শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-৩২

0
1110

শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-৩২
#আমিনা আফরোজ

সকালের সোনালী রোদের আলোর ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেল রোদের। সারারাত আকাশ- কুসুম ভাবনা চিন্তা করে শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছে ও। কিন্তু রাতে ঘুম না হওয়ায় চোখ জ্বালা করছে ওর। মাথা একপাশটাও খুব যন্ত্রণা করছে ওর । আধো ঘুমের ঘোরে পাশে তাকিয়ে দেখল বিছানা পুরোটাই খালি। ও একাই ঘুমিয়ে আছে সেখানে। প্রিয়ন্তি বা তুলির কোন চিহ্ন নেই হয়তো অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে গেছে ওরা।রোদ একবার ভাবলো আজ আর কলেজ যাবে না ও।এমনিতেই গতকালের ঘটনা নিয়ে এখনো চিন্তায় আছে ও তার ওপর আজ ওর শরীরটাও খুব একটা ভালো না। কিন্তু পরক্ষনেই নেহালের দেওয়া মেসেজের কথা মনে হতেই দ্রুত ওঠে বসল ও। নেহালের ওপর মোটেও ভরসা নেই রোদের। নেহাল যে কখন কি করবে তা বলা যায় না। এর থেকে কলেজ যাওয়া অনেক ভালো। মনে মনে কথাগুলো ভেবে বিছানা গুছিয়ে দ্রুত ফ্রেশ হতে চলে গেল রোদ।

সকালের নাস্তা টেবিলে সাজিয়ে সকলকে খাওয়ার জন্য ডেকে পাঠালো সন্ধ্যা। সব রান্না আজ ও একা হাতে করেছে। গ্রামের মেয়ে বলে ছোটবেলা থেকে রান্না থেকে শুরু করে সংসারের অন্যান্য কাজে বেশ পারদর্শী ও । তাই রান্না করতে কোন সমস্যায় পড়তে হয় নি সন্ধ্যাকে। সন্ধ্যার ডেকে পাঠানোর কিছুক্ষণের মাঝেই চলে এলো সবাই। প্রতিদিনের মতোই যে যার নির্ধারিত চেয়ারেই বসে পড়ল। চুপচাপ হয়ে বসে আছে সবাই। প্রতিদিনের মতো কারো মুখে আজ নেই কোন আনন্দ আর নেই কোন হাসি। খাবার টেবিলে নিত্যদিনের খুনশুটিগুলো হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। তার পরিবর্তে রেখে গেছে একরাশ নিরবতা।

খাবার টেবিলে নিরবতার প্রহর চলছে। যে যার মতো চুপচাপ খাচ্ছে। রোদ ,প্রিয়ন্তি আর তুলি কলেজে যাবে বলে একেবারে কলেজ ড্রেস পড়েই নিচে এসেছে। তুলি, রোদ আর প্রিয়ন্তি একসাথেই বসেছে। মনোয়ারা বেগম ও তুলির পাশে এসে বসলেন। মেয়েকে কলেজ ড্রেসে দেখেই শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বললেন,

–” তুই অফিসে যাচ্ছিস নাকি শ্রাবণ?”

ফুপির কথা শুনে মুখ তুলে তাকালো শ্রাবণ। এতক্ষণ গতকালের ঘটনাগুলো ভাবছিল ও।রোদের ভবিষ্যত জীবন নিয়ে বেশ চিন্তিত ও। বোনকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল ওর কিন্তু অজানা এক ঝড়ে সব ভেঙ্গে গেল। ছেলেটার সম্পর্কে যত দ্রুত সম্ভব সবকিছু জানতে হবে ওকে। ফুপি কথা বলাতেই শ্রাবণের ভাবনার সমাপ্তি ঘটে। ফুপিকে শান্ত স্বরে বলল,

–” হ্যাঁ ফুপি অফিসে যাব। কেন বলো তো? তোমার কি কিছু লাগবে? লাগলে বলো আমি কিনে এনে দিব।”

শ্রাবণের কথা শুনে মনোয়ারা বেগম মুচকি হাসলেন । কোনভাবে তুলিকে শ্রাবণের সাথে বিয়ে দিতে পারলেই বেঁচে যান তিনি । এরপর নিশ্চিন্তে বাকি জীবন কাটাতে পারবেন । কিন্তু মেয়ের একটা গতি না হওয়া অব্দি কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছেন না তিনি। তুলিকে যে করেই হোক শ্রাবণের কাছাকাছি রাখতে হবে, এতে করে শ্রাবণ সন্ধ্যার থেকে কিছুটা হলেও দূরে থাকবে। এসব কথা ভেবেই মনোয়ারা বেগম হেসে বললেন,

–“আমার কিছু লাগবেনা রে। তবে তুই তো অফিসেই যাচ্ছিস তাই তুই যদি তুলিকে ওর কলেজে ড্রপ করে দিস তবে খুব ভালো হয়।”

তুলি মায়ের এমন কথা শুনে বেশ বিরক্ত হচ্ছে। ওর মা যে ওকে শ্রাবণের সাথে আবারো বিয়ে দিতে চায় এই কথা জানে তুলি। তবে এ বিষয়ে অনেকবার মাকে বুঝিয়েছে ও কিন্তু কোন লাভ হয় নি বরং মাকে বোঝাতে গিয়ে আরো বেশি কথা শুনতে হয়েছে ওকে। তবে মনে মনে তুলি ভাবছে এবার একটা বিহিত করতেই হবে ওকে।

ফুপির আবদার শুনে হতাশ হল শ্রাবণ। ভেবেছিল আজ নেহালের সম্পর্কে খোঁজ নিবে ও । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজগুলো করতে হবে ওকে । বোনকে নিয়ে আর কোন রকম রিস্ক নিতে চায় না ও । তাছাড়া গতকালের ঘটনাটার বিষয়েও খোঁজ নিতে হবে ওকে। মনটা কেন জানি ওর বারবার কু ডাকছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এসব কাজ আজ আর হয়ে উঠবে না । তবুও একবার শেষ চেষ্টা করতে ক্ষতি কি?

শ্রাবণ গম্ভীর স্বরে ফুপুর দিকে তাকিয়ে বলল,

–“আজ আমার হাতে খুব একটা সময় নেই ফুপি । তুলি বরং রোদ আর প্রিয়ন্তীর সাথেই কলেজ যাক।”

মনোয়ারা বেগম এতক্ষণ বেশ খুশি ছিলেন কিন্তু শ্রাবণের কথা শুনে ওনার মুখ আবারো মলিন হয়ে গেল তিনি ভেবেছিলেন শ্রাবণ হয়তো ওনার কথা রাখবে এদিকে পপিকে মন খারাপ করতে দেখে রোদ বলে উঠলো,

–“তুমি কোন চিন্তা করো না ফুপি। আমি আর প্রিয়ন্তী আছিতো, দেখবে তুমি কোন অসুবিধা হবে না।”

মনোয়ারা বেগম এমনিতেই সন্ধ্যার ওপর চোটে ছিলেন তার ওপর রোদের কথা শুনে ওনার রাগটা যেন দ্বিগুন বেড়ে গেল । রাগে ওনার মুখের গাম্ভীর্যতা যেন বেড়ে গেল আরো দ্বিগুন। মনোয়ারা বেগম রোদের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বললেন,

–“তোর সাথে তুলিকে পাঠিয়ে দিয়ে আবারো গতকালের মত ঘটনা ঘটানোর ব্যবস্থা করি তাই না ? তোর সাথে তুলিকে কিছুতেই আমি মিশতে দেবো না। নিজে তো উড়নচণ্ডী হয়েছিস এখন আবার আমার মেয়েটার মাথা খাচ্ছিস। কি ভেবেছিস কিছু বুঝিনা আমি?”

মায়ের এমন কথা শুনে তুলি বিরক্ত হয়ে বলল,

–“মা তুমি কি একটু থামবে এখন? কখন থেকে কি সব আজেবাজে কথা বলেই যাচ্ছ আর গতকাল ঘটনায় রোদ আপুরই বা কি দোষ বল তো?”

মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে আরো রেগে যান মনোয়ারা বেগম । এই মেয়ের জন্য তিনি কত কিছুই না করছেন অথচ তার মেয়েই কি না ওনাকে কথা শোনাচ্ছে? রাগে কিড়মিড় করে বললেন,

–“তুই চুপ থাক তোকে এত কথা বলতে বলেছি আমি ? বেশি কথা বলবি তো থাপড়াইয়া সব দাঁত ফেলে দিবো বেয়াদব মেয়ে। খুব বড় হয়ে গেছ যে এখনি মায়ের মুখে মুখে কথা বলছো?আর রইল রোদের কথা রোদ অতটাও ধোয়া তুলসী পাতা নয় যতটা ওকে আমরা ভাবি। আমি শতভাগ নিশ্চিত গতকালের ঘটনা রোদের নিজ ইচ্ছায় ঘটেছে । তারপর বাসায় এসে নিজের প্রেমিককে দিয়ে মিথ্যে বানোয়াট গল্প বানিয়ে বলিয়েছে আমাদের।”

এতক্ষণ সবাই মনোয়ারা বেগমের কথা শুনছিলেন। রশিদ সাহেব আর রাবেয়া বেগম মাথা নিচু করেছিলেন পুরোটা সময়। মেয়ের ভুল থাকলে কোন বাবা-মার কথা বলার কিছু থাকেনা সবাই চুপ করে থাকলেও শ্রাবণ এবার ওর ফুপিরর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

–“আমার বোনের সম্পর্কে আর একটা কথাও শুনতে চাই না। বোনটা যেহেতু আমার তাই বোনকে শাসন করার অধিকার শুধু আমারই আছে । আর রইল গতকালের ঘটনার কথা, আমি যদি জানতে পারি গতকালের ঘটনায় রোদের হাত রয়েছে তাহলে আমি নিজে রোদকে শাস্তি দেবো। প্রয়োজনে এ বাড়ি থেকে বের করে দিতেও দুবার ভাব্বো না। আর যদি আমার বোনের কোন দোষ না থাকে তবে কেউ কিছু বললে তাকে কিন্তু আমি ছেড়ে কথা বলবো না। সে যতই আমার নিকট আত্মীয়ই হোক না কেন।”

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে শ্রাবণ খাবার টেবিল থেকে উঠে চলে গেল। শ্রাবণ চলে যাওয়ার পর পরই রশিদ সাহেব আর রাবেয়া বেগমও চলে গেলেন নিজেদের ঘরের দিকে। রোদ, প্রিয়ন্তী আর তুলি তখনো টেবিলে বসে ছিল । রোদের চোখ পানিতে পরিপূর্ণ। ফুপুর দিকে অসহায় করে তাকিয়ে ব্যাগ নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়ল কলেজের উদ্দেশ্য। রোদকে একা একা চলে যেতে দেখে সন্ধ্যা তুলি আর প্রিয়ন্তীকে ইশারায় রোদের পিছু পিছু যেতে বলল। সন্ধ্যার ইশারা পেতেই তুলি আর প্রিয়ন্তীও চলে গেল রোদের পিছু পিছু। সবাই চলে যাওয়ার পর মনোয়ারা বেগম সন্ধ্যাকে বেশকিছু কথা শুনিয়ে নিজেও ঘরের দিকে চলে গেলেন। সবাই যে যার মত চলে গেল সন্ধ্যা তখনও ঠাই দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে।

সকালে মিষ্টি আলোয় উঠানে মাদুর পেতে বসেছেন আশরাফ সাহেব। জারাকে পড়াতে বসেছেন তিনি। মেয়েটা বড্ড বেশি ফাঁকিবাজ হয়েছে, কিছুতেই পড়তে চায় না। একটুখানি সুযোগ পেলেই পড়া ফাকি দিয়ে ছুটে চলে যায় গ্রামের মেঠো পথের বাঁকে। আনোয়ারা বেগম ততক্ষণে মুড়ি তেল দিয়ে মেখে আশরাফ সাহেবের হাতে তুলে দেন। মুড়ির সাথে গুড় দিতে ভুললেনন নি তিনি। গুড় মুড়ি আশরাফ সাহেবের বড় পছন্দের খাবার। আশরাফ সাহেব কে মুড়ি দেওয়ার পর আনোয়ারা বেগমও মাদুরের এক পাশে বসে পড়লেন। তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

–” হুনেন সন্ধ্যার লগে হামার কথা বলাইয়া দিতে পারবেন? মাইয়াডার লগে কথা কওনের লাইগ্যা বুকডা ফাইটা যাইতেছে। ”

আশরাফ সাহেব স্ত্রীর কথা শুনে অপলক দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। সন্ধ্যাকে ছাড়া তিনিও খুব কষ্টে আছেন কিন্তু কথায় আছে না বাবারা তাদের আদর প্রকাশ করতে পারে না আশরাফ সাহেবের ও এ কি অবস্থা হয়েছে । তবুও স্ত্রীকে আশ্বাস দিয়ে বললেন,

–“আইচ্ছা আজকা দেখি তোমার লগে সন্ধ্যার কথা কওনের কোন ব্যবস্থা করতে পারি নাকি।”

আশরাফ সাহেবের কথা শেষ না হতেই মিন্টু মিয়া এসে হাজির হলো সেখানে। মিন্টু মিয়া পান খাওয়া দাতে ফোকলা হেসে বললেন,

–“মাস্টারমশাই হামাগোর চেয়ারম্যান সাহেব
ডাইক্কা পাঠাইছে আপনারে। কি যেন জরুরী কথা কওনের আছে আপনার লগে।”

আশরাফ সাহেব আনোয়ারা বেগম পরস্পরের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকালেন কিঞ্চিত সময়ের জন্য। তারপর হাতে রাখা মুড়ির বাটিটা নিচে রেখে পাশে রাখা পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে মিন্টুর পিছু পিছু চলে গেলেন আশরাফ সাহেব। আনোয়ারা বেগম অপলক দৃষ্টিতে স্বামীর চলে যাওয়া পথ পানে তাকিয়ে রইলেন অপলক দৃষ্টিতে।

চলবে

(আসসালামু আলাইকুম। আজকের পর্বটা কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটা পড়ে অবশ্যই নিজেদের মতামত জানাবেন। ভালো থাকবেন সবাই।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here