শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-২৫

0
1410

শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-২৫
#আমিনা আফরোজ

সময়ের সাথে সাথে সূর্যের তেজ কিছুটা বাড়ছে। কলেজ প্রাঙ্গণে এখন আর তেমন লোকসমাগম নেই । ক্যান্টিনটাও ততক্ষণে ফাঁকা হয়ে গেছে। সময় তখন 9 টা বেজে 45 মিনিট। আর 15 মিনিট পরে শুরু হবে প্রতিদিনের নির্ধারিত ক্লাস। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চের সামনের দুই ব্রেঞ্চ আগে বসে আছে রোদ আর প্রিয়ন্তী। প্রিয়ন্তীর মুখে কথার ফুলঝুরি লেগে থাকলেও রোদ তখন নিশ্চুপ হয়ে বসে রয়েছে।

তখন প্রিয়ন্তী যদি ওর পিছু পিছু না যেত তবে হয়ত ওর প্রশ্নেই উত্তরগুলো পেলেও পাওয়া যেতো কিন্তু প্রিয়ন্তি উপস্থিত হতেই নেহাল ওদের ক্লাসে যেতে বলার বাহানা দিয়ে সেখান থেকে চলে গিয়েছিল নিজ কেবিনের দিকে। নেহালের এমন কান্ডে খানিকটা অবাক হয়ে গিয়েছিল রোদ। তবে এ নিয়ে আর কোন কথা বলেনি তখন। রোদ নিজেও চায়না প্রিয়ন্তীকে এর মাঝে জড়াতে। পরে দেখা যাবে কোন সমস্যা হলে এ মেয়ে কেঁদে সারা শহর ভাসিয়ে ফেলবে। প্রিয়ন্তীকে এ বিষয়ে কোন বিশ্বাস নেই ওর। মেয়েটা খুব আবেগী কোন সমস্যাই পড়তেই না পরতেই ভ্যা ভ্যা করে কেদে পুরো নাজেহাল অবস্থা হয় ওর। মোটকথা কোন ছোট কথাকে তিল থেকে তাল বানিয়ে ফেলতেও কমতি রাখবে না ও। তার চেয়ে বরং রোদ নিজেই এ কাজ করবে।

রোদের ভাবনার মাঝেই নেহাল এল ক্লাসে। ক্লাসে ঢুকেই প্রথমেই নজর গেল চিন্তায় মগ্ন থাকা রোদের দিকে। রোদের দিকে তাকাতেই ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক হাসিটা আবারো দেখা গেলো নেহালের ঠোঁটে। তবে পুনরায় নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে ক্লাসে মন দিল ও। আপাতত একটু একটু করে রোদের কাছাকাছি যেতে হবে ওর। যদি কোনভাবে একবার রোদে অতি প্রিয় জন হওয়া যায় তবেই শুরু হবে ওর আসল খেলা। এর জন্য ওকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে আর নিজের রাগটাকে আপাতত নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে ওর। যে করেই হোক না কেন এ কাজে সফল হতেই হবে ওকে। এছাড়া সন্ধ্যাকে ফিরে পাবার আর কোনো পথ নেই ওর।

এদিকে নেহালকে নিয়েই আকাশ – কুসুম ভেবে চলছিল সন্ধ্যা কিন্তু প্রিয়ন্তীর ধাক্কা খেয়ে সে ভাবনা চিন্তা ব্যহত রাখতে হলো ওকে। চোখ রাঙিয়ে প্রিয়ন্তীকে কিছু বলতেই চোখ আটকে গেল সামনের দিকে। সাদা শার্ট পরহিত নেহালকে দেখেই শ্বাস আটকে গেল রোদের। সাদা শার্ট আর চাপ দাড়িতে প্রতিদিনের চেয়ে নেহাল কে আজ যেন একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। এত সুন্দর হওয়া কি খুব প্রয়োজন ছিল লোকটার। লোকটার দহনে যে দিনকে দিন পুড়ছে রোদ। এই দহনের মাত্রা কি শেষ হবে না কোনদিন নাকি আরো বেড়ে যাবে দিনকে দিন? রোদ কথাগুলো ভেবে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে নেহালের দিকে তাকিয়ে রইল। অবাধ্য চোখ গুলো যে কোন কথাই শুনছে না ওর । সে তো আপন মনে প্রিয় মানুষটির দর্শনেই ব্যস্ত।

রোদকে এভাবে নেহালের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রোদের দিকে মুচকি হেসে রোদকে আবারো আলতো করে ধাক্কা দিল প্রিয়ন্তী। তারপর ফিসফিস করে রোদকে বলল,

–“কিরে এভাবে ভ্যাবলার মত স্যারের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন ? প্রেমে টেমে পড়লি নাকি?”

প্রিয়ন্তীর ধাক্কা খেয়ে আবারো সম্বিত ফিরে পেল রোদ। প্রিয়ন্তীর কথা শুনে লজ্জা পেল। নিমিষেই চোখ নামিয়ে ফেললো রোদ। ও আর কিছুতেই তাকাবে না নেহালের দিকে। প্রিয়তে কথার প্রতি উত্তরে রোদ কেবল মনে মনে বলল,

–“তার চোখের মায়ায় কবেই তো প্রেমে পড়ে গেছি আজ আর নতুন করে প্রেমে পড়বো কিভাবে?। নিজেকে যে তার মাঝে হারিয়েছি বহু আগেই। ”

–“কি রে আবার কোন ধ্যান এ বসলি?”

–“কই না তো।”

–“তা বেশ এখন আমার প্রশ্নের উত্তর দে আগে।”

রোদ কিছুক্ষণ চিন্তা করে গম্ভির স্বরে বলল,

–“এসব ফালতু কথা তোর মাথায় আসে কিভাবে বুঝিনা আমি? আজে বাজে চিন্তা বাদ দিয়ে মন দিয়ে ক্লাস কর আর আমাকেও ক্লাস করতে দে। ”

–“তবে কি আমি ভূল দেখলাম? না এ হতেই পারে না।”

প্রিয়ন্তীর কথা শুনে ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল,

–“কি দেখেছিস তুই?”

–” স্যারের জন্য তোর চোখে অন্য রকম মুগ্ধতা দেখেছি আমি। যা অতি প্রিয়জনের জন্য থাকে।”

রোদ গম্ভির স্বরে বলল,

–“ভূল দেখেছিস তুই? ”

–“আচ্ছা রোদ তুই কি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছিস?”

প্রিয়ন্তির কথা শুনে রোদ তোতলাতে তোতলাতে করে বলল,

–“কই না তো।কি লুকাবো তোর কাছে।”

–“সে তো তুই ভালো জানিস কি লুকাচ্ছিস আর লুকাচ্ছিস না।”

–“এসব আজগুবি কথা না ভেবে ক্লাসে মন দে তা নাহলে স্যার দুজনকেই শান্তি দিবে।”

প্রিয়ন্তী বুঝতে পারল রোদ ওর কথা এড়িয়ে যাচ্ছে তাই আর রোদকে কিছু না বলে ক্লাসে মন দিলো। ওর প্রশ্নের উত্তর না হয় পরে জেনে নেবে ওর কাছ থেকে এখন বরং ক্লাসের মন দেওয়া উত্তম। প্রিয়ন্তী চুপ করাতে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো রোদ এতক্ষন নিজেকে খুব কষ্ট করে সামলিয়ে নিচ্ছিলো ও।নেহালের প্রতি ওর অনুভূতির কথা আর কাউকে জানাতে চায় না ও। কিছু অনুভূতি থাকনা একান্তই নিজের করে, নিজের মাঝে অতি গোপনে।

এদিকে ক্লাস শেষ হলে নেহাল আবারো রোদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে গেল।নেহালের হাসি কিন্তু রোদের চোখ এড়ালো না।নেহালের এহেন কান্ডে বেশ অবাক ও। গতকাল থেকেই নেহালের এমন অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করছে ও। যে করেই হোক এর কারণ জানতে হবে ওর।তাই আর দেরি না করে তড়িখড়ি করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে নেহালের পিছু পিছু চলে গেল রোদ।

এদিকে কিছুক্ষণ পর ওর বাবা রশিদ সাহেবের ঘরের আসে।ঘরে তখন রশিদ সাহেব ছাড়াও মিসেস রাবেয়া বেগম আর মনোয়ারা বেগম ও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। শ্রাবণকে দেখে মনোয়ারা বেগমের মুখে হাসি ফুটে উঠল তবে সে হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী রইল না। শ্রাবণের পিছনে লাল শাড়ি পরিহিতা সন্ধ্যাকে দেখে মুখের হাসি নিমিষেই মুছে গিয়ে তার পরিবর্তে ফুটে উঠল রাগের আভাস। এই মেয়েকে শ্রাবনের জীবন থেকে দূরে সরানো না পর্যন্ত শান্তি নেই ওনার।

–“বাবা ডেকেছিলে আমায়?”

–” তুই এসে গেছিস। এতক্ষণ তোর জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।”

–“আসলে আমি অফিসে যাব তাই একেবারে তৈরি হয়ে এলাম।”

–“কিন্তু তোকে তো এখন একটা কাজে যেতে হবে।”

–“কি কাজ বাবা?”

–“আসলে তোর ফুপু চাচ্ছিল তুলিকে রোদের কলেজ এ ভর্তি করাতে। তোর ফুপি চাচ্ছে তুলি ওর বাকি পড়াশোনা ঢাকা থেকে করুক।”

–“এটা তো খুব ভালো কথা। আমিও তাই ভাবছিলাম।”

–“তাহলে আজকেই বরং তুই তুলিকে কলেজ এ ভর্তি করে আন।”

–“আমি ভাবছিলাম সন্ধ্যা কেও এখন থেকে কলেজে পাঠাবো। যেহেতু বিয়েটা হয়ে গেছে তাই এখন আর কলেজে যেতে কোন সমস্যা নেই সন্ধ্যার।”

সন্ধ্যার কলেজে যাওয়ার কথা শুনে মনোয়ারা বেগম বলে উঠলেন,

–“বাড়ির বউকে পড়াশোনা করানোর কি দরকার? বিয়ে হয়ে গেছে সংসার সামলানোই এখন একমাত্র কাজ ওর তাছাড়া বাড়ির বৌদের বেশি পড়ালে উড়নচন্ডি হয়ে যায়। আর চাকরি করা নামে তো এখন যথারীতি পর পুরুষের সাথে ঢলাঢলি শুরু করে। তাই আমার মতে বাড়ির বউকে এত বেশি লেখাপড়া করানোর কোন প্রয়োজন নেই।”

মনোয়ারা বেগমের কথা শুনে শ্রাবণের রাগ উঠলেও তা সামলিয়ে নিয়ে গম্ভীর স্বরে কিছু বলার আগেই রশিদ সাহেব নিজেই বলে উঠলেন,

–“এইসব কি ধরনের কথা বলে মনু? তুই দেখি এখনো সেই আগের যুগেই পড়ে আছিস? আর সন্ধ্যা শুধু এবারের বউই নয় এবাড়ির মেয়েও বলতে পারিস। এখনকার যুগের মেয়েদের নিজেদের স্বাবলম্বী না হলে হয় না। তাছাড়া পড়াশোনা করা মানেই উড়নচণ্ডী হয়ে যাওয়া নয়। আজ সন্ধ্যার জায়গায় আমার মেয়ে রোদ থাকলেও আমি ওকে পড়াশুনা করার কথাই বলতাম। আর রইল চাকরির কথা সে যদি সন্ধ্যা করতে চায় তবে তাতেও আমার কোন আপত্তি নেই। সন্ধ্যা ওর নিজের জীবন কিভাবে গড়াবে সেটা একান্তই ওর সিদ্ধান্ত। আমি বা আমার পরিবারের কেউ এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবো না।”

রশিদ সাহেবের বলা কথাগুলো মনোয়ারা বেগমের কাছে খুব একটা ভালো লাগলো না তবুও ভাইকে খুশি করার জন্য বললেন,

–“তোমার যা ভালো মনে করো তাই করো।”

–“শ্রাবণ তুই বরং তুলি আর সন্ধ্যা কে নিয়ে এখনি বের হও।”

–“ঠিক আছে বাবা। সন্ধ্যা তুমি তুলিকে নিয়ে তৈরি হয়ে নিচে আসো। আমি গাড়ির নিয়ে অপেক্ষা করছি তোমাদের জন্য।”

সন্ধ্যা কোন কথা না বলে ধীর পায়ে ঘরের বাহিরে চলে গেল। তবে রোদের কলেজের কথা শুনে মনে আবারো হারানোর ভয় চেপে বসেছে। না জানি আগামী দিনগুলোতে ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে।

চলবে

(রিচেক দেওয়া হয়নি তাই ভুল ত্রুটি গুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। এই কয়দিন একটু ব্যস্ত ছিলাম বলে গল্প দিতে পারেনি। তবে এখন থেকে নিয়মিত গল্প দেওয়ার চেষ্টা করব। ভালো থাকবেন সবাই। হ্যাপি রিডিং ??)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here