শৈবলিনী পর্ব ৬

0
1102

#শৈবলিনী—৬
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★শুটিংয়ে বারবার শুধু ভুল হচ্ছে আদিত্যের। সবসময় ওয়ান টেকেই পারফেক্ট শট করা অভিনেতা আজ এক একটা সিনে বিশ ত্রিশবার টেক নিতে হচ্ছে। কিছুতেই যেন মনোযোগ দিতে পারছেনা। মাইন্ড ডাইভার্ট হয়ে যাচ্ছে বারবার। একবার তো এ্যাকশন সিন করতে গিয়ে ফাইটারকে সত্যি সত্যিই ঘুষি লাগিয়ে দিয়েছে। তারজন্য অনেক বার সরিও বলেছে আদিত্য। শেষমেশ ডিরেক্টর বলেই দিলো, আদিত্য আই থিংক তোমার একটু রেস্টের দরকার। তুমি বরং কিছুক্ষণ ব্রেক নাও। একটু রিল্যাক্স হও। তারপর শুটিং করবো। আদিত্যও বুঝতে পারলো আসলেই ওর একটু রিল্যাক্স হওয়া দরকার নাহলে সব ব্লেন্ডার হয়ে যাবে। ভ্যানিটিতে এসে ধপ করে বসে পড়লো আদিত্য। নিজের ওপরেই চরম রাগ লাগছে তার। এমন উদ্ভট কেন লাগছে ওর? নূর কারোর সাথে হাসি খেলা করছে তাতে ওর ব্রেইনে কেন সাইক্লোন আরম্ভ হয়েছে? আমি এতো ন্যারো মাইন্ডের কবে থেকে হয়ে গেলাম? হবে হয়তো ছেলেটা নূরের বন্ধু। আর বন্ধুদের সাথে তো এমন করাটাই স্বাভাবিক। তো এই স্বাভাবিক বিষয়টাতে এতো অস্বাভাবিক বিরক্তি কেন অনুভব হচ্ছে? হয়েছে টা কী আমার?

শিখা আজ আবারও আদিত্যর সাথে দেখা করতে এসেছে। আদিত্য ওকে বলেছিল ও চাইলে যেকোনো সময় আদিত্যর সাথে দেখা করতে আসতে পারে। নিজেকে খুব নামি-দামি মনে হচ্ছে শিখার। দ্যা সুপারস্টার আদিত্যর সাথে যখন মন চায় দেখা করতে পারা কী চারটে খানি কথা নাকি? ওর ক্লাসমেট রা এই কথা শুনে তো একেবারে জ্বলে পুড়ে তন্দুরি চিকেন হয়ে গিয়েছিল। অনেকে তো বিশ্বাসই করেনি। তাই আজ আবার যাচ্ছে আদিত্যর সাথে সেলফি নিতে, যাতে সবাই বিশ্বাস করে। ওর মাঝে নিশ্চয় স্পেশাল একটা ব্যাপার আছে নাহলে কী আর আদিত্য সবাইকে রেখে ওকেই সেরা ফ্যান হওয়ার উপহার দিলো। উৎসাহী মনে আদিত্যর ভ্যানের সামনে এগিয়ে গেল শিখা। সেখানে জিদান যথারীতি ভ্যানের বাইরে বসেছিলো। শিখাকে হেলেদুলে এদিকে এগিয়ে আসতে দেখে জিদান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–এইযে ম্যাডাম, এখানে কোথায় যাচ্ছেন আপনি? এটা কী “বোটানিক্যাল গার্ডেন” মনে হচ্ছে যে,হেলেদুলে চলে আসছেন?

জিদানের কথায় শিখা তেতে উঠে বলল,
–এই ব্যাটা “চাম বাদুড়”। আমি হেলেদুলে আসি না লুঙ্গি ড্যান্স করতে করতে আসি তাতে আপনার বাপের কী? কেডা ভাই আপনি?

” চাম বাদুড়”! প্রথমে পাতিহাঁস, এখন আবার এই মেয়ের কাছে চাম বাদুড় শুনতে হলো। এরা কী হ্যান্ডসাম সুদর্শন পুরুষকে কীভাবে সম্বোধন করতে শেখেনি? এই জিদানের এতো অপমান? নাহ, সহ্য করা যায় না কিছুতেই। জিদান গলা উঁচু করে বলল,
–এই মেয়ে কী বলছ এসব? আমি আদিত্য স্যারের পিএ বুঝেছ?

–হ্যাঁ তো আমি আদিত্যর সাথে দেখা করতে এসেছি । সরুন সামনে থেকে।

–আহাহা, বললেই হলো।হালুয়া নাকি? যে খুশি সে এসে বলবে আদিত্য স্যারর সাথে দেখা করতে চাই আর আমি করতে দিবো? চলো যাও এখান থেকে।

–আপনি জানেন, আপনি কার সাথে কথা বলছেন? আমি হলাম আদিত্যের সেরা ফ্যান। আদিত্য যদি জানে আমাকে আপনি দেখা করতে দেননি তখন দেইখেন আদিত্য আপনার সাথে কি করে।

–পুরান পাগলে ভাত পায়না নতুন পাগলের আমদানি। আরে যাও তো এখান থেকে।

–কিহ, আমি পাগল? ঠিক আছে আপনি ভেতরে গিয়ে আদিত্যকে বলুন আমার কথা,বলুন শিখা দেখা করতে এসেছে। তারপর দেখুন কি হয়।

–ঠিক আছে। তোমার এতো অপমান হওয়ার ইচ্ছে থাকলে আমার কী করার।

জিদান দরজা খুলে ভেতরে মাথাটা বাড়িয়ে দিয়ে আদিত্যকে জিজ্ঞেস করলো।
–স্যার, শিখা নামের একটা মেয়ে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে।

আদিত্য কপাল ভাজ করে মন করার চেষ্টা করলো শিখা কে। জিদানের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি৷ স্যার নিশ্চয় এখুনি বলবে, কোনো শিখা ফিখা আলুর টিক্কাকে চিনিনা আমি। বিদেয় করো ওকে। তখন এই ছুড়িকে আচ্ছামত অপমান করবে জিদান। আমাকে চাম বাদুড় বলা তাইনা? তবে আদিত্য জিদানের এই মহান পরিকল্পনাকে নোংরা ডোবায় ডুবিয়ে দিয়ে বলে উঠলো।
–আরে হ্যাঁ শিখা। ওকে ভেতরে পাঠাও জলদি।

জিদানের কোমল হৃদয় টা বেলুনের মতো ফটাস করে ফেটে গেল। চুপসে যাওয়া মুখে বলল,
–ওকে স্যার।

শিখার দিকে ফিরে তাকালে দেখতে পেল শিখার ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। যার অর্থ,দেখলি তো চাম বাদুড় কে জিতলো? শিখা এক হাতে চুলের গোছা ঝটকা মেরে জিদানকে ভেংচি কেটে ভেতরে ঢুকে গেল। জিদানের মুখটা সত্যি সত্যি ঝুলে থাকা বাদুড়ের মতো হয়ে গেল। পেছন থেকে যেন ব্যাকরাউন্ড মিউজিক বেজে উঠলো, ♬ সান ছে জো টুটে কয়ি স্বাপ্না, জাগ সুনা সুনা লাগে…..

শিখা আদিত্যর সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। আদিত্য কথায় কথায় বলে উঠলো।
–আচ্ছা তোমার কয়টা ফ্রেন্ড যেন বলেছিলে?

–আমারতো দুটো বেস্ট ফ্রেন্ড। এক নূর, আরেকটা গিয়াস।

–ও হ্যাঁ। আচ্ছা তো তখন ওই বটগাছের নিচে তাহলে তোমরা তিনজনই বুঝি আড্ডা দিচ্ছিলে। দেখলাম খুব হাসাহাসি করছিলে। তা কি নিয়ে এতো মজা হচ্ছিল শুনি?

–ও ওইটা? আসলে ওই জোকার গিয়াস টা না এমন এমন কথা বলে না হেঁসে থাকা যায়না।

–তাই নাকি? তা তোমাদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন? আই মিন তোমার আর নূরের সাথে গিয়াসের সম্পর্ক কেমন?

–আরে আমরাতো সবাই একইরকম। কে ছেলে কে মেয়ে বোঝাই যায় না আমাদের মাঝে। বলতে গেলে ভাইবোনের মতো আমরা সবাই। আর গিয়াস টা তো একটু আবুল টাইপের। তাইতো ওর কথায় না হেঁসে থাকা যায়না।

এবারে বোধহয় একটু স্বস্তির অনুভব হচ্ছে আদিত্যের। কিন্তু এতক্ষণ ধরে এই অবান্তর ফালতু একটা মনোভাব কেন হচ্ছিল? কে দিবে এই প্রশ্নের জবাব? কে সমাধান করে দিবে এই অন্তর্দেশের অগোছালো অশান্ত অনুভূতি গুলোকে?
__

প্রিন্সিপাল স্যারের অফিসের দরজায় নক করলো নূর। পিয়ন এসে নূরকে বলেছে প্রিন্সিপাল স্যার নাকি তার সাথে দেখা করতে চায়। প্রিন্সিপাল স্যার তাকে হঠাৎ কেন ডেকে পাঠালো? কিছুটা ভয় লাগছে নূরের। স্যার অনুমতি দিলে ভেতরে ঢুকলো নূর। প্রিন্সিপাল বসতে বললো নূরকে। চেয়ার টেনে বসলো নূর। স্যার বলে উঠলো।
–নূর, তোমার সাথে একটা জরুরি কথা ছিলো। আসলে বলতে তোমার একটু হেল্প লাগবে।

–এভাবে কেন বলছেন স্যার? বলুন না কী করতে হবে?

–আসলে তুমিতো জানোই আমাদের ইন্সটিটিউটে ফিল্মের শুটিং চলছে। আমি প্রতিষ্ঠানের হিতের কথা ভেবে পারমিশন দিয়েছি । কারণ প্রথমত তারা এর পরিবর্তে এই ভার্সিটিতে মোটা অংকের অনুদান দিবে, যা আমাদের প্রতিষ্ঠানের উন্নতি প্রকল্পের কাজে লাগবে। আর দ্বিতীয়ত আমাদের ভার্সিটির প্রচারণাও হবে।

–জি স্যার আপনি নিশ্চয় যা করবেন প্রতিষ্ঠানের ভালোর জন্যই করবেন।

–কিন্তু একটা সমস্যা হয়েছে। আসলে ফিল্মের অভিনেতা সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য আমাদের ভার্সিটিতে থেকে একজন স্টুডেন্ট কে তার সহযোগী হিসেবে চাচ্ছে। যে তাকে আমাদের ভার্সিটি সম্পর্কে ভালো করে গাইড করতে পারবে। আর ভার্সিটি লাইফ সম্পর্কে জানতে তাকে সহযোগিতা করবে। আসলে আদিত্য বাইরে থেকে পড়াশোনা করেছে। তাই নাকি ওর দেশের ভার্সিটি লাইফ সম্পর্কে ধারণা একটু কম আছে। তাই ও এই ভার্সিটির একজন স্টুডেন্ট কে নিজের সহযোগিতার জন্য চাইছে। তো আমি চাচ্ছি তুমি এই কাজ করো।

স্যারের কথায় চমকে গেল নূর। ওই লুইচ্চা নায়কের সাহায্য করবো আমি? নো ওয়ে। এমনিতেই সিনেমা জগৎ আমার কাছে চরম বিরক্তিকর লাগে। যাকে বলে একেবারে ভয়াবহ পেট খারাপ ওয়ালা বিরক্তি। আর নায়ক ফায়ক কে তো আমার বমি করা লেভেলের অসহ্য লাগে। কিন্তু স্যারকে সরাসরি মানাই বা করবো কীভাবে? স্যার যদি রেগে যান। নূর মিনমিনে গলায় বলল,
–স্যার আমি? আই মিন আমার চেয়ে আরও অনেক স্টুডেন্টওতো আছে। তাহলে আমি কীভাবে….

–হ্যাঁ আছে।তবে আমি এই বিষয় টাতে তোমাকেই পারফেক্ট মনে করছি। কারণ তুমি বাকিদের থেকে আলাদা। কাজের প্রতি দায়িত্বশীল। অন্য কোনো স্টুডেন্ট কে দিলে তারা এটা ঠিকমতো করতে পারবেনা। বরং আদিত্যর ছবি আর নানানরকম ভিডিও বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করবে। এতে করে আদিত্যের সিকিউরিটি থাকবেনা। আর নিজের কাজের প্রাইভেসিও থাকবেনা। তাই আমি তোমার ওপরেই ভরসা করছি।

–কিন্তু স্যার আপনিতো জানেন আমার গ্যারেজে কাজ করতে হয়। আমি তেমন সময় দিতে পারবোনা। আর আমিতো রোজ ক্যাম্পাসেও আসি না। দরকারি কিছু থাকলে তবেই আসি।

–সমস্যা নেই, তুমি যতটুকু পারো ততটুকু সময় দিলেই যথেষ্ট। তাছাড়া এটা একটা পার্ট টাইম কাজ হিসেবেও করতে পারো। কারণ আদিত্য এরজন্য পেমেন্টও করবে। তুমি রোজকার একটা এমাউন্ট ঠিক করে নাও। সেই হিসেবেই তোমাকে পেমেন্ট করবে। তাহলে তো আর সমস্যা নেই।

পেমেন্টের কথা শুনে এবার একটু ভাবলো নূর। টাকাতো ওর দরকার। গ্যারেজের কিছু জিনিসপত্র কেনা দরকার। আর ওর একটা ল্যাপটপ কেনার জন্যও টাকা দরকার। আমিতো আর কারোর দয়া দীক্ষা নিচ্ছি না। কাজের পরিবর্তে টাকা পাচ্ছি। পার্ট টাইম কাজ হিসেবে করলে করাই যায়। হ্যাঁ, এরজন্য নাহয় একটু ওই লোকটাকে সহ্য করতে হবে। কী আর করার? এমনিতেও স্যারকে মানা করা বেয়াদবি হবে। তাই রাজিই হয়ে যাই। কয়দিনেরই তো ব্যাপার। তারপর সে নিজের রাস্তায়, আমি আমার রাস্তায়। ভাবনাচিন্তা করে অগত্যা নূর রাজি হয়ে গেল। প্রন্সিপাল স্যার খুশি হয়ে নূরকে আদিত্যর ভ্যানিটিতে গিয়ে দেখা করতে বলল।
__

জিদান বেচারা চিন্তায় মগ্ন। তার স্যারের মতিগতি আজকাল সে কিছুই বুঝতে পারছে না।কোথাকার কোন মেয়ের সাথে এতক্ষণ ধরে কথা বলছে ।আবার হঠাৎ এতবড় এমাউন্ট কেন ভার্সিটিতে অনুদান করলো তাই বুঝতে পারছে না। শুটিং এর জন্য তো প্রযোজক এমনিতেই অনেক টাকা দিয়েছে। তাহলে উনি আবার নতুন করে দিতে গেল কেন? জিজ্ঞেস করার সাহসও নেই তার। স্যারের টাকা, স্যার যেখানে খুশি সেখানে দিতেই পারে। গালে হাত ঠেকিয়ে বুক ফুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে তাকাতেই চোখ দুটো ফুটবল আকার হয়ে গেল। এই কুমিরের সরদারনী আবার এখানে আসছে কেন? এখানে কী রিলিফের চাউল বিতরণ করা হচ্ছে নাকি? যার মন চাচ্ছে চলে আসছে এদিকে?

নূর জিদানের সামনে এসে বলল,
–এই ব্যাটা পাতিহাঁস, যা গিয়ে তোর স্যারকে বল নূর এসেছে।

–কেন,আপনি কী কোথাকার প্রধানমন্ত্রী নাকি যে, স্যারকে আপনার আগমনের কথা জানাতে হবে?

–ইতরামি করস আমার সাথে। বেশি প্যাটোর প্যাটোর করলে তোকে জবাই করে পাতিহাঁস ভুনা করে গরীব দুঃখীদের মাঝে বিতরণ করে দেব বুঝলি? যা ডাক তোর স্যারকে।

আর প্রতিত্তোর করার সাহস পেলনা জিদান। জান হাতে নিয়ে দৌড় দিলো আদিত্যকে ডাকতে। দরজা খুলে আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলল,
–স্যার, কুমী..আই মিন ওই গ্যারেজের মেয়েটা এসেছে।

ঠোঁট দুটো আপনাআপনি প্রসারিত হয়ে গেল আদিত্যের। তারমানে প্রিন্সিপাল ওর কাজটা করে দিয়েছে।তবে জিদানের কথার ধরন দেখে মেজাজ বিগড়ে গেল তার। আদিত্য ধমকের সুরে বলল,
–ওর একটা নাম আছে জিদান। এরপর থেকে সম্মানের সহিত ওর নাম নিয়ে কথা বলবে। মনে থাকে যেন। আর যাও ওকে সম্মানের সাথে ভেতরে নিয়ে এসো।

জিদানের নিষ্পাপ মনটা আজ দুই দুইবার আহত হলো। হৃদয় টা হাজার টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো। দুঃখ আর ধরছেনা তার। শেষমেশ কিনা এই কুমিরের সরদারনীর জন্য স্যার আমাকে এভাবে ধমকালো! আমার স্যার পর হয়ে গেছে। তবে আমি স্যারকে ভুলবোনা। এই জীবন স্যারের নামে উৎসর্গ। ভারাক্রান্ত হৃদয় থেকে আওয়াজ শুনতে পেল জিদান♬ তুমি যদি সুখী হও দাও আরও ব্যাথা দাও, বেদনার আগুনে পোড়াও। নাহ তুমি না, স্যারের ক্ষেত্রে আপনি হবে। ♬ আপনি যদি সুখী হন দেন আরও ব্যাথা দেন…..

নূর ভেতরে এসে শিখাকে দেখে কপাল কুঁচকে এলো ওর। তীক্ষ্ণ রুষ্ট চোখে তাকালো সে আদিত্যের পানে। এই ব্যাটা লুইচ্চা নায়কের স্বভাব শুধরাবার নয়। আবারও শিখাকে এখানে ডেকে এনেছে। আর এই আবালের মহারাণীও আছে, ডাকলেই আসতে হবে? ষ্টুপিড কোথাকার। নূর শিখার পানে তাকিয়ে এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
–তুই আবার এখানে কী করছিস? এই লোকটা ডাকলেই আসতে হবে তোকে?

নূরের কথায় আদিত্যর কপালে ভাজ পড়লো। নূর যে আবারও ওকে ভুল বুঝছে সেটা বুঝতে পারছে ও। আদিত্য কিছু বলতে যাবে তার আগেই শিখা বলে উঠলো।
–আরে তুই ভুল বুঝছিস। আদিত্য ডাকেনি, আমি নিজেই এসেছি। আর আমার ছাড়। তুই এখানে কী করছিস তাই বল? তারমানে কী তুইও আদিত্যের ফ্যান হয়ে গেলি?

–ও প্লিজ,এতো খারাপ দিন এখনও আসেনি আমার। মাথার নাট বল্টু এখনো টাইট আছে আমার। আমি প্রিন্সিপাল স্যারের আদেশ অনুযায়ী এখানে কাজের জন্য এসেছি। তোর হেংলীপনা করতে আসিনি।

–কাজ? কী কাজ?

নূর সবটা খুলে বললো শিখাকে। শিখা উৎসাহের সহিত বলল,
–ওয়াও ইয়ার,তাহলে তো অনেক মজা হবে। আমরা দুইজন মিলে আদিত্যর সাথে আড্ডা দিতে পারবো।

–উনি কী আমার ছোটকালের বন্ধু কালাচান নাকি যে, উনার সাথে বসে আড্ডা দিবো আমি? আমি এখানে কাজ করতে এসেছি। তাও শুধু প্রিন্সিপাল স্যারের কথায়। নাহলে জীবনেও আসতাম না এখানে।

এদের দুইজনের মধ্যে আদিত্য নিজের জন্য কোনো স্পেসই পাচ্ছে না। নূরের সাথে একটু সময় কাটানোর জন্যই তো ও এতো প্ল্যান করলো। কিন্তু সেটাই তো হচ্ছে না। শিখা থাকলে ও ভালো করে নূরের সাথে কথা বলতে পারবে না। আদিত্য কিছু একটা ভেবে শিখার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–আচ্ছা শিখা, তুমি কী আমার মুভির হিরোইনের সাথে দেখা করতে চাও?

–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। সামাইরাকে আমার অনেক ভালো লাগে। আমি কী দেখা করতে পারবো?

–কেন পারবেনা? আমি এখুনি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

আদিত্য জিদানকে ডেকে বলল, শিখাকে সামাইরার ভ্যানিটিতে নিয়ে দেখা করিয়ে দিতে। জিদান অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথা ঝাকিয়ে ঠিক আছে বলল। শিখা জিদানের সাথে বাইরে চলে গেল। শিখা যেতেই আদিত্য নূরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–বসোনা নূর, কী খাবে বলো। কফি না চা নাকি কোল্ড ড্রিংক?

নূর সোজাসাপটা ভাবে বলল,
–নাথিং। আমি এখানে ডেটে আসিনি। কাজ করতে এসেছি। সারাদিন সময় নেই আমার কাছে। কাজ শুরু করা যাক।

–আচ্ছা ঠিক আছে। বসো আগে,তারপর শুরু করছি।

এতো তাড়াতাড়ি আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে লুইচ্চা ব্যাটা। নায়কদের কাজই এই। স্যার না বললে,এই অসহ্য নায়ক ফায়কের কাছে জীবনেও আসতাম না।তবে এই ব্যাটা জানে না যে,আমি কী জিনিস। ভার্সিটি লাইফ সম্পর্কে জানতে চায় তাইনা? এখুনি শেখাচ্ছি উনাকে। এমন লেসন দিবো বাপের জন্মেও ভুলবেনা। নূর চেয়ারে বসে বলল,
–তাহলে শুরু করা যাক?

আদিত্যর ধ্যান নূরের মাঝে।খতিয়ে খতিয়ে দেখছে সে নূরকে। কালো রঙের কুর্তি আর এ্যাশ রঙের জিন্স পড়েছে মেয়েটা। মাথার চুলগুলো উপরে ঝুটি বাঁধা। মুখে কোনো প্রসাধনীর ছিটেফোঁটাও নেই। এই অতি সাধারণ মেয়েটাও যেন আদিত্যর কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে অসাধারণ নারী মনে হচ্ছে। কী এমন আছে তার মাঝে? নূরের কথায় আদিত্যের ঘোর কাটে। সে বলে ওঠে।
–হ্যাঁ অবশ্যই।

–তো আজ আমরা ভার্সিটির বন্ধু বান্ধব কীভাবে কথা বলে সেটা শিখবো। ধরুন আপনি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।

আদিত্য বিড়বিড় করে বলল,
–আই লাভ টু বি।

নূর নিজের মতো করে বলতে লাগলো।
–হ্যাঁ তো ধরুন আমরা ফ্রেন্ডস। আপনি মাত্রই আসলেন। তো আমি তখন বলে উঠবো, “আরে মামা তোরে তো হেব্বি জোস লাগতাছে। এমন চান্দের লাহান ঝিল্লিক মারতাছোস ক্যান? তিব্বত সাবান দিয়া শরীর খইসা আইছস নি? ঘটনা কী মামা?”

আদিত্যর গলায় কিছু আটকে গেল যেন। কাশতে কাশতে শুরু করে দিলো বেচারা। কাশতে কাশতে নাড়ীভুঁড়ি বেরিয়ে আসার উপক্রম। “মামা”!!! শব্দটা যেন মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকে এলোপাতাড়ি দৌড়াচ্ছি। শেষমেশ কিনা মামা! তাও নূরের মুখে? মনে হচ্ছে মুখের ভেতর কেউ দুই লিটার করল্লার জুস একবারে ঢেলে দিয়েছে। ইয়াক, ডিসকাস্টিং ফিলিং। এই মামা শব্দটা দুনিয়ার সবচেয়ে জঘন্যতম ওয়ার্ড মনে হচ্ছে আদিত্যের কাছে। আজকের পর নিজের মামাকেও আর মামা বলতে ইচ্ছে হবেনা ওর।এতো সুন্দর ফুরফুরে মেজাজের একেবারে রফাদফা করে দিলো নূর এই একটা শব্দে। আর নূর তার মতো এখনো বলেই যাচ্ছে। আদিত্য আর নিতে পারলোনা। তড়িঘড়ি করে বলল,
–ওকে ওকে স্টপ। আজকের মতো অনেক হয়েছে। বাকি লেসন কাল নিবো। এখন বরং তুমি যাও।

মনে মনে বিশ্বজয়ের হাসি দিলো নূর। তবে মুখে রাজ্যের ইনোসেন্ট ভাব ধরে বলল,
–আর ইউ সিওর স্যার? আপনি চাইলে আমি আরও কিছু উদহারন দিতে পারি। এই যেমন, আরে মা…

–আই সেড স্টপ। বললাম না আর দরকার নেই। তুমি যাও এখন। বাকি লেসন কাল হবে।

–ওকে স্যার, যেমনটা আপনি বলেন। আমি তাহলে এখন যাই।

নূর বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বেড়িয়ে গেল। আদিত্য পানির বোতল টা বের ঢকঢক খেয়ে নিলো। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। ঠোঁট দুটো বিস্তৃত করে হালকা হাসলো আদিত্য। মেয়েটা ভাবছে আমি ওর চালাকি বুঝতে পারিনি। নূর যে ইচ্ছে করে এসব করেছে তা সে ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। ব্যাপার না। আজকের দিনের জিতটা তোমার নামে। তবে পরের বার আর সুযোগ পাবেনা তুমি। এর শোধতো আমি সময়মত ঠিকই তুলবো। তবে মেয়েটার বুদ্ধি আছে বলতে হবে। সাদমান শাহরিয়ার আদিত্যকে শুধু এক কথাতেই নাস্তানাবুদ করে দিলো। এটা কেবল অসাধারণ কারোর পক্ষেই সম্ভম। মেয়েটা যেন ধীরে ধীরে ওর সবটায় আয়ত্ত করে ফেলছে। তবে কী শেষ রক্ষা আর হবে না। মনের এই হাজার অগোছালো অনুভূতি গুলোকে কে সঠিক পথ দেখাবে?

–মে হু না…

হঠাৎ সামনে থেকে কারোর কথা শুনে মাথা তুলে তাকালো আদিত্য। ব্যাক্তিটির কথায় হালকা হেসে বলল,
–আরে তুই? এখনো মরিস নি?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here