শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-২০
#আমিনা আফরোজ
রাত যত গভীর হচ্ছে নিস্তব্ধতা যেন ততই বেড়ে চলেছে। সেই সাথে থেমে গেছে দূরের কোলাহল। শহরটাকে যেন নিস্তব্ধতার চাঁদরে কেউ মুরিয়ে নিয়েছে। রাতের নিরবতার প্রহর চললেও রোদের ঘরে তখন চলছে তুমুল ঝগড়া ।দু পক্ষের কেউ হারতে রাজি নয় । দু পক্ষের মধ্যে ভাবটা এমন যেন ঝগড়ায় হেরে গেলে তাদের বিরাট কোন ক্ষতি হয়ে যাবে।প্রিয়ন্তি আর তুলির ঝগড়া দেখে মনে হচ্ছে আজ সবকিছু শেষ হয়ে গেলেও ওরা ওদের ঝগড়া অব্যহত রাখবেই রাখবে।অন্যদিকে রোহান আর সৌরভদের ও একই কান্ড। সময়ের সাথে সাথে এরা যেন আরো দিনকে দিন বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে। এদের এমন ছেলেমানুষি ঝগড়া দেখে বেশ বিরক্ত রোদ। এমনিতেই সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে ওর তার মাঝে ওদের এমন কাণ্ড দেখে বড় বিরক্ত লাগছে রোদের। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতেও পারছে না ওদের। রোদকে এমন চুপ করে থাকতে দেখে রোহান বলল,
–“রোদ আমাদের ন্যায্য পাওনাটা আমাদের দিয়ে দাও তো?”
রোহানের কথা শুনে প্রিয়ন্তি রাগী গলায় বলে ওঠল,
–“আপনাদের কিসের পাওনা শুনি?”
প্রিয়ন্তির প্রশ্নের জবাবে সৌরভ বলল,
–” আমরা যে এত কষ্ট করে ঘর সাজালাম তার কোন মূল্য নেই নাকি? হিসেব মতে এই টাকাতে তো তোমাদের কোন হক নেই তবু ও পিচ্চি বলে কিছু দিচ্ছি তা নাহলে একটা টাকাও দিতাম না।”
সৌরভের কথা শুনে তুলি রেগে বলল,
–“আমাদেরকে আপনার কোন দিক দিয়ে পিচ্চি বলে মনে হচ্ছে?আমার তো এখন মনে হচ্ছে আপনার চোখে কোন সমস্যা আছে।কালকেই একটা ভালো ডাক্তারের কাছে যাবেন।না হলে দেখা যাবে কাকে না কাকে কি বলে ডাকছেন । তখন আবার পাবলিকের মাইর খাবেন।”
তুলির বলা কথাটাই রোহান আর সৌরভের রাগ বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। হাঁটুর বয়সি পিচ্চিদের থেকে এত অপমান আর সহ্য করতে পারছিল না ওরা। রাগে সারা শরীর কাঁপছে ওদের ।এদের যে করেই হোক শাহেস্তা করতেই হবে ওদের তা না হলে শান্তি পাবে না ওরা। অবস্থা বেগতিক দেখে রোদ এবার নিজেই জোরে বলে ওঠল,
–“তোরা এমন বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছিস কেন? ”
প্রিয়ন্তি রোদের কথা শুনে অবাক হয়ে বলল,
–” আমরা ঝগড়া করছি নাকি ওনারা ঝগড়া করছে। ছেলেরা যে এত ঝগড়া করতে পারে তা আজ জানলাম।”
প্রিয়ন্তির কথার জবাবে রোহান কিছু বলতেই যাচ্ছিল কিন্তু তার আগে রোদ নিজেই বলে উঠলো,
–“তোরাও তো কম যাস না। সেই কখন থেকে ঝগড়া করেই যাচ্ছিস। এভাবে ঝগড়া করলে তো আর সমস্যার সমাধান হবে না তাই না? তাই ঝগড়া বন্ধ করে ঠান্ডা মাথায় সমস্যার সমাধান করতে হবে।”
রোদের এমন কথা শুনে প্রিয়ন্তি মুখ ভেঙ্গচিয়ে গেয়ে ওঠলো,
–“আমরা তো ভালা না
ভালা লইয়াই থাইকো ”
রোদ প্রিয়ন্তির গান শুনেও না শোনার ভান করে রোহানদের দিকে তাকিয়ে বলল,
–” আপনাদের এভাবে টাকা না দিয়ে তার থেকে বরং আমরা আগামীকাল সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে যেতে যাই। এতে করে সবাই একসাথে কিছুটা সময় আনন্দে কাটাতে পারব।এখন বলুন আপনাদের মতামত কি?”
রোহান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
–“আইডিয়া তো দারুন হয়েছে তোমার , এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে আমার সন্দেহ
হচ্ছে অন্য জায়গায়?”
রোদ ভ্রু- কুচকে জিজ্ঞাসা করল,
–” কোন বিষয় নিয়ে আপনার সন্দেহ হচ্ছে তা বলতে পারেন।”
–” সন্দেহ না, আমি পুরোপুরি নিশ্চিত তোমার এই তারছেড়া বান্ধবীদের নিয়ে গেলে আনন্দের জায়গায় কষ্টটাই বেশি হবে আমাদের। শেষে দেখা যাবে আমরা রেস্টুরেন্টে বসে কান্না করছি। ভাবতে পারছো ব্যাপারটা।”
রোহানের কথা শুনে প্রিয়ন্তি রেগে বলে উঠলো,
–“কি বললেন আপনি?”
রোদ ঝগড়ার পূর্বাভাস পেতেই কোন রকমে প্রিয়ন্তিকে সামলিয়ে বলে উঠলো,
–” ওদের সামলানোর দায়িত্বটা না হয় আমি নিলাম।এখন বলুন আপনারা রাজি আছেন কি না?”
–“ঠিক আছে আমরা রাজি।”
–“তাহলে আগামীকাল বিকেল বেলা আমরা রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি ।তবে আপনি একটু ভাইয়াকে রাজি করাবেন।বাদ বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নিব।”
–“ঠিক আছে।”
রোদরা যখন আড্ডায় ব্যস্ত ঠিক তখনই রুমে ঘরে আগমন ঘটল মনোয়ারা বেগমের। ওদের ঘর থেকে জোরে কথা বলার আওয়াজ শুনেই এ ঘরে এসেছেন তিনি। ঘরে ঢুকেই রোহান আর সৌরভকে দেখে ভ্রূ-কুচকে গেল ওনার।তিনি রোহান আর সৌরভের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–“কি ব্যাপার তোমরা এত রাতে রোদের ঘরে কি করছো?”
মনোয়ারা বেগমকে দেখে রোহান আর সৌরভের মুখে ততক্ষণে ভয়ের সাথে সাথে বিরক্তিও ফুটে উঠেছে। এই মহিলা যেকোন কথাকে তিল থেকে তাল বানাতে বেশ পটু এইটা ওরা আগে থেকেই জানে।তাই এনাকে ওরা একটু এগিয়েই চলে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে ওদের অস্বস্তি যেন দ্বিগুন বেড়ে গেল । তবুও নিজেদের যথেষ্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলল,
–“বিয়ে উপলক্ষে সবাই মিলেএকটু আড্ডা দিচ্ছিলাম।”
–“আড্ডা দিচ্ছেলে ভালো কথা কিন্তু মেয়েদের সাথে কেন? তোমরা ছেলেমানুষ ছেলেদের সাথে আড্ডা দিবে।”
মনোয়ারা বেগমের এমন কথা শুনে রোদ বেশ অস্বস্তিতে পড়ল। রোদ ওর ফুপুদের মধ্যে মনোয়ারা বেগমকেই খুব ভয় পায়। ভয়ের মূল কারণ ওনার এমন গাম্ভীর্যতা।তবে এখন লজ্জা পাচ্ছে ও না জানি রোহানরা কি ভেবে বসল আবার এ নিয়ে। তাই নিজেই বলে ওঠল,
–“উনাদের কোন দোষ নেই ফুপু। আমিই আড্ডা দেওয়ার জন্য ওনাদের ডেকে এনেছিলাম আমার ঘরে।”
মনোয়ারা বেগম রোদের এমন কথা শুনে রেগে বললেন,
–“আমি তো আগেই জানতাম এসব কাজের নাটের গুরু তুমিই হবে। তোমার তো দেখি দিনকে দিন আরো সাহস বেড়েই চলেছে। বাসায় এসব করে বেড়াও তাহলে বাহিরে যে কি করে বেড়াও তা আল্লাহ জানে।ছি ছি রাত দুপুরে ছেলেদের নিয়ে গল্প করছো তুমি।এই শিক্ষা পেয়েছে তোমার পরিবার থেকে। ”
মনোয়ারা বেগমের কথা শুনে রোদের দুচোখ পানিতে ভরে ওঠল।হয়ত যে কোন সময় তপ্ত পানি ওর গাল বেয়ে পড়বে।রোদকে কান্না করতে দেখে তুলি বলল,
–“রোদ আপু মোটেও এমন নয়। তুমি রোদ আপুকে শুধু শুধু কথা শোনাচ্ছ মা।”
তুলির কথা শুনে মনোয়ারা বেগম রেগে বললেন,
–“তোর মুখে দেখছি বুলি ফুটেছে । তবে বুলি কিভাবে কমাতে হয় তা আমি জানি। আজ থেকে ওদের সাথে আর তুই মিশবি না। ডানা গজালে সেই ডানা আমি ছেটে দিতেও পারি।”
তুলিকে কথা গুলো বলে রোহানদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–” কি ব্যাপার তোমরা এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছো । এখনই এই রুম থেকে চলে যাও তোমরা । তোমাদের যেন আর ওদের কাছে আর ঘেষতে না দেখি বুঝতে পেরেছ আমার কথা।”
রোহান আর সৌরভ আর কোন কথা না বলে চলে গেল নিজেদের ঘরের দিকে।ওরা চলে যেতেই রোদকে আরো কিছু কথা শুনিয়ে তুলিকে নিয়ে চলে গেলেন ওনার ঘরের দিকে।
মনোয়ারা বেগম চলে যেতেই রোদ গুটি গুটি পায়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। চাঁদের ম্লান আলোয় বাহিরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও। মৃদু হাওয়ার তালে দোল খাচ্ছে রোদের চুল গুলো। আবছা চাঁদের আলোতেও তা স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। কষ্ট গুলোও বারবার উঁকি দিচ্ছে মনের কোন।সেই সাথে উদয় ঘটেছে কিছু অজানা অনুভূতির। যে অনুভূতির নাম নিজের কাছেই অজানা রোদের। কিন্তু অনুভূতি গুলো বেশ বুঝতে পারে ও। আচ্ছা এই অনুভূতির কি কোন নাম দিতে পারবে ও নাকি সারাটা জীবন এই তপ্ত অনুভূতির দহনে পুড়তে হবে ওকে? নিস্তব্ধ, নির্জন রাতে মনে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস আর কিছু জবাবহীন প্রশ্ন নিয়ে বাকি রাতটুকু একাকী বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল রোদ।
চলবে
(কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।আজকের পর্ব কেমন লেগেছে জানাবেন। আপনাদের মতামত জানলে লেখার জন্য আগ্রহ বেড়ে যায়।আর যারা নীরব পাঠক আছেন তারা দয়া করে সাড়া দিবেন। আপনাদের সাড়া পেলে লেখার আগ্রহ বেড়ে যায়। ভালো থাকবেন সবাই। হ্যাপি রিডিং ??)