শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-৩৩
#আমিনা আফরোজ
গ্রামের আঁকা-বাঁকা মেঠো পথে হেঁটে চলেছে আশরাফ সাহেব আর মিন্টু। পথের দু’পাশে পাঁকা ধানের মাঠ। কেউবা হলুদ রঙের ধান কাটতে ব্যস্ত আবার কেউবা ব্যস্ত ধান বাঁগের দু’পাশে বেঁধে বাড়িতে ফেরার। এখন গ্রামে গ্রামে নতুন ফসল ঘরে তোলার ধুম পড়েছে। এই ধান রোদে শুকিয়ে গৃহস্থালির গোলায় তোলা হবে। তারপর সেই চাল দিয়ে করা হবে পিঠা-পুলির আয়োজন।
প্রায় মিনিট পনেরো হাঁটার পর মিন্টু আর আশরাফ সাহেব এসে পৌঁছল চেয়ারম্যান সামাদ মিয়ার বাড়ির দোর গোড়ায়। উঠানে কাঠের চেয়ার পেতে চেয়ারম্যান সামাদ মিয়াকে বসে থাকতে দেখতে পেল আশরাফ সাহেব। লোকটা একমনে হুকো টানতে ব্যস্ত তখন। আর মাঝে মাঝেই হুকোর ধোঁয়া উড়িয়ে দিচ্ছে আকাশের পানে।
মিন্টু আর আশরাফ সাহেব ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। মিন্টুই প্রথমে একটু জোরে কেশে সামাদ মিয়ার আকর্ষন তাদের দিকে ঘুরানোর চেষ্টা করল। মিন্টুর কাশির শব্দে সামাদ মিয়া ওদের দিকে ঘুরে তাকালেন। সামাদ ঘুরে তাকাতেই মিন্টু ওর পান খাওয়া লাল দাঁতে হেসে বলে ওঠল,
–“চেয়ারম্যান সাব এই যে হামাগোর মাষ্টার মশাইরে ধইরা নিয়ে আনছি।”
–“হু ভালা করছোস । এহন আর একখান কাম কর দেখিনি।”
–“কি করতে হইব কন?”
–” মাষ্টার মশাইয়ের জন্য একখান চেয়ারের ব্যবস্থা কর তো দেখি।”
মিন্টু আবার হেসে দিয়ে বলল,
–” এইডা তো হামার বাঁ হাতের কাম। হামি এমনি কইরা দিতাছি।”
মিন্টু সামাদ মিয়ার কথা অনুসারে অন্দরমহলে চলে গেল। মিনিট দুয়েকের মাথায় একটা কাঠের চেয়ার হাতে নিয়ে ফিরলো ও । চেয়ারটা আশরাফ সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–” এইহানে বসেন মাস্টারমশাই।”
আশরাফ সাহেব মিন্টুর দেওয়া চেয়ার টেনে চেয়ারম্যান সামাদ মিয়ার সামনে বসলেন। সামাদ মিয়া ইশারায় মিন্টু কে চলে যেতে বললেন। তাদের কথপকথনে মিন্টু থাকুক এইটা তিনি চান না। চেয়ারম্যানের ইশারা বুঝতে পেরে সেখান থেকে চলে গেল মিন্টু। তবে মনে মনে সামাদ মিয়াকে বিশ্রী গালি দিতে ভুলল না ও । এই লোকটাকে ও কিছুতেই সহ্য করতে পারে না কিন্তু ক্ষমতার দাপটের কারণে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না ও। ঘরে রেখে আসা ছেলে-মেয়ে নিয়ে আর বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এমন খারাপ লোকের সাথে পড়ে আছে ও । তা নাহলে কবেই এমন লোকের সঙ্গ ছেড়ে দিত ও। মিন্টু চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে বের হয়ে ধীর পায়ে বাজারের দিকে চলে গেল।
এদিকে আশরাফ সাহেব বসে বসে বারংবার চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। চেয়ারম্যান সামাদ মিয়ার বসতবাড়িতে বেশ বড়ই । বাড়ির বাম কোনে রয়েছে কল পাড়। তবে কল পাড় টিনের বেড়া দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত স্ত্রীলোকের গোসলের জন্য এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদিও চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে কেউ খুব একটা আসে না। এদিকে আসায় চেয়ারম্যান সাহেবের কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই চেয়ারম্যানের কঠোর নিষেধাজ্ঞা অনুসারেই সবাই বাগানবাড়িতে চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে দেখা করতে যায়। ফুটবলের ডানদিকে গেটের সংলগ্ন রয়েছে একটি হাসনাহেনা ফুলের গাছ সন্ধ্যা গড়ালেই এ ফুলের মিষ্টি সুবাসে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে চারিপাশ আশেপাশে দেখা শেষ করে আশরাফ সাহেব এবার চেয়ারম্যানের দিকে তাকালেন আবার। কিন্তু সামাদ নিয়ে তখনও নিশ্চুপ। ধূর্ত এই লোকটা কিযে ভেবে চলেছে তা ঠিক বুঝতে পারছেন না আশরাফ সাহেব। নীরবতার রেশ কাটিয়ে আশরাফ সাহেব বললেন,
–“হামাক ক্যান ডাকছিলেন কইলেন না তো?”
সমাজ নিয়ে আশরাফ সাহেবের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,
–” সব কমু আপনারে তয় এতো উতলা হইতাছেন কিয়ের লায়?”
–“আসলে আমার স্কুলে যাইতে হইবো তো তাই …..
আশরাফ সাহেব কে আর কথা বলতে না দিয়ে সামাদ নিয়ে নিজেই বলে উঠলেন,
–“ও আমার তো মনে আছিল না। তাহলে হুনেন আমি আপনার লগে সব মিটমাট করনের লাইগা ডাকছি।”
–“ঠিক বুঝবার পারলাম না আপনার কথা?”
–“হামি কইতে চাচ্ছিলাম যে , আগের সব কথা আমরা ভুইলা যাই । তখন মাথা ঠিক আসিলো না আমার । তাই রাগের মাথায় কি থাইকা কি কইছি বুঝবার পারি নাই। তয় এহন মনে হইতাছে কামডা ঠিক করি নাই হামি।”
সামাদ মিয়ার কথা শুনে আশরাফ সাহেবের চিন্তা দ্বিগুন বেড়ে গেল। বড় সাংঘাতিক লোক এই সামাদ মিয়া। যে লোক খুনখারাপি আর ভয় দেখিয়ে চেয়ারম্যানের পদ নিতে পারে সে নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য সবকিছুই করতে পারে । নিশ্চয় এমন কোন বুদ্ধি এঁটেছে যার ফলাফল খুব ভয়ানক । কি করে এমন হিংস্র লোকের পরিকল্পনার কথা জানবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। মেয়ের জীবনে আবার কোনো নতুন ঝড় আসতে চলেছে নাতো? না আর কিছু ভাবতে পারছেন না তিনি।
এদিকে আশরাফ সাহেবকে চুপ করে থাকতে দেখে সমাজ নিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল,
–“কি হইলো মাস্টারমশাই? এমন কি চিন্তা করবার লাগছেন?”
যে করেই হোক রফিককে সতর্ক করতে হবে কিন্তু এই লোকের কাছে কিছুতেই ধরা পড়া যাবে না। সামাদ মিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
–“ঠিক আছে চেয়ারম্যান সাব । আপনি যা কইবেন তাই হইব । আপনি যহন আগের সব কিছু ভুলে যাইবার যাইতাছেন তখন আর কি কওনের আছে আমার। আমি তাহলে আজ আসি, আমার আবার স্কুলে যাওন লাগব।”
–“ঠিক আছে মাস্টারমশাই এখন তাহলে চইলা যান। পরে আবার কথা কমু নি।”
চেয়ারম্যান সামাদ মিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আশরাফ সাহেব আবারো নিজের বাড়ির পথের দিকে চলে গেলেন।
এদিকে রোদ, তুলি আর প্রিয়ন্তী তিনজনে একসাথে নিরিবিলি রাস্তায় হেঁটে চলেছে । রোদ এখনো চুপচাপ হয়ে রয়েছে। ফুপির কথাগুলো খুব একটা মনের না লাগলেও ভাইয়ের কথাগুলো এখনো কানে বাজছে ওর । সত্যিই কি ভাইয়া ওকে শাস্তি দিবে ? রোদের কেন যেন এখন মনে হচ্ছে সেদিনে পাগলামি করাটা ঠিক হয় নি। পাগলামি না করলে আজ হয়তো এমন পরিস্থিতি হত না কিন্তু এখন এসব ভেবে কি লাভ? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। আজ কলেজে গিয়ে সর্বপ্রথম নেহালের সাথে কথা বলতে হবে এনিয়ে। কিছুতেই সত্য ঘটনা সবার সামনে আসতে দেওয়া যাবে না। রোদকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রিয়ন্তী বলল,
–“কি এত ভাবছিস রোদ?”
প্রিয়ন্তীর কথা শুনে বলল,
–“ভাইয়ার কথাগুলো ভাবছি । প্রিয়ন্তি আমি ছোট বেলা থেকে আজ অব্দি ভাইয়াকে এত রেগে যেতে কখনো দেখি নি।”
–“আমিও তাই ভাবছি ভাইয়া আজকে এতটা রেগে গেল কেন? আমার না তোকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে?”
–“চিন্তা তো আমার নিজেরও লাগছে কিন্তু কি করব বুঝতে পারছি না?”
–“এ বিষয়ে স্যারের সাথে কথা বললেই তো পারিস?”
–“সেটাই ভাবছি এ ছাড়া তো আর কোন পথ খুঁজে পাচ্ছি না।”
প্রিয়ন্তী আর রোদের কথার মাঝখানে এবার তুলি মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
–“আমার তোমাদের দুজনের সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”
তুলির কথায় রোদ আর প্রিয়ন্তী দুজনে একসাথে তুলির দিকে তাকালো । কৌতুহলী দৃষ্টিতে রোদ বলল,
–“কি কথা?”
রোদের কথা শুনে তুলি আরো যেন নার্ভাস হয়ে গেল। মায়ের পরিকল্পনার বিষয়ে কি বলাটা ঠিক হবে ? রোদ ই বা তুলিকে কি ভাববে? আর কেমন ভাবেই বা নিবে বিষয়টা? কিন্তু পরিস্থিতি এমন দিকে চলে যাচ্ছে এখন যদি কিছু না বলা হয় তাহলে পরে হয়ত এই নিয়ে খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। দোটানা শেষ করে তুলি আর প্রিয়ন্তী সব সত্যি কথা বলার জন্য মনস্থির করল তুলি। তারপর কোন ভনিতা ছাড়াই বলতে লাগলো,
–“কথাটা হয়তো আরো আগে তোমাদের জানানো উচিত ছিল আমার। তখন ভেবেছিলাম বিষয়টা আমি নিজেই সামলে নিতে পারব কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পরিস্থিতিতে আমার হাতে মধ্যে আর নেই তাই কোনো অঘটন ঘটার আগেই তোমাদের জানাতে চাচ্ছি।
–“কি এমন কথা আছে যে আমাদের বলিস নি তুই?”
–“রোদ আপু তুমি কি জানো মা শ্রাবণ ভাইয়ের সাথে আমাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে?”
রোদ অবাক হয়ে বলল,
–” তা কি করে সম্ভব? ভাইয়ার বিয়ে হয়ে গেছে।”
তুলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–“মায়ের এই ইচ্ছা এখন থেকে নয় বহু আগে থেকেই। আমার ছোটবেলা থেকে মায়ের ইচ্ছা ছিল তার একমাত্র মেয়েকে তিনি তার ভাইয়ের ছেলের সাথে বিয়ে দিবেন। এতে করে সারা জীবন অন্তত মেয়েটাকে সুখে দেখতে পারবেন তিনি। ছোট থাকতে তো এসব বুঝি নি কিন্তু সেদিন তোমাদের বাড়িতে আসার পর শ্রাবণ ভাইয়ের বিয়ের কথা শুনে মায়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সে রাতে ঘুমাতে পারেননি তিনি । দুশ্চিন্তায় সারারাত কাটিয়ে দিয়েছেন। তারপর সকালে উঠে আমাকে বলল যে করেই হোক শ্রাবণের সাথে তিনি আমাকে বিয়ে দিবেন । এই নিয়ে মায়ের সাথে কয়েক দফা কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে আমার কিন্তু কোন লাভ হয় নি। মা তার কথায় অনড়। তিনি কিছুতেই হার মানার পাত্রী নন। তাই মা এখন যাচ্ছে সন্ধ্যা ভাবিকে যে ভাবেই হোক শ্রাবণ ভাইয়ের জীবন থেকে সরিয়ে আমাকে ভাইয়ের জীবনের সাথে জড়িয়ে দিতে কিন্তু বিশ্বাস করো আমি নিজেও চাইনা শ্রাবণ ভাইয়ের জীবনে জড়াতে। আমি ছোটবেলা থেকে শ্রাবন ভাইকে নিজের ভাই হিসেবে জেনে এসেছি । কখনো মামাতো ভাই হিসেবে দেখি নি এখন কি করে আমি শ্রাবণ ভাইয়াকে মুখ দেখাবো বলতে পারো?”
তুলির কথা শুনে রোজ আর প্রিয়ন্তী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। ফুপি এসব মাথায় এনেছে তা বুঝতেই পারে নি ওরা। কিন্তু সব জেনেশুনে তো আর বসে থাকা যায় না কিন্তু কিছু একটা করতেই হবে, তা না হলে ওর ভাইয়ের গোছানো জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাবে। আর এমনটা কিছুতেই হতে দিতে পারেনা রোদ। সত্যিই কি সবকিছু সামলিয়ে নিতে পারবে রোদ? নাকি সবটা এলোমেলো হয়ে যাবে নিমিষেই?
চলবে
(আসসালামু আলাইকুম।কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। প্রথমেই আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।গল্প সেহরির পরে দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু সেহেরি খেয়ে নামাজ পড়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই তখন গল্প দিতে পারি নি। এজন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।আর রোজার সময় কোরআন পড়ে গল্প লেখা আমার জন্য কষ্টকর হয়ে যায়।তাই এখন থেকে কয়েকদিন পর পর গল্প দিব। তবে ঈদের পর আবার নিয়মিত গল্প পাবেন ইনশাআল্লাহ।আশা করি আমার দিকটা আপনারা বুঝবেন। ভালো থাকবেন।)