শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-২৭
#আমিনা আফরোজ
লাইব্রেরি কোনার দিকের টেবিলে বসে আছে রোদ আর প্রিয়ন্তী । লাইব্রেরিতে এখন তেমন শিক্ষার্থীর নেই বললেই চলে। শুধু জনাকয়েক কলেজ শিক্ষার্থী বসে তাদের পছন্দকৃত বই পড়ছে। লাইব্রেরীতে এমনিতেই সব সময় নিরবতা বিরাজ করে। তবে আজ যেন একটু বেশিই নীরবতা চলছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। শুধু কতগুলো নিঃশ্বাসের ওঠা-নামার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে । লাইব্রেরী কক্ষের সামনের দিকে চেয়ারে বেশ গম্ভীর মুখে বসে আছেন মিসেস রুবিনা আক্তার । সবাই তাকে লাইব্রেরি ম্যাম বলেই ডাকে । বয়স তার পঁয়ত্রিশ এর বেশি। গৌঢ় বর্ণ চেহারার একজন সুদর্শন মহিলা তিনি। লম্বায় পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি হবেন। বয়স বাড়লেও ওনার সৌন্দর্য কিন্তু কমে নি, উল্টো বয়স বৃদ্ধির অনুপাতে তা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে চোখে পড়তে হয়েছে চশমা। চোখে যে আজকাল তেমন একটা ভালো দেখতে পান না তিনি।তাইতো এই চশমার ব্যবস্থা করতে হয়েছে ওনাকে।তবে চশমা পড়া অবস্থাতেও বেশ সুন্দর লাগে তাকে। হয়তো কিছু মানুষের সৌন্দর্য এমনি যে সে যাই পড়ুক না কেন তাকে সব কিছুতেই মানায় । তবে মিসেস রুবিনা আক্তারের সৌন্দর্য যেমন তেমনি তার ব্যক্তিত্ব। সব সময় চুপচাপ গম্ভীর হয়ে থাকেন তিনি হয়ত এ কারণেই তাকে লাইব্রেরি শিক্ষিকা হিসেবে বেশ ভালোই মানিয়েছে।
বাহিরের সূর্যের আলো জানালার গ্রিলের ফাক দিয়ে রোদের টেবিলে এসে উঁকি দিচ্ছে যেন রোদদের জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতির কথা। রোদ মিষ্টি হেসে হাত বাড়িয়ে সূর্যের সেই সোনালী আভা গায়ে মাখল। রোদের আভার স্পর্শে অনুভব করতে লাগলো নেহালকে। ধুলো পড়া ডায়েরির পাতায় খুঁজতে লাগলো নেহালের সাথে তার কাটানো সুন্দর মুহূর্ত গুলো। কিন্তু সেইরকম ভালো কোনো মুহূর্ত না পেয়ে বিরক্তি ফুটে উঠল রোদের মুখে। নিমিষেই আশেপাশের সব কিছুই বিরক্ত লাগতে লাগলো রোদের।এমনকি পাশে বসে থাকা প্রিয়ন্তীকেও এই মুহূর্তে বিরক্ত লাগছে ওর।
এতক্ষণ রোদের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল প্রিয়ন্তী । বলা যায় রোদকে বোঝার চেষ্টা করছিল ও । রোদের এই যে হঠাৎ খুশিতে আপ্লুত আবার হঠাৎ করেই নিমিষের বিরক্ত হয়ে ওঠা এই সবটাই দেখছিল ও। রোদকে নিয়ে এখন সন্দেহটা আরো বেড়ে যাচ্ছে প্রিয়ন্তির। কিন্তু যে করেই হোক না রোদের কি হয়েছে ওকে জানতেই হবে। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে রোদের দিকে তাকিয়ে হতাশ স্বরে বলল,
–“তোর কী হয়েছে বল তো?”
প্রিয়ন্তীর কথা শুনে বিরক্তি যেন আরও দ্বিগুন বেড়ে গেল রোদের। এই কথা বলার জন্য এত তাড়াহুড়ো করে ওকে এখানে নিয়ে এলো প্রিয়ন্তী? এই কথা তো ক্লাসে বা বাড়িতে গিয়েও বলা যেত তবে এখানে ডেকে আনার কি খুব প্রয়োজন ছিল ?
এদিকে রোদকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রিয়ন্তি আবারো বলল,
” কিরে আমার প্রশ্নের উত্তর দিলি না তো?”
রোদ ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিল,
–“কই কিছুই হয় নি তো আমার।”
প্রিয়ন্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল,
–” এভাবে বললে ও রোদের কাছ থেকে কোন কথাই জানতে পারবে না। ওকে ঠান্ডা মাথায় রোদের সাথে কথা বলতে হবে। তবে এখন রোদকে আর কোন কথা জিজ্ঞেস করবে না ও।এই বিষয় নিয়ে বরং রাতে কথা বলবে রোদের সাথে।”
প্রিয়ন্তি যখন এসব কথা ভাবছিল রোদ তখন চারপাশ দেখতে ব্যস্ত। হঠাৎ লাইব্রেরীর দরজা ফাঁকে নেহালকে দেখতেই রোদের মন নিমিষেই ভালো হয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল মিষ্টি হাসি। যদিও ক্ষনিকের জন্য দেখছিল ও নেহালকে তবুও মনে যেন অন্যরকম এক প্রশান্তি পেল রোদ। তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে দরজার দিকেই তাকিয়ে রইল ও। যদি আর একবার দেখা যায় তাকে। কিন্তু নেহালের আর দেখা না পেয়ে রোদ বলল,
–” চল এবার ক্লাসে তাই। এমনিতেই দুইটা ক্লাস ফাঁকি দিয়েছি আজ। না জানি আজ কপালে কি আছে আমাদের।”
রোদের কথা শুনে প্রিয়ন্তির ও এবার ক্লাসের কথা মনে পড়ল। ক্লাসের কথা মনে পড়তেই একটু জোরেই বলে উঠলো ,
–” আমার তো ক্লাসের কথা মনেই ছিল না। এখন কি হবে আমাদের?”
রোদ প্রিয়ন্তির কথার উত্তর দেওয়ার আগেই মিসেস রুবিনা আক্তার গম্ভির স্বরে বলে ওঠেন,
–” কে এতো জোরে কথা বলে? লাইব্রেরীতে জোরে কথা বলা নিষেধ জানো না তোমরা।আর একবার যদি কারো কথা শুনতে পাই তবে লাইব্রেরি থেকে তাকে বের করে দিব।কথাটা যেন মনে থাকে তোমাদের।”
মিসেস রুবিনা আক্তারের কথা শেষে
লাইব্রেরীতে আবারো নীরবতা ভীর করুল। লাইব্রেরীতে অবস্থানকৃত গুটিকয়েক শিক্ষার্থী আবারো মগ্ন হয়ে রইল বইয়ের পৃষ্ঠার ভাজে।
রোদ প্রিয়ন্তীকে ফিসফিসিয়ে বলল,
–“আপাতত আগে ক্লাসে যাই তারপর পরিস্থিতি বুঝে দেখতে হবে কি করা যায়।”
–“ঠিক আছে চল তবে।”
রোদ ও প্রিয়ন্তী লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে ঝড়ো হাওয়ার বেগে ক্লাসের দিকে দৌড়ে চলে গেল।
এদিকে শ্রাবণের গাড়ি কলেজের গেটের সামনে এসে থামল। সন্ধ্যা ও তুলি গাড়ি থেকে নেমে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। শ্রাবণ গাড়ি পার্কিং করে সন্ধ্যা ও তুলিকে নিয়ে কলেজের ভেতরে চলে গেল। যেহেতু কলেজের প্রিন্সিপাল রশিদ সাহেবের পুরোনো বন্ধু তাই শ্রাবণ সন্ধ্যা ও তুলিকে নিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের দিকে চলে গেল।
প্রিন্সিপাল আমজাদ হোসেনের সামনে বসে আছে শ্রাবন,সন্ধ্যা আর তুলি তিনজন। তুলি আর সন্ধ্যা অবশ্য নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার হঠাৎ নেহালের কথা মনে পড়তেই শ্রাবণের হাত আঁকড়ে ধরল ভয়ে।শ্রাবন ও তখন অন্য হাত সন্ধ্যার হাতের উপর রেখে ভরসার ইঙ্গিত দিল সন্ধ্যাকে।এর অর্থ আমি সব সময় তোমার পাশে থাকব, তুমি ভয় পেয়ো না। শ্রাবনের ভরসা পেয়ে সন্ধ্যার অশান্ত মন যেন শান্ত হয়ে গেল।সেই সাথে ফিরে এলো আত্মবিশ্বাস। শ্রাবণরা আসার আগেই রশিদ সাহেব হয়তো ওদের আসার কথাটা বোধ হয় আমজাদ সাহেবকে জানিয়েছিলেন। তাইতো কাজ সমাধান হতে খুব একটা সবাই লাগে নি ওদের।তাই আমজাদ সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলো ওরা। তখনো সন্ধ্যা শ্রাবনের হাত ছাড়ে নি।প্রিয় মানুষটির হাতে হাত রেখে পথ চলতে বেশ ভালোই লাগছে ওর।
আমজাদ হোসেন সকাল থেকে শ্রাবনদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন । আজ সকালবেলা যখন রশিদ সাহেব ফোন দেন তখনই শ্রাবনদের ব্যাপারে জেনেছিলেন তিনি । সন্ধ্যা আগে থেকেই তার কলেজে ভর্তি হয়ে রয়েছে এখন শুধু তুলিকে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি করতে হবে। তাই আগে থেকেই সব কিছু ঠিক করেই রেখেছিলেন ওনি।
সন্ধ্যাদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে অফিসে এসেছে শ্রাবণ । গাড়ি পার্কিং শেষে গাড়ি থেকে ওর নামতেই দেখা মিলল নেহার সাথে । নেহাকে এসময় অফিসে দেখে অবাক হয়ে গেল শ্রাবণ । সাধারণত এই সময় খুব একটা নেহা অফিস আসে না। ধীরপায়ে হেঁটে নেহার সামনে গিয়ে বলল,
–“আজ হঠাৎ আমার অফিসে এলে যে?”
–“কেন আসতে পারি না নাকি?”
–“তা আস্তেই পারো কিন্তু তুমি খুব একটা অফিসে আসো না তো এইজন্য বললাম।”
–“কি করবো বলো, এর আগেও দুইদিন তোমার অফিসে এসেছিলাম কিন্তু তোমার দেখা পায় নি তারপর তোমাকে কল করেছিলাম কিন্তু তুমি তো কলই রিসিভ করো নি।”
–” একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই তোমার কল অ্যাটেন্ড করতে পারে নি। এত জরুরী ভিত্তিতে আমাকে খুজছো কেন শুনি?”
–“তোমাকে খুঁজতে পারি না বুঝি?”
–“কারণ না থাকলে এমনি এমনি তো আর কেউ কাউকে খুঁজে না তাই না।”
–“তা ঠিক বলেছ। কারন তো একটা আছেই। আগে বলো কি নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলে তুমি যে আমার কল অ্যাটেন্ড করতে পারো নি ।”
–“আমার বিয়ের খবর কি তুমি জানো না?”
–“তোমার বিয়ে মানে? কি বলছো এসব তুমি?”
–“আসলে তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছি। এইতো গত কয়েকদিন আগে আমি বিয়ে করেছি । সেইজন্যই একটু ব্যস্ত ছিলাম আর কি।”
শ্রাবণের কথা শুনে নেহার যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। শ্রাবণের বিয়ে হয়ে গেলে নেহার কে হবে? ও যে সেই ছোটবেলা থেকে শ্রাবনকে ভালোবাসে । না না এত সহজে নিজের ভালোবাসাকে হারিয়ে যেতে দিবে না ও। শ্রাবনকে ও ভুলতে পারবে না কিছুতেই । যে করেই হোক কিছু একটা করতে হবে ওকে।
কথাগুলো ভেবে শ্রাবনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল অফিস থেকে। নেহার হঠাৎ করে চলে যাওয়ায় আবারো অবাক হয়ে গেল শ্রাবন । নেহা এভাবে হঠাৎ করে এলোই বা কেন আবার এভাবে হঠাৎ করে চলেই বা গেল কেন? কিছুই বুজতে পারল না ও।এর আগে কখনো নেহা এভাবে হুট করে ওকে না বলে চলে যাইনি কখনো। তাহলে আজকে চলে গেল কেন? সে যাই হোক আপাতত অফিসের কাজে মন দিতে হবে ওকে। নেহার ব্যাপারটা পরে ভাবা যাবে।
এদিকে স্কুল ছুটির পর রোদ প্রিয়ন্তি নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলল নেহালের পিছু পিছু। অজানা অনেক প্রশ্নের উত্তর পাবে আজ ও। তাছাড়া পড়ন্ত বিকেলে নেহালের সাথে সময় কাটানোর লোভটাও সামলাতে পারে নি ও।তাইতো সবার অলক্ষ্যে নিজের ইচ্ছেটাকে পূরণ করতে এসেছে ও।
চলবে
(কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।অনেকে বলছে গল্প নাকি তাদের নিউজফিডে যাচ্ছে না।তাই কার কার নিউজফিডে গল্প যাচ্ছে একটু দয়া করে জানাবেন। ভালো থাকবেন।হ্যাপি রিডিং ?)