শিমুল ফুল পর্ব ৩৫

0
234

#শিমুল_ফুল
#৩৫
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর

পুষ্পর বাবা মায়ের জন্য মন কেমন করে।উনাদের কথা মনে পড়েই চোখে পানি জমে,কতোদিন হয়ে গেলো উনাদের দেখছে না।দিন দিন পেশকারার অত্যা/চার বাড়ছে।রাবেয়া শাশুড়ী হিসেবে একদম নরম।কিন্তু পেশকারা,সুইটি আর আসমা মিলে পুষ্পর জীবন অতি/ষ্ঠ করে ফেলছে।শিমুল তো সারাদিন ঘরে থাকেনা থাকে পুষ্প। উনারা তার সাথে যে মানুষিক অত্যা/চার টা করে তার চেয়ে এক বেলা ভাত কম খেলেও শান্তি।পুষ্পর তার আম্মার কথা মনে হয় উনি বলেছিলেন,শশুড় বাড়ির লোক ভালো না হলে শান্তি লাগে না,চেয়ারম্যান বাড়ির মানুষ ভালো না।মায়ের কথা মনে হয়ে পুষ্প ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।বুকটা চিনচিন করে জ্বালাপোড়া করে।পুষ্পর ফুপিয়ে উঠার শব্দ শুনে শিমুল পুষ্পর দিকে ফিরে।মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে পুষ্পকে কাঁদতে দেখে অবাক হয়।
চোখের পানি মুছে বললো,
“কাঁদো কেন?”

পুষ্প মাথা নেড়ে বুঝায় কিছু না।শিমুল বোধহয় বুঝতে পারে।
“মা বাবার কথা মনে পড়ছে?”

পুষ্প ফুপিয়ে উঠে।
“হ্যাঁ।”

শিমুল মুচকি হাসে।
“বোকা মেয়ে তাই বলে কাঁদতে হবে।”

পুষ্প কাঁদোকাঁদো গলায় ফ্যাসফ্যাস করে বললো,
“তুমিতো ছেলে মানুষ মা বাবা ছেড়ে আসার যে কষ্ট তা তুমি কি করে বুঝবে?”

শিমুল পুষ্পর চোখের পানি মুছে বললো,
“তাইতো।বেশী খারাপ লাগছে?”

“হুম।”

“আচ্ছা।তাহলে বাবা মায়ের কাছে নিয়ে যাবো।খুশী?”

পুষ্প খুশী হয়ে শিমুলকে জড়িয়ে ধরে।
“খুশী।”

“তুমি মা’কে বলো কালকে আমি তোমাকে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে যাবো।তারপরে নাহয় আমিও বলবো।”

“আচ্ছা।”

যথারীতি সকালে নাস্তা বানানোর সময় পুষ্প আস্তে ধীরে বাবার বাড়ি যাবার কথাটা বলে।রাবেয়া পুষ্পর থমকানো মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে।পুষ্প তার কাছে অনুমতি নিচ্ছে,তাকে বলতে ভ/য় পাচ্ছে।রাবেয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যায়।রাবেয়া ছয় মাস কি এক বছর পরে বাবার বাড়ি যাবার ইচ্ছা পোসন করলে বা তার বাবার বাড়ির কেউ নিতে আসলে তিনি ভ/য়ে পেসকারার কাছে বলতে পারতো না,শওকত কে বললে বলতো আম্মা যা বলে তাই হবে আমি এসবে নেই।
।বাবার বাড়ি যাবার আশায় মনে সাহস যুগিয়ে বললে পেশকারা কতো কথা শুনিয়েছেন।রাবেয়া ভ/য়ে ভ/য়ে বলতো,
“আম্মা কতোদিন হয়েছে যাইনা,সবাইকে দেখতে ইচ্ছে করে।”

পেশকারা মুখ ঝামটা দিয়ে বলতো,
“জামাইর বাড়ী এসে দিনের হিসাব করলে তো হবে না!তুমি চলে গেলে সংসার সামলাবে কে?রান্নাবান্না করবে কে?”

রাবেয়া ভয়ে মিহিয়ে যেতো।স্বামীকে বললেও তিনি কিছু বলতো না।মনের কষ্টে কেঁদে সারা হয়েছে।স্বামী,শশুড়-শাশুড়ি,দাদী শাশুড়ি সবার কাছে মিনতি করে চোখের পানি ফেলে অনেক সাধনার পরে যেতে দিতো।রাবেয়ার অবাক লাগতো,যে মা বাবা জন্ম দিলো এতো বছর লালন পালন করে বড়ো করে এই বাড়িতে পাঠালো সেই বাবা মায়ের কাছে যেতে এতো কষ্ট করতে হয়?এটাই কি মেয়েদের জীবন?এই কেমন সমাজ যে সমাজে বাবা মায়ের কাছে যেতে হলে চোখের পানি বিষর্জন দিয়ে যেতে হয়।রাবেয়া পরবর্তীতে তার আশেপাশের মহিলাদের দেখেছে উনাদের শাশুড়ী উনাদের সাথে যেমন ব্যবহার করতো উনারাও বউদের সাথে ঠিক এমনটাই করে,ভাবটা এমন যে আমি আমার জীবন এভাবে কাটিয়েছি তুই কেন আরামে কাটাবি?তোকেও আমি জ্বালাবো।রাবেয়া এসব দেখে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তার যাথে যেটা হয়েছে তার ছেলের বউদের সাথে এটা করবে না।প্রতি/শোধ না নিয়ে উনি উনার ইচ্ছাটা ছেলের বউদের মাঝে পূরণ করবেন।তৃপ্তি করে দেখবেন বউদের হাসিমুখ।রাবেয়া পুষ্পর মাথায় হাত ভুলিয়ে বললো,
“যাবে।অবশ্যই যাবে।এতো ভ/য় পাচ্ছো কেন?”

রাবেয়ার এমনতর কথায় পুষ্প ঝরঝর করে কেঁ/দে দেয়।
“যদি যেতে না করেন তাই খুব ভ/য় লাগছিলো আম্মা।”

“যারা তোমাকে জন্ম দিয়েছে তাদের কাছে যাবে এতে না করার কি আছে?পাগল মেয়ে।”

“আম্মা আমি কলেজে পড়লে কি কোনো সমস্যা হবে?”

“সমস্যা হবে কেনো?অবশ্যই লেখাপড়া করবে।আমিও এটাই বলতে চাচ্ছিলাম।এতোদিন হলো এই বাড়িতে এসেছো কলেজের নাম নেই যে!”

“আব্বার বাসায় বইপত্র আছে সেগুলো আনতে হবে।আর ভাবছিলাম আপনারা পড়তে দেন কিনা।”

“আমরা পড়তে দেয়ার না দেয়ার কে?তোমার লেখাপড়া তুমি করবে।মেয়েদের এই পড়াটাই হাতিয়ার।জীবনে চলার পথে নিজেকে তৈরি রাখা জরুরি।জীবনের মোড় কখন কোথায় যায় কে জানে!”

পুষ্প হেসে বললো,
“আম্মা আপনি খুব ভালো।আমার ধারনার চেয়েও ভালো।”

পেশকারা এতোক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে দুজনের কথোপকথন শুনেছে।একে তো শিমুলের সাথে সুইটিকে বিয়ে দিতে পারেনি,সেদিন আবার পুষ্পর জন্য সুইটির চুল কা/টলো।তার আদরের সুইটি সেই দুঃখে ঘর থেকে বেরোয় না।দিনকে দিন পুষ্প তাদের চোখের বি/ষ হয়ে যাচ্ছে।তাদের কাছে গিয়ে বললো,
“কোথায় যাবে পুষ্প?”

রাবেয়া ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
“বাবার বাড়ি যাবে।”

“কয়দিন আগে না নাইওর করে আসলো এখন আবার কিসের যাওয়া?এখন যাওয়া যাওয়ি নাই।”

পুষ্প আৎকে শাশুড়ির দিকে তাকায়।রাবেয়া সহয-ভাবেই বলে,
“আম্মা মা বাপেরে দেখতে যাবে এতে আমাদের এতো নাক গলানো ঠিক না।ওর মা বাপ ওরে জন্ম দিয়েছে মেয়ে হিসেবে তাদের কাছে যাওয়ার অধিকারটুকু পুষ্পর আছে।তাছাড়া হঠাৎ করে বাবা মা ছেড়ে আছে ছোট মানুষ হয়তো খারাপ লাগছে,ঘুরে আসুক মন ভালো থাকবে।”

পেশকারা ফুসে উঠে বললো,
“বউকে এতো লাই দিওনা।পরে লাগাম টানতে পারবেনা।”

“লাগাম টানার জন্য শিমুল আছে।আমি লাগাম টানার কে? আমি আমার ছেলের লাগাম টানতে পারি ছেলের বউয়ের না।”

পেশকারা অ/গ্নিদৃষ্টি নিয়ে রাবেয়াকে দেখে।তারপর বলে,
“বিয়ে হয়েছে এখন আর পড়ে কি করবে?সংসার করো,বাচ্চা নাও।পড়ালেখার কি দরকার?”

পুষ্প মাথা নিচু করেই বললো,
“আমি পড়বো বুবু।”

“পড়ার দরকার নেই,পড়ে কি করবে?”

শিমুল ডাইনিং টেবিলে বসে বললো,
“আমার বউকে আমি অফিসার বানাবো।”

পেশকারা বিরক্ত চোখে শিমুলকে দেখে।ছেলেটা আজকাল বেয়া/দব হয়ে গেছে।কই তার ছেলে তো এমন বউয়ের পক্ষ নিয়ে তর্ক করেনি এই ছেলে এমন কেন?পেশকারার মনে হয় পুষ্প তা/বিজ করেই শিমুলকে এমন বানিয়ে দিয়েছে।
“তোরে কিছু বলেছিনা তো ভাই তুই চেতোস কেন?”

“আমার বউ আর আমি একি তো হলাম।তাই না!।”

“মহিলাদের সব কথায় নাক গলাস কেন?”

ফুলি রুটি বানাতে বানাতে বললো,
“বুবু আফনে কি বয়রা?হুনেন না ভাইজান কইতাছে ভাবি আর ভাই এক।তো কেডায় নাক গলাইবো আফনের জামাইয়ে?”

পেশকারা ফুলির দিকে তাকায়।
“এই তুই এতো পকপক করোস কেন?”

“আল্লায় মুখ দিছে কতা কইতাম না?”

“বেশী কথা বলিস।থা/প্পড় দিয়া দাঁত ফালাই দেবো বেয়া/দব।”

ফুলি বিরবির করে বললো,
“এইজন্যই ভাইজান কয় আফনের গলা চুলকায়।”

ফুলির কথা শুনে উপস্থিত সবাই মুচকি হাসে।পেশকারা ফুলিকে মা/রতে গেলে রাবেয়া আটকায়।পুষ্পর দিকে তাকিয়ে?মুখ ভেংচিয়ে বলে,
“রাবেয়া তুমি কথায় কথায় এই মেয়েকে ছোট বলো কেন?এই মেয়ে নাকি ছোট?ছোট হলে জামাইর লগে থাকে কেমনে?”

পেশকারার কথা শুনে রাবেয়া লজ্জা পায়।উনি কি পাগল শিমুলের সামনে এগুলা কি বলে।আলগোছে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়।শিমুল পেশকারার কাছে এসে দাঁত কেলিয়ে হাসে।মাথাটা নিচু করে খপ করে পেশকারার হাত ধরে বললো,
“কেমনে থাকে দেখবা?চলো দেখাই।”

পেশকারা শিমুলের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে রে/গে সেখান থেকে চলে যায়।আজকে শওকত আসুক।এই শিমুলের এতো তর্ক বের করবে।পেশকারা চলে গেলে রাবেয়া আসে।
শিমুল মায়ের কাছে এগিয়ে আসে।
“আম্মা পুষ্প কান্নাকাটি করছে ওকে একটু তাদের বাড়ি দিয়ে আসি?”

“আচ্ছা।বিকালেই নিয়ে যাস।”

“ঠিক আছে।”

পুষ্প হঠাৎ করে রাবেয়াকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।রাবেয়া কিছু না বলে পুষ্পকে জড়িয়ে ধরে,তিনি পুষ্পর কাঁদার কারণটা ধরতে পেরেছে।পুষ্প সুখে কাঁদছে এতো ভালো শাশুড়ি কয়জন পায়?সব আপুদের মুখে শাশুড়িদের নিয়ে ভ/য়াবহ কথা শুনতে শুনতে তার মনে একটা ভ/য় ঢুকে গিয়েছিলো।কিন্তু আল্লাহর রহমতে রাবেয়া তার শাশুড়ি না আরেক মা।শিমুল মুগ্ধ চোখে দুজনকে দেখে।এই দুজনই তার দুনিয়া।এই দুজনকে যখন একসাথে দেখে বুকটা সুখে চিনচিন করে উঠে।বউ আর মা ঝগ/ড়া,দন্ধ লেগে থাকলে যে পুরুষটা কি মানুষিক চাপে দিন কাটায় এটা একটা পুরুষ ছাড়া কেউ জানে না।

পুষ্পকে বাবার বাড়িতে মাত্র দুইদিন থাকতে দেয়া হলো।শিমুলের বুকভরা আহাজারি,প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দিয়ে মন খারাপের বার্তা,রাতের গভীরে কান্না কান্না ভাব করে পুষ্পকে কাছে ডাকা,ফিসফিস করে আদুরে কথা,সব মিলিয়ে পুষ্পকে পা/গল করে ছেড়েছে।পুষ্প বলেছে তার সাথে থাকতে কিন্তু শিমুল থাকবেনা তার নাকি লজ্জা লাগে।দুইদিন থেকে পুষ্পর নিজেকে আর মানাতে পারে না।তারও যে মন আনচান করছে।সবাইকে বলে শিমুল এসে ফের নিয়ে যায়।
রাতের খাওয়া দাওয়ার পরে পুষ্প রুমে আসে।শিমুল তার অপেক্ষাই বসে ছিলো।পুষ্প ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আয়না দেখে দেখে মুখে ক্রীম দেয়।শিমুল গভীর চোখে পুষ্পকে দেখছে,আয়নায় শিমুলের চোখের দৃষ্টি দেখে পুষ্পর কেমন লজ্জা লাগে।মাত্র দুইদিন পরে দেখা হয়েছে অথচ মনে হচ্ছে নতুন করে দেখা হলো,চোখের দৃষ্টি পড়ে গায়ে নতুন করে শিহরণ জাগলো।পুষ্পও সমানতালে শিমুলকে জ্বালাতে মাদক মিশিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।প্রেয়শীর চোখের ভাষা পড়তে শিমুলের বেগ পেতে হয় না।চঞ্চল দেহটা বিছানায় বসতে নারাজ।ঠোঁট কামড়ে হেসে বিছানা ছেড়ে এগিয়ে আসে।পুষ্পকে তার দিকে ফিরিয়ে বুকে জড়িয়ে নেয়।শান্তি শান্তি গলায় বলে,
“আহ বউ।এতোক্ষনে শান্তি লাগছে।এই দুই দিন কি অবস্তায় ছিলাম!”

পুষ্প দু’হাত দিয়ে শিমুলকে জড়িয়ে মুখটা উপরে তুলে।
“মিস করেছো?”

শিমুল পুষ্পর কপালে চুমু দেয়।পুতুলটার নাকের ডগায় নিজের নাক আলতো করে ধাক্কা দিয়ে বলে,
“প্রচুর।”

পুষ্প হাসে।শিমুলের বুকে আঙুল দিয়ে বিলি কাটে।শিমুলের শরীর ঝিমিয়ে উঠে।ঘোর লাগা চোখে পুষ্পকে বিছানায় নিয়ে যায়।পুষ্প চোখ বন্ধ করে বললো,
“আপনি খুব খারাপ।শিমুল ভাই।”

“ম্যাডাম আপনিই তো খারাপ বানিয়েছেন।”

পুষ্প আর কথা বলার সুযোগ পায় না।শিমুলের ছন্নছাড়া ছোঁয়ায় খিলখিল করে হেসে উঠে।শিমুল দিশা হারায়।হারিয়ে যেতে চায় সুখের রাজ্যে যেখানে প্রতিটা নিঃশ্বাস সুখে হাসে,সুখে কাঁদে।শিমুল ফিসফিস করে বললো,
“আরে বাবা এতো সুরসুরি কেন?”

পুষ্প কথা বলেনা।কেন এতো সুরসুরি এর ব্যাখ্যা তারা জানা নেই।

রাবেয়ার মন রক্ষার্থে শওকত হাওলাদার পলাশ আর নিধিকে ফোন করে বাড়িতে আসার অনুরোধ করে।সবাই এতে বেশ অবাক হয়।চেয়ারম্যান এতো সহযে হার মানার পাত্র তো নয়!তাহলে?পলাশের মন মানেনা।কিছুতো চলছে তার আগে পিছে।কিন্তু কি?সেটাই ধরাছোঁয়া যাচ্ছে না।পলাশ পাশে ঘুমিয়ে থাকা নিধিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।নিধি তার কতোটা জুড়ে শুধু সে আর তার আল্লাহ জানে।এই মেয়েটার কোনো ক্ষ/তি সে হতে দিবেনা।দরকার হলে নিজে ম/রে যাবে তারপরেও নিধিকে ভালো রাখা চাই।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here