাঝে। শেষমেশ আমিই পুরো টাকা নিয়ে ঘরে এসে দরজা আটকে দেই। খুব ঘুম পাচ্ছে। জামা পাল্টে বিছানায় এসেই হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরি। ফোনটা হাতে নিতেই দেখি আরাবী মেসেজ। সেখানে লেখা,
-“প্রেয়সী! আর কত দিন এভাবে তুমিহীন দহনে পোড়াবে? আমার নিশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হয়। তুমি আমার থেকে দূরে গেলে বোধ হয় আমি বাঁচব না। নিঃশেষ হয়ে যাব। ফিরে এসো যত দ্রুত সম্ভব। তুমিহীন কেউ বিরহ দহনে পুড়ছে নিরন্তর।”
মেসেজটা কয়েকবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। ফোনটা রেখে আবেশে চোখ বন্ধ করে তলিয়ে পরি ঘুমের দেশে। আরাবী ছোট একটা বার্তা যথেষ্ট আমার দুচোখে প্রশান্তি ছায়া হয়ে নেমে আসার জন্য। কারণ ভালোবেসে ফেলেছি তাকে। অনেকটাই বেশি। কখন? কিভাবে? তা জানা নেই। ভালোবেসেছি আমিও তাও আরাবী কে।
~চলবে…..