শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-২১
#আমিনা আফরোজ
সকালের মিষ্টি রোদের ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেল সন্ধ্যার। সূর্যের সোনালী আলোয় কেটি রাতের অন্ধকার।ভোরের স্নিগ্ধ আলোকে সাক্ষী রেখেই সূচনা ঘটল আরেকটি নতুন দিনের। নিজকে কারো বাহুডোরে আবিষ্কার করতেই পিছন ফিরে তাকিয়েই দেখতে পেল শ্রাবণের নিষ্পাপ মুখ। শ্রাবণের দিকে তাকিয়েই আনমনে হেসে উঠলো সন্ধ্যা।এই মানুষটির সাথে আগের শ্রাবণের কোনই মিল খুঁজে পাচ্ছে না ও। এই শ্রাবণ সম্পূর্ণ নতুন আরেকজন । যার চোখে ওর জন্য শুধু একরাশ ভালোবাসা দেখতে পায়। এইসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে সন্ধ্যার খেয়াল হলো এখন ওকে ওঠতে হবে। বাড়ির বউদের যে এতক্ষণ ঘুমাতে নেই।তাই দ্রুত বিছানা থেকে উঠতে নিলেই বাধা পায় শ্রাবণের কাছ থেকে। সন্ধ্যা যত ওঠার জন্য চেষ্টা করছে শ্রাবণ ঠিক ততটাই সন্ধ্যাকে নিজের সাথে জরিয়ে নিচ্ছে। শেষ অব্দি শ্রাবণের সাথে পেরে ওঠতে না পেরে সন্ধ্যা অসহায় স্বরে বলল,
–“দয়া করে এখন ছেড়ে দিন। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাড়ির সবাই কি ভাবছে বলুন তো?”
সন্ধ্যার কথা শুনে শ্রাবণ ঘুম জড়ানো স্বরে বলল,
–“তোমাকে এখন ছাড়া যাবে না। আপাতত আরো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকো আমার পাশে।”
শ্রাবণের কথা শুনে সন্ধ্যা অবাক হয়ে বলল,
–“আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?”
–“মাথা খারাপ হয়ে নি তবে মনটা বুঝি খারাপ হয়ে গেছে আমার। মন শুধু বলে তোমার কাছাকাছি থাকতে।এতে আমার কি দোষ বলো তো?”
–“থাক এখন আর আপনাকে নিজের দোষ খুঁজতে হবে না। আপাতত আমাকে ছাড়ুন।আমি ফ্রেশ হয়ে নিচে যাব।”
–“না গেলে হয় না ? আমার যে তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।”
–“না হয় না আর ছাড়তে ইচ্ছে না করলেও ছাড়তে হবে এখন।”
–“কি আর করার আছে, বউ যদি অবুঝ হয় তাহলে তো আর করার কিছু নেই। যাও তবে তার আগে আমাকে আমার পাওনাটা দিয়ে যাও।”
–“আপনার আবার কিসের পাওনা?”
–” আরে ভুলে গেলে ? প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে স্ত্রীর কাছ থেকে আদর পাওয়াটা স্বামীদের কাছে মিষ্টি পাওনা।”
–“তাই বুঝি?”
–” হুম তাই । এখন এত বেশি কথা না বলে ঝটপট কাজটা সেরে ফেলো দেখি।”
–“পারবো না ,ছাড়ুন তো । আপনার এই সব আজগুবি কথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না। সব সময় শুধু বাহানা , ছাড়ুন।”
–“দেখো ভালো করে বলছি শুনছো না তো? আমি যদি কাজটা করতে যাই তবে কিন্তু তোমাকে অনেক পস্তাতে হবে । এখন বলো কি করবে তুমি?”
–“দেখুন…
সন্ধ্যাকে আর কথা বলতে না দিয়ে শ্রাবণ বলল,
–“বুঝতে পেরেছি তোমাকে দিয়ে হবে না, যা করার আমাকেই করতে হবে।”
এই বলে শ্রাবন সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। ততক্ষণে শ্রাবণের হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে আসতেই সন্ধ্যা সুযোগ বুঝে বিছানা থেকে উঠে এক দৌড়ে রোদের ঘরের দিকে চলে গেল। এদিকে শ্রাবণ তখনও হতভম্ব হয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে আছে । সন্ধ্যা যে এমন একটা কান্ড করবে তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি ও।
যতক্ষণে বুঝতে পেরেছিল ততক্ষণে সন্ধ্যা ওর নাগালের বাহিরে চলে গেছে। শ্রাবণের ঘোর কাটতেই জোর গলায় সন্ধ্যাকে বলল,
–“আমার থেকে পালিয়ে কতদূর যাবে তুমি? সেই তো আবার আমার কাছে ফিরতে হবে। তবে এর শোধ আমি তুলব শুধু একবার পাই তোমাকে।”
সন্ধ্যাও শ্রাবনকে ভেংচি কেটে বলল,
–“সে পরে দেখা যাবে। আগে তো কাছে পান তারপর না হয় তুলবেন।”
শ্রাবণ সন্ধ্যার কথা শুনে মুচকি হেসে মনে মনে বলল,
–“তোমাকে কি করে কাছে আনতে হয় তা আমি খুব ভালো করেই জানি।এখন শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা তারপর দেখো আমি কি করি।”
কথাগুলো মনে মনে বলে আবারো ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো শ্রাবণ এদিকে সন্ধ্যা রোদের ঘরে আসতেই দেখল রোদ একাকী বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। কারো উপস্থিতির আভাস পেতেই সে দিকে তাকালো রোদ। সন্ধ্যাকে সকালে নিজের ঘরে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল ও। নিচু স্বরে বলল,
–“তুমি এত সকালে আমার ঘরে কেন ভাবি? কিছু কি লাগবে?”
–“তুমি এত সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কি করো?”
–“ঘরের ভিতরে ভালো লাগতেছিল না তাই ভাবলাম বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। তুমি এখানে কি করো?”
–“তেমন কিছু নয়। তুমি থাকো আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”
–“ঠিক আছে যাও।”
সন্ধ্যা রোদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফ্রেশ হতে। সন্ধ্যা চলে যেতে হাফ ছেড়ে বাঁচলো রোদ। কালকের কথাটা কিছুতেই জানাতে চায় না ও সন্ধ্যা। তাছাড়া এই নাম না জানা অনুভূতির কথা কিই বা বলবে সন্ধ্যাকে। ওতো নিজেই বিষয়ে এখনও সন্দিহান। তাই আপাতত সঠিক সময়ে না আসা পর্যন্ত কিছুতেই কাউকে বলবে না রোদ। ততদিন অব্দি এই অনুভূতি গুলো যত্ন করে মনের মনিকোঠায় রেখে দিবে ও।
এদিকে সন্ধ্যা ফ্রেশ হয়ে তড়িঘড়ি করে নিচে চলে গেল। বাড়ির সবাই ততক্ষণ উঠে পড়েছে। সন্ধ্যা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল রান্না ঘরের দিকে। মিসেস রাবেয়া বেগম তখন সকালের নাস্তা তৈরি করছিলেন। সন্ধ্যাকে রান্না করে দেখে বললেন,
–“এ মা তুমি কেন আজ রান্না করে এসেছ বল তো? যাও নিজের ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করো। আমি এদিকটা সামলিয়ে নিবো।”
মিসেস রাবেয়া বেগমের কথার প্রতি উত্তরে সন্ধ্যা কিছু বলার আগেই পিছন থেকে মনোয়ারা বেগম বলে উঠলেন,
–“বাড়ির বউ কখনো এত দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে দেখেছো কোথাও? কোথায় সকাল সকাল উঠে শাশুড়ির সাথে একটু কাজে সহায়তা করবে তা না ওনি এত বেলা করে ওঠে এতোক্ষণে রান্না ঘরে আসছেন।”
মনোয়ারা বেগমের কথা শুনে মিসেস রাবেয়া বেগম বলে উঠলেন,
–“ওকে কিছু বোলো না মনু। ছোট মানুষ এত কিছু বোঝে নাকি? তাছাড়া আমি তো আছিই। এখনই সংসারের দায়িত্ব নিতে হবে না।”
–“থাক ভাবি তুমি আর এ মেয়ের হয়ে কথা বলো না। বাড়ির বউদের বাড়ির বউ এর মতই থাকতে বল। এতেই সংসারের মঙ্গল হবে।”
কথাগুলো বলে মনোয়ারা বেগম আর কারো কথা না শুনেই নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। এ মেয়েকে তো তিনি দুদিনেই এখান থেকে তারাবেন। তারপর তুলিকে বাড়ির বউ বানাবেন।
মনোয়ারা বেগমের কথা শুনে সন্ধ্যার মনটা খারাপ হয়ে গেল । এতে অবশ্য মনোয়ারা বেগমকে দোষ দিচ্ছে না ও। উনি তো ঠিকই বলেছেন বাড়ির বউরা তো আর এতক্ষণ অবদি ঘুমায় না। সন্ধ্যাকে মন খারাপ করতে দেখে মিসেস রাবেয়া বেগম হেসে বললেন,
–“মনুর কথা শুনে রাগ করো না তো। ও একটু এমনি।”
সন্ধ্যা মুচকি হেসে মিসেস রাবেয়া বেগমের কাছে গিয়ে বলল,
–“আমি আপনার কাজে একটু সহযোগিতা করে দিই আন্টি?”
সন্ধ্যার মুখে আন্টি ডাক শুনে ভ্রুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন,
–“আমি কি তোমার আন্টি হই নাকি?”
সন্ধ্যা নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল,
–“দুঃখিত মা। আসলে এতদিন আন্টি বলে অভ্যাস হয়ে গেছে তো তাই আন্টি বলে ডেকে ফেলেছি।”
–“ঠিক আছে তবে এরপর থেকে যেন আর আন্টি বলে ডাকতে না শুনি। মনে থাকবে তো ?”
–“জি মা মনে থাকবে।”
সন্ধ্যা বাকি কাজটুকু মিসেস রাবেয়া বেগমের সাথে করতে লাগলো। সকালের নাস্তা তৈরি হলে রাবেয়া বেগম সবাইকে নিচে খেতে ডাকলেন । মিসেস রাবেয়া বেগমের ডাক দেওয়ার মিনিট দশেকের মধ্যে সবাই খাবার টেবিলে এসে উপস্থিত হলো। সবাইকে খাবার সার্ফ করে দিল সন্ধ্যা নিজেই। এটা অবশ্য রাবেয়া বেগম বাদ সাধলেন না। তিনি চাচ্ছিলেন না মনোয়ারা বেগম আমার সন্ধ্যাকে কথা শুনাক। খাওয়া হলে শ্রাবণ সবার উদ্দেশ্যে বলল,
–“আজ বিকেলে সবাই মিলে বাইরে যাব। তাই সময়মত সবাই তৈরি থাকিস। রোদ, প্রিয়ন্তী আর তুলি তোরাও কিন্তু যাচ্ছিস।”
শ্রাবণের কথা শুনে মনোয়ারা বেগম বললেন,
–“মেয়েদের অত বাইরে যাওয়ার কি দরকার?ওদের বাইরে যেতে হবে না।তোরা চলে যাচ্ছিস যা।”
–“এই সময়ে এসেও তুমি এইসব কি কথাবার্তা বলো ফুপি? আমি কোন কথা শুনতে চাই না। বিকেলে আমি সবাইকে নিয়ে বাইরে যাব, মনে থাকে যেন কথাটা।”
শ্রাবণের কথা শুনে প্রিয়ন্তী তো বেজায় খুশি। মনে মনে বলল,
–“শ্রাবণ ভাইয়া বুড়িকে কথা শুনিয়ে খুব ভালো করেছে। সব বিষয়েই বুড়িটা কথা বলবেই বলবে। বয়স্ক মানুষ একটুখানি চুপ করে থাকলেই তো হয় তা না সব সময় কথা বলে।”
শ্রাবনের কথা শুনে যে যার ঘরের দিকে চলে গেল। গতকাল ফুপির কথা শুনে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছাটুকু শেষ হয়ে গেছে ওর তবুও সবার জন্য রাজি হয়েছে ও।
হেমন্তের পড়ন্ত বিকেল বেলায় প্রকৃতি সেজেছে নিজের রূপে। গোধূলির কনে দেখা আলো সেজেছে সে। গোধূলি লগ্নে শহরের অভিজাত রেস্টুরেন্টে বসে আছে সবাই। সবার মাঝে হাসিমুখ থাকলেও দূরে বসে থাকা একজনের মুখে নেই কোন হাসি। এত প্রতীক্ষার প্রহর শেষে প্রিয়জনকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা হবে নাকি সেই মানুষটিকে অন্য কারো সাথে দেখে রাগ করবে তাই ভেবে ওঠতে পারছে না সে। তাই ধীর পায়ে বহুপ্রতীক্ষিত মানুষটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে।
চলবে
(কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুল ত্রুটি গুলো ক্ষমার নজরে দেখবেন । গতকাল আমার গল্পের জন্য অনেকের অনুরোধে একটি ম্যাসেঞ্জারে গ্রুপ খুলেছি। যারা সেই গ্রুপে এবং হতে চান জানাবেন। তবে গ্রুপে এড হতে হলে নিয়মিত পাঠক হতে হবে। আশা করি আজকের পর্ব ভালো লাগবে আপনাদের। ভাল থাকবেন সবাই।হাপি রিডিং ???)