#শ্রাবণ_ধারা-২
#পর্ব-৫
#সাদিয়া
তিনদিন পর তারা সিলেট থেকে ফিরে আসে।
শ্রাবণের কাজ ঠিকঠাক ভাবে হলেও রকির কাজ ঠিকঠাক ভাবে হয়নি। তারা মহিলার কোনো খোঁজ পায়নি। রাসেলের ইনফরমেশন যে ভুল ছিল তা না তবে শতভাগ সঠিকও ছিলো না। শ্রাবণ আজ বেশ চটে আছে রাসেলের উপর। ওইদিকে ভয়ে রাসেল বেচারার অবস্থা খারাপ।
তিন দিন পর হাসপাতালে আসে শ্রাবণ। হাসপাতালে ঢুকতেই শ্রাবণের মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায়। সে কোনো রকমে নিজেকে সামলে কেবিনে চলে যায়। কেবিনে এসে রাগে টেবিলে জোরে কয়েকটা ঘুষি দেয় যার ফলে তার হাত কেটে যায়।
—কেন কেন কেন ধারা কেন? কেন নিজের ভালোটা বুঝতে পারছো না? নিজের নিজের বরবাদি ডেকে আনছো ধারা।
শ্রাবণ নিজেকে স্থির করে হাতে ব্যান্ডেজ করে নিলো। তারপর রাসেলকে ফোন লাগালো।
—হ্যালো স্যার।
—আরে রাখো তোমার হ্যালো। কোথায় আছো তুমি?
—বাসায় স্যার।
—বাসায় বসে থাকার জন্য আমি তোমাকে মাসে মাসে পয়সা দিই ডাফার।
—সরি স্যার।
—কথায় কথায় সরি বলাটা তোমার অভ্যাসে পরিনত হয়েছে রাসেল। এটা খুব খারাপ অভ্যাস। অভ্যাসটা বদলাও। আর শোনো তোমাকে তিন দিনের সময় দিলাম। এই তিন দিনের মধ্যে ওই মহিলাকে আমার চাই রাসেল। অক্ষত অবস্থায়।
—জ্বী স্যার হয়ে যাবে।
—এবার আর আমি কোনো সরি শুনতে চায় না।
কট করে ফোন কেটে দিলো শ্রাবণ।
—আসতে পারি ডা.শ্রাবণ?
—জ্বী আসুন।
ভেতরে প্রবেশ করলো নাজমুল। নাজমুলকে দেখে শ্রাবণের রাগ মাথা চড়া দিয়ে উঠলো। রাগে শ্রাবণ হাত মুষ্টি বদ্ধ করে নেয়।
—কেমন আছেন ডা.শ্রাবণ রহমান?
শ্রাবণ দাঁত চেপে বললো,
—কেন এসেছো এখানে?
—আরে আরে রিল্যাক্স ডা.শ্রাবণ রিল্যাক্স। আমি তো এখানে তোমার হালচাল জানতে এসেছি।
—তাহলে জেনে রাখো আমি খুব খুব খুব ভালো আছি।
নাজমুল শ্রাবণের রাগি চেহারা দেখে বাঁকা হাসলো। শ্রাবণকে আরেকটু রাগিয়ে দিতে বললো,
—ধারাকে দেখেছিস শ্রাবণ? আগের থেকে আরো বেশি সুন্দরী হয়ে গেছে তাই না? দেখতে আগের থেকে আরো মোহনীয় লাগে।
এবার শ্রাবণ হাসলো।
—কি বলছো ভাই। আমার বিয়ে করা বউকে আমি দেখবো না তা হয় নাকি। এতো বছর পর বউ এলো আমার তো মনে চায় সারাক্ষণ বউকেই দেখি। কিন্তু কি বলো তো আমি তো আর তোমার মতো শুধু নামের ডাক্তার নই যে নিজের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করবো। তাই পেশেন্ট দেখার পাশাপাশি বউকে দেখি। ইউ নো না আমার বউ আগের থেকে কতটা সুন্দরী হয়ে গেছে।
শেষের কথাটা বলে শ্রাবণ বা চোখে টিপ্পনী কাটে।
—বউ? বউ মানে? তোদের তো ডিভোর্স হয়ে গেছে। তাহলে ধারাকে নিজের বউ কেন বলছিস?
—কোনোদিন শুনেছো এক মাসে ডিভোর্স হয়? তাও আবার বিয়ের প্রথম এক মাসেই। এটা রিল লাইফ না ব্রো। তবে কি বলোতো রিয়েল লাইফেও এমন কিছু মানুষ থাকে যারা সিনেমার ভিলেনকেও হারিয়ে দেয়।
নামজুল শ্রাবণের কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে,
—তার মানে তোদের ডিভোর্স হয়নি?
—নোপ ব্রো। আসলে আমার বউ আমাকে তালাক না দিয়েই দেশান্তর হয়েছিলো।
নাজমুল আর কোনো কথা না বলে হনহন করে শ্রাবণের কেবিন থেকে চলে যায়। নাজমুলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকায় শ্রাবণ।
—উুহ আসছে আমার বউকে সুন্দরী বলতে। কেন রে আমার কি চোখ নেই? আমার বউ যে আগের থেকে সুন্দরী হয়েছে সেটা তো আমি দেখেছি নাকি। তোর কেন বলতে হবে। কিন্তু এখন কোথায় গেলো? আমার বউয়ের কাছে যায়নি তো? আমার বউয়ের কাছে যায় কেন এতো।
শ্রাবণ হন্তদন্ত হয়ে ধারার কেবিনে যায়। কেবিনের দরজাটা কিছুটা ফাঁক করা। ধারাকে কেবিনে দেখে শ্রাবণ একটু স্বস্তি পায়। ধারা পেশেন্ট দেখছে। একটা বাচ্চা মেয়ে তার সাথে তাদের বয়সী একটা ছেলে। ছেলেটা ধারার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। শ্রাবণ বিরক্ত হলো। সে কেবিনের সামনের চেয়ারে বসে বিরবির করে বলতে লাগলো,
—এদের চোখে কি শুধু আমার বউকেই পড়ে? এতো কেন দেখতে হয় এদের আমার বউকে? সৈকতের বউও তো ডাক্তার কই তার দিকে তো কেউ এভাবে তাকিয়ে থাকে না। ওহ ভুলে গেছিলাম সৈকতের বউয়ের তো বাচ্চা হবে। ইশশ যদি আমার একটা বাচ্চা থাকতো!
—তাহলে আমাকে বিয়ে করে নাও। তাহলে বউ আর বাচ্চা দুটোর শখই পূরণ হবে।
শ্রাবণ পাশ ফিরে দেখে তার পাশে রুশা বসে আছে।
—তুমি?
—হুম আমি। আসলে আজ পেশেন্টের চাপ ছিলো না। তাই ভাবলাম তোমার সাথে একটু দেখা করে যাই। তিনদিন তো তোমার সাথে কথা হয়নি ভালো করে।
রুশাকে কেন যেন শ্রাবণের তেমন একটা সহ্য হয় না। রুশা যে খারাপ তা নয়। সে যথেষ্ট ভালো একজন মেয়ে তবে একটু গায়ে পড়া স্বভাবের।
লাঞ্চ টাইমে ক্যাফেটরিয়ায় যায় ধারা। ঢুকতেই চোখে পড়ে শ্রাবণ আর তার সাথে বসে থাকা রুশাকে। এইসময় শ্রাবণের সাথে ধারার চোখাচোখি হয়ে যায়। শ্রাবণের সাথে রুশাকে দেখে ধারার মন খারাপ হয়ে যায়। সে মুখ কালো করে একটা চেয়ারে বসে যায়। ধারা চুপচাপ বসে আছে। ধারাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে শ্রাবণ কাউকে একটা টেক্সট করে দেয়।
ধারা কফি আর স্যান্ডউইচ খাচ্ছে এমন সময় কেউ তার পিঠে ধুমধাম কয়েকটা কিল বসিয়ে দেয়। ধারা ব্যাথায় মৃদু আর্তনাদ করে। পিছনে তাকাতেই দেখে সাথি দাঁড়িয়ে আছে। সাথি ধারার পুরোনো বান্ধবী। সেও একজন ডাক্তার। এই হাসপাতালেরই। আর সে ডা.সৈকতের বউ।
—একা একা খাচ্ছিস রাক্ষুসী। আমাকে ডাকলি না।
—আমি ভাবলাম তুই ডায়েটে আছিস। দিনদিন যেভাবে ফুলছিস।
বলেই হাসে ধারা।
—ঠিকই বলেছিস রে ধারা। আমি ফুটবলের মতো ফুলে যাচ্ছি। আসলে কি বল তো প্র্যাগনেন্সির শুরু থেকে আমার জামাই আমাকে খাওয়াতে খাওয়াতে এমন বানিয়ে দিয়েছে।
ধারা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
—তুই প্র্যাগনেন্ট?
সাথি স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়ে উপর নিচে মাথা নাড়ায়।
—তোদের বিয়ের কতদিন হয়েছে?
—সাড়ে তিন বছর।
ধারা কিছু বললো না। একবার শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।
ওইদিকে শ্রাবণ ভাবছে,
—কি হলো আমার বউয়ের? আবার মন খারাপ করলো কেন? সৈকতের বউ কি বললো আমার বউকে যে তার মন খারাপ হয়ে গেলো? এই সৈকতের বউকে এনেছিলাম আমার বউয়ের মন ভালো করতে। কিন্তু ওই মহিলা তো আমার বউয়ের মুডের অবস্থা আরো খারাপ করে দিলো। আমার সাথে এদের কি সমস্যা সেটাই বুঝলাম না আমি।
.
ডিউটি আওয়ার শেষে ধারা হাসপাতালের সামনে রিক্সার জন্য দাঁড়ায়। এমন সময় তার সামনে একটা গাড়ি এসে থামে। গাড়িটা ধারা চেনে। এটা শ্রাবণের গাড়ি। ধারা কিছুটা সামনে এগিয়ে দাঁড়ায়। গাড়িটিও ধারার সাথে সাথে যায়। এবার ধারা আরেকটু সামনে আগায়।
শ্রাবণ ভ্রু কুঁচকায়।
—সমস্যা কি এই মেয়ের। ওকি বুঝতে পারছে না ওকে আমি নিজের সাথে নিয়ে যেতে চাইছি। নাজমুল ভাইয়ের সাথে তো নাচতে নাচতে ধেইধেই করে চলে যায়। এই মেয়েকে নিয়ে আমি কি করবো।
শ্রাবণ এবার গাড়ির গ্লাস নিচে নামিয়ে ধারাকে ডাকে। ধারা জবাব দিলো না।
—মিস ধারা উঠে আসুন। আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।
—আমি যাবো না।
—আর ইউ শিউর?
—হুম।
—ওকে ভালোই হয়েছে। আমার আবার রুশার সাথে শপিংয়ে যাওয়ার কথা। আপনি রুশাকে চেনেন? রুশা আমার হবু বউ। খুব ভালো মেয়ে।
“হবু বউ” কথাটা শুনে ধারা মনে মনে শান্তি পেলো।
—ওকে মিস ধারা বাই।
শ্রাবণ গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগেই ধারা ঝটপট করে গাড়িতে উঠে বসলো। ধারার কান্ডে শ্রাবণ মুখ চেপে হাসলো। শ্রাবণ যে হাসছে তা ধারা বুঝতে পেরে মুখ বাঁকালো।
গাড়ি এসে তিথিদের বাসার নিচে থামালো শ্রাবণ। পুরো রাস্তা দুজনের মধ্যে কোনো প্রকার কথা হয়নি।
শ্রাবণ গাড়ি থামিয়েছে মিনিট দুই হয়েছে। কিন্তু ধারা নামছে না আর কোনো কথাও বলছে না। শ্রাবণও চুপচাপ স্টেয়ারিংয়ে কুনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে ধারার দিকে তাকিয়ে আছে।
নিরবতা ভেঙে ধারা মৃদু স্বরে বলে,
—আপনি কি এখন সত্যি ওই রুশা নামের মেয়েটার সাথে শপিংয়ে যাবেন?
শ্রাবণ গাল থেকে হাত সরিয়ে অবাক চোখে ধারার দিকে তাকালো। শ্রাবণের এমন ভাবে তাকানো দেখে ধারা অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। সে আমতা আমতা করে বললো,
—ন..না মানে এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম আরকি।
শ্রাবণ মৃদু হাসলো।
—যাওয়ার কথা ছিলো। আমার দেরি হচ্ছে বলে রুশা মা আর ভাবির সাথে শপিংয়ে চলে গেছে।
ধারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। গেইটে ঢুকতে গিয়ে পিছন ফিরে একবার তাকালো। শ্রাবণ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ধারা আলতো হেসে ভেতরে চলে গেলো। শ্রাবণ এখনও ধারার যাওয়ার তাকিয়ে আছে। কিয়ৎকাল একইভাবে তাকিয়ে থেকে সে চলে গেলো নিজের বাসায়।
#চলবে…..ইনশাআল্লাহ
(ধারার কাজে অনেকেই বিরক্ত তাই না??)