#শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-০৩
#আমিনা আফরোজ
আলস্যর চাদর অবমুক্ত করে সূর্য তখন পুব আকাশে নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার কাজে ব্যস্ত। বর্ষার মৌসুম শুরু হয়েছে। তাইতো সূর্য যেকোনো সময় ঢেকে যেতে পারে কালো মেঘের অন্তরালে। বর্ষাকাল মানেই আকাশ কালো করা ঘন মেঘের আনাগোনা, যখন-তখন ঝমঝমিয়ে পড়া বৃষ্টি। পথে-ঘাটে কাদা পানি আর ঘরে স্যাঁতসেঁতে ভাব। বর্ষার রূপ,রস আর সৌন্দর্যের ছোঁয়ায় প্রকৃতি যেন সজীব হয়ে উঠেছে। প্রচন্ড তাপদাহকে বিদায় জানিয়ে বর্ষার বর্ষণে সিক্ত হয় প্রকৃতি। আবার নতুন করে প্রকৃতি তার প্রাণ ফিরে পায়। বয়ে যায় শীতল বাতাস, ধরণীতে নেমে আসে প্রশান্তি। অবারিত মাঠ ,মেঘলা আকাশ, টলমলে জলের পুকুর, মাটির সোঁদা গন্ধ, ভেজা সবুজ ঘাস আর পাতার হাসি এইসব যেন বর্ষার এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। শাপলা, পদ্ম, কদম, কেয়া আরো রং-বেরঙের ফসলের হাসিতে জেগে ওঠে বাংলার প্রতিটি গ্রাম।
গ্রামের কদমার্ক্ত মেঠো পথ ধরে এগিয়ে চলেছে আশরাফ মিয়া এবং মিন্টু। গন্তব্য চেয়ারম্যানের বাগানবাড়ি। বৃষ্টির বর্ষণে গ্রামের রাস্তার অবস্থা বেশ করুন। প্রায় মিনিট দশেক পর আশরাফ মিয়া ও মিন্টু এসে পৌঁছালো বাগান বাড়ির সামনে। আশরাফ মিয়া ও মিন্টু ধীর পায়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো।চেয়ারম্যান সামাদ মিয়া বারান্দাতেই বসে ছিলেন তখন । সেই সকাল থেকে তিনি আশরাফ মিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আশরাফ মিয়াকে উঠানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি বলে উঠলেন,
–“আসসালামুয়ালাইকুম মাস্টার সাহেব। ঐহানে দাঁড়ায়া আছেন কেল্লাই। ভিতরে আইয়া বহেন।”
চেয়ারম্যান সামাদ মিয়ার কথা শুনে আশরাফ মিয়া এগিয়ে গিয়ে তার পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন। আশরাফ সাহেবকে বসতে দেখে সামাদ মিয়া বলে উঠলেন,
–“মাস্টার মশাই কেমন আছেন? বাড়ির সক্কলে ভালা আছে নি?”
–“জি আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে। আপনি হঠাৎ এত সক্কাল সক্কাল ডাইকা পাঠাইলেন কেল্লাই?”
–“হ ডাইকা তো পাঠিয়েছিলাম একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা কওনের লাইগা।”
–“কিসের গুরুত্বপূর্ণ কথা চেয়ারম্যান সাহেব?”
–“আপনি তো জানেন আমার একটা মাত্র পোলা। হেই পোলারে নিয়া আমার কত স্বপ্ন। কিন্তু হেই সপ্নো বুঝি আর হামার পূরণ হইব না।”
–“আমি ঠিক বুঝবার পারতাছিনা আপনি কি কইতাছেন।”
–“আসলে কথাটা যে কেমনে কই হেইডা মুই ও বুঝবার পারতাছি না।আমার পোলা নেহাল আপনার মাইয়া সন্ধ্যারে নাকি পছন্দ করে। হের লাইগা পোলায় আমার শহর নাকি কি সব চাকরি বাকরি করবো।এই কথা হুইনাই ওর মা তো কান্দন শুরু করছে।এহন আপনিই কন আমি কি কইরা আমার পোলারে শহরে যাইতে দিতে পারি?
চেয়ারম্যান সাহেবের কথা শুনে আশরাফ মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
–” সবই তো শুনলাম এহন আপনেই কন আমারে কি করতে হইব ?
চেয়ারম্যান সাহেব তার পান খাওয়া দাঁতে হেসে বললেন,
–“বেশি কিছু করণ লাগত না শুধু আপনার মাইয়ারে কইবেন আমার পোলার প্রস্তাবে যেন রাজি না হয়।আর নেহালের সামনেও যেন না আসে।”
আশরাফ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–“আপনি না বললেও আমি এমনটাই করতাম।যাই হোক আজ তাহলে আসি চেয়ারম্যান সাহেব। ভালো থাকবেন।”
–“না খাইয়াই চলে যাইবেন। কিছু খাইয়া যান।”
–“না চেয়ারম্যান সাহেব। বাড়িতে রান্ধন করতাছে।আজ বরং আমি ওঠি। আমার আবার স্কুলে যাওন লাগব।”
–“ঠিক আছে।”
চেয়ারম্যান সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন আর মনে মনে ভাবলেন আজ রাতে এ বিষয় নিয়ে সন্ধ্যার সাথে কথা বলবেন তিনি। চেয়ারম্যান সাহেব চোখ কতটা ভয়ঙ্কর মানুষ তাতো তিনি জানেন। তাই তিনি জেনেশুনে তার মেয়েকে এত বড় বিপদে পড়তে দেবেন না।
অন্যদিকে সন্ধ্যা সকাল থেকে ওর মাকে রান্নার কাজে সাহায্য করে এখন স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। এমন সময় ওর বাবা ঘরে ফিরে। সন্ধ্যাকে স্কুলের ড্রেস পরা দেখে বলল,
–“কিরে মা স্কুলে যাইতেছোস নাকি?”
সন্ধ্যা ওর বাবার প্রশ্নের জবাবে বলল,
–“হ বাবা স্কুলে যাইতেছি। কিছু কইবা নাকি?”
–“না তেমন কিছু না। তুই স্কুলে যা।”
–“ঠিক আছে বাবা।”
এই কথা বলে সন্ধ্যা আর জারা স্কুলের উদ্দেশ্যে চলে গেল। সন্ধ্যারা চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যার মা বলে উঠলো,
–“কি ব্যাপার চেয়ারম্যান সাহেব তোমারে এত সকাল-সকাল ডাইকা পাঠায়ছিল কেন?”
স্ত্রীর প্রশ্ন শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–“ওনার ছেলে নেহাল নাকি আমাগোর সন্ধ্যারে পছন্দ করে। তাই আমাদের সতর্ক করনের লাইগা ডাইকা পাঠাইছিল।”
–“কি কই এই সব তুমি। সন্ধ্যারে কিন্তু কিছুতেই ওমন বদ পোলার লগে বিয়া দিমু না আমি।”
–“আহা হেইডা তো আমিও দিমু না।আমি ভাবতাছি সন্ধ্যারে পড়াশোনা করনের লাইগা ঢাকা পাঠাইয়া দিমু।”
–“কিন্তু…
স্ত্রীরকে কথা শেষ করতে না দিয়েই আশরাফ মিয়া বলে উঠলেন,
–“তোমার কি মনে হয় নেহাল এত সহজে আমাগোর সন্ধ্যা ছাইড়া দিবো? আমি যতোটুকু নিহালরে চিনি ও এত সহজে আমাগোর সন্ধ্যারে ছাড়বো না। তাই সন্ধ্যারে ঢাকা পাঠানোই ঠিক হইব।”
–“তুমি যা ভালো বুঝো।”
স্ত্রীর সাথে কথা শেষ করে আশরাফ মিয়া ওনার স্কুলের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন আর ওনার স্ত্রী ও সংসারের কাজে লেগে গেলেন।
এই মাঝে কেটে গেছে দুইদিন। এই দুইদিন সন্ধ্যা ওর বাবার কথা গুলো খুব ভেবেছে। সন্ধ্যা আনমনে এসব কথা ভাবতে ভাবতে হেঁটে যাচ্ছিল হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে ভাবনার অবসান হলো ওর। ধাক্কা খাওয়া লোকটির দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যায় সন্ধ্যা। ধাক্কা খাওয়া লোকটি আর কেউ নয় নেহাল ছিল। নেহাল সন্ধ্যাকে কে এভাবে আনমনে হাঁটতে দেখে বলে উঠলো,
–” তোমাকে আমি যখনই দেখি তখনই কোনো না কোনো চিন্তায় বিভোর থাকো তুমি। কি এত ভাব সারা দিন বলতো?”
সন্ধ্যা নেহালের কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। কোনরকমে আমতা আমতা করে বলে,
–“তেমন কোন কিছু না।”
–“আচ্ছা বাদ দাও। আগে বল কি সিদ্ধান্ত পৌঁছালে তুমি?”
নেহালের প্রশ্ন শুনে সন্ধ্যার ওর বাবার কথা গুলো মনে পড়ল। দুদিন আগে রাতে খাবার পর সন্ধ্যা নিজের ঘরে এসে পড়তে বসেছিল। তার কিছুক্ষণ পর আশরাফ মিয়া ওর ঘরে আসে। বাবাকে এসময় নিজের ঘরের দিকে মোটেও অবাক হয় না সন্ধ্যা। কেননা সন্ধ্যা সকালেই আন্দাজ করেছিল ওর বাবা ওর ঘরে আজকে আসবে।
–“কিরে মা পড়ছিলি বুঝি?”
–” হ্যা বাবা।”
আশরাফ মিয়া ধীর পায়ে মেয়ের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
–“চল সামনে পুকুর পাড়ে যাই। আজ আর পড়তে হবে না তোকে। আজ বরং আমরা বাবা- মেয়ে মিলে আড্ডা দেই।”
বাবার কথা শুনে সন্ধ্যা ওর বই বন্ধ করে বলল,
–“ঠিক আছে বাবা চলো।”
তারপর বাবা-মেয়ে মিলে এগিয়ে গেল পুকুরপাড়ের দিকে। পুকুরপাড়ে শুনশান নিরবতা বিরাজ করছে। চারিদিকে অন্ধকার। আকাশের চাঁদ আজ ঘন কালো মেঘের আড়ালে ঢেকে গেছে। হয়তো কিছুক্ষণ পরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। সন্ধ্যা আর ওর বাবা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে দুজনেই। নীরবতার রেশ কাটিয়ে আশরাফ নিজে বলে উঠলেন,
–“সন্ধ্যা তুই কি জানিস তুই আমার কত আদরের। জানিস যেদিন তোর অস্তিত্বের কথা জানতে পারি সেদিন ছিলাম আমি সবচেয়ে সুখী লোক। সেদিন থেকেই তোকে নিয়ে স্বপ্ন বোনা শুরু আমার। প্রথম বাবা ডাকের আত্ম তৃপ্তি পেয়েছে তোর কাছ থেকেই। যেদিন তুই হলি সে দিন ও ঠিক এমনই বর্ষণমুখর দিন ছিল। দাইমা যখন সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে তোকে আমার হাতে দেয় তখন আমি খুশিতে কেঁদেই দিয়েছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে তোর কানের কাছে আজান দিয়েছিলাম সেদিন। তোর নরম হাতের ছোঁয়ায় আমার সব দুঃখ কষ্ট যেনো দূর হয়ে যেত। আস্তে আস্তে বড় হতে থাকলি আর সেইসাথে আমার স্বপ্নগুলো ডানা মেলতে শুরু করল। আমার খুব ইচ্ছা তুই অনেক পড়াশুনা করবি।অনেক বড় হবি। সমাজে নিজের আলাদা পরিচয় করবি।”
সন্ধ্যা এতক্ষণ মন মুগ্ধ হয়ে ওর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। কথা বলার সময় ওর বাবার মুখে যে আত্মতৃপ্তি ছিল তা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে সন্ধ্যা। সন্ধ্যার ভাবনার মাঝেই ওর বাবা আবার বলে উঠলো,
–“দেখ সন্ধ্যা আমি চাইনা তুই কোন খারাপ পথে পা দে। তুই তো জানিস চেয়ারম্যান সাহেব কেমন মানুষ। কতটুক ভয়ঙ্কর ওনি। মানুষ খুন করতেও উনার হাত কাঁপে না। আমি তোকে নিয়ে কোনো রকমের ঝুঁকি নিতে পারবো না। এখানে থাকলে নেহাল তোকে অত সহজে ছাড়বে না তাই আমি ঠিক করেছি তোকে ঢাকায় আমার এক বন্ধুর বাসায় পাঠাবো। সেইখান থেকেই পড়াশোনা করবি তুই।”
সন্ধ্যা ওর বাবার কথা শুনে বলল,
–“তুমি যা বলবে তাই হবে বাবা।”
মেয়ের কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন আশরাফ মিয়া। মেয়েকে নিয়ে আপাতত দুশ্চিন্তামুক্ত তিনি। তাই মেয়েকে নিয়ে আবারো ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
এদিকে সন্ধ্যাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিহাল বলল,
–“মাঝে মাঝে কোথায় হারিয়ে যাও তুমি?”
নেহালের কথা শুনে ভাবনার রাজ্যে থেকে বেরিয়ে আসলো সন্ধ্যা। তারপর দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে নিহালের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো।
চলবে
(কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। দেখা যাক সন্ধ্যা নেহালকে কি সিদ্ধান্ত জানায়। দেখা যাক নিয়তি তাদের কোন দিকে নিয়ে যায় )