লারিসা পর্ব ৮

0
513

গল্প : লারিসা | পর্ব : আট

বল্লম কাঁধে করে দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। আবছা আলো আঁধারিতে তার বল্লমে গেঁথে থাকা নেকড়েটাকে দেখা যাচ্ছিল। সেটার পেটের ক্ষত থেকে চুয়ে চুয়ে রক্ত ঝড়ছে। নেকড়েটা তখনও বেঁচে আছে। মৃত্যু যন্ত্রণায় থরথর করে কাঁপছে।

লোকটার চেহারায় গর্ব৷ বড়াই করা হাসি। কিন্তু তার দিকে বাকি লোকজন এভাবে কেন তাকিয়ে আছে? সবার চেয়ে থাকার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, কিছু একটা গন্ডগোল আছে। কী কারণে যেন সবার চোখে আতঙ্কের ছাপ দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। তবে কেউ কিছু বলছে না। উঃ শব্দটিও করছে না। নড়ছেও না। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। জ্বলন্ত আগুন ফিকে হয়ে এসেছে। পরিস্থিতি একেবারেই থমথমে, শান্ত এবং গাঢ় নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন।

গরগর শব্দ হচ্ছে মনে হয়!

কেমন একটা ভারী গরগর আওয়াজ লোকটার কানে আসলো। যে লোকটা বল্লম হাতে দাঁড়িয়ে আছে তার পেছন দিক থেকেই আওয়াজটা আসছে। হিংস্র বাঘ প্রচন্ড রেগে গেলে যেমন আওয়াজ হয়, ঠিক তেমনই আওয়াজ। কিন্তু এই জঙ্গলে বাঘ নেই। তাহলে?

আগুনের সামনে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের বুক শুকিয়ে গেছে। আতঙ্কে হাত-পা পাথর হয়ে গেছে। সামনে নির্ঘাত মৃত্যু। পালাতে গেলেই প্রাণ যাবে। যে আগে দৌড় দিবে তার প্রাণটাই আগে যাবে। সুতরাং মৃত্যুর মিছিলে কেউ নিজের নামটা আগে লেখাতে চাইলো না।

বল্লম হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার পেছন দিকে অন্ধকার থেকে খুবই ধীর পা ফেলে এগিয়ে আসছে নেকড়েগুলো। কুচকুচে কালো ওদের দেহ। অন্ধকারের সাথে মিশে আছে একদম৷ শুধু ওদের রুপালি হিংস্র চোখগুলো দেখা যাচ্ছে। বাসিন্দারা প্রথমে ভেবেছিল চার-পাঁচটা নেকড়ে হবে হয়তো। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হলো, নিকষ কালো অন্ধকারে যতগুলো চোখ দেখা যাচ্ছে; অন্তত কয়েকশত নেকড়ে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে! কয়েক শত! পুরো জঙ্গলের নেকড়েগুলো বুঝি একসাথে চলে এল! গত একশো বছরের ইতিহাসে এই প্রথম এতগুলো নেকড়ে একসাথে দেখা গেল!

সাধুদের মধ্যে সবচে’ বয়স্ক লোকটা বিড়বিড় করে বলে উঠল, “অসম্ভব। এটা অসম্ভব। এতগুলো নেকড়ে একসাথে আসা একেবারেই অসম্ভব। এরা নেকড়ে না। কখনোই নেকড়ে না। এতগুলো নেকড়ে হতে পারে না!”

কেউ কোনো জবাব দেয় না। আতঙ্কিত চোখে নেকড়েগুলোর চোখের দিকে চেয়ে থাকে আর ভাবে, চোখের সামনে নেকড়েগুলো দাঁড়িয়ে। অথচ উনি বলছে নেকড়ে না!

লোকটা আবার বিড়বিড়িয়ে উঠে, “এখানে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে। এরা নেকড়ে না। হতে পারে না। এতগুলো নেকড়ে কখনোই একসাথে আসবে না।”

“তাহলে এগুলো কী?” নিচু আওয়াজে বলে উঠে একজন।

“এগুলো অন্য কিছু। হতে পারে প্রেতাত্মা! নিশ্চয়ই কেউ… না না না! এতগুলো প্রেতাত্মা একসাথে ডেকে আনা সম্ভব না। কিছুতেই না!”

“তাহলে এরা কারা? কেন এখানে এল?”

চুপ করে থাকে লোকটা। বিড়বিড়িয়ে মন্ত্র পড়তে থাকে। পকেট থেকে মৃত নেকড়ের হাড় বের করে আনে যেটা দিয়ে সে কালোজাদুবিদ্যা চর্চা করে। সেই হাড়টা বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে এত জোরে চেপে ধরে যে, তার হাত কেটে রক্ত পড়তে শুরু হয়। হাতটা সে আগুন থেকে প্রায় তিনফুট উঁচুতে ধরে রাখে যাতে রক্তের ফোঁটা আগুনে পড়ে। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত আগুনে পড়তে থাকে এবং লোকটা মুখে বলতে থাকে, “দ্যাশলেই নে বাফরাম, দ্যাশলেই নে বাফরাম, দ্যাশলেই নে বাফরাম…”

বল্লম হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার একেবারে কাছে চলে এসেছে একটা নেকড়ে। সেটার উচ্চতা প্রায় তিন ফুট। গলা দিয়ে গরগর আওয়াজ তুলে লোকটার চারপাশে ঘুরতে লাগলো নেকড়েটা। ভয়ে, আতঙ্কে লোকটার হাত থেকে বল্লম পড়ে গেল। মুহূর্তেই প্যান্ট ভিজে গেল তার। নেকড়েটা একবার লোকটার মুখের দিকে তাকাল। তারপর…

নেকড়েটা যখন ওই লোকের রক্তাক্ত দেহ মুখে করে নিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিল তখন কয়েকশত নেকড়ে এদিকে আসতে লাগলো। উপস্থিত সবাই এক পা নড়ার সাহস পেল না। বয়স্ক লোকটা মন্ত্র পড়েই গেল, “দ্যাশলেই নে বাফরাম, দ্যাশলেই নে বাফরাম…”

পড়তে পড়তে সে সব দেখছিল। সে জানত, আজ ওই নেকড়েগুলো সবাইকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। এখানে মানুষ পঞ্চাশজনও হবে না। এদিকে নেকড়ে কয়েকশত। এরা একটু করে খেলেও মানুষগুলোর হাড় ছাড়া আর কিছুই বেঁচে থাকবে না। কিন্তু নেকড়েগুলোর কান্ড দেখে লোকটার মুখ হা হয়ে গেল। শুধু তার না, উপস্থিত বাকি সবাই বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে পড়ল। কারণ, নেকড়েগুলো একসঙ্গে ওই ঘরের সামনে গেল, যেখানে লি রি’কে আটকে রাখা হয়েছে। এবং ওরা নিজেদের হাত দিয়ে দাঁত দিয়ে দরজা ভেঙে লি রি’কে বের করে আনল। লি রি যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল, যখন হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন নেকড়েগুলো ডানে-বাঁয়ে ছড়িয়ে গিয়ে মাঝখান দিয়ে রাস্তা করে দিচ্ছিল! যে মেয়েটাকে লি রি’র ঘরে পাঠানো হয়েছিল আত্মাশুদ্ধির জন্য, সে এতগুলো নেকড়ে দেখে অজ্ঞান হয়ে গেছে। তার উদাম দেহ কোনোমতে ঢেকে দিয়ে তাকে কোলে করে হেঁটে যাচ্ছে লি রি। সাধুদের মধ্যে সবচে’ বয়স্ক লোকটা মন্ত্র পড়া বন্ধ করে দিয়েছে। এবার সে ভরাট গলায় বলে উঠল, “এ আমি কী দেখলাম! এটা কী দেখে ফেললাম আমি! যে নেকড়েগুলো মানুষ দেখলেই হামলে পড়ে, এমন মানুষখেকো নেকড়েরা জড়ো হয়ে একটা মানুষের রাস্তা করে দিচ্ছে! আমি স্বপ্ন দেখছি। আমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নই দেখছি!”

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে যেতে যেতে ভোর হয়ে গেল। সাড়ে পাঁচটা থেকে ছ’টার মাঝামাঝি সময়ে মেয়েটাকে নামিয়ে রাখল লি রি। তখন তার চোখে পড়ে, মেয়েটা ড্যাবড্যাব করে তার দিকেই তাকাচ্ছে। লি রি’কে অবাক হতে দেখে সে বলে, “অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি, না?”

লি রি ভাবলেশহীনভাবে বলে, “চল্লিশ কিলোগ্রাম ওজনের একটি মেয়েকে সারারাত বয়ে বেরিয়েছি। একটু কষ্ট তো হবেই।”

মেয়েটা মুখ বাঁকিয়ে বলে, “কিন্তু আমার ওজন তো চল্লিশ কেজি না।”

“তাহলে?”

“পঞ্চান্ন।”

“আসলেই?”

“বিশ্বাস হয় না? আরেকবার কোলে নিয়ে দেখুন।”

“থাক, বিশ্বাস করলাম।” বলে চলতে শুরু করে লি রি। মেয়েটা গায়ের উপর এলোমেলোভাবে জড়িয়ে রাখা কাপড় পরতে পরতে বলে, “কোথায় যাচ্ছেন?”

লি রি যেতে যেতে বলে, “জানি না।”

“আমি যাব আপনার সাথে।”

“না। আমাকে ফলো করবেন না।”

“কেন নয়? আপনি আমাকে ভয় পান নাকি?”

লি রি থমকে দাঁড়ায়। ফিরে তাকিয়ে বলে, “আমার অনেক বিপদ। সাথে আসলে আপনিও বিপদে পড়বেন। ভালো চান তো নিজের শহরে চলে যান।”

“কিন্তু আপনি?”

“আমার ঠিক নেই। আমি শুধু এতটুকু জানি যে, আজ হোক কিংবা কাল, ওরা আমার থেকে প্রতিশোধ নেবেই।”

“ওরা? ওরা কারা?”

জবাব দেয় না লি রি। ঘনঘন পা ফেলে হারিয়ে যায়। মেয়েটা বসে থাকে চুপচাপ। একসময় লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলে, “অামাকে প্রত্যাখ্যান করল! অদ্ভুত মানুষ তো!”

তিনদিন পায়েচলা পথ পেরিয়ে একটা দ্বীপের কাছে চলে এসেছিল লি রি। এই তিনদিনে সে কিছুই খায়নি। কারণ, ছোটোবেলা থেকেই সে গৃহবন্দি ছিল। জানালা দিয়ে তাকে একরকম খাবারই দেওয়া হয়েছে। কোনো প্রকার নরম বস্তু সাথে গরম ঝোল। নরম বস্তুটা শামুকের মতো। খেতে নোনতা। আর ঝোলটা ফুটন্ত জল। আর কিছুই না। কিন্তু সবখানে খোঁজেও অমন জিনিস পেল না লি রি। শুধু গরম জল পাওয়া গেল। কিন্তু জল খেয়ে আর কতক্ষণ? এদিকে গা ঘেমে গন্ধ বেরোচ্ছে। বিকেলের দিকে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি সে। তাই জল দেখেই নেমে পড়েছিল। প্রথমে বুঝতে পারেনি। কিন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে বুক অবধি ডুবে যাওয়ার পর সে টের পেল, পানি এতটাই গরম যে, তার দেহ পুড়ে যাচ্ছে। গা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন, সমুদ্রে নয়, বরং ফুটন্ত পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে সে!

চলবে
মো. ইয়াছিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here