#শাপলা_ও_সেতুর_গল্প
#প্রভা_আফরিন
[পর্ব-৪]
জাহিদুল ইসলামের শো-রুমের একপাশে বরাদ্দকৃত স্বচ্ছ কাচের ঘরে বসে আছে রাসিফ। ওর উল্টোদিকে জাহিদুল ইসলাম ও তার মেয়েরা। এসির প্রভাবে পুরো ঘর শীতল। তবে শীতলতা নেই উপস্থিত মানুষগুলোর মাঝে। লিখি নাক-মুখ কুচকে তাকিয়ে আছে রাসিফের দিকে। ওর চিকন ভ্রুযুগলের মাঝে মসৃণ খাদ বিশিষ্ট একটি সরু রেখা লক্ষণীয়। দুইবোন মিলে বাবার শো-রুমে এসেছিলো নিজেদের রুমের জন্য নতুন একটা টেলিভিশন নিতে। কোথা থেকে হুট করে একটা লোক এসে যা নয় তাই বলে মিথ্যা অভিযোগ করে ফেললো। বাবা এসে পরিস্থিতি শান্ত করে কারণ জানতে চাইলে লোকটা যা বললো, তাতে ওর মেজাজ ছোট টিলা ছাড়িয়ে কেওক্রাডং থেকে তাজিনডং পর্বতসম হয়ে গেছে।
এখন ভর দুপুর। শো-রুমে উজ্জ্বল কৃত্রিম আলোর পসরা। লিখি ভালো করে রাসিফের দিকে তাকালো। শ্যামলা গড়নের লম্বাটে চেহারা। দেখে মনে হচ্ছে স্বভাবে স্থিরতা কম। বারবার এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। সেদিন যাত্রাপথে একই বাসে পাশাপাশি বসলেও লিখি রাসিফের মুখটা তেমন খেয়াল করেনি। অবশ্য খেয়াল করার কথাও নয়। প্রতিদিন যাত্রাপথে নানান মানুষের সাথে দেখা হয়, পাশে বসতে হয়। কোনো কারণ ছাড়া মনে রাখার মানসিকতা নিয়ে কারো দিকেই তাকানো হয় না। ফলে রাসিফকেও সে চিনতেও পারেনি। কিন্তু সেই ক্ষনিকের যাত্রা যে এত বড় একটা কান্ড ঘটাবে কে জানতো? জাহিদুল ইসলাম হঠাৎ নিরবতা চুরমার করে অট্টহাসিতে মেতে উঠলেন। রাসিফ ভড়কালো। ভড়কালো রিথীও। তার বাবা যতবার জোরে শব্দ করে হাসে, রিথী প্রতিবারই চমকে ওঠে। লিখি বললো,
“বাবা তুমি হাসছো?” 
“হাসবো না? দেখেছিস ছেলের কান্ড? শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে সে এতকিছু বাধিয়ে বসেছে! বলেছিলাম না রাসিফ ছেলেটা খুবই সরল। দেখলি তো!”
“দেখলাম। আর বুঝলাম ওনার চেয়ে তুমি বেশি সরল।”
এরপর রাসিফের দিকে ফিরে ফুসতে থাকা কন্ঠে বললো,
“সেদিন বাস থেকে ঠেলাঠেলি করে নামতে আমার পার্সটাও তো চুরি গেছে, আমি কি আপনাকে দোষ দিয়েছি? সামনে পেছনে তো কম মানুষ ছিলো না। তাহলে আপনি কেনো আমাকেই পকেটমার ভেবে সিনক্রিয়েট করলেন?” 
রাসিফ চমকালো,
“আপনার পার্সও চুরি গেছে?” 
“গেছে।” লিখি শক্ত গলায় টেনে টেনে উত্তর দিলো।
আঙ্কেলের মেয়ে হলেও রাসিফের সন্দেহ পুরোপুরি  কাটলো না। সে কৌতুহল নিয়ে আবারো প্রশ্ন করলো,
“সত্যিই সেদিন আপনার পার্স চুরি গেছে?” 
লিখি চরম বিরক্ত। জাহিদুল ইসলাম এবার সম্মতি দিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ রাসিফ, লিখির পার্সও চুরি হয়েছে। মেয়েটা মামাবাড়ি থেকে ফেরার পথে অর্ধেক রাস্তায় নেমে টাকার জন্য আটকে গেছিলো। পরে আমি গিয়ে নিয়ে এসেছি।”  
রাসিফ তার কাজে লজ্জিত। মেয়েটাকে সে পকেটমারের আসনে বসিয়ে সারাদিন এতটাই বিতৃষ্ণা জমিয়েছে যে দেখা মাত্রই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো। সে মিনমিন করে বললো,
“আসলে আঙ্কেল বাসের লোকেরা এমনভাবে পকেটমারের বর্ণনা দিচ্ছিলো, আর উনিও এমনভাবে ঘেঁষে..” 
“ঘেঁষে মানে? আমি কি ইচ্ছে করে আপনার গা ঘেঁষেছি?” লিখি তেতে উঠলো।
রাসিফ ভুল শোধরানোর ভঙ্গিতে বললো,
“না, তা বলতে চাইনি। মানে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিলো যে আমি ভাবতে বাধ্য হয়েছিলাম আপনিই হয়তো..” 
“চমৎকার! তাই আপনি আগে-পিছে না ভেবে পাব্লিক প্লেসে মানুষের মান-সম্মান ডুবিয়ে দেবেন?”
রিথী তাল মিলিয়ে বললো,
“বাবা উনি আমাকে ধমক দিয়েছে। দাত খুলে নেওয়ার হুমকিও দিয়েছে।” 
জাহিদুল ইসলাম রিথীকে পাশে টেনে একহাতে জড়িয়ে ধরলেন। রাসিফ ও লিখির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“দেখো, যা হয়েছে তা ভুল বোঝাবুঝির জন্য হলেও রাসিফ কাজটা কিন্তু আসলেই ঠিক করোনি। জানি তোমার ভেতর অস্থিরতা কাজ করছিলো, তবুও নিশ্চিত না হয়ে একটা মেয়ের সাথে এতটা রুড বিহেভ করা ঠিক হয়নি।” 
“সরি আঙ্কেল। আমার কাজে আমি নিজেই লজ্জিত বোধ করছি। মাটিতে মিশে যাচ্ছি।”
“তোমার ওপর আমার রাগ নেই ছেলে। আমি তোমাকে বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার দুই নয়ন বেজায় রেগে আছে। তোমরা নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ঠিক করে নাও। আর এই কাজ থেকে শিক্ষা নাও, নিশ্চিত না হয়ে শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কাজ করলে তার পরিনামে নিজেকে কতটা নিচু হতে হয়।”
জাহিদুল ইসলাম উঠে চলে গিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। রাসিফ লিখিকে সরি বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলো। এরপর ভেবে বললো,
“আচ্ছা, যদি আপনারও পার্স চুরি হয়ে থাকে তাহলে সেদিন সন্ধ্যায় আপনি বাসস্ট্যান্ডে কি করছিলেন?” 
“আমাকে দেখেছেন, আমার আশেপাশে বাবাকে দেখেননি?”
“না তো।”
“বাবা আমাকে আনতে গিয়েছিলেন।”
রাসিফ নিজের বোকামোতে আরেকবার ঢোক গিললো। বললো,
“ওহহ আচ্ছা।” 
লিখি কপালের ভাজ আরেকটু গাঢ় করলো। বিরক্তি উগড়ে বললো,
“আপনি কি জানেন আপনি একটা আহা’ম্মক?” 
“আগে জানতাম না। তবে এখন মনে হচ্ছে।”
রিথী মাঝখান দিয়ে বললো,
“মনে হচ্ছে না, আপনি তাই।” 
রাসিফ প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বললো,
“দেখুন, আমি জানি আমার ব্যবহার খুবই রুড ছিল। আমার এমনটা করা উচিৎ হয়নি।”
রিথী সাথে যোগ করে বললো,
“আপনার ভাষাও ভালো না। আপনি আপুকে চু’ন্নি বলেছেন। শাকচু’ন্নিও বলেছেন।” 
রাসিফ চোখ বুঝে গালে, ঘাড়ে হাত বুলিয়ে নেয়। জাহিদুল আঙ্কেলের ছোট মেয়ের প্রতি ওর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কিন্তু শোনার মতো কাজ করেছে বলে প্রত্যুত্তর করতে পারলো না। লিখিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আমি নিজের কাজে খুবই লজ্জিত। এক্সট্রিমলি সরি। আমায় ক্ষমা করবেন।” 
লিখি তার কাধ ছাড়ানো সোজা চুলগুলো পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,
“অপমান করলেন সবার সামনে। আর সরি বলছেন একা একা?” 
“কি করবো আপনিই বলুন। কি করলে আপনি আমার সরি এক্সেপ্ট করবেন? আমার দিকটাও একবার ভেবে দেখুন। এতসব চিন্তার মাঝে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি।”
রিথী বললো,
“আপু ওনাকে সবার সামনে কানে ধরে ওঠ-বস করাও। তাহলেই ঠিক হবে।” 
“তুই চুপ কর।”
রিথী চুপ করে গেলো। বোনের আড়ালে রাসিফকে কয়েকবার মুখ ভেংচিও কাটলো। রাসিফ দেখেও প্রত্যুত্তর করলো না। সে মনোযোগ দিয়ে লিখিকে দেখছে। পাতলা গড়নের একটি মেয়ে। মুখের দিকে তাকালে সরু, মেদহীন থুতনিটা নজর কাড়ে। মুখে মিষ্টি ভাব থাকলেও স্বভাবে তীক্ষ্ণতা আছে বোঝা গেলো। লিখির হাতে একটি পাঁচ টাকার কয়েন। সে বারকয়েক সেটাকে শূন্যে ছুড়ে লুফে নিলো। এরপর টস করার মতো শূন্যে তুলে তড়িৎ গতিতে দুইহাতের তালু দ্বারা চেপে ধরে বললো,
“যদি সেতু হয়, তবে সরি এক্সেপ্ট করবো কিনা বিবেচনা করে দেখবো। আর যদি শাপলা হয়, আপনার সরি এক্সেপ্ট করছি না।”
রাসিফ যারপরনাই বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ে বলে কি! একটা কয়েনের ওপর তার সরি ঝুলে থাকবে? লিখি একহাত তুলে তালুতে থাকা কয়েনটা সামনে তুলে ধরলো। পাঁচ টাকার কয়েনের শাপলার দিকটা জ্বলজ্বল করছে। লিখির ঠোঁটে কাঙ্ক্ষিত হাসি। সে কয়েনটা মুঠোয় পুরে পার্স হাতে তুলে নিলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে রাসিফকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“সো মিস্টার?” 
“রাসিফ রাওয়াদ।”
“মিস্টার রাসিফ রাওয়াদ, শাপলা যেহেতু উঠেছে, সুতরাং আপনাকে আমি ক্ষমা করছি না। আপনার ব্যবহার আমার সম্মানে আঘাত করেছে। আমি এত সহজে ভুলতে পারবো না। আপনি বাবার প্রিয় মানুষ বলে কপটতা ফুটিয়ে সৌজন্যবোধ দেখাতে পারলাম না।”
লিখি বেরিয়ে গেলো কাচের দরজা ঠেলে। রিথী হাসি হাসি মুখে বললো,
“একদম ঠিক হয়েছে।” 
রাসিফ রিথীর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললো,
“তোমাকে আমি সরি বলিনি খুকি। বড্ড বেশি বকো। তোমার দাত খুলে নেওয়াই উচিৎ।” 
রিথী কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,
“আমি এক্ষুনি বাবাকে গিয়ে আপনার কথা বলছি।” 
রাসিফ মুচকি হেসে বললো,
“আমিও আঙ্কেলকে বলবো বড় ভাই হিসেবে একটু মজা করেছি।” 
“কে বড় ভাই? আপনার মাথায় কয়েকটা পাকা চুল দেখেছি আমি। আর যাদের চুল পাকে তারা বয়স্ক হয়। আপনাকে তো আমি আঙ্কেল ডাকবো।”
রাসিফ থতমত খেয়ে গেলো। পকেট হাতড়ে নামাজ পড়ার টুপিটা বের করে মাথায় দিলো। রিথী হাসতে হাসতে রুম ত্যাগ করলো।
রাসিফ হতাশ হয়ে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। একটা কয়েনের জন্য তার সরি আটকে রইলো। নাকি এখান থেকেই শুরু হলো নতুন কোনো গল্প?
চলবে…





