শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-৩০
#আমিনা আফরোজ
সময় তখন রাতের দ্বিপ্রহর। চারিদিক নিস্তব্ধ। পুরো শহরটাই যেন নিরবতার চাদরে মুড়ে আছে। নিস্তব্ধ এই শহরটাকে যেন কোন এক মৃত্যুপুরী রাজ্য বলে মনে হচ্ছে । সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে সবাই যখন পাড়ি জমিয়েছে ঘুমের রাজ্যে তখনো দুজোড়া কপোত-কপোতী ব্যস্ত তাদের রঙিন স্বপ্ন বুনতে।
সময়ের সাথে সাথে বেড়ে চলেছে শীতের তীব্রতা। দূর সীমান্তে ক্রমেই বেড়ে চলছে কুয়াশার আস্তরণ। কুয়াশার এ আস্তরনের জন্যই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না কোন কিছুই। সামনে তাকালে শুধু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে একরাশ সাদা ধোঁয়ার। ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলোরও টিমটিম করে জ্বলছে । তারবিহীন নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সন্ধ্যা। মৃদু হাওয়ার তোড়ে উড়ছে ওর অবাধ্য চুলগুলো। কিন্তু সেদিকে সন্ধ্যার কোন খেয়াল নেই। ও ডুবে আছে অন্য কোন খেয়ালে। সন্ধ্যার পাশে দাঁড়িয়েই শ্রাবণ সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার মনের কোণে যে কষ্টের কালো মেঘরা এসে ভর করেছে তা অনুভব করতে পারছে ও। তাইতো নিচে থেকে আসার পর থেকে এমন চুপচাপ গম্ভীর হয়ে আছে ওর মায়াবতী। তখন সন্ধ্যাকে ফুপির ঐ কথাগুলো বলা ঠিক হয় হয়নি তবুও ফুফুকে কিছু বলতে পারে নি ও। বয়স্ক মানুষকে আর কত বলা যায়। শুধু ফুপুর দিকে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে সন্ধ্যার হাত ধরে উপরে নিয়ে এসেছিল ও । কিন্তু এই মুহূর্তে শ্রাবণের নিজেকে ব্যর্থ স্বামী বলে মনে হচ্ছে । সন্ধ্যার অপমানে জোর গলায় কিছু বলতে না পারার অনুতাপে পুড়ছে ও। সন্ধ্যার এ কষ্টে শ্রাবণেরও যে কষ্ট হচ্ছে । শ্রাবনের নিজের মনের অবস্থাও যে খুব একটা ভালো এমনটাও নয়। রোদের বিষয়টা নিয়ে ওর নিজেরও রয়েছে হাজার সংশয়। মনটা কেন যেন ওর অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠছে বারবার ।
তখন নেহাল চলে যাবার পর বাড়ির প্রতিটি সদস্য চুপ করে বসেছিল অনেকক্ষণ। যেনো এই মুহূর্তে সবাই বোবা হয়ে গেছে । মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের ক্যাচক্যাচ শব্দ তখন সকলের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুশ্চিন্তা আর বিরক্তির আভাস তখন সকলের মুখে বিদ্যমান । নীরবতার রেশ কাটিয়ে মনোয়ারা বেগমই সর্বপ্রথম বলে উঠলেন,
–“ছেলেটা যা বলে গেল তা কি সত্য রোদ?”
রোদ কখন ড্রইংরুমের এক কোনায় চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। ফুপির গলার আওয়াজ শুনে মুখ তুলে তাকালো ও। ফুপির চোখে সন্দেহের আভাস পেতেই চুপসে গেল ও। মনে মনে দোয়া পড়তে লাগল রোদ। আজ এ বিপদ থেকে রক্ষা পেল আর কোনদিন এমন পাগলামী করবে না বলে ওয়াদাও করলো মনে মনে। দোয়া পড়তে পড়তেই সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে নিল ও। দেখল ওর বাবা-মা সোফায় বসে উত্তরের অপেক্ষায় ওর দিকেই তাকিয়ে আছে আর ওর বাবার পাশে বসে ফুপি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। এভাবে তাকানোর অর্থ বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হলো না ওর। এর অর্থ হলো- আর একটা মিথ্যে কথা বলবি তো তোর গাল থাপ্পর দিয়ে লাল করে দিব। তুলি আর প্রিয়ন্তীকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল । দুজনেই দাঁত দিয়ে নখ কামড়ে কিছু একটা ভেবে চলেছে। ঘরে গিয়ে আজ যে ও আর রক্ষা পাবে না এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত রোদ। শ্রাবনকে ওর বাবার পাশে বসে থাকতে দেখলেও সন্ধ্যাকে ঘরের এক কোনায় দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দেখতে পেল ও।
–“কিরে চুপ করে আছিস কেন? কথা কি কানে যাচ্ছে না নাকি?”
ফুপির ধমক শুনে সবার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবারো ফুপির দিকে তাকাল ও। তারপর মৃদু স্বরে বলল,
–” হ্যা ফুপি ওনি যা বলে গেছেন তা সত্যি।”
–“তো অমন নির্জন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার কি প্রয়োজন ছিল তোর শুনি?”
–“আমার মন খারাপ থাকলে আমি ঐখানে যাই। এর আগেও কয়েকদিন গিয়েছি এমন ঘটনায় পরি নি কখনই। প্রিয়ন্তিও এর আগে গেছে সেখানে।”
রোদের কথা শোনার পর সবাই এবার একসাথে প্রিয়ন্তির দিকে তাকালো। সবার এভাবে তাকানো দেখে আবারো ভয় পেলো ও। মনোয়ারা বেগম তখন বাজখাঁই গলায় বললেন,
–“তুমিও রোদের সাথে গিয়েছিলে নাকি?”
প্রিয়ন্তি ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
–” জি আমি রোদের সঙ্গে বার তিনেক গিয়েছিলাম সেখানে।”
–“গিয়েছিলে ভালো কথা তো এমন ভয়ে ভয়ে বলছো কেন?”
মনোয়ারা বেগমের কথার প্রত্তিউত্তরে রশিদ সাহেব নিজেই বললেন,
–“আহ মনু থাম এবার।বাচ্চা মেয়েটাকে এভাবে ভয় দেখাস না আর। ও বোধহয় রোদের ঘটনা শুনে এমনিতেই ভয়ে আছে। তুই আর ওর ভয়টা বাড়াস না।”
রশিদ সাহেবের বলা কথাগুলো হয়তো মনোয়ারা বেগমের ভালো লাগে নি তাইতো তিনি ভাইয়ের ওপর ক্রোধে জোর গলায় সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
–“সব দোষ এই মেয়ের। যবে থেকে ও এই বাড়িতে এসেছে তবে থেকেই ঝামেলা শুরু হয়েছে।”
–” আহ মনু এর মধ্যে তুই আবার সন্ধ্যাকে টানছিস কেন? ওর কি দোষ এখানে?”
–” ঐ তো সবার নাটের গুরু। অলক্ষি,অপয়া মেয়ে।এ বাড়ির সর্বনাশ করতে এসেছে ও। খোঁজ নিয়ে দেখো গ্রামে কোন কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে এসেছে নাকি।”
রশিদ সাহেব এবার বেশ জোরেই মনোয়ারা বেগমকে ধমকে বললেন,
–“চুপ করবি তুই এবার? আমি বলছি তো সন্ধ্যার এখানে কোন দোষ নেই তবুও তুই ওকে এইসব বলেই যাচ্ছিস।”
ভাইকে রেগে যেতে দেখে কিছু না বলে চুপ করে রইলেন মনোয়ারা বেগম। তবে সন্ধ্যাকে তখনো মনে মনে গালি দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। অবস্থা বেগতিক দেখে শ্রাবন সন্ধ্যার হাত ধরে ওর ফুপুর দিকে তাকিয়ে বলল,
–“আমার বউ কেমন তা আমি জানি ফুপু। তোমার থেকে আমার বউয়ের সম্পর্কে কিছু জানতে হবে না। আর রইল রোদের কথা সেটাও একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি।”
ছেলের কথা শুনে রশিদ সাহেব বললেন,
–” কি ভেবেছিস এ ব্যপারে?”
–“বাবা ছেলেটার সব সম্পর্কে সব খোঁজ-খবর নিয়ে যদি দেখি ছেলে ভালো তাহলে বিয়ে দিতে বাধা কোথায়।”
–“এইটা ঠিক বলেছিস। তাহলে কাল থেকেই ছেলেটার বিষয়ে খোঁজ নেওয়া শুরু কর।”
–“ঠিক আছে বাবা। তুমি কোন চিন্তা করো না,আমি দেখছি কি করা যায়।”
তারপর সন্ধ্যার হাত ধরে ওপরে নিয়ে এসেছে ও। ততক্ষণে সন্ধ্যার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে কয়েক ফোঁটা নোনা পানি। ড্রয়িং রুমের উপস্থিত সকলে নিরবে যে যার ঘরের দিকে চলে গেল।
তখনকার ভাবনা শেষ হতেই শ্রাবণ এগিয়ে গেল ওর মায়াবতীর দিকে। পরম যত্নে মুড়িয়ে নিলো ওর মায়াবতীকে। যেন আর কোন কষ্ট ওর মায়াবতীকে ছুঁতে না পারে।সন্ধ্যাও পরম ভরসায় শ্রাবণের বুকে মাথা রাখল। নিমিষেই সব কষ্ট যেন হাওয়খ হয়ে গেল তার পরিবর্তে মন জুড়ে দখল করল শান্তি।বাকি রাতটুকু কাটল সুখের স্পর্শে।
অন্যদিকে নিচে থেকে নিজের ঘরে আসতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রোদ। এতক্ষণ যেন দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রোদের। আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে হয়ত মারাই যেত ও। ঘরে আসতেই তুলি আর প্রিয়ন্তী ঘিরে ধরলো রোদকে।ওদের চোখে তখন কৌতুহলী দৃষ্টি।ওদের দেখে ভাবলেশহীন ভাবে রোদ বলল,
–“তোরা দুজন আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”
রোদের কথা শুনে প্রিয়ন্তী এবার রেগে বলল,
–“দেখ রোদ আমি তোকে সেই ছোটবেলা থেকে চিনি। তাই আমাকে এমন মিথ্যে বাহানা দিতে আসবি না । কি ঘটেছে সব সত্যি করে বল আমাকে।”
রোদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় ওপর দুই পা ভাঁজ করে বসল। রোদের দেখাদেখি প্রিয়ন্তী আর তুলিও ততক্ষণে বিছানায় এসে বসেছে। তারপর বলল,
–“আমি ওনাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতাম কিন্তু ওনাকে কখনো বলি নি একথা। এতগুলো দিন সে কথা নিজের মাঝেই রেখেছিলাম । শুধু রাতের নিস্তব্ধতারা জানতো আমার এ অনুভূতির কথা। ভেবেছিলাম তাকে কখনো আমার এই অনুভূতির কথা গুলো বলবো না কিন্তু আজ যখন তার সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম তখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে নি। বলে দিয়েছি তাকে আমার মনে জমে থাকা সুপ্ত অনুভূতিগুলো যার দহনে প্রতিনিয়ত দগ্ধ আমি।”
–“স্যার তোর কথাগুলো শোনার পরেই বিয়ে করে নিল তোকে?”
–“না তিনি বিয়ে করেন নি বলতে পারিস আমিই জোর করে বিয়ে করেছি ওনাকে। আমি নিজেও জানি না কাজটা ঠিক করেছি কি না কিন্তু সেই মুহূর্তে এটাই আমার কাছে ঠিক বলে মনে হয়েছে।”
–“এখন যদি শ্রাবণ ভাইয়া স্যারের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে আসল ঘটনা জেনে যায় তাহলে কি হবে ভেবে দেখেছিস একবার?”
–“আমি তো চেয়েছিলাম বাড়িতে এসে সবাইকে সত্যি কথাই বলব কিন্তু উনি যে কেন মিথ্যা কথা বলল তা এখনো বুঝতে পারছি না আমি। উনি যে এখানে এসে এমন একটা কাহিনী বানিয়ে বলবেন সেটা আগে থেকে জানতাম না আমি।”
প্রিয়ন্তী কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বললে উঠলো,
–“স্যার যেহেতু নিজে এ কাহিনী বানিয়েছেন সেহেতু আর কোনো চিন্তা করিস না তুই।স্যার নিজেই সবকিছু সামলে নিবেন।”
প্রিয়ন্তীর কথার প্রতিউত্তর দেওয়ার আগেই রোদের পাশে রাখা ফোনে আলো জ্বলে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটি দেখেই রোদ ওর ফোন নিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেল বারান্দার দিকে। প্রিয়ন্তী আর তুলি সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আবারো নিজেদের গল্পে মেতে উঠল।
চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। আজকের পর্ব কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্প পড়ে সবাই নিজেদের মতামত জানাতে ভুলবেন না কিন্তু । ভালো থাকবেন সবাই।)