#শ্রাবণ_ধারা-২
#শেষাংশ
#সাদিয়া
শ্রাবণকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে সাথে সাথেই জ্ঞান হারায় ধারা। ধারাকে জ্ঞান হারাতে দেখে নাজমুল তাকে আগলে নেয়। নাজমুল ধারাকে নিয়ে প্রস্থান করার আগেই সেখানে পুলিশ নিয়ে রাসেল আর রকি এসে হাজির হয়। পুলিশকে আসতে দেখে ঘাবড়ে যায় নাজমুল। সে পুলিশের উপর গুলি চালানোর আগেই পুলিশ তার হাতে গুলি করে দেয় যার ফলে নাজমুলের হাত থেকে রিভলবারটা নিচে পড়ে যায় সেই সাথে ধারাও নিচে পড়ে যায়।
শ্রাবণ যে জায়গাটায় পড়ে আছে তার অনেকটা শ্রাবণের রক্তে লাল হয়ে গেছে। রকি আর রাসেল শ্রাবণের কাছে ছুটে আসলো।
—স্যার? স্যার? কথা বলুন স্যার।
শ্রাবণ তখনো জ্ঞান হারায়নি। সে অস্পষ্ট সুরে কিছু একটা আওড়ালো অতঃপর সে রকির কোলে জ্ঞান হারালো।
শ্রাবণ আর ধারাকে রাসেল আর রকি মিলে তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। শ্রাবণ আর ধারা দুজনের কারোরই জ্ঞান নেই। হাসপাতালে আনতেই ধারাকে স্যালাইন দিয়ে নরমাল কেবিনে দেওয়া হলো আর শ্রাবণকে নিয়ে যাওয়া হলো ওটিতে। যেহেতু শ্রাবণের প্রচুর পরিমাণে ব্লিডিং হয়েছে তাই ডা.সাঈদ ওদের রক্তের ব্যবস্থা করে রাখতে বলেছে। ডাক্তারের কথায় রকি গেলো রক্তের জোগাড় করতে আর রাসেল শ্রাবণের বাড়ির লোকদের জানিয়ে দিলো।
আধঘন্টার পর শ্রাবণের বাড়ির সবাই এসে জমা হলো হাসপাতালে। কান্না করতে করতে শ্রাবণের মায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। তিনি বার বার অজ্ঞান হচ্ছেন যার জন্য তাকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে শ্রাবণের বাবা মূর্তির ন্যায় বসে আছে। আজকে তার নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হচ্ছে। ছেলে নির্দোষ জানা সত্ত্বেও তিনি ছেলের জন্য কিছুই করতে পারেননি। শ্রাবণের নির্দোষ হওয়ার প্রমাণ তিনি আট বছর আগেই পেয়েছিলেন কিন্তু নিজের মেয়ে আর নাতনিকে বাঁচাতে তিনি চুপ ছিলেন। তিনি কাওকে সত্যিটা জানান নি। আজকে তার মনে হচ্ছে তার ছেলের এই দশা শুধু মাত্র তার জন্য। তিনিই তার ছেলেকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দিয়েছেন। শ্রাবণের বাবার চোখ থেকে দুফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
ঘন্টাখানেক বাদে ওটি থেকে ডা.সাঈদ বেরিয়ে আসলেন। তাকে বেরিয়ে আসতে দেখে শ্রাবণের ভাই শিহাব তার দিকে এগিয়ে যায়।
—ডাক্তার আমার ভাই কেমন আছে?
ডাক্তার সাঈদের উত্তরের জন্য সকলে তার দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। সবাই মনে মনে দোয়া করছে যেন ডাক্তার সাঈদের কাছ থেকে তারা কোনো পজিটিভ সংবাদ পেতে পারে। কিন্তু ডাক্তার সাঈদ তাদের নিরাশ করে দিয়ে শ্রাবণের কোনো ভালো সংবাদ দিতে সক্ষম হয় নি।
—দেখুন গুলিটা একেবারে শ্রাবণের হার্টের খুব কাছে গিয়ে ঠেকেছে। ওখান থেকে এক ইঞ্চি সরে গিয়ে ঠেকলেও আমরা সহজে গুলিটা বের করতে পারতাম। কিন্তু গুলিটার পজিশন এমন যে আমরা যদি এটা বের করতে যাই তাহলে ওর হার্ট ইনজোর্ড হতে পারে। এমনিতেও হার্টের খুব কাছে গুলি লাগার কারণে ওর হার্ট কিছুটা ড্যামেজ হয়েছে। আরো একটা জিনিস আমরা লক্ষ করলাম শ্রাবণের মস্তিষ্কে কিছুটা রক্ত ক্ষরণও হয়েছে। এখন কেসটা ক্রমশই ক্রিটিক্যাল হয়ে যাচ্ছে। আগে তার ব্রেনে রক্ত ক্ষরণ বন্ধ করতে হবে। কারণ ওর শরীর থেকে এমনিতে অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে। যে রক্ত বেরিয়েছে তা পূরণ করতে দুই থেকে তিনদিন সময় লাগবে। তাই ব্রেনের রক্ত ক্ষরণ অতি দ্রুত বন্ধ করতে হবে। আর গুলি বের করার বিষয়টাও জটিল। ওর বাঁচার চান্স ফিফটি ফিফটি।
এতটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ডাক্তার সাঈদ। শ্রাবণ তার ছাত্র ছিলো। খুব মেধাবী ছেলে ছিলো শ্রাবণ। কখনো কথার অমান্য করে নি। ডাক্তার সাঈদ শ্রাবণকে অনেক স্নেহ করতেন।
—এখন বলুন অপারেশনটা কি আপনারা করাতে চান। ভেবে বলবেন কারণ অপারেশন টেবিলেই শ্রাবণের মৃত্যু হতে পারে।
অনেক ভেবেচিন্তে শিহাব অপারেশনের জন্য রাজি হয়। ডাক্তার সাঈদও চলে যায় নিজের কর্তব্য পালন করতে।
শ্রাবণের অপারেশন শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই জ্ঞান ফেরে ধারার। জ্ঞান ফেরার পর থেকে শ্রাবণ শ্রাবণ করে তার অবস্থা পাগল প্রায়। যার জন্য তাকেও ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে।
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। সবাই আল্লাহ্ কে ডাকছে। সবার প্রার্থনাতে আজ শ্রাবণ। এতোক্ষণে হাসপাতালে ধারার বাবা-মা ও চলে এসেছে। অদ্ভুত হলেও এটাই সত্যি যে তারাও আজ শ্রাবণের সুস্থতার জন্য দোয়া করছে। এসব দেখে রাসেল আরও রকি তাছ্যিলের হাসি দিলো। তাদের কাছে এসব ন্যাকামি ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না। মানুষের স্বভাবটাই এমন শুধু তাদের কৃতকর্ম দেখে কর্মের পেছনের আসল মটিভটা তারা কখনো দেখবে না বিবেচনা করবে না। কোনো কিছু বিবেচনা না করেই তারা দোষারোপ করবে, কটুবাক্য প্রয়োগ করবে। আরো কতো কি করবে সেটা তারাই ভালো জানে।
সাড়ে চারঘণ্টা পর আবারো বেরিয়ে আসলেন ডাক্তার সাঈদ। এবার আর তিনি কাউকে নিরাশ করেননি। ভালো সংবাদ না দিলেও খুব একটা খারাপ সংবাদ তিনি দেন নি। ডাক্তার সাঈদ বলেছেন যদি ৭২ ঘন্টার মধ্যে শ্রাবণের জ্ঞান না ফেরে তবে সে কোমায় চলে যাবে। এখান এটাই দেখার পালা ৭২ ঘন্টার মধ্যে শ্রাবণের বডি কোনো মুভমেন্ট করতে সক্ষম হয় কি না।
শ্রাবণের মায়ের ঘুম ভাঙ্গলো অপারেশন শেষ হওয়ার এক ঘন্টা পর। তিনি অশ্রু সিক্ত চোখে আই সি ইউর বেডে পড়ে থাকা শ্রাবণের নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে আছেন। এতোগুলা বছর পর ছেলেকে এই অবস্থায় দেখতে হবে তা তিনি কোনো দিন স্বপ্নেও কল্পনা করেন নি। শিহাবের চেয়ে তিনি শ্রাবণকে বেশি ভালোবাসেন আর তাই অভিমানটাও শ্রাবণের উপরই বেশি। তার শরীরটা খুব একটা ভালো না থাকায় শিহাব তাকে আর বাবাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। তারা যেতে চায়নি শিহাব তাকে অনেক জোরাজুরি করে বাসায় পাঠাতে সক্ষম হয়।
ধারার ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে সে শ্রাবণের পাশেই বাসে আছে। তাকে শিহাব অনেক অপমান করেছে কিন্তু ধারা সেসব কানে তুলেনি। কারণ শিহাব খুব একটা ভুল বলেনি। তার জন্যই তো আজ শ্রাবণের এই অবস্থা। তাকে যদি শ্রাবণ ভালো না বাসতো তবে তো এতো কিছু ঘটতো না। সবাই সুখে থাকতে পারতো। ধারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রাবণের হাতে হাত রাখলো।
—উঠে পড়ুন না শ্রাবণ। দেখুন সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। কখন আপনি উঠবেন চোখ খুলে তাকাবেন। উঠুন না শ্রাবণ। আপনাকে কেউ আর কষ্ট দেবে না শ্রাবণ। কেউ আপনাকে চরিত্রহীনও বলবে না। কেউ আপনাকে কোনো দোষ দেবে না। আপনি শুধু একবার উঠে পড়ুন।
ধারা কান্নায় ভেঙে পড়লো। তার কান্না বাঁধ মানছে না। সব কিছুর জন্য তার নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে।
শ্রাবণের এমন গুরুতর অবস্থায় শ্রাবণের বাবার মাইনর হার্ট এট্যাক করেছে। শ্রাবণের মাও প্রচন্ড ভেঙে পড়েছে। এখন সকলের মনে হচ্ছে আট বছর আগে যদি তারা প্রথমেই শ্রাবণের উপর রাগারাগি না করে শ্রাবণের এমন একটা পদক্ষেপ নেওয়ার কারণ খুঁজে বের করতো তাহলে হয়তো এমন একটা তাজা প্রাণ এখানে নিথর হয়ে পড়ে থাকতো না। আজ তাদের সকলের আফসোস হচ্ছে। শ্রাবণের এমন পরিণতির জন্য সবাই এখন সবাই নিজেদের দায়ী করছে! তবে এখন আর আফসোস করে তো লাভ নেই।
ওইদিকে ঘটনার দুইদিন পর নাজমুলকে কোর্টে তুলা হয়েছে। নাজমুল বাঁচার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে সক্ষম হয় নি। অর্গান স্মাগলিং আর এট্যামট টু মা’র্ডারের কেসে তার যাবত জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। শ্রাবণ নাজমুলের বাঁচার কোনো পথ খোলা রাখেনি। নাজমুল ভাবে,
—নিজে মরতে মরতে আমার মরার ব্যবস্থাও করে দিয়ে গেছে সে। বলতে হবে এলেম আছে ছেলের।
এই জীবনে নাজমুলের আর জেল থেকে ছাড়া পাওয়া হবে না। জেলে যাওয়ার সাথে সাথে নাজমুল তার পাওয়ার সব হারিয়েছে যার জন্য এখন তার জেলে পঁচে ম’রা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
.
ডাক্তার সাঈদের দেওয়া ৭২ ঘন্টা শেষ হতে আর মাত্র দুই ঘন্টা বাকি। এই সত্তর ঘন্টায় শ্রাবণের বডিতে কোনো রকমের মুভমেন্ট দেখা যায়নি। এই ৭০ ঘন্টায় ধারা শ্রাবণের কেবিনে শ্রাবণের হাত ধরে আহার নিদ্রা ছেড়ে ঠায় বসেছিলো। শত বলেও কেউ তাকে এখান থেকে সরাতে পারেনি। কেবিনের বাইরে লোকের সমাগম। সবাই শ্রাবণের সুস্থতা কামনা করছে।
শ্রাবণের কেবিনে শ্রাবণের সাথে গল্প করায় ব্যাস্ত ধারা। জার্মানিতে ধারার দিন কেমন কেটেছে তাই সে বলছে শ্রাবণকে। এর মাঝে ডাক্তার সাঈদ আসলেন শ্রাবণের চেকাপের জন্য। ডাক্তার সাঈদ কিছুক্ষণ শ্রাবণকে দেখে চলে গেলেন। ডাক্তার সাঈদ চলে যেতেই ধারা টুল টেনে বসলো। শ্রাবণের বা হাতের উপর নিজের ডান হাতটা রাখলো।
—আমাদের শ্রাবণ-ধারার কাহিনী এখনো তো শুরুই হয়নি শ্রাবণ। আপনাকে উঠতে হবে। আপনাকে সুস্থ হতে হবে। আমার জন্য সুস্থ হতে হবে। আমাদের ভালোবাসার জন্য আপনাকে সুস্থ হতে হবে শ্রাবণ। আমাদের শ্রাবণ-ধারার কাহিনীকে পূর্ণতা না দিয়ে আপনার রক্ষে নেই শ্রাবণ। আমাদের ভালোবাসা নাজমুল নামের নষ্ট কিটের কাছে হেরে যেতে পারে না শ্রাবণ। আজ যদি আপনি না উঠেন তাহলে ভালোবাসা হেরে যাবে শ্রাবণ। কেউ আর ভালোবাসতে সাহস পাবে না। সবাই ভালোবাসাকে অভিশাপ মনে করবে। আপনাকে উঠতে হবে শ্রাবণ। আপনাকে উঠতে হবে। বাইরে বসে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের জন্য আপনাকে উঠতে হবে। আপনাকে আপনার মায়ের জন্য উঠতে হবে। আপনাকে আপনার বাবার ঢাল হতে হবে শ্রাবণ। আপনি একবার বলেছিলেন না আপনি আপনার ভালোবাসার মানুষের সাথে নিজের জীবনের শেষ ষাট বছর আনন্দে কাটাতে চান। ভুলে গেলেন সব? আপনি ভুলে যেতে পারেন না শ্রাবণ। আপনাকে উঠতে হবে। আপনি উঠতে বাদ্য শ্রাবণ।
ধারা শ্রাবণের হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে মৃদুস্বরে বললো,ভালোবাসি! খুব ভালোবাসি শ্রাবণ!
কথাগুলো শ্রাবণের কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো কিনা তা ধারা জানে না। ধারার মনে হচ্ছে আজকে ভালোবাসার পরীক্ষা। এই দুই ঘন্টায় শ্রাবণের বডি যদি মুভমেন্ট করে তবে জিতে যাবে ভালোবাসা। আর যদি না করে তবে হেরে যাবে ভালোবাসা। ধারা বুকে পাথর চাপা দিয়ে শ্রাবণের চোখ খোলার অপেক্ষায় বসে আছে। তার শ্রাবণ স্যারের অপেক্ষায় বসে আছে।
**অসমাপ্ত**
(