#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
১৯.
ভালোবাসার রঙিন ডানায় করে কেটে গেছে রঙিন একটা মাস। আজ আদ্রিশ বাড়ির কোনায় কোনায় ক্যামেরা সেট করছে। এমনকি বেডরুমেও। এসব দেখে রুশা ক্ষেপে গেল।
“বেডরুমে! বেডরুমে কেউ ক্যামেরা লাগায়? তুমি এসব কী করছো?”
“রুশা, আমার পক্ষে ব্যবসা বানিজ্য রেখে ঘরে বসে থাকা সম্ভব না আর তোমাকে সব সময় নিজের সাথে রাখাও সম্ভব না। জারিফ কখন কি করে বসে, আমি কোনো রিক্স নিতে চাইনা। আমি যেখানেই থাকি না কেন তোমার উপর আমার দৃষ্টি থাকবে। তোমার বিপদ হলে জানতে পারব।”
“তাই বলে ঘরে ক্যামেরা? কোনো প্রাইভেসি নেই?”
“স্বামী স্ত্রীর মাঝে কিসের প্রাইভেসি? আমি ছাড়া অন্য কেউ দেখতে পাবে না।”
“তাহলে এক কাজ করো ওয়াশরুমেও ক্যামেরা লাগিয়ে দেও।”
আদ্রিশ আলতো হেসে বলল,
“প্রয়োজন পড়লে তাও দেব।”
রুশা চোখ বড়বড় করে চেয়ে আছে। আদ্রিশ বারান্দার ক্যামেরা লাগানো দেখতে চলে গেল। রুশা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও কি করছে কিছুই বুঝতে পারছে না। রাগ হচ্ছে প্রচুর।
আদ্রিশ অফিসের কাজ করতে করতে ল্যাপটপের স্কিনে রুশাকে দেখছে। রুশা পুরো দিন ঘর থেকে বের হয়নি। ঘরের কাজ করেছে, শুয়ে শুয়ে বই পড়েছে, গান শুনেছে, ঘুমিয়েছে। খাওয়ার জন্যও নিচে যায়নি। রুশা যে সব ইচ্ছে করে করছে বুঝতে পারছে। প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। রুশা ফ্রেশ হয়ে নিচে গেল। তবে খেতে নয় বাইরে গিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করতে। কিন্তু দরজার সামনে যেতেই একজন সামনে এসে মাথা নিচু করে বলল,
“সরি মেম, আপনার বাইরে যাওয়ার পারমিশন নেই।”
রুশা অবাক হয়ে বলল,
“মানে? আমি বাড়ির বাইরে যাচ্ছি না। বাগানে যাব।”
“সেখানে যাওয়ার অনুমতিও আপনার নেই।”
“অদ্ভুত! সরুন আমি বাইরে যাব।”
“আপনাকে যেতে দিলে স্যার ফিরে এসে আমাদের কঠিন শাস্তি দেবে।”
রুশা রেগেমেগে ছুটে নিজের ঘরে চলে গেল। পেছনে থেকে একজন সার্ভেন্ট ওকে খাওয়ার জন্য অনেকবার ডাকল কিন্তু ও শুনলো না। দরজা বন্ধ করে রাগে গজগজ করতে করতে শুয়ে পড়ল। মুখের উপর বালিশ দিয়ে রাখল যাতে আদ্রিশ ওকে দেখতে না পায়। দু মিনিটের মাথায় ওর মোবাইলে ফোন এলো।
আদ্রিশ কল করেছে। রুশা রিসিভ করে চুপ করে কান পেয়ে রইল।
আদ্রিশ ওপাশে থেকে বলল,
“রুশা, খেয়ে নেও। বিকেল হয়ে গেছে এখনো দুপুরের খাবার খাওনি কেন?”
“আমি খাব না।”
আদ্রিশ আরেকটু কড়া করে বলল,
“রুশা, খেয়ে নেও।”
“খাব না আমি।”
রুশা রাগ দেখিয়ে কল কেটে দিল।
।
।
আধা ঘণ্টা পর আদ্রিশ হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল। রুশা শুয়ে ছিল। আদ্রিশ খেঁকিয়ে বলল,
“তোমার জন্য কী আমি কাজও করতে পারব না?”
রুশা হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে বলল,
“আমি তোমাকে কাজ করতে কখন বারন করলাম?”
“তুমি খাওনি কেন?”
“ইচ্ছে নেই।”
আদ্রিশের রাগ উঠে গেলেও নিজেকে শান্ত করল। তারপর ওর পাশে বসে ওকে কাছে টেনে আদুরে গলায় বলল,
“আমি তো তোমার জন্যই এসব করছি। তোমার কথা ভেবেই। মাত্র কিছুদিন। জারিফজে ধরতে পারলে তোমাকে আর এভাবে থাকতে হবে না। নিজের মতো থাকতে পারবে। এই কয়দিন কো-অপারেট করো।”
রুশা তবুও কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আমার সারাদিন এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগে না। এভাবে একটা মানুষ বাঁচতে পারে? আমি তো রোবট নই।”
“আচ্ছা, খেয়ে তৈরি হয়ে নেও। আমি তোমাকে আশ্রমে নিয়ে যাব।”
রুশা ওর কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে খেতে চলে গেল।
.
দুদিন পর। আদ্রিশ মোবাইলে কারো সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করছে। রুশা ওকে চিৎকার করতে দেখে দৌড়ে ঘরে আসে। পেছনে থেকে শুনতে পায়।
আদ্রিশ চেঁচিয়ে বলছে,
“পঞ্চাশ লাখ টাকা কি তোর বাপ দিবে? এক পয়সা কম নেব না। আমার পুরো ১০কোটি চাই। এক টাকা কম হলে তোকে গুলি মেরে মাটি চাপা দিয়ে দেব।”
“বস, লোকটা দিতে চাইছে না।”
“ওকে আমার কথা বল। বলবি এক টাকা কম দিলে ওর খবর আছে। যদি বাড়াবাড়ি করে
ওখানেই শেষ করে দিবি। টাকা দিতে না পারলে বাঁচার দরকার নেই। মেরে দে।”
ওর কথা শুনে রুশা অবাক না হয়ে পারল না। আদ্রিশ এত টাকার মালিক সেখানে পঞ্চাশ লাখ টাকার জন্য এভাবে কথা বলছে। আবার মেরে ফেলার কথা বলছে। লোকটার হয়তো আর্থিক সমস্যা আছে তাই দিতে পারছে না।
আদ্রিশ কল কেটে গালাগাল করতে করতে ঘুরে রুশাকে দেখল। রুশা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছে।
“লোকটার হয়তো আর্থিক সমস্যা আছে। কথা বলে আর কিছুদিন সময় দেও।”
“অনেক সময় দিয়েছি। ওর আর্থিক সমস্যা থাকলে সেটা ওর ব্যাপার আমার দেখার দরকার আছে? আমি আমারটা চাই এট এনি কস্ট।”
“পঞ্চাশ লাখ টাকার জন্য মেরে ফেলবে? টাকার দাম বেশি মানুষের চেয়ে?”
“আমার কাছে মানুষের চেয়ে টাকার দাম বেশি। টাকা না থাকলে এই পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে বাঁচা যায় না। সম্মান পাওয়া যায় না। টাকা না থাকলে কাউকে পাশে পাওয়া যায় না। আজ টাকা আছে লাইফে সব আছে। টাকা না থাকলে তুমি থাকবে নাকি আমার সাথে? টাকা না থাকলে তুমিও ছেড়ে চলে যাবে।”
রুশা ওর কথা শুনে বড়সড় ধাক্কা খেল। আদ্রিশ ওকে লোভী ভাবছে?
“আমি তোমার টাকার জন্য তোমার সাথে আছি?”
“উহু, টাকার জন্য হয়তো নেই কিন্তু টাকা না থাকলে আমাকে ছেড়ে অন্যের হাত ধরতে দু’বার ভাববে না। মেয়েরা টাকার জন্য সব করতে পারে।”
“আদ্রিশ! সবাই এক নয়। সবাইকে এক রকম ভাবে জাজ করো না। আর প্লিজ আমাকে এত লোভী ভেবো না।”
“আচ্ছা ধর, আমি হঠাৎ করে গরিব হয়ে গেলাম, আমার ব্যবসা-বাণিজ্য যাবতীয় সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে গেল তখন তুমি কি করবে?”
“কি করব? তোমার সাথে থাকব। তোমার জন্য সব পরিস্থিতিতে ফাইট করব। আমি তোমার স্ত্রী।”
আদ্রিশ হাসল। সে হাসিতে তাচ্ছিল্য দেখতে পেল রুশা।
“স্বার্থ ছাড়া কেউ কারো সাথে থাকে না। আমি তুমি দুজনেই দুজনের স্বার্থের জন্য একে অপরের সাথে আছি। ভালোবাসাও এক ধরনের স্বার্থপরতা। নিজের ভালোবাসার জন্য মানুষ কত কি করে। আমি নিজেই কত কি করেছি। তোমার ভালোবাসা আদায় করতেও আমাকে অনেক কিছু করতে হয়েছে। কেন করেছি? নিজের স্বার্থে। তুমি ব্যথা পেলে আমি ব্যথা পাই কেন? অস্থির অস্থির করি কেন?নিজের স্বার্থে।”
রুশা অবাক হয়ে আদ্রিশকে দেখছে। কি সব উল্টো পালটা কথা বলছে। সব উল্টো ভাবে দেখছে। উলটো ভাবে ভাবছে। আদ্রিশ আসলেই অসুস্থ মানুষ। এই মানুষটার সাথে কি করে আজীবন থাকবে জানা নেই। কখন কি বলে, কি করে কোনো দিকে হুশ নেই।
রুশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি নিজেও নিজের দিকটা আগে ভাবি কিন্তু তাই বলে অন্যের ক্ষতি চাইনি কখনো। অন্যের কষ্ট, সমস্যা বোঝার চেষ্টা করেছি। সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। এদিক দিয়ে তোমার চেয়ে কিঞ্চিৎ হলেও কম স্বার্থপর। লোকটাকে মেরো না। একটা মৃত্যু অনেক গুলো মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। একা মরে না অনেকগুলো মানুষকে জীবন্ত লাশ করে দিয়ে যায়। আর হ্যা, তোমার সৎ মায়ের মতো সবাইকে বিবেচনা না করে আপন মায়ের মতোও বিবেচনা করতে পারো। তাতে কোনো ক্ষতি নেই।”
রুশা ঘর থেকে চলে গেল।
দিন দিন আদ্রিশ আর রুশার সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। রোজ রোজ নতুন তিক্ততা ঘিরে ধরছে মিষ্টি সম্পর্কের মধ্যে। আদ্রিশ রুশাকে পুরো দিনে তিনবার মোবাইলে কথা বলতে দেখেছে। কার কাউকে অনেকটা সময় নিয়ে মেসেজ করতে দেখেছে। আদ্রিশ রুশাকে ওর বিপক্ষে কিছু করতে দিতে চাইছে না। আর না চাইছে প্রতারক হিসেবে কঠিন শাস্তি দিতে। আদ্রিশ চাইছে রুশা ওর সাথে ওর হয়ে থাকুক। ওকে হারাতে পারবে না। আজকাল মাথায় বিভিন্ন চিন্তা চাড়া দিয়ে উঠে। নিজের উপর কন্ট্রোল রাখতে পারছে না। উল্টো পালটা কাজ আর কথা দুটোই করছে। রুশা আদ্রিশের ব্যবহারে বারবার ঘাবড়ে যায়। রুশাকে এতবার কারো সাথে কথা বলতে দেখে মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
আদ্রিশ অফিস থেকে ফিরেই ওর হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেয়। রুশা শুয়ে ছিল। আদ্রিশকে দেখে ভয় পেয়ে গেল। এভাবে মোবাইল কেড়ে নেওয়ায় বুক কেঁপে উঠে।
“আমার মোবাইল এভাবে নিলে কেন?”
রুশা হাত বাড়ায় মোবাইল নেওয়ার জন্য। আদ্রিশ দেয়ালে ছুড়ে মারে। মোবাইল, ব্যাটারি, কভার সব আলাদা হয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। রুশা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আদ্রিশের দিকে চেয়ে আছে। আবার ভাবছে আদ্রিশ এমন কেন করছে। রুশা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে।
আদ্রিশ চেঁচিয়ে বলল,
“আজ থেকে মোবাইল ব্যবহার করা নিষেধ।”
“কারণ?”
রুশা কারণ শব্দটা উচ্চারণ করতেই আদ্রিশের মাথায় আগুন জ্বলে গেল। চোয়াল শক্ত করে চোখে মুখে কাঠিন্য এনে বলল,
“জানিস না তুই? সারাদিন এত কার সাথে কথা বলিস? আজ ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেছিস মোবাইলে। তুই আর মোবাইল ব্যবহার করতে পারবি না।”
“আমি আশ্রমে কথা বলি। কথার সাথে, বন্ধুদের সাথে কথা বলি।”
“আজকের পর যার যার সাথে কথা বলার আমার মোবাইল দিয়ে বলবে।”
“তুমি আমাকে সন্দেহ করছো?”
“অসম্ভব কিছু?”
রুশা ওর কথা শুনে হতবাক। আদ্রিশ ওকে সন্দেহ করে।
আদ্রিশ আবারও বলল,
“যেভাবে বললে আজকাল যেন কেউ পরকিয়া করে না। স্বামী থাকতে অন্যের হাত ধরে পালিয়ে যায় না? স্বামীকে ধোঁকা দিয়ে অন্যের সাথে দিনের পর দিন হোটেলে, এখানে সেখানে অবৈধ সম্পর্কে যায় না?”
রুশার কান জ্বলে যাচ্ছে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। আদ্রিশ আজকাল এমন ব্যবহার কেন করে? কেন ওকে এভাবে ছোট করে? কেন সব সময় কষ্ট দিয়ে কথা বলে? আজ যা বলল তাতে রুশার মন তিক্ত হয়ে গেছে। আদ্রিশের সাথে কথা বলতেও ঘৃণা লাগছে। কিন্তু জবাব না দেওয়া মানে সব স্বীকার করে নেওয়া।
“আদ্রিশ তোমার মনে হয় না তুমি বেশিই বলছো? এসব পরকিয়া যেমন মেয়েরা করে তেমনি ছেলেরাও করে। তুমি সারাদিন বাইরে থাকো। কোথায় কি করো তা কি আমি জানি, না দেখতে যাই? এমনও তো হতে পারে তুমি আমাকে দীর্ঘদিন ধরে ধোঁকা দিচ্ছো?”
রুশার কথা শুনে আদ্রিশ ওর নাম ধরে চিৎকার করে হাত উঁচু করে মারার জন্য। রুশা হাতের দিকে চেয়ে আছে। আদ্রিশ হাত নামিয়ে নিল। রুশা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“নিজের বেলায় ষোলো আনা। সব ভালো চরিত্র যেন একা তোমার। জ্বালা অন্যেরও হয়। উপলব্ধি করতে শিখো।”
আদ্রিশ রাগে ফোঁসফোঁস করছে।
.
অনেকদিন পরে কথা এসেছে রুশার সাথে দেখা করতে। রুশার ওকে দেখে একটু ভালো লাগছে। সারাদিন একা একা বাসায় বসে থাকতে কার ভালো লাগে? রুশা আজকাল আদ্রিশের সাথে তেমন কথা বলে না। সব সময় গাল ফুলিয়ে থাকে। আদ্রিশের অভ্যাস হয়ে গেছে রুশার এমন মুখ দেখতে দেখতে। কথার সাথে গল্প করে ওর ভালোই লাগছে। সুযোগে আছে ওর মোবাইলটা ব্যবহার করার জন্য। রুশা বই পড়ছিল। বই রেখে রুশা হাসি মুখে গানের সুরে সুরে আস্তে আস্তে বলল ওর মোবাইলটা যেন ওয়াশরুমে রেখে আসে। কথাকে আগেই বলে দিয়েছে আদ্রিশ ওর মোবাইল নিয়ে নিয়েছে। বাইরে যেতে দেয় না। সারাক্ষণ ঘরবন্দী করে রাখে। কথা রুশার ফিসফিসানি কথা শুনে নার্ভাস হয়ে গেল। যদি ধরা পড়ে যায় তাহলে তো খবর আছে। আদ্রিশ ওকে না মেরে দেয়। কথা অসহায় মুখ করে রুশার দিকে তাকাল। রুশা ইশারায় অনুনয় করছে। কথা ওয়াশরুমে যাওয়ার বাহানায় মোবাইল রেখে এল। তারপর ওরা কিছুক্ষণ গল্প করে রুশা শাওয়ারের জন্য ওয়াশরুমে যায়। ওয়াশরুমে গিয়ে বড় করে শ্বাস নিয়ে মেসেজ করল শানকে। এখানকার সব অবস্থা জানাল রুশা।
??
রাতের বেলা খাবার টেবিলে রুশা আদ্রিশের অনেকটা দূরে বসে খাচ্ছে। দুজনের মধ্যেই দূরত্ব বিরাজ করছে, পাশাপাশি নীরবতা। কেউ কারো সাথে আদুরে গলায় কথা বলে না, কারো হাতে খাওয়ার জন্য বায়না করে না, এক সাথে বসে গল্প করে না।
আদ্রিশ খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল,
“কথার সাথে ফিসফিস করে কি কথা বলছিলে?”
রুশা চমকে আদ্রিশের দিকে তাকাল। আদ্রিশের এত সময় কী করে হয়? সবকিছুই কি করে দেখে? কোনো কিছুই কি চোখ এড়ায় না? মোবাইলের ব্যাপারটা জেনে গেল না তো?
“কত কথাই তো বলেছি। তুমি কোনটা শুনতে চাইছো?”
“বেশি ড্রামা করো না। তুমি নিশ্চয়ই গোপন কিছু বলছিলে। তোমার বলার ধরণ, কথার দৃষ্টি তাই বলছিল।”
রুশা খাওয়া থামিয়ে বলল,
“অদ্ভুৎ! এখন আমি কথার সাথে বসেও একটু শান্তিতে কথা বলতে পারব না? তার জন্যও কৈফিয়ত দিতে হবে? হাসি, আনন্দ, সুখ, শান্তি সবকিছু তো কেড়ে নিয়েছে। এখন এই জীবনটাই পড়ে আছে আর কী চাইছো? এখন আমি ওর সাথে কী কথা বলেছি তারও হিসেব দিতে হবে?”
রুশা প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে গেল। আদ্রিশ ওর পেছনে পেছনে গেল। ঘরে গিয়ে রুশাকে চেপে ধরে বলল,
“আজকাল বড্ড মেজাজ দেখাচ্ছো তুমি। রুশা নয় অন্য কোনো চরিত্রে ঢুকে পড়েছো। আমাকে হিসেব দিবে না তো কাকে দিবে? ”
“আজকাল তুমি আমার সাথে কুকুর, বিড়ালের মতো ব্যবহার করছো। মানুষ মানুষের সাথে এমন করে না। এই বাড়ি নামক খাঁচায় বন্দী করে রেখেছো। মানসিক টর্চার করছো। প্রতিনিয়ত আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কী করেছি আমি? কিসের জন্য এমন ব্যবহার?”
“কি করেছিস তুই জানিস না? তোকে বলতে হবে? মুখ বন্ধ করে থাক। নয়তো জিভ কেটে দেব।”
আদ্রিশ রুশাকে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দিল। রুশার চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। মন চাইছে সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে।
রুশা এক পাশে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে। আদ্রিশ অন্য পাশে। রুশার চোখে ঘুম নেই। ওর মাথা ফেটে যাচ্ছে রাগে।
“অনেক হয়েছে আদ্রিশ। এতদিন তোমাকে ভালোবেসে সব সহ্য করেছি। আমাকে এই বাড়িতে আঁটকে রাখবে আর আমি পড়ে থাকব? তেমন মেয়ে আমি না। কিন্তু তোমাকে ভালোবেসে সব টর্চার মেনে নিয়েছি। তোমার ভালোবাসার জন্য নিজেকে বদলে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সব ভুলে তোমাকে ভালোবেসে তোমার সাথে থাকব কিন্তু তুমি নিজেকে বদলাতে পারলে না। আমি আমার সমস্ত প্লানে পানি ঢেলে দিয়েছিলাম। যে কারণে নিজেকে এভাবে তৈরি করেছি সে কারণটাই মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছিলাম। লাইফের এত বড় রিক্স নিয়েছিলাম, লক্ষ্য থেকে সরে এসেছিলাম, সব মাটি চাপা দিয়ে তোমার সাথে বাঁচতে চাইছিলাম কিন্তু বিনিময়ে তোমার কাছ থেকে কিছুই পাইনি। তুমি আমাকে ভালোই বাসো না। তুমি ভালোবাসার নামে অভিনয় করে গেছো। তুমি আমাকে বোকা বানিয়েছো। অনেক বড় গেম খেলছো আমার আড়ালে আর আমি এত বোকা যে তোমার এই প্লান ধরতে পারিনি। সব ভালোই ভেবে এসেছি। তুমি কি করতে চাইছো আদ্রিশ? তোমার মাথায় কি চলছে? আমাকে নিয়ে কোন গেম খেলছো? আজ থেকে তোমার আর আমার পথ আলাদা আদ্রিশ। আমাকে আর বোকা বানাতে পারবে না। আমি জানি তুমি আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গেছো। এতদিন ধরে অভিনয় করেছো। মেইন প্লান এক্সিকিউট করার সময় চলে এসেছে।”
.
সকাল থেকে ঘনঘন বমি আর মাথা ঘুরে যাওয়ার কারণে রুশার মনে কু ডাকছে। এখন তিক্ত সম্পর্ক হলেও মাসখানেক আগেও মধুর সম্পর্ক ছিল ওদের। রুশার মাথা আরো যন্ত্রণা করছে। কেমন ভনভন করছে। চারদিকে সব কিছু উলট পালট হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করে রুশা মেঝেতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।
জ্ঞান ফেরার পরে একজন মহিলা ডাক্তারকে দেখল। তিনি মিষ্টি হেসে উঠে বাইরে গেল। রুশাও বিছানা থেকে নেমে গেল। বাইরে কথার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
“মিস্টার আদ্রিশ আফসান, আপনার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট। আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন। উনার বিশেষ খেয়াল রাখবেন।”
এসব শুনে রুশার পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল। জীবন ওর সাথে কি খেলা খেলছে বুঝতে পারছে না। যেখানে ওর জীবনের সিকিউরিটি নেই সেখানে একটা বাচ্চাকে কি করে জন্ম দিবে? আদ্রিশের মতো একটা ক্রিমিনাল, খুনি, সাইকো আর রুশার মতো প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বদ্ধ উন্মাদ মানুষ কি করে ওর বাবা-মা হতে পারে? যারা একে অপরের শত্রু? একে অপরের বিরুদ্ধে ছক কষে যাচ্ছে তারা ওকে কি সুন্দর জীবন দিতে পারবে? কী করে দেবে? রুশা নিজেই আগুনে ঝাপ দিয়ে বসে আছে। আস্তে-আস্তে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে সেখানে বাচ্চা? আর আদ্রিশ কি নিজের সন্তানকে বাঁচতে দেবে?
আদ্রিশ বাচ্চা আসার কথা শুনে খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছে। ও বাবা হবে, একটা পরিবার হবে, ওকে বাবা বাবা বলে ডাকবে এসব ভাবতেই ভেতরে কেমন একটা শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।
দ্রুত ঘরে এলো। রুশাকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ওর মুখ ফ্যাকাসে। রুশার ফ্যাকাসে মুখ দেখে আদ্রিশ প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
চলবে….