গল্প : লারিসা | পর্ব : চৌদ্দ
বন-জঙ্গল-গাছগাছালি আর লতাপাতা ডিঙিয়ে বহু পথ পেরিয়ে যে জায়গায় যেতে লি রি’র তিন দিনেরও বেশি সময় লেগেছিল, ঠিক ততটুকু পথ মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে পেরিয়ে গেল প্রাণীগুলো। সংক্ষিপ্ত রাস্তা তবে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রাণীগুলো এত দ্রুত চলছিল যেন মনে হয় রাস্তাটা তাদের গড়গড়া মুখস্ত। নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকে শুঁকে এগোচ্ছিল ওরা। অনেক দূর থেকে পিছু করছিল রোবান। নেকড়েগুলোর কান্ড দেখে রোবানের বিস্মিত চোখদু’টো ক্রমশ বড়ো হয়ে যাচ্ছিল। উঁচুনিচু, ঢালু-সমতল, বিরাট গর্ত, জলাশয় পেরিয়ে এগিয়ে চলা পথ। কোথাও হাঁটুজল তো কোথাও একেবারে হাবুডুবু অবস্থা। নেকড়েগুলো সাঁতরে পার হলো। ওরা পানি থেকে উঠে যাবার পর অন্তর্পণে জলে নেমে যায় রোবান। নিঃশব্দে পার হয়ে ডাঙায় উঠে যায়। দাঁড়ায় না, দ্রুত পিছু করে। ততক্ষণে নেকড়েগুলো অনেক দূরে চলে গেছে। নাগাল না পেয়ে দৌড় দেয় রোবান। লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে৷ তারপর, হঠাৎ যখন দূর থেকে আবার নেকড়েগুলোর কালো কালো গা দেখা যায়, তখন ফের ধীরে ধীরে পা চালায় সে। আর ভাবে, এতগুলো নেকড়ে একসঙ্গে যাচ্ছে কোথায়? এদিকে তো শুধু গভীর জঙ্গল, জলাশয় আর ফাঁকা ময়দানে ভরপুর। তাহলে?
হাঁটা যখন শেষ হয়, তখন বিস্তীর্ণ ফাঁকা জায়গায় রাশি রাশি বালি দেখতে পায়। তকতকে বালি; ঠান্ডা। রোবান অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকে যাতে প্রাণীগুলো টের না পায়। কিন্তু এতদূর থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।
রোবান আরো কয়েক পা এগিয়ে যায়। দেখে, একসাথে প্রায় কয়েক শত নেকড়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝখানে কী আছে তা দেখা যাচ্ছিল না কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের ঠিক মাঝখানে প্রায় ছ’ ফুট লম্বা প্রাণী উঠে দাঁড়াল। প্রাণীটার পুরো শরীর ঘন কালো লোমে ভরতি। পিঠের দিকে তিনটি শিং। আর… এমন অদ্ভুত প্রাণী এর আগে কখনো দেখেনি রোবান। অবাক হয়ে চেয়ে থাকে সে৷ তার বিস্ময় আরো বেড়ে যায় যখন সে দেখে প্রাণীগুলো সবাই ওই অদ্ভুত প্রাণীটার দু’দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ডানপাশে এক সারি, বাঁ পাশে আরেক। তারপর, সারি লম্বা হয়ে গেলে একে একে একজন করে এগিয়ে যায় সেই অদ্ভুত প্রাণীটির সামনে। তারপর নিঃশব্দে কী যেন বলে! আশ্চর্যের বিষয় হলো, সবার পরে যে প্রাণীটি গেল, তার মুখে একটা ফুল ছিল। সেই ফুলটা ওই অদ্ভুত প্রাণীটার পায়ের কাছে রেখে চলে আসতে শুরু করে ওরা।
এতগুলো নেকড়ে একসাথে এতদূর এসে এই অদ্ভুত প্রাণীকে ফুল দিয়ে যাচ্ছে! এদের সাথে এই প্রাণীটার সম্পর্ক কী? আর এরা ফুল দিচ্ছে কেন? আজ কি কোনো বিশেষ দিন?
আড়ালে চলে যায় রোবান। প্রাণীগুলো যেপথে এসেছিল সেদিকে চলে যেতে থাকে। অনেক দূরে চলে গেলে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে রোবান। দেখে, সেই অদ্ভুত প্রাণীটা বালির উপর শুয়ে পড়েছে। অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, সেই প্রাণীটার ঠিক পাশেই একটি মেয়ে মানুষ শুয়ে আছে! মেয়েটি অন্যদিকে মুখ দিয়ে শুয়ে আছে বলে তার চেহারা দেখতে পেল না রোবান।
তবে, ভোর হবার আগে আগে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। দৃশ্যটা দেখে রোবান এতটাই অবাক হলো যে, বিস্ময়ে তার মুখ হা হয়ে গেল। চোখদু’টো এতটাই বড়ো হলো যেন একটুর জন্য বেরিয়ে আসবে। আচমকা হাত-পা কাঁপতে শুরু করল। মুহূর্তেই চাপা নিঃশ্বাসে ভরে উঠল তার বুক। কপালের ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে এল ধীরে ধীরে। কৌতূহল তাড়ানোর জন্য সে আরো কয়েক পা এগিয়ে গেল। নাঃ, না না, ভ্রম নয়, সত্যি সত্যি! সত্যি দেখছে সে! বালির উপর শুয়ে থাকা লোমশ দেহের সেই অদ্ভুত প্রাণীটা ধীরে ধীরে মানুষ হয়ে যাচ্ছে! রোবান আরো অবাক হলো যখন দেখল মানুষটা আর কেউ না, স্বয়ং লি রি!
রোবান সেই রাতে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। তাদের বসতির লোকজন যেখানে আশ্রয় নিয়েছে সেখানে সবাই আছে শুধু সে ছিল না। হঠাৎ একদিন সবার সামনে উপস্থিত হয় রোবান। এতদিন পর তাকে দেখে উৎসুক জনতা এগিয়ে আসে। অনেকে নিজেদের দুঃখের কথা বলে। এখানে ওদের এক মুহূর্তও ভালো লাগছে না। এক মুহূর্তও না। তাদের কষ্টের কথা শুনতে শুনতে আচমকা শব্দ করে হেসে উঠে রোবান। তার হাসিমুখ দেখে কেউকেউ অবাক হয়। কেউ রেগে গিয়ে প্রতিবাদ জানায়, গর্জন করে বলে, “আমাদের কষ্টের কথা শুনে হাসছো তুমি? আমাদের কষ্ট দেখার জন্যই এতদিন পর এখানে এসেছ, না? চলে যাও, দূর হয়ে যাও এখান থেকে।”
কিন্তু ওদের কথায় কান দেয় না রোবান৷ বরং খোশ গলায় চেঁচিয়ে বলে, “তোমরা কি পুরনো বসতিতে ফিরে যেতে চাও?”
হঠাৎ এমন কথা শুনে সবাই অবাক হয়। কেউ কেউ সমস্বরে বলে উঠে, “অবশ্যই চাই! আমরা আমাদের পুরনো বসতিতে ফিরে যেতে চাই!”
“তাহলে চলো।”
রোবানের এই সহজ কথা শুনে সবাই দমে যায়। সবাই জানে, এভাবে চলে গেলে সবাইকে নেকড়ের কবলে পড়তে হবে, মরতে হবে। তাই তারা সাহস করে না। কিন্তু রোবান আশ্বাস দেয়, বলে, “আমি থাকতে তোমাদের কারোর কোনো ক্ষতি হবে না। তোমরা আমার নির্দেশমতো চললে নেকড়ে কেন নেকড়ের বাপও তোমাদের কিছু করতে পারবে না।”
কেউ কথা বলে না। আগ্রহ দেখায় না। রোবান হাত উঁচু করে বলে, “কে যাবে আমার সাথে? গেলে চলো। আমি বলছি কারোর কিছু হবে না। কে যাবে আমার সাথে?”
প্রথমে দু’-একজন সাড়া দেয়। তারপর আরো ক’জন। ওদের দেখাদেখি আরো। একসময় দু’-চারজন বাদে সবাই বসতিতে ফিরে যেতে রাজি হয়ে যায়। তখনই রোবান থমকে যায়। বলে, “এখন না, আমাকে তিনদিন সময় দাও। তিনদিন পর আমি তোমাদেরকে বসতিতে নিয়ে যাব।”
এই বলে সে চলে যায়। যাবার সময় শক্ত, জোয়ান কিছু ছেলেমানুষ নিয়ে যায় সাথে। ওদের দিয়ে কী কাজ আছে তা বলে না।
দু’দিন পর।
গভীর রাত।
খোলা আকাশের নিচে বালির উপর চিত হয়ে ঘুমুচ্ছে লি রি। তার উদাম বুকের উপর মুখ গুঁজে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে লারিসা। আজ তাদের বিয়ের পাঁচদিন পূর্ণ হলো। এখনও তাদের বাসর হয়নি। তা অনেক দূরে, লি রি একবার ভালোভাবে তাকিয়ে দেখেনি লারিসাকে। ওর মতো এমন সুন্দরী মেয়ে এই পুরো এলাকায়, পুরো শহরে, পুরো দেশে দু’টি নেই। ভালো করে তাকিয়ে দেখেনি বলেই জানে না, চোখে চোখ রাখিনে বলে লি রি এখনও জানে না যে, পৃথিবীর সবচে’ সুন্দরী মেয়েটি তার বউ! এখন সেই মেয়েটি তার বুকের উপর ঘুমাচ্ছে। মেয়েটির খোলা এলোমেলো চুলগুলো লি রি’র বুকের উপর, গলায়, মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। লি রি আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। অপরদিকে লারিসার নিঃশ্বাস ঘন। হঠাৎ, কী কারণে যেন আচমকা ঘুম ভেঙে গেল লারিসার। চোখ কচলে মুখ তুলে একবার লি রি’র মুখের দিকে তাকাল লারিসা। মুখটার প্রতি এত এত এত মায়া লাগল, আবেগে অন্তত একটি চুমু দিতে ইচ্ছে করল তার। এবং সে দিলোও, আস্তে করে মুখ তুলে লি রি’র কপাল বরাবর ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। কিন্তু, কিন্তু এখানেই থেমে যেতে পারল না। লি রি’র ঘুমন্ত মুখের দিকে যতই তাকাল ততই যেন আবেগে আড়ষ্ট হয়ে পড়ল সে। কিছুতেই যেন নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না এমন অবস্থায় উন্মুক্ত হয়ে লি রি’র ঠোঁটের উপর ঠোঁট রাখল লারিসা। এভাবে অনেক্ষণ কেটে গেল। তারপর সে যখন উঠে যাবে তখন নিচু এবং আদুরে গলায় বলল, “এখানেই থাকো মাই ডিয়ার। আমি এক্ষুণি ড্রিংকস নিয়ে আসছি। আজ দু’জনে মিলে ড্রিংক করব খুব। এক মিনিট, আসছি। উম্মাহ্!”
ফ্লাইং কিস দিয়ে ঘনঘন পা ফেয়ে এগিয়ে যায় লারিসা। সে যাবে তার ঘরে। সেখান থেকে ড্রিংকস্-এর বোতল, গ্লাস, স্ট্রো, বরফ আর যা যা লাগে নিয়ে আসবে। তারপর লি রি’কে ডেকে তুলবে। তরল গিলতে গিলতে ইনিয়ে বিনিয়ে বলবে, “শুনুন মিস্টার, আসলে, হয়েছে কী, আমার একটি কিউট বেবি গার্ল লাগবে।”
[আমার ইদানীং হয়েছে কী জানি না। যে গল্পই লিখতে বসি সেই গল্পের নায়িকার প্রেমে পড়ে যাই। এবার বোধহয় লারিসার প্রেমে পড়তে যাচ্ছি। ও গড, সেভ মি!]
চলবে
মো. ইয়াছিন