শেষ বিকেলের প্রণয় পর্ব ৪

0
967
Made with LogoLicious Add Your Logo App

#শেষ_বিকেলের_প্রণয়
#লেখিকা_আলো_ইসলাম
‘৪’

-” রানীমা আপনি? ঘাবড়ে যাওয়া কন্ঠে বলে উঠে ছুটি। পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ছায়া। ছুটির কথায় ছায়া বোনের দিকে অপরাধের ন্যায় তাকালে ছুটি ভ্রু কুচকে তাকায়।
– আমরা ভেতরে গিয়ে কথা বলি! শান্ত কন্ঠে বলেন মমতা খান। ছুটি কিছু না বলে সরে দাঁড়ায়। মমতা খান ভেতরে গেলে ছায়া ওইখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।
– তুই আসবি না? ছুটির কথায় ছায়া কিছু বলতে যাবে তখনই মমতা খান বলে ছায়ার কোনো দোষ নেই ছুটি, আমি ওকে ফোর্স করি তুমি কোথায় আছো সেটা বলতে। ছায়া অবশ্য অনেক ভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। মমতা খানের কথায় ছুটি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এদিকে ছায়া কাঁদো কাঁদো ভাব নিয়ে তাকায়। তার চোখ মুখ বলছে সরি আপাই।

— ভেতরে আয় বলে ছুটিও চলে যায় ভেতরে।

— রানীমা! ছুটির অপরাধী কন্ঠ। বাকি কথা বলার আগে মমতা খান বলে আমি বলবো আর তুমি শুনবে এবং জবাব দেবে। কথার মধ্যে তার তিক্ততা, কঠোরতা প্রকাশ পাই একটু।
— তুমি বিয়ে করবে না সেটা তোমার ব্যক্তিগত মতামত। তুমি বিয়ের জন্য বারণ করতেই পারো। এখানে তোমাকে কেউ জোর করতে পারেনা বা করবে না,কিন্তু এমন একটা কাজ কেনো করলে তুমি? ছুটির মাথা নুয়ে যায়। এই কথার জবাব নেই তার কাছে।
– আমি তোমাকে খুব বুদ্ধিমান আর শান্ত স্বভাবের জানতাম ছুটি। ছোট থেকে তোমাকে দেখে আসছি আমি। এমন টা আশা করিনি কখনো। হতাশার সহিত বলেন তিনি।

— ছুটি, ছায়া দুজনেই নিরব।

— তাশরিফ কে বিয়ে না করার কারণ’টা কি জানতে পারি ছুটি? হঠাৎই বলে উঠেন মমতা খান। ছুটি এবং ছায়া দুজনেই চমকানো চোখে তাকায়।
— আমি যতদুর জানি, ছুটি তাশরিফকে ভালোবাসে,এবং সেটা এক দুদিনের ভালোবাসা নয়। ছোট থেকেই তাশরিফ ছুটির মনে জায়গা করে আছে। যদিও তাশরিফ কখনো সেটা উপলব্ধি করতে পারেনি। বুঝতে পারেনি তোমার ভালোবাসাটা। তাহলে আজ কি এমন কারণ আছে যার জন্য নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে ফিরে পাওয়ার সুযোগ পেয়েও সেটা গ্রহণ করতে পারছো না তুমি?

— মমতা খান অপেক্ষা করছে ছুটির জবাব পেতে। খুব দরকার আজ এই কথা গুলো জানার।

— যে আমার ভালোবাসা কখনো উপলব্ধিই করতে পারেনি তার কাছে কি মূল্য আছে আমার ভালোবাসার বলতে পারেন রানীমা? তাছাড়া আমি ভালোবেসেছিলাম সেটা যে আজও একইভাবে আছে বা থাকবে এমনও তো নয়। তিনটা বছর কম সময় নয় রানীমা। মানুষের মন পরিবর্তন হতে যথেষ্ট সময় কিন্তু এটা।

– শক্ত কোনো ভীত থাকলে সেটা দাঁড় করাও। তোমার সাথে এই যুক্তি গুলো ঠিক যাচ্ছে না আর যাইও না। মমতা খানের কথায় বিস্ময় নিয়ে তাকায় ছুটি।
– আমি একজন মা। আমি সন্তানদের বুঝতে পারি,তাদের মনের কথাও উপলব্ধি করতে পারি। আমার ছেলে যেটা কখনো বুঝেনি সেটা কিন্তু আমি বুঝেছিলাম অনেক দিন আগে। মনে আছে নিশ্চয়?

– ছুটি কি বলবে বুঝতে পারছে না।

— আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম তোমাকে নিয়ে আর সে স্বপ্নে তোমাকেও সাথে নিয়ে ছিলাম। ইন্ধন দিয়েছিলাম আমার ছেলের বউ করার। কিন্তু তাশরিফ যে আরেকজন ভালোবেসে ফেলবে ভাবিনি। তোমার মতো আমিও বিশ্বাস করতাম তাশরিফের মনে তোমার জন্য জায়গা আছে । কিন্তু যেদিন ও ইলহামকে ভালোবাসার কথা বললো সেদিন তোমার মতো আমারও সব স্বপ্ন ভেঙেচূড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম ছেলের ভালোবাসার কাছে। জোর করে আর যাই হোক সম্পর্ক গড়া যায়না। তাই সেদিন তুমি যেমন নীরবে সরে এসেছিলে সেদিন আমিও সব মেনে নিয়েছিলাম।

– তবে আজ কেনো নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছেন রানীমা। তাশরিফ ভাইয়া তো চাইনা আমাকে বিয়ে করতে। তার মনে তো এখনো অন্যজন আছে । তার সব কিছু জুড়ে ইলহাম আছে৷ তাহলে আজ কেনো মনে হচ্ছে আপনার জোর করে নতুন একটা সম্পর্ক করা দরকার? ছুটির মধ্যেকার ক্ষোভ ফুটে উঠে।

— আমার ছেলেটা ভালো নেই ছুটি! একটু ভালোবাসার খুব দরকার ওর। নিজেকে যতই স্বাভাবিক রাখুক না কেনো,ভেতরে কি হচ্ছে ওর আমি তো জানি৷ ইলহামকে খু’ন করার দায় ও নিজের উপর নিয়েছে, কিন্তু কেনো এমন করেছে আমি জানি না। তাশরিফ ওর কথা আর জেদে অটুট। আমি কোনো ভাবে তাকে নড়াতে পারছি না তার জায়গা থেকে । কিন্তু তুমি বলো ছুটি, যাকে এতটা ভালোবাসে সে তাকে কি খু’ন করা সম্ভব? টাকা আর পাওয়ারের ভিত্তিতে আমি আমার ছেলেটাকে বাইরে বের করে আনতে পেরেছি৷ কিন্তু বেশি দিন আমি এই শক্তি দিয়ে ধরে রাখতে পারবো না ওকে। তাশরিফ যদি ওর সিদ্ধান্ত না বদলায়, মিথ্যা থেকে বেরিয়ে না আসে তাহলে যে ওর ফাঁসি হয়ে যাবে ছুটি।

– চমকানো চোখে তাকায় ছুটি।

– অদৃশ্য কোনো শক্তি কাজ করছে তাশরিফের বিরুদ্ধে। আমার বিশ্বাস সেই খু’ন করেছে ইলহাম কে। কিন্তু তাশরিফ কেনো বারবার এক কথা বলছে আমি বুঝতে পারছি না। একটা ঘটনা সব শেষ করে দিলো আমার ছেলের। মমতা খান ভেঙে পড়েন কথাটা বলে।

— আপনি তো অন্য কাউকে দেখতে পারতেন তাশরিফ ভাইয়ার জন্য। আমাকেই কেনো রানীমা? ছুটি বলে।

– তাশরিফ কে বিয়ে করার জন্য হয়তো মেয়ের অভাব হবে না৷ কিন্তু ওকে ভালোবেসে আগলে রাখবে এমন মানুষের যে বড্ড অভাব রে ছুটি। আমি জানি তুই ছাড়া ওকে কেউ সামলাতে পারবে না৷ এই মিথ্যা থেকে তুই পারবি আমার ছেলেটাকে বাঁচাতে।

– কিন্তু আমি যে তা চাইনা রানীমা কেনো বুঝতে পারছেন না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছি। নিজেকে নিজে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, কেনো আবার প্রলোভন দেখাচ্ছেন আমায়। কেনো ছোট করতে চাইছেন আমার ভালোবাসাকে। আমার অনুভূতির কি কোনো মূল্য নেই রানীমা? তাছাড়া বাকি সবার মতো আমিও বিশ্বাস করি উনি একজন খু’নি।

– মমতা খান হাসে। ছায়া আর ছুটি কৌতুহলী হয়ে তাকায়।

– পৃথীবির সবাই যেটা ভাবে সেটা যে তুমি ভাবো না এটা আমি জানি৷ এমনকি আমি এটাও জানি তুমিও চাও তাশরিফ সব কিছু থেকে বেরিয়ে আসুক। সুস্থ একটা লাইফ লিড করুক।
– মমতা খানের কথায় ছুটি হকচকিয়ে উঠে। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে।

— যাই হোক, তুমি যখন চাচ্ছো না তাশরিফ কে বিয়ে করতে তখন আমি আর জোর করবো না। সে অধিকারও আমার নেই। তোমার জীবন তোমার নিজস্ব মতামত আছে। আমি সম্মান করি সে মতামতের, রেডি হও৷ আমরা এখনি বেরিয়ে যাবো। বাড়িতে তোমার বাবা-মা চিন্তা করছে। আর একটা কথা, তাশরিফ কিন্তু বিয়েটা করতে রাজী হয়েছে, যদি সম্ভব হয় তো আরেকবার ভেবে দেখো। সৃষ্টিকর্তা তোমাকে আরেকটা সুযোগ করে দিয়েছে ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরতে, তুমি চাইলে সে সুযোগ নিতে পারো, আমি নিচে আছি তোমরা এসো বলে মমতা খান চলে যায়।

– ছুটি বিছানার উপর বসে যায় ধপ করে। মাথায় যেনো কাজ করছে না৷ কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। তাশরিফের কোনো ক্ষতি কখনোই চাইনি ছুটি। ছোট থেকে পথ চলা তাদের। হয়তো অনেকের কাছে সেটা বন্ধুত্বের ছিলো কিন্তু ছুটি তো সব সময়ই অন্য কিছু ভেবে এসেছে।

– ছোট থেকে ছুটি, ছায়া,আবির, তাশরিফ একসাথে আছে। ছুটি আর ছায়ার সব সময় আনাগোনা ছিলো খান বাড়িতে। তাশরিফ সবার মধ্যে বড় ছিলো। ছোট থেকেই গানের গলা ভালো ছিলো তাশরিফের। প্রায় ছুটি কে গান শোনাতো তাশরিফ ডেকে নিয়ে। সবাই মিলে গানের আড্ডাও জমাতো। ছুটি প্রথম থেকে তাশরিফের গানের ফ্যান ছিলো। তাশরিফ আর ছুটির বন্ধন টা এমন ছিলো যে সবাই ভাবতো তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের বাইরেও কিছু আছে। কিন্তু সেটা শুধুমাত্র ছুটির ক্ষেত্রেই ছিলো। তাশরিফ ছুটিকে গুরুত্ব দিতো, তার কেয়ার করতো, সব কিছু শেয়ার করতো ঠিকই কিন্তু সেটা বন্ধু হিসেবেই। যেটা ছুটি ভালোবাসা ভেবে ভুল করেছে।

— ছুটি বাড়ি ফিরে এসেছে একদিন হলো। এসে পর্যন্ত একদম চুপচাপ হয়ে গেছে৷ না পারছে নিজেকে শান্ত করতে না পারছে নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে। রানীমার বলা কথাগুলো ভাবাচ্ছে তাকে। মেয়েকে ফিরে পেয়ে আরমান তালুকদার অনেক খুশি। মমতা খান বলে দিয়েছেন বিয়ের জন্য ছুটি কে যেনো জোর না দেওয়া হয়। তাছাড়া আরমান তালুকদার ও ভেবে নিয়েছে ছুটি না চাইলে এই বিয়ে হবে না৷ ছুটির সিদ্ধান্তই সব।

– আপাই! ছায়ার ডাকে ঘুরে দাঁড়ায় ছুটি। খা-খা দুপুরের মধ্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনে কিছু ভাবছিলো ছুটি।
– কি হয়েছে তোর আপাই? এসে পর্যন্ত দেখছি কেমন গম্ভীর হয়ে গেছিস। বিয়েটা তো ভেঙে গিয়েছে৷ তাহলে কেনো এখন এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিস না?

– আচ্ছা ছায়া, আমার কি বিয়েটা করা উচিত? হঠাৎ ছুটির মুখে এমন কথা শুনে ছায়া অবাক হয়ে তাকায়।

– তোর কি হয়েছে আপাই? এই তো বিয়ে করবি না বলে এত কান্ড করলি৷ আজ যখন বিয়েটা ভেঙে গেছে তখন বলছিস বিয়েটা করা উচিত।

– আমি কি করবো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না ছায়া। আমি যে কি চাই নিজেও বুঝতে পারছি না। পাগল পাগল লাগছে আমার নিজেকে।

– যদি আমার মতামত জানতে চাস তাহলে বলবো তাশরিফ ভাইয়ার তোকে খুব দরকার। তাছাড়া আপাই একটা কথা ভেবে দেখ, তুই কিন্তু তাশরিফ ভাইয়াকে ছাড়া অন্য কাউকে মানতে পারবি না৷ এতদিন যেমন পারিসনি।

— ছায়ার কথায় বিস্মিত হয়ে তাকায় ছুটি।

– জানিস ছায়া আমার মনটা বলছে বিয়েটা করতে আবার মনে হচ্ছে আমার ভালোবাসাকে ছোট করে ফেলছি আমি। আমার অনুভূতি গুলো কে সম্মান দিতে পারছি না আমি। ছুটির অস্থির মনোভাব।

— ছায়া ছুটির কাছে এগিয়ে গিয়ে ওকে ধরে দোলনায় বসায়।
– শুন আপাই! নিজেকে শান্ত কর। তোর মন কি চাই, হৃদয়ের অনুভূতি গুলোকে ভালো করে উপলব্ধি কর। তবে আমিও রানীমার মতো বলবো উপর আল্লাহ একটা সুযোগ দিয়েছে তোকে আবার সব কিছু ঠিক করে নেওয়ার। কয়জনের এমন ভাগ্য হয় বলতো, ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে যাওয়ার পর আবারও ফিরে পাওয়া সবার যে হয়না রে আপাই।

– কিন্তু আমি তো এইভাবে চাইনি উনাকে! আমি তো উনাকে সম্পুর্ণ রুপে আমার করে চেয়েছিলাম। এমন অপশন হিসেবে তো কখনো চাইনি। ছুটির আক্ষেপ জড়ানো কথা।

– সব চাওয়া কি সব সময় পূর্ণ হয় আপাই। কিছুটা বে-নিয়মেও হয়ে থাকে। মনে কর তোর বেলা এমন কিছু হয়েছে। শুনেছি সামনে তাশরিফ ভাইয়ার শুনানি আছে কোর্টে। আর সেদিনই সব ফায়সালা হয়ে যাবে। ভাইয়া যদি সত্যি খু’নি হয়। তাহলে ভাইয়াকে ফাঁ’সির আদেশ দেওয়া হবে৷ আবির ভাইয়া বলছিলো এইসব। তাশরিফ ভাইয়া নাকি ইলহাম ভাবিকে খু’ন করেছে। এটা সব সময় বলে যাচ্ছে। যেখানে আসামি নিজেই দোষ স্বীকার করে সেখানে কার বা কি করার থাকে বল?

– উনি এমন পাগলামি কেনো করছেন কার জন্য করছেন? ঠিক কি হয়েছিলো সেদিন সব টা জানতে হবে। বাবা কোথায় রে? ছুটির কথায় ছায়া কৌতুহল নিয়ে বলে বাবা তো ঘরে গেলো। কিন্তু কেনো?

আয় আমার সাথে, গেলেই বুঝতে পারবি, ছুটি ঘর থেকে এক প্রকার ছুটে বেরিয়ে আসে। ছায়াও কৌতুহল নিয়ে ছুটে আসে বোনের পেছনে….

চলবে…

❌কপি করা নিষেধ ❌ভুলক্রুটি মাফ করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here