শ্রাবণ ধারা ২ পর্ব ৮

0
440

#শ্রাবণ_ধারা-২
#পর্ব-৮(বোনাস)
#সাদিয়া

ঘুমন্ত ধারার কানে কথাগুলো বসে নিজের সিটে সোজা হয়ে বসে নাজমুল। আজ তার অনেকটা হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে মাথা থেকে বড় একটা বোঝা নেমে গেছে। কিয়ৎক্ষণ পর ধারা চোখ খুলে তাকায়। তার চোখ অদ্ভুত ভাবে ফুলে লাল হয়ে আছে। ধারাকে এমন অবস্থায় দেখে নাজমুল অস্থির হয়ে পড়ে।
—কি হয়েছে ধারা? তোমাকে এমন লাগছে কেন?

ধারা ধরা গলায় জবাব দেয়,
—মাথাটা অনেক যন্ত্রণা করছে ভাইয়া। আমাকে একটু বাসায় দিয়ে আসবেন?

—কি হয়েছে বলবে তো।

—আপনি আগে বাসায় চলুন। আমার ভালো লাগছে না।

—হ্যাঁ হ্যাঁ।
নাজমুল তড়িঘড়ি করে গাড়ি স্টার্ট দেয়। বাসার সামনে গাড়ি থামতেই ধারা গাড়ি থেকে নেমে এক দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। রুমের দরজা লাগিয়ে দরজায় মাথা ঠেকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে ধারা। তখন নাজমুলের বলা প্রত্যেকটা কথা শুনেছে ধারা। নাজমুল যখন ধারার চুল সরিয়ে দিতে এসেছিলো তখন ই ঘুম ভেঙে গেছিলো ধারার।
—শ্রাবণ স্যার আমাকে বাঁচাতে আমার সম্মান বাঁচাতে নিজের বোনের বাচ্চাকে বাঁচাতে নাজমুল ভাইয়ের কথায় এইসব কিছু করেছে। আর আমরা তাকে কতো ভুল বুঝলাম। তাকে দূরে ঠেলে দিলাম। সে তো আমার খারাপ চায়নি। শুধু আমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলো। একটা নিষ্পাপ বাচ্চাকে বাঁচাতে চেয়েছিলো। আর আমি তাকে অপমান করলাম। ঘৃণা করলাম। এখন কি শ্রাবণ স্যার আমাকে ক্ষমা করবেন? কিভাবে তিনি আমাদের ক্ষমা করবেন কিভাবে? আমরা কেউ তো তাকে ক্ষমা করিনি তখন। তবে সে কেন এখন আমাদের ক্ষমা করবে।
ধারা পাগলের মতো নিজের ফোন খুঁজতে থাকে। ফোন হাতে পেয়েই শ্রাবণকে ফোন দেয়। শ্রাবণ ফোন তুলছে না। ধারা এগারোটা কল দিয়ে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেয়।

অপরদিকে,
গোডাউন থেকে এসেই শাওয়ারে যায় শ্রাবণ। তার গায়ে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। তার সাদা শার্ট রক্তে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। একজন ডাক্তার হিসেবে মানুষের জীবন বাঁচানো যেমন তার দায়িত্ব তেমনি একজন সচেতন মানুষ হিসেবে সমাজের জন্য ক্ষতিকর কিটকে ধ্বংস করা তার কর্তব্য। রসেল যাকে আই উইডনেস ভেবে তুলে এনেছিলো সে আসলে আই উইডনেস ছিলো না। সেও রকির উপর হওয়া আক্রমণের সাথে জারিত ছিল। তার কাছ থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী তারা তাদের বসকে চেনে না। তাদের বস কখনো তাদের সামনে আসেনি সবসময় ফোনেই সব কাজ বুঝিয়ে দিয়েছে। শ্রাবণ লোকটার থেকে তাদের বসের ফোন নম্বর নিয়েছে। ফোনটা বন্ধ আছে বর্তমানে। আর ফোনের লাস্ট লোকেশন ছিলো শ্রাবণের হাসপাতালে। মানে ওদের যখন শেষ ফোন কল করা হয় তখন তাদের বস হাসপাতালে ছিলো।
শ্রাবণ পুরো অংক না মেলাতে পারলেও অংশিক সমাধান পেয়ে গেছে। বাকিটা ওই মহিলাকে না পেলে সম্ভব না। এখন ওই মহিলাই শেষ ভরসা।

শাওয়ার শেষে কোমড়ে এক টাওয়াল পেঁচিয়ে অন্য এক টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে শ্রাবণ। রাসেলকে কল দেওয়ার জন্য ফোনটা হাতে নিতেই ধারার নম্বর থেকে আসা এগারোটা কল চোখে পড়ে শ্রাবণের।
—ধারা আমাকে কেন ফোন করবে? ওর কাছে তো আমার নম্বর থাকার কথা না। কোথা থেকে পেলো? সে যেখান থেকেই পাক আমার বাপের কি। দেখি ম্যাডাম ভিক্টোরিয়া কেন আমাকে স্মরণ করেছিলেন।
শ্রাবণ ধারার নম্বরে কল লাগালো। ফোনের রিংটোন বাজতেই ধারা ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো শ্রাবণ ফোন করেছে। তাড়াতাড়ি রিসিভ করতে গিয়ে ভুল করে কলটা কেটে যায়।
—এটা কি হলো? এতোক্ষণ তো নিজেই ফোন করে করে আমার ফোনের ব্যাটারি লো করে দিলো। এখন আমি ফোন করতেই ম্যাডাম ভিক্টোরিয়া ফোন কেটে দিলো। বেয়াদব মেয়ে মানুষ! ওই দেখো এখন নিজে ফোন করেছে। ধরবো না হুহহ। না থাক ধরি। হ্যালো।

শ্রাবণের কণ্ঠে শুনে ধারার থেমে যাওয়া কান্না নতুন করে শুরু হয়েছে। ধারার কান্নার শব্দ শুনে শ্রাবণ অস্থির হয়ে যায়।
—ধারা? ধারা আর ইউ ওকে? কি হয়েছে আপনার? আপনি কাঁদছেন কেন? আরে বলুন না কি হয়েছে আপনার। মিস ধারা?

কান্নার জন্য ধারা কথা বলতে পারছে না। ওইদিকে শ্রাবণের অস্থিরতা বেড়েই চলেছে।
—আমি আসছি একটু অপেক্ষা করুন। আমি এখনই আসছি।

—ক..কোথায় আসছেন আপনি?

—আরে বাবা আপনি কাঁদছেন। কেন কাঁদছেন তা বলছেন না। এখন আমি ঘরে বসে থাকবো নাকি। আজব।

—আ..আপনার আসতে হবে না।

—কেন? কেন আসতে হবে না কেন? আমি আসবো মানে আসবো।

—আপনি এখানে আসলে আন্টি কি ভাববে?

—ঠিক আছে আমি তিথিদের বাসার সামনে আসছি আপনি নিচে নামুন।

—সত্যি আসবেন?

—জানি না।
বলেই খট করে ফোনটা কেটে দিলো শ্রাবণ। পেন্ট পড়ে নিয়ে শার্ট হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। দরজা লক করতে গিয়ে ফিরে আসলো। গাড়ির চাবি নেয়নি সে। গাড়ির চাবি নিয়ে দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে যায় সে। ধারা চোখ মুখ ধুয়ে নিলো। এই ভাবে বাইরে গেলে আন্টি প্রশ্নের বন্যা বানিয়ে দেবে। তিথিদের বাসার সামনে এসে ধারাকে ফোন দেয় ধারা। শ্রাবণের ফোন পেয়ে ধারা হাসপাতালের ইমারজেন্সি বলে বেরিয়ে আসে। গাড়িটা তিথিদের বাসার একটু দূরে পার্ক করেছে শ্রাবণ। ধারা গাড়ির কাছে আসতেই শ্রাবণ গাড়ির দরজা খুলে দেয়। ধারা গাড়িতে উঠে শ্রাবণকে জরিয়ে ধরে। আকস্মিক ঘটনায় শ্রাবণ প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও সে নিজেকে সামলে নেয়। শ্রাবণ ধারার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
—কি হয়েছে মিস ধারা? আপনি এমন কেন করছেন?

কান্নার আওয়াজের সাথে মৃদু স্বরে “সরি” নামক শব্দটি শ্রাবণের কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই ভ্রু কুঁচকায় সে।
—সরি? সরি কেন?

—আ’ম সরি। আ’ম রিয়েলি ভেরি সরি স্যার।

—আচ্ছা ইট’স ওকে। এখন বলুন সরি কেন?

ধারা কিছু বলছে না। শ্রাবণের বুকে সে কেঁদে গঙ্গা যমুনা বানিয়ে দিয়েছে।

—মিস ধারা আমি অন্তর্জামি নেই যে না বললেও বুঝে যাবো আপনার কি হয়েছে। তাই দয়া করে বলুন কি হয়েছে আপনার। এই অধমের উপর একটু দয়া করুন।

—কেন এমন করলেন স্যার?

ধারার আচমকা প্রশ্নে শ্রাবণ অবাক হয়। শ্রাবণ কিছুক্ষণ ভাবলো।
—না আমি তো নতুন করে কোনো রকমের অঘটন ঘটায়নি। কোনো কুকাজও করিনি। উত্তেরি! মিস ধারা গোডাউনের বিষয়টা জেনে যায়নি তো? আর গোডাউনের বিষয়ে জেনে গেলে তো আমাকে ধারা নয় পুলিশ কাকুরা জরিয়ে ধরতো। ঘাপলা কি? হুয়াট ইজ দ্যা ঘাপলা?

—আ..আব আমি কি করেছি মিস ধারা?

—কেন সত্যিটা সকলের থেকে লুকালেন।

শ্রাবণ মনে মনে ভাবলো,লে মেয়ে বলে কি। আরে ভাই আমি কি সবাইকে জানিয়ে জানিয়ে মানুষের উপরে যাওয়ার টিকিট কাটবো? এই মেয়ে সত্যি পাগল।

—মিস ধারা সোজাসুজি বলুন তো কি করেছি আমি? আর কোন সত্যিটা লুকিয়েছি।

—আট বছর আগে নাজমুল ভাইয়ের কথা কেন কাউকে বলেন নি?

এবার শ্রাবণের নয়ন বিস্ফোরিত হয়। সে কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললো।
—মা…মানে কি বলছেন আপনি?

—আমি সব জেনে গেছি শ্রাবণ স্যার। মনে রাখবেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না

—কে বলেছে যায় না। অবশ্যই যায়। আরে ওই যে পুঁটি মাছ আছে না ওইগুলা তো সুন্দর করে ঢাকা যাবে।

ধারা শ্রাবণের বুকে ধমাধম কয়েকটা কিল বসিয়ে দিলো।
—উহ! মিস ধারা মারছেন কেন আমাকে এভাবে? ব্যাথা লাগে না বুঝি!

—এখন আপনার ব্যাথা লাগছে? আমাকে কষ্ট দেওয়ার সময় ব্যাথা লাগেনি?

শ্রাবণ কিছু বললো না। সে তো নিজের ভাবনায় ডুব দিয়েছে,মিস ধারা কি জানলো? কতটুকু জানলো? আর কিভাবে জানলো? কে বলেছে তাকে?

শ্রাবণ নিজের গলাটা ঠিক করে বললো,
—মিস ধারা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?

শ্রাবণের বুক থেকে ধারা তুলে বসলো। দুইহাতে মুখ মুছে বললো,
—আমি কিভাবে সত্যিটা জানলাম সেটাই জানতে চাইছেন তো?
শ্রাবণ উপর নিচে মাথা ঝাঁকালো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধারা বলে,
—নাজমুল ভাইয়ের মুখ থেকেই শুনেছি সত্যটা।
শ্রাবণ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো।
—বিশ্বাস হচ্ছে না?

শ্রাবণ “না” বোধক মাথা ঝাকালো। ধারা নিজের ফোন বের করে একটা রেকর্ডিং চালু করলো যাতে নাজমুলের স্বীকারোক্তি রয়েছে। শ্রাবণ অবাক নয়নে ধারার দিকে তাকালো।
—আসলে আজকে হাসপাতালের সামনে তার সাথে দেখা হয়েছিলো। আমার মনটা একটু খারাপ ছিলো বলে উনি আমাকে নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। পথে আমার চোখ লেগে যায়। নদীর পাড়ে গিয়ে আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে তিনি একে একে নিজের সকল অপকর্মের কথা বলে দেন।

—তুমি ঘুমিয়ে থাকলে ওই হারামির কথা রেকর্ড কে করলো?

—আমিই করেছি।

—ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে? আপনার সাথে কি অন্য কেউ আছে নাকি গো?

—অন্য কেউ মানে?

—আরে রাতের বেলায় তাদের নাম বলতে নেই।

—কাদের নাম রাতের বেলায় বলতে নেই শ্রাবণ স্যার?

—আরে ওই যে দেখেন না ওরা ধরলে মানুষ কেমন উইয়ার্ড বিহেভ করে। গাছে চড়ে যায়। পাগলামি করে।

এবার ধারা বিষয়টা ধরতে পরলো। সে কটমট দৃষ্টিতে তাকালো শ্রাবণের দিকে।
—আপনাকে ডাক্তারির সার্টিফিকেট কে দিয়েছে?

—ওই হেলাল স্যার দিয়েছেন। সাথে এ-ও বলেছেন ‘শ্রাবণ আমার বিশ্বাস তুমি একজন ভালো ডাক্তার হবে’।

—তাকে গিয়ে বলিয়েন আপনি খুব বাজে একজন ডাক্তার হয়েছেন।

—হুহ জ্বলে তোমার। আমি বুঝি। আমার সফলতাতে তুমি জ্বলছো।

ধারা মুখ বাঁকালো। অতঃপর নিরবতা।

#চলবে….ইনশাআল্লাহ।

(আপনাদের কি মতামত বলুন? শ্রাবণ-ধারার মিল চান নাকি চান তারা আলাদা হোক। কোনটা?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here