শাপলা ও সেতুর গল্প পর্ব ৭

0
301

#শাপলা_ও_সেতুর_গল্প
#প্রভা_আফরিন
[পর্ব-৭]

সকালে রাসিফের কর্মচারী মুমিনুল দেরি করে দোকানে এলো। ছিপছিপে শ্যামলা গড়নের ছেলেটা ইদানীং বেশ বদলে গেছে। আগের মতো অগোছালো থাকে না। মেজাজও ফুরফুরে থাকে। সেই সাথে কাজে ফাঁকি দেওয়ার বাহানা খুঁজে হবু স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা। তবে আজ ওর মুখে অমাবস্যা ঘনঘটা লক্ষণীয়। রাসিফ নতুন তোলা কুর্তিগুলো সাজাতে সাজাতে বললো,
“এত দেরি হলো যে?”

“আসলে ভাই ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে।”

“রাত জাগলে উঠতে তো দেরি হবেই। বিয়ে ঠিক হতেই এই অবস্থা!”

মুমিনুল লজ্জা পেয়ে গেলো। লজ্জা পেলে ছেলেটা চোখ তুলতে পারে না। রাসিফও তাই না ঘাটিয়ে নিজের কাজে মন দিলো। মুমিনুলও হাতে হাতে সাহায্য করলো। রাসিফ জামা ঝোলানো শেষে মুমিনুলের কাধে হাত দিয়ে বসলো। বললো,
“এমন মুখ নিয়ে কাস্টমারের সঙ্গে কথা বললে চলবে? বাড়ির ঝামেলা বাড়িতেই ফেলে আসতে হবে। কাজের সঙ্গে মেশালে চলবে না।”

“কিন্তু ভাই, কাজের জন্যই তো বাড়ির ঝামেলা লেগে গেছে।”

“কি ঝামেলা?”

“সারাদিন মহিলা কাস্টমারদের আপা এদিকে আসেন, আপা কি লাগে, আপা এই কালারটা শুধুই আপনারে মানাবে বলতে বলতে মাঝে তো বাড়িতেও আম্মাকে বলে ফেলি ‘আপা খাবার দেন।’ ”

রাসিফ শব্দ করে হেসে ফেললো।
“এটাতো নতুন না। চাচি কি ঝারি দিলো নাকি? এরজন্য মন খারাপ?”

“না ভাই, ঘটনা আরো গভীরে পৌঁছে গেছে।”

“তা শুনি সেই গভীরতম গল্প।”

“কালরাতে উনার সাথে কথা বলতে গিয়েও ঘুমের ঘোরে ভুলে আপা ডেকে ফেলছি। এখন উনি ভাবছে মেয়ে কাস্টমারের সঙ্গে বোধহয় আমার ভাব বেশি। কি করে বোঝাই যে বেচাকেনার জন্য কথা বলতেই হয়, ডাকতেই হয়।”

মুমিনুল ‘উনি’ শব্দটি দ্বারা কাকে নির্দেশ করছে বুঝতে অসুবিধা হয় না রাসিফের। সে কৌতুক করে বললো,
“তাহলে তোমার ব্যক্তিগত উনিকে আপা ডাকার ফলেই আজ এই বেহাল দশা?”

“ভালোবেসে ফেলছি ভাই। তার প্রতি দুর্বল হয়ে গেছি। মেয়েদের এত হিংসা থাকে কেনো?”

রাসিফের ভালো লাগলো কথাটা। সে মুমিনুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ছেলেটা আসলেই অনেকটা বদলে গেছে।
“খুশি হও বুঝলে। কেউ তোমাকে নিয়ে হিংসা করছে। তারমানে তুমি তার কাছে অনেকটা দামি। আর এইসব ছোটখাটো বিষয়ে মনকষাকষির মানে নেই। বয়স কম তাই আবেগ বেশি। তাকে বুঝিয়ে বলো কাজ কাজের যায়গায় আর সে তার যায়গায়।”

মুমিনুলকে বুঝিয়ে কাজে মন দিতে গেলেও রাসিফের মন বসলো না। কারো হিংসার কারণ হওয়া বুঝি আসলেই ভাগ্যের! সে কেনো হলো না! বাড়ি থেকে মেয়ে দেখার তোড়জোড় চলছে। তার অর্ধাঙ্গিনী মন মতো হবে তো!

রুনি বাপের বাড়ি এসেছে এক সপ্তাহ পেরোলো। এরমাঝে নওশাদ একদিন এসে থেকে গিয়েছে। রুনিকে নিতে চাইলে সে যায়নি। ভাইয়ের বিয়ের জন্য পাত্রী দেখার এমন বিশেষ মুহূর্তগুলো সে শ্বশুরবাড়ি বসে নষ্ট করতে চায় না। তবে শ্বাশুড়িকে সে ভীষণ মিস করছে। মানুষটার সঙ্গে ঝগড়া, হিংসা লেগে থাকলেও রুনির নরম মনে শ্বাশুড়ির জন্য কিঞ্চিৎ ভালোবাসাও আছে। সেই ভালোবাসা থেকেই রুনি শ্বাশুড়িকে ফোন করলো। বেশ কয়েকবার কল বেজে তারপর রিসিভ হলো। ফোন রিসিভ করলো জেসমিন। অভিমানী গলায় বললো,
“ভাবী, বাপের বাড়ি গিয়ে তো আমাদের ভুলেই গেছো।”

“ভুললে কি ফোন দিলাম? বরং তোমাকে আনার ব্যবস্থা করছি।”

“আমাকে?”

“হ্যাঁ, আমাদের বাড়ি এসে থাকতে কেমন লাগে তোমার?”

জেসমিন সাধারণভাবেই উত্তর দিলো,
“ভালোই, কিন্তু তোমাদের বাসায় রুম কম। বেড়াতে গেলে রুম শেয়ার করে ঘুমাতে হয়, যা আমার একদম পছন্দ না।”

রুনির মুখ কালো হলো। সামলে নিয়ে বললো,
“আর ভাইকে কেমন লাগে?”

“রাসিফ ভাই?”

“হ্যাঁ, কেমন লাগে?”

“তোমার ভাইটা না একদমই ক্যাবলা মতোন। কোথায় এই বয়সে জিম টিম করে সুন্দর একটা বডি বানাবে তা না। আর জামা কাপড়ের তো কোনো চয়েসই নেই। এই চয়েস নিয়ে তোমার ভাই কাপড় ব্যবসায়ী হলো কি করে?”

রুনির মেজাজ বেজায় গরম হলো। এই মেয়েকে কিনা সে ভাইয়ের জন্য পছন্দ করে বসে আছে! রুনির মনে জেসমিনকে ভাইয়ের বউ করার আশা ক্ষীণ হলো। ভাবীর সাড়া না পেয়ে জেসমিন বললো,
“কই হারিয়ে গেলে ভাবী?”

“আছি। আমার ভাইকে তুমি দূর থেকে দেখো বলে ক্যাবলা লাগে। ওর সঙ্গে মিশলে বুঝবে কত বুদ্ধিমান। আর শোনো, পুরুষমানুষ একটু ক্যাবলাই ভালো। তাহলে বউদের সুবিধা।”

“কি জানি। আমি অত বুঝি না।”

“বুঝে কাজ নেই। আম্মা কোথায়?”

জেসমিন ফোনটা নিয়ে নাজিয়া বেগমের কাছে গেলো। রুনি গদগদ হয়ে বললো,
“আম্মা, আমাকে মিস করেন তাইনা?”

“একদমই না। তুমি বাড়ি নেই বলে বাড়িতে শান্তি বিরাজ করছে। কাজও কমে গেছে। তুমি এলেই আবার শান্তির শ্রাদ্ধ শুরু করবে।”

“এ কথা বলতে পারলেন আপনি? আমি শান্তির শ্রাদ্ধ করি?”

“যেটা সত্যি তাই বললাম।”

“আমি আর ফিরবোই না।”

“তোমার সব জিনিসপত্র কি পাঠিয়ে দেবো তাহলে?”

রুনি কিছুক্ষণ চুপ রইলো। এরপর বললো,
“কিচ্ছু পাঠাতে হবে না।”

নাজিয়া বেগম অজান্তেই মুচকি হাসলেন। কন্ঠে গম্ভীরতা টেনে বললেন,
“এই না বললে ফিরবে না? তাহলে সব পাঠিয়ে দেই?”

“একশবার ফিরবো। ওটা যেমন আপনার শ্বশুরবাড়ি তেমন আমারও শ্বশুরবাড়ি। আপনি থাকলে আমিও থাকতে পারি।”

ফোন রেখে রুনি রাসিফকে কল দিলো। রাসিফ এখন মায়ের পুরোনো একটা বাটন ফোন ব্যবহার করছে। টাকা জমিয়ে আবারো ভালো একটা ফোন কিনবে বলে সবুর করছে। ফোন রিসিভ করতে রুনি বললো,
“শোন ভাই, বিকেলে বোম্বাই মরিচে ঠাসা ঝালমুড়ি কিনে আনবি আমার জন্য। ঝালে যেন ঘন্টাখানেক কাঁদতে পারি।”

রাসিফ আঁতকে উঠলো,
“সেকি! বোম্বাই মরিচের ঝালে নাকের জলে চোখের জলে করে যে কি কান্ড করো তার খেয়াল আছে?”

“আজকে একটু ঝাল খেতে মন চাইছে। আর মিষ্টি দেখে লিচুও আনিস। ঝাল খেয়ে মিষ্টি খেলে ঠিক হয়ে যাবে। সাথে নানির পানও আনবি। ফুরিয়ে গেছে।”

“আনবো।”

রুনি ফোন রেখে মিচকে হাসি হাসে। আজ বিকেলে নওশাদ আসবে। সে আসার আগেই রুনি ঝাল খেয়ে নাকের জলে চোখের জলে করে কান্না জুড়ে দেবে।
প্রেমের বিয়ে এবং বউয়ের বোকা স্বভাবের ফলেই কিনা নওশাদের হৃদয় রুনির জন্য তুলোর মতো কোমল। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর আগের চেয়ে আহ্লাদও করে বেশি। সে বউয়ের কান্না সইতে পারবে না। এখানে ফেলে রেখেও যাবে না। জোর করে নিয়ে যাবে। তাতে রুনির বাড়ি ফেরা সহজতর হবে, আবার শ্বাশুড়ির সামনে ইগোকেও নত করা হবে না। নিজের বুদ্ধিতে নিজেরই পিঠ চাপড়াতে ইচ্ছে করলো রুনির।
____________

বিকেল নাগাদ রাসিফ বেড়িয়েছিলো পান, লিচু কিনতে। ঝালমুড়ি এলাকা থেকেই কিনে নিতে পারবে। আজকের আকাশ সকাল থেকেই মেঘাচ্ছন্ন। মেঘ গুরগুর করলেও বৃষ্টিকে বিসর্জন করতে নারাজ। অবশ্য তাতে ভালোই হয়েছে। সূর্যের তাপ নেই বলে বায়ুতে শীতলতা রাজত্ব করছে আপন মহিমায়। রাসিফ ফুরফুরে মেজাজে ফল কিনে বাড়ির পথে যাত্রা করলো। পথিমধ্যে তাকে কাউকে দেখে থামতে হলো। স্কুলের ইউনিফর্ম পরা রিথী কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে স্কুলেরই ইউনিফর্ম পরা একটা ছেলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। মেয়েটির চোখে ভিন্ন ভাষা। ঠোঁটে অর্থবহ হাসি লেপ্টে আছে। যা রিথীর বয়সের সাথে খুবই বেমানান ঠেকলো রাসিফের কাছে। কত হবে মেয়েটার বয়স? তেরো কিংবা চৌদ্দ, খুব বেশি হলে পনেরো। রাসিফ অনুমান করার চেষ্টা করে আঁতকে ওঠে। এই বয়সেই!

রিথীর ততক্ষণে কথা বলা শেষ। ছেলেটাকে বিদায় দিয়ে সে সম্মুখের পথ ধরেছে। তখনই নজর গেলো রাসিফের ওপর। রিথী চমকে উঠলো। রাসিফ ঠোঁট চেপে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রিথী কাছাকাছি এসে নিজেকে স্বাভাবিক করে হাসার চেষ্টা করে বললো,
“কেমন আছেন, ভাইয়াঙ্কেল?”

“খুব ভালো আছি, খালাম্মাবোন।”

রিথী বড়বড় চোখে তাকিয়ে বললো,
“আমি খালাম্মা? আপনার কি চোখেরও বয়স হয়েছে নাকি, যে আমাকে বয়স্ক ভাবছেন?”

“আগে ভাবতাম না। তবে আজ মনে হচ্ছে চোখের বয়সটা বুঝি বাড়লো।”
রাসিফ ছেলেটার যাওয়ার দিকে ইশারা করে ভ্রু নাচালো। রিথীর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। রাসিফ আবার বললো,
“তোমাকে খুকি দেখা গেলেও তুমি আসলে খুকি নও মেয়ে। এই বয়সে এসব কি?”

“কোন সব?” রিথী তুতলে ওঠে।

“যা দেখলাম।”

“কি দেখেছেন কে জানে। আমি তো ক্লাসমেটের সঙ্গে কথা বলে আসলাম। আপনার মস্তিষ্কও বুড়ো হয়ে যাচ্ছে।”

রাসিফ নিজের ওপর আফসোস করে বললো,
“আহারে, আমি বুঝি আসলেই বুড়িয়ে যাচ্ছি! ঠিক আছে তাহলে, তোমার বাবাকেই বলবো সবটা। দেখি উনি সব শুনে এই বয়স্ক হওয়া প্রতিরোধ করার মেডিসিন জানে কিনা।”

রিথী আরেকদফা ঘাবড়ালো,
“কি বলবেন বাবাকে?”

“এই যে যা দেখলাম। লজ্জামাখা মুখ, মুচকি মুচকি হাসি বিনিময়, একান্তে দাঁড়িয়ে কথা বলা। অবশ্য আমি তো বুড়িয়ে যাচ্ছি। ভুলও দেখতে পারি।”

রিথীর মুখটা কেঁদে ফেলার যোগাড়। রাসিফ আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
“নিজেকে সামলাও। এটা রাস্তা।”

রিথী মাথা নিচু করে মিনমিনে কন্ঠে বললো,
“ও আমার ক্লাসমেট। আমাকে প্রপোজ করেছিলো।”

“তুমি কি উত্তর দিয়েছো?”

“ঝুলিয়ে রেখেছি।”

“ঝুলিয়ে রেখে আবার আড়ালে আবডালে হাহা হিহি কিসের? এই বয়সে এত কিছু? আমি কিনা তোমায় খুকি ভেবে বসে আছি!”

“আপনি ভুল ভাবছেন ভাইয়া।”

রাসিফ ঠোঁট বেকিয়ে হাসে। “এখন শুধু ভাইয়া?”

“হ্যাঁ, আপনি কচি ভাইয়া। এক্কেবারে পুচকে ভাইয়া।”

রাসিফ ব্যস্ততা দেখিয়ে বললো, “তবুও আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলতে হবে আমায়।”

রিথী এবার প্রায় কেঁদেই ফেললো। মা- বাবা জানলে ওকে আস্ত রাখবে না। কম্পিত কন্ঠে বলে,
“এমন করবেন না প্লিজ।”

“না করলে আমার লাভ?”

“কি চান আপনি?”

“তোমার ওই ভাবওয়ালা বোনকে মানাতে হবে। বোঝাবে যেন আমার সঙ্গে হওয়া দুর্ঘটনাবসত সবকিছু ভুলে যায়।”

“আপনি আমার আপুকে ভাবওয়ালা বললেন?”
রিথীর গলা চড়ে গেলো। রাসিফ ভ্রু বাঁকাতেই আবার মিনমিন করে বললো,
“আপনার আর আপুর ঝামেলায় আমাকে কেনো টানছেন?”

“ঠেকায় পড়ে। তুমিও যেমন আমার কাছে ঠেকায় পড়লে। এবার সুন্দরমতো আপুকে গিয়ে বোঝাও যেন আমাকে ক্ষমার দায় থেকে মুক্ত করে দেন। আমিও তোমার সবকিছু ভুলে যাবো।”

রিথী কাধের ব্যাগটা দুইহাতে শক্ত করে ধরে বললো,
“আমি আজই গিয়ে আপুকে ক্ষমার গুরুত্ব বোঝাবো। দরকার পড়লে ক্ষমার উপকারিতা নিয়ে রচনা লিখে দেবো। ক্ষমা নিয়ে দেয়ালিকা বানিয়ে আপুর ঘরে ঝোলাবো।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here