#শ্রাবণ_ধারা-২
#পর্ব-৭
#সাদিয়া
.
আই.সি.ইউ. এর বাইরে মাথা নিচু করে বসে আছে শ্রাবণ। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রাসেল। রকির অবস্থা তেমন একটা ভালো নয়। ডাক্তার বলেছে ২৪ ঘন্টা না গেলে কিছু বলা যাবে না। রকি আর রাসেল শ্রাবণের ডান হাত বাম হাত। ওদের ছাড়া শ্রাবণ কখনও কোনো কাজ করেনি। এদের দুজনকে ছাড়া শ্রাবণ একজন সাধারণ ডাক্তার ছাড়া কিছুই না। যে বা যারা রকির উপর আক্রমণ করেছে তাদের মোটিভ কি হতে পারে সেটাই ভাবছে শ্রাবণ। পার্সোনাল দুশমনি থেকে যে রকির উপর আক্রমণটা করা হয়নি এটা নিশ্চিত শ্রাবণ। কারণ রকির মতো ছেলের পার্সোনাল দুশমন থাকতে পারে না। তাহলে কি শ্রাবণের বিশ্বস্ত লোক বলে রকির উপর আক্রমণ করা হয়েছে? যদি তাই হয় তাহলে শ্রাবণ তাকে ছাড়বে না। কিছুতেই না। কেউ তার জন্য তার কাছের মানুষদের ক্ষতি করবে এটা শ্রাবণ সহ্য করবে না একদম না। এখন শুধু খুঁজে বের করতে হবে কে আক্রমণ করেছে আর কেন আক্রমণ করেছে।
—রাসেল।
—জ্বী স্যার।
—খোঁজ লাগাও কারা আক্রমণ করেছে আর কার কথায় করেছে।
—স্যার আমি অলরেডি লোক লাগিয়ে দিয়েছি। তারা যেকোনো সময় যেকোনো খবর দিতে পারে স্যার।
শ্রাবণ চোখ বন্ধ করে নেয়। তার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। রকির জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত শ্রাবণ শান্তি পাবে না। এর মাঝেই রাসেলের ফোন এলো। ফোনে কথা বলে কিছুটা চিন্তিত মুখে শ্রাবণের কাছে আসলো রাসেল।
—স্যার?
—বলো। তোমার মুখ এমন ফ্যাকাশে লাগছে কেন? এনিথিং সিরিয়াস?
—তেমন কিছু নয় স্যার। আসলে খবরি ফোন করেছিলো। যারা রকির উপর আক্রমণ করেছে তারা এই শহরের না। এই শহরে এর আগে তাদের দেখা যায়নি।
শ্রাবণের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে। শ্রাবণ কিছুক্ষণ ভাবলো।
—আচ্ছা রাসেল রকিকে যেখানে এ্যাটাক করা হয়েছে ওখানে কি সিসি ক্যামেরা আছে কোনো? বা ঘটনার কি কোনো আই উইডনেস আছে?
—সিসি ক্যামেরা তো নেই। কারণ এটা যথেষ্ট শুনশান এলাকা। তবে হে একজন আই উইডনেস আছে মনে হয়।
—গ্রেট! তাকে কতক্ষণে হাজির করতে পারবে?
—ঘন্টা লাগবে।
—টেক ইউর টাইম বাট আই নিড দ্যাট আই উইডনেস এ্যাট এনি কস্ট।
রাসেল চলে গেলো নিজের কাজে। রাসেলের রক্তও গরম হয়ে আছে। রকিকে সে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করে। তার এমন হাল যে করেছে তাকে সে ছাড়বে না কিছুতেই না।
সকাল সাতটায় বাসায় আসে শ্রাবণ। রকির জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার বলেছে এখন সে আপাতত আউট ওফ ডেঞ্জার তবে তাকে কয়েকদিন দিন হাসপাতালে থাকতে হবে। জ্ঞান ফেরার পর শ্রাবণকে পাশে দেখতে পেয়ে রকি ভীষণ খুশি হয়েছিলো। রকি জানে শ্রাবণ তাদের খুব ভালোবাসে। শ্রাবণ রকির সাথে দুয়েকটা কথা বলে বাসায় আসে। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ ঘুমায় শ্রাবণ। তাকে তো আবার হাসপাতালেও যেতে হবে। ডা.সৈকতকে সে ফোন করে বলে দিয়েছে আজকে তার হাসপাতালে যেতে একটু দেরি হবে তাই চিন্তা নেই।
সকাল এগারোটায় হাসপাতালে যায় শ্রাবণ। লাঞ্চ টাইমের আগ পর্যন্ত পেশেন্ট দেখে চলে যায় রকির কাছে। রকি বেডে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে আর তার পাশে টুলে বসে রকিকে আপেল কুচি কুচি করে কেটে দিচ্ছে রাসেল। শ্রাবণকে আসতে দেখে রাসেল দাঁড়িয়ে যায়। শ্রাবণ তাকে ইশারায় বসতে বলে নিজেও অন্য আরেকটা টুল নিয়ে বসে রকির সামনে।
—এখন কেমন বোধ করছো?
—এখন একটু বেটার স্যার।
—ব্যাথা কেমন আছে?
—আগের থেকে একটু কমেছে।
—আচ্ছা রকি তোমার উপর যারা আক্রমণ করেছে তারা কারা ছিলো বলতে পারবে?
—না স্যার। আমি তাদের চিনি না। তবে এদের মধ্যে একজনকে আমি মনে হয় সিলেটে দেখেছিলাম।
ভ্রু কুঁচকে আসে শ্রাবণের।
—সিলেটে?
—হ্যাঁ স্যার। কয়েকদিন আগে আমরা গেছিলাম না সিলেট একজন মহিলাকে খুঁজতে তো ওইখানেই আমি এদের মধ্যে একজনকে দেখেছিলাম।
শ্রাবণ কিছু একটা ভেবে বললো,
—তার মানে এই আক্রমণটা ওই মহিলা রিলেটেড। এখন তো ওই মহিলাকে খুঁজে বের করা আরো জরুরি হয়ে উঠেছে। এই মহিলাকে খুঁজে বের করতে না পারলে অনেকগুলো জীবন বরবাদ হয়ে যাবে। রাসেল?
—জ্বী স্যার?
—আই উইডনেসকে পেলে?
—জ্বি স্যার। ওকে ছেলেরা মিলে গোডাউনে নিয়ে গেছে।
—আচ্ছা তাহলে তুমি রকির কাছে থাকো আমি গোডাউনে যাচ্ছি। আর কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই ফোন করো।
শ্রাবণ গোডাউনে চলে যায়।
.
সকাল থেকে ধারা শ্রাবণকে খুঁজে চলেছে কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না। শ্রাবণের সাথে ধারার একটা সার্জারী নিয়ে আলোচনা করার ছিলো কিন্তু নবাবের তো পাত্তাই নেই!
—দেখি একটা ফোন করে সে কোথায়।
শ্রাবণকে ফোন করতে গিয়ে ধারা খেয়াল করলো তার কাছে শ্রাবণের নম্বর নেই। এবার সে কি করবে? কোথায় পাবে শ্রাবণকে? ধারা কিছু একটা ভেবে ডা.সৈকতের কাছে গেলো শ্রাবণের নম্বর আনতে।
ডা.সৈকতের কাছ থেকে শ্রাবণের নম্বর নিয়ে শ্রাবণকে ফোন লাগায় ধারা। কিন্তু ধারাকে নিরাশ করে দিয়ে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে এই মূহুর্তে শ্রাবণের ফোন বন্ধ আছে।
—কি হলো উনার? সকাল থেকে একবারো দেখা পেলাম না এখন আবার ফোটাও বন্ধ। কোনো বিপদ হলো না তো? ছিঃ ছিঃ ছিঃ কিসব ভাবছি আমি। বিপদ কেন হতে যাবে।ফোনে হয়তো চার্জ নেই তাই ফোন বন্ধ বলছে।
ধারা হাসপাতাল থেকে বেরিয় রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। এর একটু পরই একটা গাড়ি এসে থামলো ধারার সামনে। প্রথমে ধারা ভেবেছিলো এটা শ্রাবণের গাড়ি। কিন্তু ধারাকে ভুল প্রমাণিত করে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসে নাজমুল। ধারা আশাহত হয়। নামজুল ধারার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
—কেমন আছো ধারা?
—আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া। আপনি?
—আমিও আলহামদুলিল্লাহ। তোমার কাজ শেষ?
—জ্বী ভাইয়া শেষ।
—চলো নদীর পাড়ে যাই।
যেহেতু ধারার মনটা খুব একটা ভালো না তাই সে রাজি হলো। যদি নদীর পানিতে পা ডুবালে মন ভালো হয়! সেই আশায়।
নদীর পাড়ে এসে গাড়ি থামায় নাজমুল। নদীর শীতল বাতাসে মনটা ভরে উঠলো তার। ধারার দিকে তাকিয়ে দেখলো ধারা ঘুমিয়ে গেছে। ধারার সামনের ছোট ছোট চুলগুলো তার মুখে এসে পড়ছে বার বার। নাজমুল আলতো হেসে ধারার মুখ থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ ধারার দিকে তাকিয়ে থেকে ধারার গালে আলতো করে হাত বুলালো।
—তোমায় আমি খুব ভালোবাসি ধারা। এতটা ভালোবাসি তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। তোমাকে আমার চাই ধারা। যেকোনো মূল্যে চাই। তোমাকে পেতে আমি সব করতে পারি ধারা। সব করতে পারি। দেখলে না কেমন করে শ্রাবণের জীবনটা বিষাদে ভরিয়ে দিলাম। বেশিকিছু না ওকে তো শুধু ওর অপরাধের শাস্তি দিয়েছি আমি। ওর কতো বড় সাহস ভেবে দেখো ও তোমাকে ভালোবাসতে গেলো। কেন আর কোনো মেয়ে ছিলো না? তোমাকে কেন ভালোবাসলো? তাই শাস্তি দিয়েছি ওকে। চরম শাস্তি। এখন ও সকলের চোখে ভিলেন। যেখানে ও নিজেই একজন ভিক্টিম সেখানে সবাই ওকে ভিলেন ভাবছে। বেচারা কিছু না করেও সকলের চোখে ছোট হয়ে গেছে। আসলে ওর তো দোষ নেই কোনো। ও যা বলেছে সব তো আমার কথায় বলেছে। আর ও যা করেছে সব তো তোমাকে বাঁচাতে তোমার সম্মান বাঁচাতে করেছে নিজের বোনের বাচ্চাকে বাঁচাতে করেছে। দেখোনা নিজের ভালোবাসার মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে সে তোমার চোখের বালি হয়ে গেলো। আট বছর আগের ঘটনায় শ্রাবণের কোনো দোষ ছিলো না। ও আমাকে শুধু বলেছিলো তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো। কিন্তু আমিও তো তোমায় ভালোবাসি তাই তোমায় ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। জানো শ্রাবণ আমার পায়ে পর্যন্ত ধরেছিলো ওইদিন। কিন্তু আমার তো কিছু করার ছিলো না। ওকে তো শাস্তি পেতেই হতো তাই না? শুনবে না শ্রবণ কেন ওইসব বলেছিলো? বলছি তোমায় তুমি শুনো। আমি শ্রাবণকে ব্ল্যাকমেইল করেছিলাম। আমি ওকে বলেছিলাম আমি যা যা বলবো তাই তাই করতে। যদি ও আমার কথা অনুযায়ী কাজ না করে তবে….
থামলো নাজমুল। বোতল থেকে এক ঢোক পানি গিললো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো,
—আমি ওকে বলেছিলাম ও যদি আমার কথা মতন কাজ না করে তবে তোমার আর আমার কিছু হটি হটি ছবি আমি ভাইরাল করে দেব। তুমি তো জানোই এখন ইডিটের যুগ! ইডিট করে সব করা যায়। আমার কথায় শ্রাবণ ভয় পেয়ে যায় কিন্তু রাজি হয় না। তারপর আমি ওর বোনের সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চাকে কিডন্যাপ করি। প্রি-ম্যাচিয়ুর বেবি হওয়ায় বাচ্চাটার অবস্থা বেশি একটা ভালো ছিলো না। শ্রাবণের হাতে আর কোনো অপশন ছিলো না। সে রাজি হয়ে যায় তোমার সম্মান আর নিজের বোনের বাচ্চাকে বাঁচাতে। আসলে তোমাদের খুব ভালোবাসে কি না! তোমার এত বড় অসম্মান সে কি করে হতে দিতে পারে! এইসব ছবি ভাইরাল হলে তুমি কি করতে? লজ্জায় গলায় দড়ি দিতে তাই না? তোমার বাবা-মা ভাই কি করতো? সমাজে মুখ দেখাতে পারতো না। আর ওর বোনের বাচ্চার কিছু হলে তো ওর বোন মরেই যেত কারণ বাচ্চাটা ছিলো ওর বোনের স্বামীর শেষ চিহ্ন! আমি ভেবেছিলাম শ্রাবণকে সবার নজরে খারাপ বানিয়ে নিজে হিরো সেজে তোমায় বিয়ে করে নেব। কিন্তু তোমার বাবা আমাকে সেই সুযোগটা দেয়নি। ব্লাডি ওল্ড ম্যান। কিন্তু কোনো ব্যাপার না এখন তুমি আমার হবে। শুধুই আমার। আসলে শ্রাবণ এতোটাও দোষী না যতটা তোমরা সবাই ওকে ভাবো। মাঝে মধ্যে ওর জন্য আমার অনেক কষ্ট হয় জানো? ও না পরিবার ছাড়া থাকে। একা থাকে সম্পূর্ণ একা! ও তোমাকে ভালোবাসতে এসেছিলো তাই ওকে একা করে দিলাম। এখন শুধু তোমাদের ডিভোর্সের পালা। তাহলেই আমাদের এক হওয়ায় কোনো বাধা থাকবে না। থাকবে না কোনো বাঁধা।
#চলবে