শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-৪২

0
1035

শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-৪২
#আমিনা আফরোজ

তখন প্রায় মধ্যরাত । ঘড়িতে হয়ত দুটো বাজে। অর্থাৎ রাতের দ্বিপ্রহর চলছে। চারিদিক শুনশান,নিস্তব্ধ।শুধু মাঝে মাঝে গাড়ির তীক্ষ্ণ শব্দ ভেসে আসছে দূর সীমান্ত থেকে। এই চাঁদনী রাতকে সাক্ষী রেখেই তখন একজোড়া কপোত- কপোতি পাড়ি জমিয়েছে নিজেদের স্বপ্নের রাজ্যে। দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দে তখন ভারী হয়ে উঠেছে বদ্ধ ঘরের চারপাশ। বাহিরে তখন মৃদু হাওয়া বইছে। কপোত -কপোতির মধুর মিলনে সাক্ষী হতে পেরে আকাশের পূর্নিমার চাঁদটাও যেন লজ্জায় মেঘের আড়ালে মুখ লুকাচ্ছে বারংবার।

সময় চলছে তার আপন খেয়ালে। আর কিছু সময় গড়ালেই উদয় হবে নতুন সূর্যের।শুরু হবে আরো একটি নতুন দিন আর জীবন থেকে হারিয়ে যাবে স্মৃতিঘেরা একটি দিনে, ধুলো পড়া ডায়েরির মতো সেও হারিয়ে যাবে অতিতের অতল গহ্বরে।এই চাঁদনী রাতে কেউ বা তার প্রেয়সিকে নিয়ে হারিয়ে যায় স্বপ্নের রাজ্যে আবার কেউবা দীর্ঘরাত টুকু কাটিয়ে দেয় নিঃসঙ্গতায়।

রাতের এই দ্বিপ্রহরে নেহাল বেলকুনির একপাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। নেহার সাথে কথা শেষ করে তখন বাসায় চলে আসে নেহাল। রাতে খাবারের পর বাবা-মাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে ও । উদ্দেশ্য রোদের বিষয় নিয়ে কথা বলা। তবে বিয়ের কথাটা আপাতত বলবে না নেহাল। এখন ওর চিন্তা হচ্ছে সন্ধ্যাকে নিয়ে। ওর বাবা যদি সন্ধ্যা দেখে ফেলে তবে কিছুতেই এই বিয়ে হতে দেবেন না তিনি।

নেহালের বিপরীতে বসে আছেন সামাদ মিয়া ও জমিলা বেগম। এখানে আসার পর থেকে তিনি নেহালকে পর্যবেক্ষন করে চলেছেন। নেহালের মাঝে অনেক পরিবর্তন ও দৃষ্টিগোচর হয়েছে ওনার। তবে ছেলেকে নিয়ে যথেষ্ট ভাবনায় আছেন তিনি। ছেলের মনে যে কি চলছে তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না সামাদ মিয়া। ছেলে কি তবে সন্ধ্যাকে খুঁজে পেয়েছে? নাকি অন্য কোন কারণে ডেকে পাঠিয়েছে ওনাদের? সামাদ মিয়ার মনে হাজারো প্রশ্নেরা এসে ভিড় জমিয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। কিন্তু এখন অব্দি উত্তর খুঁজে পান নি তিনি। তবে আশায় আছেন‌ ছেলের কাছ থেকে উত্তর পাবার । হয়তো তিনি নিরাশ হবেন না।

ড্রইংরুমে এই মুহূর্তে পিনপতন নীরবতা চলছে। নীরবতার কারণে সকলের নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যাচ্ছে । নিরবতার রেশ কাটিয়ে নেহাল নিজেই বলে উঠলো,

–” বাবা আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল আমার?”

নেহালের কথা শুনে সামাদ নিয়ে মুখ তুলে তাকালেন ছেলের দিকে। তারপর মুচকি হেসে বললেন,

–” কি কথা আব্বা? কইয়া ফালান ।”

নেহাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ,

–“বাবা রোদ নামের একটি মেয়েকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, ওকে বিয়ে করতে চাই আমি । সে কারনেই আপনাদের গ্রাম থেকে ডেকে আনা।”

নেহালের মুখে সন্ধ্যার পরিবর্তে অন্য মেয়ের নাম শুনেই ভ্রু কুঁচকে গেল সামাদ মিয়া ও জমিলা বেগম উভয়ের। তবে কি সন্ধ্যার দিক থেকে মন সরে গিয়েছে নেহালের নাকি এই বিয়ের পিছনে অন্য কোন কারন আছে?ছেলেকে খুব ভালোভাবেই চিনেন তিনি।এমনিতেই তো কোন কাজ করে না নেহাল তার পিছনে কোন না কোন স্বার্থ অবশ্যই থাকে‌। কথাগুলো ভেবে সামাদ মিয়া গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,

–” মাইয়া কি করে আব্বা আর মাইয়ার বাপ- মাই বা কি করে?”

বাবার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকালো নেহাল তারপর বলতে লাগলো,

–” রোদ আমার কলেজে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। খুব শান্তশিষ্ট একটি মেয়ে। আমি চচ্ছি খুব দ্রুতই ওর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে।”

সামাদ মিয়া বলে উঠলেন,

–” ম্যাইয়া ভালো তো আব্বা? সব খোঁজখবর নিয়েছেন?”

–” রোদ খুব শান্তশিষ্ট ,ভদ্র মেয়ে।”

–” তারপরেও আমি নিজে থেকে কিছু জানবার চাই। আমার কত আদরের সন্তান আপনি তা তো জানেনেই। ”

ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল নেহাল। ওর বাবা যে এত সহজে রাজী হবেন না এটা আগেই বুঝতে পেরেছিল ও। তবুও শেষ চেষ্টা করতে ক্ষতি কি?

–” বাবা আমি বলছি তো রোদ মেয়ে হিসেবে নিঃসন্দেহে ভালো । আপনি শুধু মেয়ের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবেন। তখন না হয় রোদকে দেখে নিবেন।”

নেহালের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সামাদ মিয়া। নেহালের জেদ সম্পর্কে অবগত তিনি। ছেলে যখন বলেছে বিয়ে করবে তখন রোদ নামের মেয়েটিকে বিয়ে করেই ছাড়বে।কারো কথা শুনবে না।এমনকি স্বয়ং মেয়ের বাবার কথাও না। তাই আর কথা না বাড়িয়ে বললেন,

–” কবে যাওন লাগবো ?”

–“বাবা দিন দুয়েকের মধ্যে গেলে ভালো হয়।”

–” আপনি যহন বিয়ে করবেন ক ষইছেন তহন আর না করি কেমনে? আমি আর আপনার মা দুজনে মিলে মাইয়া দেখতে যামু নে ২ দিন পর।”

–” বাবা আরো একটা কথা বলার ছিল।”

–” কি কথা আব্বা ?”

–“বাবা আমি এই সপ্তাহের মধ্যেই বিয়েটা সেরে ফেলতে চাই।”

–” এত তাড়াহুড়ো করতাছেন ক্যান আব্বা ?”

–“আসলে বাবা আমি দেরি করতে চাইনা।”

–” ঠিক আছে আপনি যা ভালো বুঝবেন তাই হবে।”

এতক্ষণ বাপ ছেলের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন জমিলা বেগম । ঘুমে ওনার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।রাত তো আর কম হয় নি কিন্তু বাপ-ছেলের কথার ঝুড়ি যেন আজ ফুরোতেই চাচ্ছে না, তাই জমিলা বেগমেরকেও বাধ্য হয়ে এখানে বসে থাকতে হচ্ছে।তারপর হাই তুলতে তুলতে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

–” আমি কিন্তু চাঁন্দের লাহান মাইয়া নিমু বাবু। মাইয়া যদি চান্দের লাহান সুন্দর না হয় তাহলে কিন্তু এই বিয়ে হইব না কইয়া রাখলাম।”

নেহাল মায়ের এমন ছেলে-মানুষি কথা শুনে মুচকি হেসে বলল,

–” ভয় নেই মা । মেয়ে তোমার মন মতই হবে, এ নিয়ে কোন চিন্তা করো না তুমি।”

ছেলের কথা শুনে জমিলা বেগম খুশি হয়ে ঝিমুতে ঝিমুতেই বলে ওঠলেন,

–” তাহলে তো হয়েই গেল । আমার খুব শখ আছিল বাবু, তোর বউ চান্দের লাহান হইব আর আমি রাত-দিন হের মুখের দিকে তাকাইয়া থাকুম।”

সামাদ মিয়া জমিলা বেগমের কথা শুনে ধমক দিয়ে বললেন ,

–“রাত -বিরাতে কি শুরু করেছো তুমি? চলো ঘুমাতে চলো।”

হঠাৎ স্বামীর এমন রেগে যাওয়ার কারন বুঝলেন না জমিলা বেগম। বেশ কিছুক্ষণ বোকার মত স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর স্বামীর ইশারা পেতেই ষষ্ট ইন্দ্রিয় জাগ্রত হলো ওনার । তাই চটজলদি নেহালের থেকে বিদায় নিয়ে তাদের নির্ধারিত ঘরের দিকে চলে গেলেন। নিজেদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে হবে যে।

এদিকে বাবা-মা চলে যেতেই নেহালও চলে এলো ওর নিজের ঘরে । তারপর বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট জ্বালালো ও। সিগারেটের সাদা ধোঁয়া ওপরের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টিতে। নেহার কথাগুলো শোনার পর থেকেই আবারও নিজের মধ্যে দ্বিধা চলে এসেছে ওর। নিহাল কিছুতেই বুঝতে পারছে না কি করবে ও? রোদ কে বিয়ে করবে নাকি নেহার কথামতো সন্ধ্যা কে বেছে নিবে? সন্ধ্যার কথা মনে হতেই নিজের মধ্যে প্রতিহিংশা জেগে ওঠে নেহালের মনে। তাহলে কি শেষ অব্দি সন্ধ্যাকেই বেছে নেবে নেহাল?

ভোরে আজানের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় সন্ধ্যার। ঘুম ভাঙ্গার পর নিজেকে শ্রাবনের বাহুডোরে দেখে লজ্জা
পেল সন্ধ্যা। নিজেকে শ্রাবণের বাহুডোর থেকে ছাড়িয়ে ওঠে বসল ও। শ্রাবন তখনো ঘুমে বিভোর হয়ে রয়েছে। এলোমেলো চুলে বেশ সুন্দর লাগছে শ্রাবনকে। সন্ধ্যা শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।ছেলেটা কি সুন্দর করে ছোট বাচ্চাদের মতো ঘুমাচ্ছে। সন্ধ্যা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল শ্রাবণের দিকে। তারপর আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল শ্রাবনের কপালে। সন্ধ্যার উষ্ণ স্পর্শে শ্রাবণের ঘুম কিছুটা হালকা হলো।আধখোলা চোখে বলল,

–” এত ভোরে ওঠে কি করছো মায়াবতী? এসো ঘুমিয়ে পড়।”

শ্রাবনের ঘুম ঘুম কন্ঠ শুনে শ্রাবনের দিকে আর একটু ঝুঁকে এলো সন্ধ্যা। তারপর শ্রাবণের কানে ফিসফিস করে বলল,

–“এক সুদর্শন পুরুষকে দেখছি।”

সন্ধ্যার কথা শুনে শ্রাবণ হেসে বলল,

–” তা সুদর্শন পুরুষকে দেখা হয়েছে আপনার?”

–” না তো। তাকে দেখার তৃষ্ণা তো আমার মিটছেই না। কি করি বলুন তো?”

–“চলুন তাহলে আপনার তৃষ্ণা মিটাবার ব্যবস্থা করি।”

শ্রাবণ কথাটা বলেই সন্ধ্যাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিল। সন্ধ্যার চুলে মুখ ডুবাতেই সন্ধ্যা শ্রাবনের বাহুবন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে উঠল,

–“অনেক হয়েছে। চলুন ফ্রেশ হয়ে দুজনে একসাথে নামায পড়বো।”

শ্রাবণ ঘুম ঘুম চোখে বলল,

–“আজ না পড়লে হয় না?”

শ্রাবনের কথা শুনে সন্ধ্যা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

–“না হয় না।আমি আপনাকে নিয়ে জান্নাতে জেতে চাই। তাই জলদি ওঠুন। সময় বেশি নেই।”

অগত্যা শ্রাবন আরামের ঘুম ত্যাগ করে সন্ধ্যার পিছু পিছু ফ্রেশ হতে ছুটলো। এই আরাম ত্যাগ করে যদি পরকালে সন্ধ্যার সাথে জান্নাতে যেতে পারে তবে তাই হোক। দিনেটা না হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি দিয়েই শুরু হোক।

চলবে

(আসসালামু আলাইকুম। আপনারাও আপনাদের দিনের শুরু আল্লাহর নামেই করবেন। এইটা আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ রইল। আজকে পর্ব কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। যারা নীরব পাঠক আছেন তারা দয়া করে সাড়া দিবেন। ভালো থাকবেন সবাই। আল্লাহ হাফেজ। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here