শ্রাবণ ধারা ২ পর্ব ১

0
1072

আজ আট বছর পর নিজের দেশে পা রাখছে ধারা। আজ এতোদিন পর সে নিজ দেশে পা রাখছে। মনটা যেন তার নিমিষেই ভালো হয়ে গেলো। ধারা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো। ইশশ কতদিন পর সে নিজের দেশকে দেখছে। আট বছর!
আজকের ধারা আর আট বছর আগের ধারার মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যাবধান। আট বছর আগের ধারা ছিলো দূর্বল আর ভীতু কিন্তু আজকের ধারা তা নয়। ধারা আট বছরে নিজের জীবনকে পুরোপুরি বদলে ফেলেছে। অতীতকে এক পাশে রেখে নতুন করে নিজের জীবন সাজিয়েছে। যদিও অতীতকে পুরোপুরি ভুলতে পারেনি। ধারা এখন একজন ডাক্তার । ডাক্তারিটা সে জার্মান থেকেই কিছুদিন আগে শেষ করেছে। আর আজকে বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছে।
এয়ারপোর্ট থেকে ধারা ক্যাব বুক করে সোজা তিথির বাড়ি চলে যায়। ধারা আজকে দেশে আসছে এই কথা তার পরিবারের কেউ জানে না। ধারা জানায় নি। সে জানাতে চায় না।মা-বাবাকে কেন যেন ধারা এখনো মন থেকে ক্ষমা করতে পারেনি। এতোগুলো বছরেও না।

আর শ্রাবণ! এই আট বছরে এমন একটা দিন নেই যেদিন ধারার শ্রাবণের কথা মনে পড়েনি,এমন একটা রাত নেই যে রাত ধারা কেঁদে বালিশ ভেজায়নি। অতীত ভুলে যাওয়া এতো সহজ নয়। তা যদি হয় তিক্ত কোনো অতীত তাহলে তো তা ভুলে থাকার সম্ভাবনা আরো কম। তিক্ত অতীত মানুষ কখনো ভুলতে পারে না। চাইলেও না।
.
তিথির বাসার সামনে এসে ক্যাব থামলে ধারা টাকা দিয়ে ল্যাগেজ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

নিজের রুমে সাউন্ড বক্সে গান ছেড়ে মনের আনন্দে নাচছে তিথি। দিনদুনিয়ার কোনো খবর তার নেই। তিথির মা মিসেস তন্নী রান্না ঘরে কাজ করছে। তখন কলিং বেল বেজে উঠলো। মিসেস তন্নী হাত মুছে হাসি মুখে দরজা খুলে দেয়।
মিসেস তন্নীকে দেখে ধারা হাসিমুখে সালাম দেয়,
—আস্সলামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছো?

—ওয়া আলাইকুমুস সালাম মা। আমি ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?

—আমি একদম মাস্ত আছি আন্টি। তা তোমার মেয়ে কোথায়?

—আর বলিস না এই মেয়ে এখনও বড় হলো না। গিয়ে দেখ নিজের রুমে সাউন্ড বক্সে গান চালিয়ে তিনি লাফাচ্ছেন ব্যাঙের মতো।

মিসেস তন্নীর কথায় ধারা হেঁসে তিথির রুমের দিকে পা বাড়ায়। তিথির রুমে প্রবেশ করতেই ধারা থ হয়ে যায়। ধারা ভাবছে এ আদো তিথি নাকি অন্য পাঁচ বছরের কোনো বাচ্চা। তিথি লুঙ্গি ডান্স গান চালিয়ে স্কার্টকে লুঙ্গি বানিয়ে নেচে চলেছে। ধারা কিয়ৎকাল থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে সেও তিথির সথে যোগ দেয়।

নিজের পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই তিথি তার নাচ থামিয়ে দেয় কিন্তু পাশ ফিরে তাকায় না। তার পাশে কেউ একজন অনবরত নেচে চলেছে সে তা অনুভব করতে পারছে। বাসায় এই মূহুর্তে তিথি আর তার মা ছাড়া কেউ নেই। তাই তিথি ধরেই নিলো তার পাশে একটা ভুত বা অশরীরী কিছু নাচ করছে। ভয়ে তিথি দিলো এক চিৎকার।

তিথির চিৎকারে ধারার কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার যোগার। অন্যদিকে তিথির চিৎকার শুনে মিসেস তন্নী রান্না ঘর থেকে ছুটে আসেন। এসে দেখের তিথি মুখে দুই হাত চেপে কিছু বিরবির করে চলেছে তার পাশেই ধারা কানে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে।
—কি হয়েছে তিথি? এমন ভাবে চিৎকার করলি কেন?

মায়ের কণ্ঠ শুনে যেন প্রাণ ফিরে পায় সে। দৌড়ে গিয়ে মা কে জরিয়ে ধরে।
—ভু….ভুত..!

তিথির মা আর ধারা দু’জনেই ভুরু কুঁচকে তিথির দিকে তাকায়। এই মেয়ে ভুত দেখলো কোথায়?
—ভুত?কোথায় ভুত?

—আ..আম্মু এই ঘরে ভুত আছে। আমার সাথে নাচ ছিলো।
তিথির কথায় মিসেস তন্নী এবং ধারা দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠে। মায়ের হাসি ছাড়াও আরেকটা পরিচিত হাসির শব্দে তিথি মুখ তুলে তাকায়। মুখ তুলতেই তিথি ধারাকে দেখতে পায়। ধারা তিথির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচায়।ধারাকে দেখেই তিথি “ধারা” বলে চিৎকার দিয়ে ধারাকে জরিয়ে ধরে।

—কখন আসলি তুই?

—ওই যখন তুই পাগলের মতো বিহেভ করছিলি।

তিথি মুখ গোমড়া করলো।আমতা আমতা করে বললো,
—আমি কখন পাগলের মতো ব্যবহার করলাম?

—সরি সরি মাই মিস্টেক! পাগল আবার কি পাগলের মতো ব্যবহার করবে।

ধারার কথায় তিথি রেগে গেলো। রেগে ধারার পিঠে কয়েকটকা কিল বসিয়ে দিলো।

—ধারা তিথি খাবি আয়।

মিসেস তিন্নীর ডাক শুনে মারামারি থামিয়ে দুই বান্ধবী খেতে চলে যায়।

.
রাতে শুয়ে শুয়ে ফোন স্ক্রল করছে ধারা। তিথি পাশে শুয়ে ধারাকে দেখছে। আগের ধারা আর এখনকার ধারার মধ্যে কি কি পার্থক্য হয়েছে সেটাই পর্যবেক্ষণ করছে সে।

—আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখছিস এভাবে?

—তুই আগের চাইতে মোটা হয়ে গেছিস ধারা।

তিথির এমন কথায় ধারা চোখ বড় বড় করে তাকায় তার দিকে।
—হু সত্যি বলছি। তুই তো আগে খুব রোগা ছিলি কিন্তু এমন ভুটকি হলি কি করে বলতো?

এবার ধারা রেগে যায়। কি সমস্যা ধারা একটু মোটা হয়েছে তাতে? আগে যখন রোগা ছিলো তখন সবাই বলতো তোমাকে কি তোমার বাবা মা খেতে দেয় না? আর এখন যখন স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে তখন এসব বলছে? ধারা কোনো কথা না বলে চুপচাপ ঘুমিয়ে যায়।

.
পরদিন সকালে নাস্তা করে ধারা আর তিথি দৌড় লাগায়। তিথি যায় নিজের ক্লিনিকে আর ধারা যায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। বিডিতে আসার আগে ধারা সোহরাওয়ার্দীতে জীবের জন্য এপ্লাই করেছিলো। ওটা কালকে রাতে কনফার্ম হয়েছে। আর আজকে থেকেই জয়েন।
হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে ধারা হাসপাতালটাকে এক নজর দেখে নিলো। গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে সে ভেতরে গেলো। তাকে পাঠানো হলো ই.এন.টি ডিপার্টমেন্টের প্রধান ডা.শ্রাবণের কাছে। শ্রাবণ নামটা শুনে ধারা প্রথমে ভীষণ অবাক হয়েছিলো। অতঃপর কিছু একটা বলে নিজেকে সামলে নিলো সে।

ই.এন.টি ডিপার্টমেন্টর হেড ডা.শ্রাবণের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালো ধারা। ডা.শ্রাবণের এ্যাসিস্টেন্ট ধারাকে জানালো এখন পেশেন্টের সিরিয়াল অনেক তাই তাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। ধারা কেবিনের সামনে থাকা চেয়ারে বসলো। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে হাতে নিতেই ডা.শ্রাবণের এ্যাসিস্টেন্ট তাকে ভেতরে যেতে বললো।

—মে আই কাম ইন?

—কাম।

ধারা ভেতরে ঢুকে দেখলো সাদা এফ্রোন পরিহিত একজন লোক প্যাশেন্টের গলায় লাইট দিয়ে মনোযোগ সহকারে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করছে। পেশেন্ট দেখতে দেখতে সে ধারাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—বসুন।

—জ্বী স্যার।

ধারা বসলো।

—উঠে বসুন।

—আমার কি হয়েছে ডাক্তার সাহেব?

—আপনার টনসিলটায় একটু সমস্যা হয়েছে। চিন্তা করবেন না আমি মেডিসিন লিখে দিচ্ছি। নিয়ম করে খাবেন ঠিক হয়ে যাবে।

এই বলে লোকটি ঘুরে দাঁড়ালো। লোকটিকে দেখে ধারা যেন ৪৪০ ভোল্টের শক খেলো। আচ্ছা সে যা দেখছে তা কি আদো ঠিক? নাকি তার ভ্রম? এতো গুলে বছর পর সে ভ্রম দেখবে?

—আপনার ডকুমেন্টস গুলো দিন।

—…..

—মিস ধারা..

ধারা এবারো চুপ। এবার লোকটা ধমক দিলো।
—মিস ধারা!

ধারা চমকে উঠলো।
—জ্….জ্বী?
ধমক শুনে ধারা বুঝতে পারলো এটা তার ভ্রম নয়! এটা পানির মতো স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার সত্যি! এতোগুলো বছর পর ধারা নিজের অতীতের মুখোমুখি হবে তা সে ভাবেনি।

—পাশের কেবিনে ডা.সৈকত আছে। উনার কাছে যাবেন। গিয়ে বলবেন আমি পাঠিয়েছি। আর সাথে এটাও বলবেন আপনার কানের সমস্যা আছে।

শ্রাবণের এমন কথায় ধারা ভ্রু কুঁচকায়।

—আপনাকে কে বলেছে আমার কানে সমস্যা আছে?

—আসলে কি বলুন তো অন্যের কথার চাইতে নিজের অভিজ্ঞতাকে প্রধান্য দেওয়া উচিত। আর আমি তাই করেছি।

শ্রাবণের কথার আগা গোড়া ধারা কিছুই বুঝলো না। সে বোকার মতো শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে আছে।

—হুয়াট এভার! আপনার ডকুমেন্টস গুলো দিন।

ধারা নিজের ফাইলটা এগিয়ে দিলো। শ্রাবণ নিঃশব্দে ধারার ডকুমেন্টস গুলো দেখলো।
—আমি রহিম চাচাকে বলে আপনার কেবিন রেডি করাচ্ছি ততক্ষণে আপনি রিসিপশনে গিয়ে এই কাগজটা জমা দিয়ে আসুন।

শ্রাবণের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে ধারা শ্রাবণকে সালাম দিয়ে কেবিন ত্যাগ করে। ধারার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শ্রাবণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

#চলবে..

#শ্রাবণ_ধারা-২
#সূচনা পর্ব
#সাদিয়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here