শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-২৮

0
1215

শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-২৮
#আমিনা আফরোজ

সময় তখন চারটা বেজে ত্রিশ মিনিট । শহর থেকে খানিকটা দূরে নির্জন জায়গায় এসেছে রোদ আর নেহাল। বিকেলের শীতল বাতাস মাঝে মাঝেই আপন খেয়ালে ছুঁয়ে যাচ্ছে ওদের দুজনকে । নরম ঘাসের উপর এদিক সেদিক প্রায় ছুটোছুটিই করছে রোদ। নেহাল তখন রোদের পিছনে দাঁড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে রোদের দিকে তাকিয়ে আছে। নেহালের কাছে রোদকে এখন দুরন্ত এক কিশোরী বলে মনে হচ্ছে। যে কিশোরী তার স্বাধীনচিত্তে এদিক-ওদিক মনের আনন্দে যেতে পারবে, সে কোন বাধা- নিষেধ মানে না।

রোদকে এদিক-সেদিক মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে দেখে হঠাৎ করেই সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে যায় নেহালের। আজ সকালে সন্ধ্যা যখন শ্রাবণের হাতে হাত রেখে মাঠের মধ্যে গেটের দিকে যাচ্ছিল তখন ওকে দেখছিল নেহাল। প্রথমে সন্ধ্যাকে দেখে খুশি হলেও পরবর্তীতে তা রূপ নেয় প্রতিহিংসায়।

সন্ধ্যাকে শ্রাবণের হাত ধরা দেখে নেহাল রেগে যায়। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।নেহালের দৃষ্টিতে সন্ধ্যা গুরুতর অপরাধ করেছে। এ অপরাধের কোন ক্ষমা হয় না। সন্ধ্যার কথা মনে হতেই পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটু কোনার দিকে চলে গেল নেহাল। সিগারেট খেতে খেতে ভাবতে লাগল পরবর্তীতে কি করবে ও? কি করেই বা সন্ধ্যাকে আবারো ওর কাছে নিয়ে আসবে?

এদিকে নরম ঘাসের উপর হাটতে বেশ ভালই লাগছে রোদের। এদিকে এর আগে কখনো আসে নি রোদ। নেহাল ওকে এখানে না নিয়ে আসলে হয়তো ও কোনদিন জানতোই না শহর থেকে একটু দূরে এমন সুন্দর একটি জায়গা আছে। জায়গাটা নিরিবিলি। এখানে নেই শহরের ব্যস্ততম গাড়ির আওয়াজ । যে কারো মন ভালো করার জন্য জায়গাটা একেবারে উপযুক্ত। রোদ ভাবল এখন থেকে মন খারাপ হলেই এখানে আসবে ও । প্রিয়ন্তিকেও সাথে নিয়ে আসবে। নেহালের কথা মনে হতেই এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো ওকে। চারিপাশ দেখতে দেখতে নেহালের কথা ভুলে গেছে ও।রোদের বাম দিকের কিছুটা দূরে নেহালকে একাকী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল ও। ভীরু পায়ে সে দিকেই এগিয়ে গেলো রোদ।

পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে দুজন ভিন্নধর্মী মানুষ। একজন মেতে উঠেছে কোন এক হিংস্র খেলায় ,যে খেলায় নিজের কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাবে না জেনেও সে খেলায় মত্ত হয়ে ওঠেছে আর অন্য একজন এক সমুদ্র ভালোবাসা নিয়ে তার প্রিয় মানুষটির আশায় অপেক্ষারত আছে । দুটি ভিন্নধর্মী মানুষ কি শেষ অব্দি এক পথে পাশাপাশি চলতে পারবে নাকি আজীবন এমন আলাদা পথে নিরন্তর চলতে থাকবে?

হাওয়ার তোড়ে উড়ছে রোদের অবাধ্য চুলগুলো। নেহাল অবশ্য আড় চোখে মাঝে মাঝে দেখছে রোদকে। অনেক চেষ্টা করেও রোদ ওর অবাধ্য চুলগুলো আয়ত্তে আনতে না পেরে বিরক্তি নিয়ে চুল ছেড়ে দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো । নেহাল তখন মৃদু স্বরে বলল,

–“এভাবেই তো ভালই লাগছে তোমাকে। অযথা চুলগুলো কেন বাধছো।এভাবেই থাক না”

নেহালের কথা শুনে রোদের মুখে যেন একরাশ লজ্জা এসে ভর করল। লজ্জা রাঙ্গা মুখে তাকিয়ে রইল অন্যদিকে তবে চুলগুলো আর বাঁধল না। এলোমেলো হাওয়ার তোড়ে উড়ুক না ওর চুলগুলো একদিন । এভাবে কেটে গেল প্রায় বেশ কিছুক্ষণ । সময় তার আপন গতিতে এগিয়ে চলছে বরাবরের মতো। নীরবতার রেশ কাটিয়ে রোদ নিজেই বলে ওঠল,

–“কাউকে ভালোবেসেছিলেন কখনো?”

রোদের প্রশ্ন শুনে ওর দিকে ঘুরে তাকালো নেহাল । স্নিগ্ধ শীতল চোখে চোখ রেখে বুঝতে চেষ্টা করল রোদের মনে কি চলছে এ মুহূর্তে। কিন্তু এ চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারছে না ও। বরং এ চোখে অন্য কিছুর আভাস পাচ্ছে ও। সে চোখে রয়েছে কাউকে কাছে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

নেহালকে চুপ করে থাকতে দেখে রোদ বলল,

–” উত্তরটা তো পেলাম না। থাক কিছু কথা অজানা থাকায় ভালো।”

নেহাল কৌতুহল নিয়ে রোদকে বলে,

–“যদি এই একই প্রশ্ন আমি তোমাকে করি তবে সে ক্ষেত্রে তোমার উত্তর কি হবে?”

নেহালের প্রশ্ন শুনে রোদের মনের কোণে জমে থাকা পুরনো অনুভূতিগুলো যেন আবারো উদয় হতে লাগল।মন বলতে লাগল এই তো সঠিক সময় তাকে ওর লুকানো অনুভূতির কথাগুলো জানানোর। ।আজকেই না হয় ওর মনের কথাগুলো বলে দিবে ওর প্রিয় মানুষটিকে। এতে করে যদি দহনটা কমে তাতে ক্ষতি কি। কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

–” হ্যা আছে এমন একজন যার দহনে দিবা রাত্রি পুড়ে মরছি আমি। না পারছি তাকে বলতে আর না পারছি এ দহন সইতে। আচ্ছা এ দহনের ভারটা কি একটু নিতে পারবেন আপনি?”

এতক্ষণ মনযোগের সাথে রোদের কথাগুলো শুনছিল নেহাল। কিন্তু রোদের বলা শেষ কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

–“মানে?কি বলতে চাইছো তুমি?আমি বুঝতে পারছি না তোমার কথা?”

রোদ কোন ভনিতা না করেই বলল,

–“বিয়ে করবেন আমাকে?”

–“কি বলছো এসব। যা বলছো ভেবেচিন্তে বলছো তো?”

–“আমি জানি আমি কি বলছি। আপনাকে আমি অনেকদিন আগে থেকেই ভালোবাসি।প্রথমে এইটা ভালোলাগা ভাবলেও পরবর্তীতে বুঝতে পারি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি।তাইতো আপনার এত অবহেলা সত্বেও আপনাকে একনজর দেখার জন্য ছুটে আসতাম আপনার সামনে । আপনাকে ভেবে ভেবে কতগুলো রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি তা নিজেও জানিনা ‌ আপনাকে নিয়ে মনের কুঠুরিতে সাজিয়েছি বহু স্বপ্ন । সেই স্বপ্নগুলো প্রতিদিন রঙিন তুলিতে রাঙ্গিয়েছি নিজ হাতে। আপনি কি আমার সে স্বপ্ন গুলো সত্যি করবেন?”

নেহাল রোদের কথা শুনে ঘোর লাগা স্বরে বলল,

–“পরে আবার আজকের দিনটার জন্য আফসোস করবে না তো?”

রোজ নেহালের দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে নেহালের চোখে চোখ রেখে বলল,

–“কখনো আফসোস হবে না বরং আজকে আপনাকে একান্তই নিজের করে পাওয়াতে শান্তি লাগবে অনেক।”

–“তবে তাই হোক।”

রোদ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নেহালের দিকে। নেহালের বলা কথাটা এখনো ওর কানে বাজছে।তাহলে কি এতো দিনে সুখ নামক অপার্থিব জিনিসটি ও পেতে চলছে নাকি সম্পূর্ণটাই মিথ্যে ধোঁয়াশা কেবল?

অন্যদিকে নেহা দুপুরের দিকে বাড়ি এনে দরজা আটকে বসে রয়েছে। সময় গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে ধরনীর বুকে। দিনের আলোকে গ্রাস করে নিচ্ছে রাতের কালো অন্ধকার। সেই যে দুপুরে ঘরে ঢুকেছে এখন অব্দি বের হয় নি নেহা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ইমতিয়াজ খান আর ওনার স্ত্রী। ঘরের ভেতর থেকে ভাঙ্গচুরের আওয়াজ পাচ্ছেন তারা। মেয়েকে কাঁদতে কাঁদতে দরজা আটকাতে দেখেই ওনার স্ত্রী ওনাকে কল করে বাসায় আসতে বলেন। মেয়ের কথা শুনে বিন্দুমাত্র দেরি করেন নি তিনি। সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছেন মেয়ের কাছে । ছোটবেলা থেকেই নেহাকে তিনি আদরে বড় করেছেন । নেহার কোন ইচ্ছা এ পর্যন্ত পূর্ণ করেন নি এমনটা আজ পর্যন্ত হয়নি। মেয়ের ঘরের বাহিরে চিন্তিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ইমতিয়াজ খান। তার মেয়েকে কে কষ্ট দিয়েছে এ নিয়ে ভাবছেন তিনি? কিন্তু কোন কিছু খুঁজে পেলেন না ।তাই নিরুপায় হয়ে মনে মনে বললেন,

–” এভাবে চলতে পারে না । মেয়ের সাথে কথা বলতে হবে ওনাকে।”

তাই নেহাকে আদুরে সরে ডাকলেন ইমতিয়াজ খান,

–“নেহা মা দরজাটা খোল। আমাকে কিছু না বললে কি করে বুঝবো তোর কি হয়েছে? আর কিছু না জানলে তোকে সাহায্য করব কি করে?”

বাবার কণ্ঠস্বর শুনে ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল নেহা। দরজাটা খুলে আবারো ঘরের মেঝেতে বসে পড়ল ও। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে দুশ্চিন্তা কেটে গেল ইমতিয়াজ খানের। স্ত্রীকে আশ্বাস দিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে গেলেন তিনি।

ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো। বিছানাটাও এলোমেলো হয়ে আছে। মেঝের এক কোণে এলোমেলো চুলে হাটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে নেহা। ঈষৎ অন্ধকারে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাকে। মেয়েকে এ অবস্থায় দেখে অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল ইমতিয়াজ খানের। একপা- দুপা করে তিনি এগিয়ে গেলেন সেদিকে।

নেহার সামনে মেঝেতে বসে মেয়েকে মৃদুস্বরে ডাক দিলেন তিনি। নেহা মুখ তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে কেঁদে দিল এবার। নেহাকে কাঁদতে দেখে উৎকণ্ঠা স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,

–“কি হয়েছে মামণি? কাঁদছো কেন? কেঁদো না আমাকে সব খুলে বলো। দেখো তোমার পাপা এসে গেছে এখন সবকিছু ঠিক করে দিবে তোমার।”

নেহা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,

–“পাপা শ্রাবণ অন্য একজনকে বিয়ে করেছে। তুমি তো জানো শ্রাবনকে আমি সেই ছোট বেলা থেকে ভালবাসি । ওকে আমি ভুলতে পারব না পাপা। ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে এনে দাও পাপা।”

ইমতিয়াজ শাহেব কিছুক্ষণ ভেবে নেহা যা বললেন,

–“মেয়েটার ব্যাপারে কিছু জানো কি?”

–“না পাপা।তবে একবার দেখেছিলাম। আঙ্কেলের পুরনো এক বন্ধুর মেয়ে নাকি সে। তাই তখন ওকে নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই নি আমি।”

–“নাম কি মেয়েটার?”

–“সন্ধ্যা।”

–“রশিদের পুরনো বন্ধু তো একজনই আছে তার নাম আশরাফ ‌। কিন্তু রশিদ এমন হঠাৎ করে ঘরোয়া ভাবে শ্রাবণের বিয়ে দিল কেন? আমাকেও জানালো না এ বিষয়ে? আমার মনে কিন্তু কেমন যেন খটকা লাগছে বিষয়টা।”

–“বুঝলাম না পাপা?”

–“আপাতত এত কিছু বুঝতে হবে না তোমায়। এখন চোখের পানি মুছো।এভাবে চোখের পানি ফেলে শ্রাবনকে ফিরে পাবে না তুমি। শ্রাবনকে ফিরে পেতে হলে সন্ধ্যা সম্পর্কে জানতে হবে তোমায় । মনে রাখবে শত্রুর সম্পর্কে তুমি যত বেশি জানতে পারবে তাকে তুমি ততো বেশি আঘাত দিতে পারবেন।”

–“কিন্তু ওই মেয়েটার সম্পর্কে কোন কিছুই তো জানতে পারছি না আমি। আঙ্কেল আন্টি বা রোদের থেকে সন্ধ্যা সম্পর্কে কিছুই জানা যাবে না কারন ওরা কিছুই বলবে না। তাহলে এখন কি করব পাপা?”

–“সন্ধ্যা সম্পর্কে জানতে হলে সেই গ্রামে যেতে হবে তোমায়। অবশ্যই সন্ধ্যাকে এমন কিছু হয়েছে যার কারণে এত তাড়াতাড়ি লুকিয়ে বিয়ে দিতে হয়েছে ওদের দুজনকে। আমি সেখানে যেতে পারব না কারন আসরাফ আমাকে চেনে তাই তোমাকেই সেখানে যেতে হবে।”

সন্ধ্যা ওর বাবার কথা শুনে বুঝতে পারল ওর করণীয় কি এখন। ওর আর শ্রাবণের মাঝে সন্ধ্যা নামক এই দেয়ালকে সে সরিয়েই ছাড়বে , এজন্য তাঁকে যা করতে হয় করবে। আগামীকালকেই যাবে ও সন্ধ্যাদের গ্রামের পথে।

চলবে

(আসসালামু আলাইকুম।সবাইকে রমাদান মোবারক। আল্লাহ তা’লা সবাইকে পবিত্র মাহে রমজানের রোজা রাখার তৌফিক দান করুক। আর আগামীকাল থেকে হয়তো দুপুরের দিকে বা রাত নয়টার পরে গল্প দিব।এখন আপনারা বলুন কোন সময়ে গল্প দিলে আপনাদের জন্য সুবিধা হবে। ভালো থাকবেন সবাই।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here