শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-৪৯
#আমিনা আফরোজ
দেখতে দেখতে হাওয়ার তোড়ে কেটে গেল দিনগুলো। হেমন্ত ঋতুকে বিদায় জানিয়ে প্রকৃতিতে আগমন ঘটলো শীতের ধূসর বাধ্যক্যের। শুষ্কতা, রুক্ষতা আর দিগন্তবিস্তৃত সুদূর বিষাদের প্রতিমূর্তি সে। শীত মানেই কুয়াশার চাদরে মুড়িয়ে রাখা ক্লান্ত সকাল। শীত মানেই মাধবীলতারা পত্রশূন্য, ঝুমকোলতার রং বিবর্ণ, ঘাসে -ঘাসে ফান্ডুরতা। তবুও এই কুয়াশা ঘেরা শিশির ভেজা পত্রশূন্য প্রকৃতির আছে নিজস্ব স্নিগ্ধতা।
লোকে বলে শীত নাকি বিয়ের মৌসুম। অর্থ্যাৎ হাড় কাঁপানো শীতে নাকি বিয়ের ধুম বেশি পড়ে।শীতের এ আমেজে নতুন রূপে সেজেছে চৌধুরী বাড়িও। চৌধুরী বাড়ির সবাই ব্যস্ত রোদের বিয়ে নিয়ে। তবে আজ সব থেকে ব্যস্ত রশিদ সাহেব। এতদিন পর পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হচ্ছে ওনার ।খুশি না হয়ে উপায় আছে কি? তাইতো সকাল থেকে সবাইকে ব্যস্ত রেখেছে বন্ধুর আপ্যয়নের জন্য। বন্ধুর পছন্দের সব খাবার রান্না করতে বলে বেরিয়ে পড়েন বন্ধুকে নিজ বাড়িতে আনার জন্য। আজ ওনার বড্ড আনন্দের দিন। কত দিন পর দেখা হচ্ছে দুজনের। আচ্ছা আশরাফ কি বদলে গেছে নাকি আগের মতোই আছে?কে জানে ? উনিশ বছর কম তো নয় বদলে গেলেও যেতে পারে?
এদিকে রশিদ সাহেবের মুখে আশরাফ সাহেবের নাম শুনে আবারো পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল মনোয়ারা বেগমের। কত সুখ-দুঃখের স্মৃতিই না ছিল সেসব। আচ্ছা মানুষটা এতদিন পর তাকে দেখে একটুও কি আবেগপ্রবণ হবে নাহলে নাকি আগের মতই অনুভূতিহীন হয়েই সামনে এসে দাঁড়াবে? আচ্ছা আজো কি মানুষের পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারবে? হয়তো পারবে। কেননা মাঝে অনেকগুলো দিন অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে যে। উনিশটা বছর কম তো নয়। এই উনিশ বছরে পরিবর্তন হয়ে গেছে সবকিছু । হয়তো আগের মতো অনুভূতিগুলোও এখন আর কাজ করবে না মানুষটার প্রতি অথবা অনুভূতি কাজ করলেও আগের মতো তা আর দৃষ্টিগোচর হবে না অন্যকারো সামনে। এটাই হয়ত ভূমিতব্ব।
মনোয়ারা বেগমকে চুপ থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন রাবেয়া বেগম। বিয়ের পর মনুকে যখন তিনি কাছে পান তখন মনোয়ারা বেগম ছিল এক পাক্ষিক ভালোবেসে তাকে না পাওয়ায় সেই ভালোবাসায় দগ্ধ হওয়া এক কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী। সেই দিন সেই ছোট্ট ভগ্ন হৃদয়ের মেয়েটাকে আদরে কাছে টেনে নেন তিনি। ধীরে ধীরে মেয়েটি সব ভুলে গেলেও কিছু স্মৃতি আজো মনের আঁকড়ে ধরে রেখেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনোয়ারা বেগমের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে বললেন,
–“ পুরোনো দিনগুলোকে এখনো কেন আঁকড়ে ধরে আছো মনু? ভুলে যাও সেদিনগুলো। নতুন করে আবার শুরু করো তোমার পথচলা।”
রাবেয়া বেগমের কথা শুনে মনোয়ারা বেগম আলতো করে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল,
–“উনিশ বছরে অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারি নি। হয়তো পারবই না ভাবি। লোকটা আমার সবকিছু শেষ করে দিয়েছে ।”
–“তুমি এখনো সেই সব স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছো বলেই এমন মনে হচ্ছে তোমার। একবার সবকিছু ভুলে নতুন করে শুরু করো সবকিছু,দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।”
–” তোমার কথাগুলো মনে রাখব ভাবি। তবে আমার কাছে তাকে ভোলা সহজ নয়। ”
–“মনু তুলির ভবিষ্যতের কথা ভেবো। তোমার কারনে ছোট মেয়েটার ভবিষ্যতটা যেনো নষ্ট না হয়।”
–” ঠিক আছে ভাবি। ”
কথাগুলো বলে রাবেয়া বেগমকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজ ঘরের দিকে চলে গেল। রাবেয়া বেগম মনোয়ারা বেগমের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
–” তোমাকে কিছুটা হলেও চিনি মনু । তুমি যে এতো সহজে আশরাফ ভাইকে ছাড়বে না তা আমি জানি। জানিনা আগামী দিনগুলোতে কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। সবকিছু নিয়তির হাতেই ছেড়ে দিলাম। সময়কে না হয় তার মতোই ছেড়ে দেই হয়তো এতেই সবার মঙ্গল হবে।”
ধীরে ধীরে কুয়াশার আস্তরন ভেদ করে সূর্য আলো ছড়াতে শুরো করেছে। হিমশীতল হাওয়া বইছে ধীরে ধীরে। গাছপালার ডাল-পালা আর পাতা থেকে টুপটাপ ঝড়ে পড়ছে শিশির বিন্দু। চারিদিকে নেই কোন কোলাহল,আর নেই কোন ব্যস্ততা।
রশিদ সাহেব শহরের নিশ্চুপ রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছেন সামনের দিকে। গন্তব্য কমলাপুর রেলস্টেশন। সেইখানেই দাঁড়িয়ে আছে ওনার প্রানপ্রিয় বন্ধু। হঠাৎ করে সেই দিনের ঘটনাটি আবারো চোখে ভেসে ওঠে রশিদ সাহেবের।
সেদিন যখন পরির কথা কলেজ কর্তৃপক্ষ জানতে পেরে আশরাফ সাহেবকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করেছিল সেদিন সন্ধ্যায় রশিদ সাহেবকে আঁকড়ে ধরে কান্নারোদন করে আশরাফ সাহেব বিলাপের সুরে বলছিলেন,
–“আমার পরিকে ওরা অনেক খারাপ কথা বলছে রশিদ। আমি ওদের কথার কোন প্রতিউওর করতে পারছি না। না পারছি ভাই হয়ে বোনকে কলঙ্কের ছাপ থেকে আগলে রাখতে আর না পারছি তোর গায়ে লাগে থাকা মিথ্যা কলঙ্ক মুছতে। আমার মতো অভাগা আর এই দুনিয়ায় কেউ নেই। ”
–“তুই এত সহজে হাল ছেড়ে দিচ্ছিস কেন? একটু ধৈর্য রাখ সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।”
–“যতদিন আমার আর পরির ছায়া তোর জীবনে থাকবে ততদিন পর্যন্ত কিছুই ঠিক হবে না। তাই তোর ভালোর জন্যই আমাদের দূরে যেতেই হবে। ”
–“কি বলছিস এসব? পাগল হয়ে গেলি নাকি?”
–“পাগল হয় নি বরং সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছি আমি। পরিকে নিয়ে আবারো ফিরে যাবো রূপগঞ্জে। তুই মনুকে দেখে রাখিস। তুই তো জানিস মনুকে আমি পরির মতোই বোনের চোখে দেখি। তাই ভাই হয়ে বোনের ক্ষতি দেখতে পারবো না।”
–“কিন্তু……..
–“আর কোন কিন্তু নয়। পরিকে নিয়ে আজ রাতের ট্রেনেই চলে যাবো আমি। তুই রাবেয়া আপাকে নিয়ে ভালো থাকিস। কথা দে পরি বা আমার ঠিকানা কাউকে দিবি না তুই।”
–“তুই সত্যিই আমাকে ফেলে চলে যাবি?”
–“তোদের ফেলে যাচ্ছি না তো। তোর সন্তানের সুখের জন্য যাচ্ছি। যাতে তোর অনাগত সন্তানকে এসব কলঙ্কের কথা শুনতে না হয়।”
–“তাহলে কথা দে আমার শ্রাবনের সাথে পরির মেয়ের বিয়ে দিবি।”
–” ঠিক আছে তাই হবে।”
কথাগুলো বলে সেদিনই রশিদ সাহেবের থেকে বিদায় নিয়ে পরিকে সাথে করে রিক্ত হাতেই বেরিয়ে পড়েন আশরাফ সাহেব। এরপর আর কোনদিন ঢাকামুখো হয় নি ।
–“স্যার কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে গেছি।”
ড্রাইভারের কথা কানে আসতেই সম্ভিত ফিরে পেলেন রশিদ সাহেব। পুরনো স্মৃতিতে চোখে ভেসে উঠতেই দুচোখ আবারো নোনা জলে সিক্ত হয়ে উঠেছে ওনার। চোখের কোনে গড়িয়ে পড়া পানি আলতো করে মুছে ড্রাইভারকে সিক্ত গলায় বলে উঠলো,
–“এখানে গাড়ি থামাও।”
অতঃপর গাড়ি থেকে নেমে রেলস্টেশনের দিকে চলে গেলেন। চেনমাষ্টারের কাছ থেকে জানতে পারলেন রুপগঞ্জ থেকে আগত ট্রেনটি মিনিট দশেকের মাঝেই স্টেশনে এসে থাকবে। অগত্যা ট্রেন আসা অব্দি অপেক্ষা করতে লাগলেন রশিদ সাহেব। প্রায় মিনিট দশেক এর মাথায় ঝিকঝিক শব্দ তুলে ট্রেন এসে থামল কমলাপুর রেলস্টেশনে। হাজার লোকের ভিড়ে রশিদ সাহেবের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল মধ্যবয়স্ক একটি লোকের উপর। লোকটির পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর মাথা ভর্তি আধা পাকা চুল,মুখভর্তি দাড়ি ,গুরুগম্ভীর মুখ আর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমাও রয়েছে মধ্যবয়স্ক লোকটির। সময়ের পরিবর্তনের তুলনায় লোকটির বয়সের দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। সেই আধ-পাকা চুল গুলো নাড়াতে নাড়াতে মধ্যবয়স্ক লোকটি রশিদ সাহেবের সামনে এসে দাড়ালো। তারপর ফিশেল হেসে বলল,
–“কিরে এভাবে হা করে দাড়িয়ে আছিস কেন? চিনতে পারছিস না নাকি? অবশ্য না চেনারই কথা। বুড়ো হয়ে গিয়েছে তো তাই আর আগের মতো নেই।”
লোকটির কথার ফাঁকে তার পাশে এসে দাঁড়াল কালো বোরখা পরিহিত এক নারী আর চৌদ্দ বছরের একটি মিয়ে। বোরকা পরিহিত মহিলাকে কি চিনলেও চৌদ্দ বছরের মেয়েটিকে ঠিক চিনতে পারছেন না রশিদ সাহেব। মেয়েটির দিকে ইশারা করে মধ্যে বয়স্ক লোককে উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
–“এ তোর মেয়ে নাকি রে আশরাফ?”
রফিক সাহেবের কথায় আশরাফ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন,
–“তুই দেখি আগের থেকেও বলদ হয়ে গেছিস রশিদ?”
বন্ধুর বউ আর মেয়ের সামনে বলদ বলাই একটু অস্বস্তিতে পড়লেন রশিদ সাহেব কোনরকমে তোতলাতে তোতলাতে বলে ওঠলেন,
–” এসব কি বলসিস তুই ভাবি আর মামির সামনে। চল বাসায় চল বাদ-বাকি কথা না হয় পরে হবে। বাসায় সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”
–“হ্যাঁ হ্যাঁ চল আমার আর তর সইছে না। কখন যে সন্ধ্যা কে দেখব?”
বন্ধুকে নিয়ে রশিদ সাহেব চলে এলেন চৌধুরী বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকেই হাঁক-ডাক শুরু করে দিলেন তিনি। বন্ধু এসেছে বলে কথা। রশিদ সাহেবের হাক ডাক শুনে সবাই এসে ড্রইংরুমে জোড় হলো। এতদিন পর বাবাকে দেখতে পেয়ে সন্ধ্যা ছুটে চলে গেল ওনাদের কাছে। মেয়েকে কাছে রেখে আসার সাভার আনোয়ারা বেগম আবেগপ্লুত হয়ে পড়লেন। মেয়ের সাথে কিছু কথা বলে আশরাফ সাহেব এগিয়ে গেলেন রাবিয়া বেগম আর আনোয়ারা বেগমের দিকে।
–“কেমন আছেন ভাবী?
–” কেমন আর থাকি ভাইজান। যেমন রেখেছেন তেমনি আছি।”
–” আপনি এভাবে বলছেন কেন ভাবি?”
–“তো কি করবো আপনিই বলুন? সেই যে চলে গেলেন আর ফিরলেন না । আমাদের কি দোষ ছিল বলুনতো ভাইজান ?”
আশরাফ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–” আমাদের কারোরেই দোষ ছিল না ,দোষ ছিল নিয়তির। সে যাই হোক রোদ মা কই? রোদ মাকে তো দেখছিনা ? যার বিয়েতে এলাম তাকে তো আগে দেখি।”
–“আসলে ভাইজান রোদ ওর বান্ধুবীদের সাথে একটু বাহিরে গেছে, কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে আসবে।”
–“ঠিক আছে তাহলে পরে না হয় পরিচয় হয়ে নিবো রোদ মামুনীর সাথে।”
–“ঠিক আছে ভাইজান। আপনারা বরং বিশ্রাম নিন কিছুক্ষণ। অনেকটা পথ এসেছেন। নিশ্চয় ক্লান্ত লাগছে।”
–” না ভাবি আমরা ঠিক আছি। চিন্তা করবেন না। ”
–“আমি বরং ভাবীর সাথে একটু কথা বলে আসি ।সেই কবে থেকে কথা হয় নি ভাবির সাথে।”
–“ঠিক আছে। পরিচয় হয়ে আসুন।”
রাবেয়া বেগম চলে যেতে আশরাফ সাহেবের দৃষ্টি চলে গেল মনোয়ারা বেগমের দিকে। দেখলেন এখনো আগের মতই আছে সেই কলেজ পড়ুয়া মেয়েটি শুধু সময়ের সাথে সাথে চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে মাত্র। আশরাফ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে গুটিগুটি পায়ে মনোয়ারা বেগমের সামনে এসে দাড়ালেন। তারপর মনোয়ারা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন,
–” কেমন আছো মনু?”
মনোয়ারা বেগম এতক্ষণ অব্দি নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু বহু বছর পর মানুষটির কণ্ঠস্বর শুনে নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না তিনি। কম্পিত স্বরে বলে উঠলেন,
–” ভালো আছি মাস্টারমশাই। অনেক ভালো আছি, যতটা আপনি চেয়েছিলেন ।”
–“মনু এখনো ভুলোনি সেসব কথা সেসব কথা?”
–” সেই কথাগুলো কি আদৌ ভোলা যায় মাস্টারমশাই?”
–” মনু……
–” থাক আপনি কি আর কিছু বলতে হবেনা মাস্টারমশাই । সব বুঝি আমি। আপনাকে আমি এত সহজে ছেড়ে দেবো, কখনোই না । আপনি আমাকে যে কষ্ট দিয়েছেন তা কখনো ভুলবো না আমি। আপনি চাইলে আমাদের নিয়তি আজ অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু আপনি তা হতে দেন নি।”
–“এতগুলো বছর আমার প্রতি এতো ঘৃনা নিজের মনে জমে রেখেছো মনু ? ঠিক আছে এবার না হয় সবকিছু মিটমাট করে নিবো। ”
–“দেখা যাবে।”
কথাগুলো বলেই আবারো নিজ ঘরের দিকে চলে গেলেন তিনি। আশরাফ সাহেব তখনো সেদিকেই তাকিয়ে ছিলেন। আশরাফ সাহেবের যখন অন্য মনষ্ক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তখন আনোয়ারা বেগম পাশে এসে দাড়ালেন ওনার। মনোয়ারা বেগমের কথা আগেই শুনেছিলেন স্বামীর মুখে। স্বামীর কাধে হাত রেখে আত্নবিশ্বাসের স্বরে বললেন,
–” মনুকে নিয়ে ভেবো না এবার যখন এসেছি তখন ওর জীবনকে বদলে তবেই যাব। চিন্তা করো না। সব আল্লাহর হাতে ছেড়ে দাও । নিশ্চয় তিনি সবার জন্য মঙ্গলজনক কিছু রেখেছেন।”
–“তাই যেন হয় আনু,তাই যেন হয়।”
ভবিষ্যতের সুন্দর দিনগুলোর কামনায় চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি সদস্য চলে গেলেন নিজ নিজ বরাদ্দকৃত ঘরের দিকে।
আজ শুক্রবার । আজ সেই শুভ দিন। আশরাফ সাহেদের আসার পর কেটে গেছে একদিন। এই একদিনের ব্যবধানে কোন সমস্যা হয় নি চৌধুরী পরিবারের কোন সদস্যের। আর চৌধুরীর বাড়িতে বিয়ের ধুম পড়ে গেছে। বিয়ে উপলক্ষে অনেক লোকের সমাগম ঘটেছে চৌধুরী বাড়িতে ।পুরো বাড়িতে সাজ সাজ রব। ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো চৌধুরী বাড়ি । পুরো বাড়ি লাইটিং করা হয়েছে লাল সোনালী আর নীল রঙের মরিচ বাতিতে। ফুল দিয়ে গেট তৈরি করা হয়েছে বাড়ির সামনে। তারপর সেখান থেকে স্টেজ অব্দি রুপোলী রংয়ের ভালভেটের গেটের কার্পেট বিছানো হয়েছে। যার উপর রয়েছে বিছানা রয়েছে সাদা ও নীল রঙের গোলাপে পাপড়ি । স্টেজটা ঠিক বাগানের একপাশে করা হয়েছে। বাগানের অন্যদিকটাতে গেষ্টদের বসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে শ্রাবনদের বাসার ছাদে।
রোদকে আজ লাল রঙের বেনারসি পড়ানো হয়েছে, সাথে রয়েছে ব্রাইডাল সাজ আর গা ভর্তি ভারি গহনা। ভারি গহনাতে রোদের অসস্তি লাগলেও কাউকে কিছু বলছে না রোদ।
প্রিয়ন্তি আর তুলি দুজনেই ডার্ক পার্পেল রঙের ঘেরওয়ালা লেহেঙ্গা পড়েছে।দুজনের লম্বা চুলগুলোই ছেড়ে দিয়েছে পিঠ বরাবর।
অন্যদিকে ,সন্ধ্যা আজ নীল রঙের শাড়ি পড়েছে। লম্বা চুলগুলো খোঁপা করে খোঁপায় জড়িয়েছে বেশিফুলের গাজরা। মুখে হালকা প্রসাধনীর ছাপ। বিয়ে বাড়ি বলে কথা।
অন্যদিকে ,শ্রাবন আজ ডার্ক ব্লু কালারের কমপ্লিট সুট পরেছে আইস ব্লু রঙের শার্ট দিয়ে। গলায় লাইট ব্লু কালারের ব্লু টিনি টাই। সব মিলিয়ে শ্রাবনকে খুব একটা মন্দ লাগছে না।
হঠাৎ বিয়ে বাড়ির লোক সমাগমের মাঝে শোনা গেল সন্ধ্যার নিখোঁজ হওয়ার খবর। মুহুর্তের মধ্যেই বিয়ে বাড়ীতে নেমে এলো শোকের ছায়া। কান্নার রোল পড়ে গেল সবার মাঝে। বাড়ির প্রতিটি আনাচে-কানাচে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সন্ধ্যাকে কোথাও পাওয়া গেল। সন্ধ্যার নিখোঁজ হওয়ার খবর শুনে দিকবেদিক শূন্য হয়ে আশরাফ সাহেব ইমতিয়াজ খানের সামনে এসে দাড়িয়ে বলতে লাগলেন,
–“এজন্যই এত বছর মেয়েটাকে নিজে আগলে রেখেছিলাম। কিন্তু আজ তুই আমার পরির মত সন্ধ্যাকেও কেড়ে নিলি।”
ইমতিয়াজ খান অবাক হয়ে বললেন,
–“আমি কেন সন্ধ্যাকে কেড়ে নিবো? ”
–“তুই তো এতদিন ওদেরই খুজছিলি। আজ পেয়োও গেছিস। তাই আমার মেয়েটাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলি।”
–” তারমানে সন্ধ্যা আমার মেয়ে।”
কম্পিত স্বরে কথাগুলো বলে নিরবে কান্না করতে লাগলেন তিনি। কি হতভাগা পিতা তিনি নিজের সন্তানকে এত কাছে থেকেও চিনতে পারেন নি তিনি। চৌধুরী বাড়ির সকল সদস্যই চিন্তিত হয়ে ভাবতে লাগলেন সন্ধ্যার অপহরণের বিষয়টি।
এদিকে অন্ধকার একটি ঘরে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় সন্ধ্যা। যতদূর মনে পড়ে শরীর খারাপ লাগার কারনে সন্ধ্যা নিজের ঘরে চলে যায় একটু বিশ্রামের আশায়। তারপর সেখানেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে লুটিয়ে পড়ে বিছানায়। অতঃপর নিজেকে আবিষ্কার করে এই অন্ধকার ঘরে। মাথাটা প্রচন্ড ঝিম ধরে আছে ওর। তারপর নিজেকে বন্দী অবস্থায় দেখে সকল আতঙ্ক যেন ঘিরে ধরল ওকে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে সেই আতঙ্ক জন্য আরো বেড়ে গেলো দ্বিগুণ। ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো পরিচিত একটি মুখ। ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো সন্ধ্যার দিকে।
চলবে
(আজকের পর্ব পড়ে হয়তো অনেকে বকা দিবেন আমায়। তবুও বলবো কেমন লাগলো ঝটকাটা)