শ্রাবন সন্ধ্যা পর্ব:-২৩
#আমিনা আফরোজ
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে সবে। কিছুদিন আগেই এই আলো ছিল তীব্র, তবে এখন তা বেশ মিষ্টি। কুয়াশার চাদর সরিয়ে আলো ছড়াতে শুরু করেছে পথ-ঘাট-ক্ষেত সব স্থানে। দুর্বাঘাসে শিশির বিন্দু, দূর থেকে দেখলে মনে হচ্ছে দুর্বাঘাসে মুক্তার কনা জ্বলজল করছে। শিশিরের সিক্ত সকালের এই রূপ স্নিগ্ধ সুন্দর। সকালের সেই মিষ্টি আলোর ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেল সন্ধ্যার। ঘুম ভেঙ্গে আজও নিজেকে শ্রাবণের বাহুডোরে আবিষ্কার করল ও। নিজেকে শ্রাবণের বাহুডোরে আবদ্ধ দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল ও । ওর যতদূর মনে পড়ে গতকাল বারান্দায় আকাশ-কুসুম ভাবতে ভাবতেই সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিল ও।তাহলে কি শ্রাবন ওকে বারান্দা থেকে ঘরে নিয়ে এসেছি? তাই হবে হয়তো । নেহালের কথা কি শ্রাবনকে বলে দিবে ও? কথাটা ভাবতেই আনমনে শ্রাবণের দিকে তাকালো ও। শ্রাবনের নিষ্পাপ মুখ দেখে নেহালের তিক্ত কথাগুলো আর বলার ইচ্ছে হলো না ওর। শুধু শুধু লোকটাকে দুচিন্তায় ফেলানোর কোন মানেই হয় না। আপাতত নেপালের কথাগুলো মাথা থেকে ছেড়ে ফেলে সাবধানে বিছানা থেকে উঠতে নিলেই পিছন থেকে বলিষ্ঠ হাতের বাঁধা পায় ও। সন্ধ্যা পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল শ্রাবণ মুচকি হেসে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে তবে চোখে এখনও ঘুমের আভাস রয়েছেই।
সন্ধ্যার তাকানো দেখে শ্রাবণ বলল,
–“কি ব্যপার চোরের মত পালিয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন?”
শ্রাবনের কথা শুনে সন্ধ্যা রেগে বলল,
–” আমি কি চোর যে চোরের মত পালাতে যাব ?”
–” যেভাবে যাচ্ছিলে মনে হচ্ছিল তুমি মহামূল্যবান কোন জিনিস চুরি করেছে তাই অন্য কারো হাতে ধরা পড়ার ভয়ে এভাবে ছুটে পালাচ্ছিলে। অবশ্য তুমি মহামূল্যবান সম্পদ ইতিমধ্যেই চুরি করে ফেলেছো। সেদিক বিবেচনা করলে অবশ্য তোমাকে চোর বলাই যায়।”
শ্রাবণের কথা শুনে সন্ধ্যা তো অবাক। শ্রাবণের কোন কথায় সন্ধ্যার মাথায় ঢুকছে না সব যেনো ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে । তাই আমতা আমতা করে বলল,
–“আমি আবার কি মহামূল্যবান সম্পদ চুরি করলাম বলুন তো? আমার জানামতে এমন কোন মহামূল্যবান সম্পদ চুরি করেছে বলে আমার মনে পড়ছে না।”
সন্ধার কথা শুনে শ্রাবণ দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে বলল,
–“আমার মনটা কি তোমার কম দামি জিনিস বলে মনে হয় সন্ধ্যা?”
–“মানে?”
–“এর অর্থ হলো তুমি আমার মন চুরি করেছ।আর এই অপরাধের জন্য তোমাকে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে?”
শ্রাবণের কথা শুনে এতক্ষণে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সন্ধ্যা। ওতো ভেবেছিল কি না কি হয়েছে? তারপর মুচকি হেসে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলল,
–“তো কি শাস্তি দেওয়া হয়েছে আমাকে?”
শ্রাবণ সন্ধ্যাকে আরো নিজের দিকে টেনে নিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
–“আমৃত্যু আমার সাথে থাকতে হবে তোমায়। আমাকে নিয়ে সাজাতে হবে তোমার রঙিন শহর। যে শহরের অলি-গলিতে শুধু আমার বিচরন থাকবে। অন্য কারো প্রবেশ সেখানে নিষিদ্ধ। কি শাস্তি মেনে নিতে রাজি তো?”
শ্রাবনের এত কাছে এসে সন্ধ্যার শরীর শিহরিত হয়ে উঠল। শ্রাবণের বলা কথাগুলো শুনে মনে দোলা দিচ্ছে অন্যরকম ভালোলাগা। এই ভালোলাগার বুঝি শেষ নেই কেবল দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। সন্ধ্যা ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,
–” তবে তাই হবে।আজ থেকে আমার রঙিন শহর শুধু আপনার নামে করে দিলাম। সেই শহরে অন্য কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ হোক আজ থেকে। সেই শহরের অলি-গলিতে শুধু আপনার বিচরণ থাকুক। আপনার ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে থাকুক সে শহর।”
–“মুখে বললে তো হবে না প্রমাণ চাই আমার।”
–“কি প্রমান লাগবে আপনার?”
–” তেমন কিছু না শুধু শহরটাকে রঙিন করতে অনুমতি চাই আমার। কি দিবে তো সেই অনুমতি?”
–“আপনার শহর আপনি সাজাবেন এতে অনুমতির দরকার আছে নাকি?”
সন্ধ্যার কথা শুনে শ্রাবণ মুচকি হেসে বলল,
–“চলো তাহলে শহরটাকে রঙিন রঙের চাদরে মুড়িয়ে দেই। নতুন ধাঁচে সাজায় শহরটাকে।”
সন্ধ্যা শ্রাবণের কথার প্রতি উত্তরে শুধু মৃদু হেসে শ্রাবনকে জড়িয়ে ধরল। সব কথা কি মুখে বলতে হয় তার থেকে থাক না কিছু কথা অনুভূতির আড়ালে। এভাবে চুপিসারে শুরু হোক নতুন স্বপ্ন বোনা। সকালের স্নিগ্ধ আলোকে সাক্ষী রেখেই দুটি দেহ পাড়ি দিল তাদের অজানা শহরের অলি-গলিতে। যে শহরের অলি-গলিতে মিশে আছে হাজারো অনুভূতি, হাজারো স্বপ্ন,আর হাজারো আকাঙ্ক্ষা। যে শহরটা একান্তই নিজের ওদের।
অন্যদিকে আরেকটি নির্ঘুম রাত কাটল রোদ আর নেহালের। দুজনের মনই তখন দগ্ধ অজানা অনুভূতিতে। একজনের মনদগ্ধ তার অনুভূতিগুলোকে নিজের করতে না পারায় আর অন্যজনের মনদগ্ধ প্রিয়তমকে অন্য কারো হতে দেখায়। এই দুর্বিসহ দহন থেকে হয়তো মুক্তি নেই দুজনের। তবে কি আজীবন এই দহনে জ্বলতে হবে ওদের দুজনকে নাকি জীবনের কোনো এক বাঁকে এর সমাপ্তি ঘটবে ? সেই বাঁক থেকেই শুরু হবে নতুন এক অধ্যায়। দেখা যাক নিয়তি কোন দিকে নিয়ে যায় ওদের।
প্রায় কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা নিচে এসে রান্নাঘরে গেল।এত সকালে রহিমা খালা ব্যতিত আর কেউ ওঠে নি দেখেই স্বস্তি পেল ও। তারপর ঝটপট কাজে লেগে পড়ল ও।সকলের জন্য চা করে নিয়ে যাবার রহিমা খালাকে বলল,
–“খালা আমি যতক্ষণে সবাইকে চা দিয়ে আসি আপনি ততক্ষণ বরং এদিকে সকালের নাস্তা করার জিনিসগুলো বের করে রাখুন। আমি এসেই বাকি রান্নাগুলো শেষ করব।”
–“ঠিক আছে মা তুমি যাও আমি সবকিছু রেডি কইরা রাখতেছি। এই লইয়া তুমি কোন চিন্তা কইরো না।”
–“ঠিক আছে খালা।”
সন্ধ্যা রান্না ঘর থেকে বের হতেই দেখল রশিদ সাহেব সোফায় বসে পেপার পড়বেন। সন্ধ্যাকে চা নিয়ে আসতে দেখে বললেন,
–“বেশ ভাল করেছো বৌমা আমি তো ভাবছিলাম চায়ের কথা আমি নিজেই তোমাকে বলবো । এই হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে চা না হলে কি চলে বল? সকালে উঠেই মনটা শুধু চা চা করে।”
–“হ্যা তোমার তো মনটা এমন চা চা করবেই।বাড়ির আমাকে একটু হয়রান করাতে হবে না ? হয়রান করাতে না পারলে তোমার তো আবার সকাল বেলা মনটা ভালো লাগে না ।”
কথাগুলো বলতে বলতে মিসেস রাবেয়া বেগম নিচের দিকে আসছিলেন। রশিদ সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
–“এমন ভাবে বলছো যেনো প্রতিদিন তুমি সেই কাকডাকা ভরে ওঠে আমাকে চা করে দাও?”
–“কবে দিলাম না তোমাকে চা করে শুনি?”
–“কবে দিয়েছো সেটাই তো মনে পড়ছে না আমার।”
–“কি বললে তুমি? এতগুলো বছর সংসার করে আজ আমাকে এই কথা শুনতে হলো তোমার থেকে?”
–“ হ্যাঁ দেখতে দেখতে জীবনের অনেকগুলো বছর যে কি করে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।”
সন্ধ্যা তখন নীরব দর্শকের মত অনাদির দিকে তাকিয়েছিল। দুজনের খুনসুটিময় ঝগড়া দেখে আপন মনেই হেসে উঠল সন্ধ্যা। হয়তো আজ থেকে বেশ কয়েক বছর পর এভাবেই সন্ধ্যা আর শ্রাবন খুনসুটিময় ঝগড়ায় মেতে উঠবে। এভাবেই হয়তো দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসার তোরে কেটে যাবে বাকি জীবন।
সন্ধ্যাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিসেস রাবেয়া বেগম বললেন,
–“আমাদের মিষ্টি ঝগড়া দেখে তুমি রাগ করো না?”
–“না মা রাগ করি নি কিন্তু আমার কাছে বেশ ভালো লাগছিলো আপনাদের এই মিষ্টি ঝগড়া গুলো।”
–“আমাদের দুজনের চায়ের কাপটা এদিকে দিয়ে তুমি বরং বাকিদের কে চা দিয়ে এসো।”
রাবেয়া বেগমের কথা শেষ না হতেই সেখানে এসে উপস্থিত হলেন মনোয়ারা বেগম। সন্ধ্যাকে দেখে বিস্বাদে ভরে ওঠল ওনার মন। সেই সাথে হানা দিল গতকাল রাতের রাগটা। গতকাল রাতে তুলিকে নিজের কাছে নিয়ে শ্রাবণের ব্যাপারটা বুঝাচ্ছিলেন ওনি। কিন্তু তুলি ওনার কথায় সায় না দিয়ে ওনাকে দু-চার কথা শুনিয়ে দিয়েছে। মেয়ের এহেন নির্বুদ্ধিতার কথা শুনে তখন থেকেই মেয়ের উপর বেজায় চটেছেন তিনি। তবে তার মূল রাগটা যে সন্ধ্যাকে কেন্দ্র করে এতে কোন সন্দেহ নেই। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ছক করতে লাগলেন কিভাবে সন্ধ্যাকে তিনি শ্রাবণের জীবন থেকে সরিয়ে ফেলবেন। কাজটা অবশ্য মোটেও সহজ নয় উনার পক্ষে এজন্য প্রতিপক্ষ কাউকে দরকার তার যে ও তার মতই সন্ধ্যার শ্রাবনকে আলাদা করতে চাই। তবে এজন্য প্রথমে ওনাকে এ বাড়িতে থাকার বন্দোবস্ত করতে হবে। তা না হলে সবকিছুই উনার হাতের বাহিরে চলে যাবে কিন্তু সেইটা তো তিনি হতে দিবেন না কিছুতেই। তাই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মনোয়ারা বেগম বলে উঠলেন,
–“আমি এখন থেইকা ঢাকাতেই থাকতে চাই ভাইজান। আসলে তুলিত বড় হচ্ছে তাই ঢাকাতেই ভালো কলেজে ভর্তি করে দিতে চাচ্ছি। তুলির পড়াশোনা শেষ হওয়া অব্দি বাড়ির জমি জমা না হয় অন্য কাউকে দেখার জন্য ভার দিতে হবে।”
বোনের কথা শুনে খুশিতে চকচক করে উঠলো রশিদ সাহেবের চোখদুটো। ছোট বোনটাকে অনেক আগেই এখানে থাকতে বলেছিলেন তিনি কিন্তু বোন তার স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়ি ছেড়ে এখানে থাকার জন্য রাজি হচ্ছিল না। আজ যখন বোন হাজির হয়েছে তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
–“আমিতো তোকে এই কথা আগেই বলেছিলাম। তুইতো রাজি হলি না। এতদিনে ভালো একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। তুই কোন চিন্তা করিস না তুলি মা কে কলেজে ভর্তি করার দায়িত্ব আমার।”
–“তোমার উপর ভরসা করেই তো এখানে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম ভাইজান।”
–“একদম ঠিক কাজ করেছিস তুই।”
কথাগুলো বলে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বললেন,
–“বৌমা যাও তো শ্রাবনকে দিকে ডেকে নিয়ে এসো। ওর সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
–“ঠিক আছে বাবা । আমি এক্ষুনি ডেকে নিয়ে আসছি।”
সন্ধ্যা রফিক সাহেবের কথা অনুযায়ী এক কাপ চা হাতে নিয়ে চলে গেল ওদের ঘরের দিকে। পেছনে তাকালে সন্ধ্যা হয়তো বুঝতে পারত একজোড়া চোখ বড় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
চলবে
(কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। বিগত কয়েকটা দিন একটু পারিবারিক সমস্যায় ছিলাম বলে গল্প দিতে পারেনি তাই এখন থেকে নির্মিত গল্প দিব। আর গল্প নিয়ে আপনাদের যদি কোন অভিযোগ থাকে তাহলে কমেন্টে জানাবেন। ভালো থাকবেন সবাই। হ্যাপি রিডিং ??)