#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#পর্ব_২৩
আলিশা
স্মরণ এবাড়িতে নেই মানে সত্যিই সে নেই। সকলে অবাক হলো। হুট করে সে যাবে কোথায়? কিছুটা বিচলিত ছিলাম সহ প্রত্যেকে। কেবল যেন অঙ্কনই স্থির ছিলো। সে ফোন করে বসলো স্মরণের কাছে। অবশেষে কিনা খবর এলো সে হঠাৎ জরুরি ফোনের দরুন বেরিয়ে গেছে। তা যে সে জরুরি ফোন নয়, তার আজ ভোর সাতটায় ফ্লাইট। ডিউটি আছে। দেশের বাইরে যেতে হবে। তার আগে তাকে পৌঁছাতে হবে ঢাকায়। একথা সে ভুলেই বসেছিল। সেহেরি করে গেলে হয়তো ফ্লাইট ধরা হবে না তার। তবে ফ্লাইট ধরতে যাওয়ার কালে রাস্তায় গাড়িতে বসে সে সেহেরি খেয়ে নেবে। সকলের আনন্দে ছিটেফোঁটায় ফিকে ভাব দেখা দিলো। অঙ্কন কথা বাড়ালো না ফোনে। আমার মনটা অজান্তেই খারাপ হয়ে গেলো। সকলেই সামান্য মন খারাপ ঠেলেঠুলে সরিয়ে খাওয়ায় মন দিলেও আমি পারলাম না। অর্ধেক খাবার প্লেটে রেখে উঠে যেতে বাধ্য হলাম।
শেষে রাতের বাকি সময়টুকু কাটলো ভারি মন নিয়ে। অতঃপর আজানের ধ্বনি শুনে নামাজ আদায় করে শুয়ে পরেছিলাম। ঘুম ভাঙলো প্রিয়ার ডাকে। তখন সকাল সাতটা। প্রিয়া ফোন হাতে বসেছিল। আমার ঘুমে কপোকাত চোখ দুটোতে ভরপুর বিরক্তি। প্রিয়ার দিকে কটমট করে তাকাতেই সে আমার কানে গুঁজে দিলো ফোন। ফোনের ওপাশের একটা কন্ঠ আমাকে স্তব্ধ করে দিলো।
— খেয়া?
ঘুম ছুটে পালালো আমার। প্রিয়ার দিকে তাকাতেই ও ঘুমের ভঙ্গি দেখিয়ে বড় করে হা করলো। অতঃপর ছন্নছাড়া ভাব নিয়ে বলল
— অন্য কেউ না রে বোইন। তোরই জিনিস। আর ফোনটা তোর পিএ জাহিন ভাইয়ের। আমাকে বলল স্যার ফোন করেছে একটু দিয়ে আসুন ম্যামকে।
প্রিয়ার কথা শেষ হতেই মনোনিবেশ করলাম ফোনে। কানে এলো
— সরি, বলে আসতে পারিনি কাউকে। সরি এগেইন।
— আচ্ছা।
আমি বলার মতো কিছু খুঁজে পাইনি। আর রাগে বুঝিনি তার সরি বলার কারণ। বলে যায়নি আবার কিনা শেষ মুহূর্তে ঢং!
— বি কেয়ারফুল ওকে? টেক কেয়ার।
আমি এবার হালকা স্বরে বললাম
— হুম।
ওপাশে স্মরণ রেগে ফোন কাটার কথা ছিল। আমাকে ডিজগাস্টিং বলে একটা ঝাড়ি দেবে বলে প্রস্তুতি নিয়ে ছিলাম আমি। কিন্তু সে এমন কিছুই না করে আরো ভয়ঙ্কর কাজ করে বসলো। হুট করে শত আবেগ কন্ঠে ঝাড়িয়ে বলল
— এবারের ডিউটিতে ফোন ব্যাবহার করা যাবে না। প্লেনে ওঠার আর দু’মিনিট বাকি। পাঁচ মিনিটের জন্য একটা বিরতি ছিলো। তিন মিনিট ছোঁয়ার সাথে কথা বলে দু’মিনিট তোমার জন্য রেখেছিলাম।
কথাগুলো বলার পরই ফোনটা কাটা হলো। আমার হৃদপিণ্ড সেকেন্ড কয়েকের জন্য যেন থমকে গেলো। অসুখ বাঁধলো ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ ছন্দ পতনের। লোকটা এমন তবে? দিন অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে যেন প্রতিফলিত হচ্ছে তার আসল সত্ত্বা। আমার মনে হচ্ছে, মন্দ নয় সে বা তার কোনোকিছু।
.
.
.
সময় গেলো তার গতিতে। দেখতে দেখতে আজ দু’দিন পেরিয়ে গেল স্মরণ চলে গেছে। দিনগুলো আগের মতোই কাটছিলো আমার। সকালে স্কুলে যাওয়া, দুপুর একটার পর বাড়ি ফেরা। মাঝে সময় সুযোগ পেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বসা সবুজ মাঠে, পার্কে বা সমুদ্র তীরে। প্রিয়া খামখেয়ালী করে বসে প্রায়ই। তবে সে কথা বলতে গেলেই ছোঁয়া পাতা ছুতে দেয় না। আমরা বন্ধুরা প্রত্যেকেই বুঝতে পারি, প্রিয়া তার হৃদয় পোড়া ডাক্তারের প্রেমে বেশ মশগুল। শান্ত প্রিয়ার বিয়ের বিষয় নিয়ে মজার অন্ত রাখে না। প্রিয়া যে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবার মেয়ে তাও নয়। সেও কথা মাটিতে পরার পূর্বেই ছো মেরে তুলে এনে ছুড়ে দেয় শান্তর দিকে। আজও তাই হচ্ছে। সজিব, নিলীমা আর আমি শুধু দর্শক সেজে বসে আছি। মাঝে মাঝে দু’জনকে উস্কে দিচ্ছে নীলিমা। শান্ত এক পর্যায়ে অঙ্কনের নিক নেম দিয়ে বসলো ” ছ্যাকা বেডা”। নিজের বরের এমন নাম প্রিয়া মোটেও মেনে নিতে পারলো না। সাথে সাথে পায়ের জুতো হাতে তুলে নিয়ে ছুটলো সে শান্তর পিছু। প্রায় মিনিট দশেক পর এলো ক্লান্ত দেহ নিয়ে। শান্ত অশান্ত বাক্য বুনে ছুড়ে দিলো সকলের উদ্দেশ্যে
— ধুর আ লবা। ছ্যাকা বেডার জন্য কলিজা শুকাই গেছে। টেপা পুতুল এমন দৌড়ানি দিলো যে ভুলেই গেছিলাম আজ রোজার দিন।
প্রিয়া ফুঁসে উঠলো শান্তর কথায়। চোখ মুখ কুঁচকে বলে উঠলো
— রোজার দিন। মুখের ভাষা কাইন্ডলি ঠিক কর ভাই।
শান্ত ক্ষুদ্ধ হয়ে বলল
— মূর্খ! বেঠিক কি পাইলি তুই? উল্টো করে বলছি না আমি?
আরো কিছুক্ষণ বিবাদ চলল দুজনের। আমি পার্কের ইট পাথরের বানানো বসার আসনে বসে ঝিমোচ্ছিলাম। গত রাতে খুব একটা সুবিধার ঘুম হয়নি। শান্তর দিকে তাকিয়ে বললাম
— আমি চলে যাই। তোরা থাক।
শান্ত মাথা দুলিয়ে সাঁই জানালো। প্রিয়াও আমার সাথে হাঁটা দিলো। নীলিমাও বাকি রইলো না। জাহিন এগিয়ে এলো আমার নিকট। সে গাড়ি নিয়ে সর্বদাই এমন প্রস্তুত থাকে। আমাকে ফলো করাই তার একমাত্র লক্ষ্য ও গুরুতর কাজ। প্রিয়া আর নীলিমা একটা রিকশা নিয়ে চলে গেলো। আমিও খামোখা বিলম্ব না করে বিণাবাক্যে গাড়িতে উঠে পরি।
দিন ফুরিয়ে রাতের আগমন হলো। গোধূলি প্রহর কাটলো ব্যাস্ততায়। ছোঁয়া আমার রান্নার কাজে টুকটাক সাহায্য করার জন্য উন্মুখ ছিলো। নিয়ম করে সে তিনটে রোজা রাখে। সকালে ইফতার, দুপুরে ইফতার আর আমার সঙ্গে বসে সন্ধ্যায় একবার ইফতার করে সে। এইতো! এভাবেই কাটছে আমাদের মা মেয়ের দিন। ঘুমানোর আগে প্রিয় বাবার প্রসংশায় পঞ্চমুখ থাকে ছোঁয়া। আজও প্রশংসা করলো। আমার কল্পনায় স্মরণ ভেসে উঠলো। জল্পনা শুরু করে শুয়ে রইলাম বন্ধ চোখে। মুহূর্তেই চলে গেছি স্বপ্নের জগতে। অবচেতন মন চোখে ভাসিয়ে তুলল ছোট একটা পরিবার। ছোঁয়া, স্মরণ আর আমি হাঁটছি ফুলে বিছানো এক রাস্তায়। আমার প্রিয় কাঠগোলাপের গালিচা যেন বিছানো পুরো সড়কে। কি মনকাড়া হাসি তার! আমার লম্বা শাড়ির আঁচল নিয়ে সে বিরক্ত, আমার লম্বা চুলের বেণীতে সে মুগ্ধ। এরপরের দৃশ্যটা হলো বিভৎস। হঠাৎ করে আমার আর ছোঁয়ার ওপাশ হতে উধাও হয়ে গেলো স্মরণ। না বলে, না জানিয়ে। আমি চমকে উঠলাম। খুজতে শুরু করলাম তাকে। অতঃপর হঠাৎ আমি চলে গেলাম এমন কোথাও যেখানটার আশপাশ দেখে বোঝা গেলো এটা হসপিটাল। ছোঁয়া করিডোরে বসে বাবা বলে চিৎকার দিয়ে কাঁদছে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতেই ছোঁয়া উত্তর দিলো
” বাবা, বাবা তুমি প্লিজ আসো? বাবা, বাবা”
বিরতিহীন ডাক। আমি যেন স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তারপর দৌড়াতে শুরু করলাম কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে। পথে হোঁচট খেয়ে হুড়মুড় করে পরে যাই। আর তখনই এক ঝটকায় বিছানা থেকে উঠে বসে পরি। হাঁপাতে শুরু করলাম। আশপাশ ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় আবছা। এ যে দুঃস্বপ্ন ছিলো তা বোঝার পর যেন বুকের ওপর থেকে নেমে গেলো কয়েক টন ওজনের পাথর। চোখে হাত লাগিয়ে অনুভব করলাম অশ্রুকণা গড়াগড়ি খাচ্ছে গালে। মন পুনরায় স্বপ্নটা কল্পনা করতে গেলে বুক কেঁপে উঠলো আমার। শান্তি উড়ে গেলো মন থেকে।
রাতটা মোটেও ভালো কাটলো না আমার। মন উন্মাদ হয়ে উঠলো তার একটা খবরের আশায়। একটা বাজে স্বপ্ন কে ঘিরে মাথায় তৈরি হলো অসংখ্য বাজে ভাবনা। বারংবার চোখ ভিজে উঠলো। তাকে তো ফোন করা গেলো না। আর না নেওয়া হলো খোঁজ। তার অফিস, স্টাফ কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না। কেননা এসবের কোনো তথ্যই জানা নেই আমার। দুশ্চিন্তা আর ছটফট ভাব নিয়ে ঠেলতে ঠেলতে সময় পার করে পৌছালাম রাতের শেষ প্রহরে। ঠিকঠাক খাওয়া হলো না। তবে এই সময়ের জন্য একপ্রকার অপেক্ষা করছিলাম আমি। জাহিনের সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা। ঘুম ভেঙে গিয়েছিল রাত বারোটার পর। তখন জাহিনকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করতে দ্বিধা হচ্ছিলো। একবার রিং হতেই ওপাশে জাহিন ফোন রিসিভ করে সালাম জানালো আমাকে। আমি স্মরণের সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে সে বলল, অফিসে ফোন করবে সে। ফেন করে জেনে নেবে স্মরণ কোথায় আছে, কেমন আছে।
সকাল দশটা হবে। আমি ছোঁয়া কে নিয়ে আমার স্কুলে গিয়েছি। অফিস রুমে বসে হাজিরা খাতায় নাম তুলছিলাম। ছোঁয়া ওর ফোনে ভিডিও দেখায় মগ্ন ছিলো। হঠাৎ ওদিকে একটু কান খাড়া করতেই শুনি নিউজ পড়া হচ্ছে, আজ সকাল ন’টায় অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে যাত্রা করা এক প্লেন আকাশপথে দূর্ঘটনার শিকার হয়েছে। যাত্রীদের মাঝে বাংলাদেশ সি আই ডি ডিপার্টমেন্টের গোটা একটা স্টাফ ছিলো। বিধ্বস্ত হওয়া প্লেনে ত্রিশজন যাত্রীর মাঝে দশজন নিহত।…..
চলবে…..
( আর একটা দুইটা পর্ব তাই শেষ 🫡)