রাজনীতির অন্তরালে, পর্ব:২

0
589

#রাজনীতির_অন্তরালে
#তমসা_চক্রবর্তী

#পর্ব-২

।। ৬ ।।

‘নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে খুন করিমপুরের বিধায়ক ধীমান অধিকারী’।

‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’- এম.এল.এ হোস্টেলে রাতের অন্ধকারে নিজের ঘরেই খুন হলেন করিমপুরের বিধায়ক ধীমান অধিকারী’।

হাতের খবরের কাগজটা উজানের দিকে ছুড়ে দিয়ে বিরক্ত গলায় প্রধান সাহেব বললেন,

-“একটা খুন হয়েছে,৪৮ ঘন্টাও হতে পারল না, আর এরই মধ্যে মিডিয়া একেবারে পুলিশের বাপবাপান্ত করতে শুরু করে দিয়েছে।রিডিকিউলাস”!

-“কি আর করবেন স্যার!এমন কুড়িয়ে পাওয়া ষোল আনা কি মিডিয়া হাতছাড়া করবে কখনো!!ছেড়ে দিন। মিডিয়ার কথা বেশি গায়ে মাখলে আমরা আমাদের আসল কাজটাই করে উঠতে পারব না”!

উজানের কথায় হতাশার হাসি ঠোঁটের কোনে ঝুলিয়ে প্রধান সাহেব বললেন,

-“মিডিয়ার কথায় না হয় কান দিলাম না, কিন্তু উপরমহলের আগুন সামলাবে কি করে আই পি এস উজান রায়!!এই কেস রাজ্য-রাজনীতিতেও যে পরিমাণ শোরগোল ফেলতে শুরু করেছে তাতে আগামী কয়েকদিন আমাদের নাভিশ্বাস উঠতে চলেছে।

আসলে এই ধীমান অধিকারী ছিলেন বিরোধী দলনেতা। রুলিং পার্টির সাথে সম্পর্ক ছিল সাপে নেউলের। সামনের মাসে তো রুলিং পার্টির বিরুদ্ধে তহবিল তছরুপের অভিযোগে বিরাট মিছিলের আয়োজন করেছিলেন ধীমান অধিকারী”!!

-“আরও একটা ব্যাপার কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন স্যার”!!

-“আবার কি”!! ভ্রূ কুঁচকালেন প্রধান সাহেব।

-“অপজিশন পার্টি কিন্তু ইতিমধ্যেই হুমকি দিয়েছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে খুনিদের গ্রেফতার করা না হলে সামনের সোমবারই বাংলা বন্ধ করা হবে”!!

-“ধুর ধুর!!এই পুলিশের চাকরি জীবনটাকে নরক বানিয়ে ছেড়ে দিল।অপজিশন বন্ধ ডাকলেই, রুলিং পার্টি বন্ধের বিরোধীতা করবে।ব্যাস!! পুলিশ সব কাজ ছেড়ে দিয়ে তখন ঠ্যালা সামলাতে লেগে পড়বে”!!

কাজের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করেই থামলেন প্রধান সাহেব। তারপরেই হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে উজানকে প্রশ্ন করলেন,

-“তোমার অ্যাসিস্ট্যান্টটি কোথায় বলতো”!!

-“অরণ্যকে সকাল সকাল এম.এল.এ হোস্টেলে পাঠিয়ে দিয়েছি স্যার। ওখানকার গার্ড, কেয়ারটেকার, রুম অ্যাটেন্ডেন্ট আর স্পেশালি আলম এবং সাবীরের বয়ান রেকর্ড করছে ও”।

এতক্ষনে মুখে প্রশস্ত হাসি ছড়িয়ে প্রধান সাহেব বললেন,

-“আমি যতই গালাগালি করি না কেন উজান, অরণ্য ছেলেটা কিন্তু আস্তে আস্তে বেশ তুখর হয়ে উঠেছে”!!

প্রধান সাহেবের মুখে অরণ্যের সুনাম আর ভূতের মুখে রাম নাম উজানের কাছে প্রায় একই ব্যাপার।তাই বড় বড় চোখে প্রধান সাহেবের দিকে তাকিয়ে উজান বললো,

-“অরণ্য বরাবরই সিনসিয়ার ছেলে। তবুও যে আপনি ওকে কেন এত বকাবকি করেন স্যার”!!

টেবিল তবলার তাল তুলে চোখ নাচিয়ে প্রধান সাহেব উত্তর দিলেন,

-“আখের রস বানাতে দেখেছো কখনো!!আখকে যত বেশি করে মেশিনে পিষবে ততই রস বেরিয়ে আসবে।বুঝলে কিছু!!

।। ৭ ।।

-“পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট চলে এসেছে স্যার”!!

অরণ্যের আগমনে কম্পিউটার থেকে চোখ সরাল উজান।

-“তা নতুন কিছু বলছে কি বলছে, তোমার পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট”!!

-“না স্যার, নতুন সেরকম কোনো তথ্য নেই। রিপোর্ট বলছে, শ্বাসরোধ করে খুন, ‘manual strangulation’! মৃত্যুর সময় অ্যারাউন্ড রাত ১২টা”।

হাতের ইশারায় অরণ্যকে সামনের চেয়ারে বসতে বলে উজান বললো,

-“তারমানে পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট ইন্দ্রানী দেবীর বয়ানে শিলমোহরের ছাপ দিল।কি বলো”!!

-“কিছুটা তাই। তবে স্যার আজ আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় মনে হল এই কেসের একটা অন্য অ্যাঙ্গেলও থাকতে পারে”!!

নড়েচড়ে বসল উজান।

-“অন্য অ্যাঙ্গেল!!সেটা কেমন”!

-“বিধায়ক ধীমান অধিকারীর ছোটভাই বিমান অধিকারীর স্ত্রী মাস দুয়েক আগেই সুইসাইড করেন। পুলিশ আর পোস্ট মর্টেম উভয় রেকর্ড অনুযায়ীই মৃত্যুর কারণ অত্যাধিক ঘুমের ওষুধ।যদিও পুলিশ রেকর্ডে লেখা আছে, যে স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় কারনে বেশ কিছুদিন ধরেই ডিপ্রেশনে ছিলেন মৌমিতা অধিকারী মানে বিমান বাবুর স্ত্রী। এরজন্য যদিও ওনার চিকিৎসা চলছিল।তবে সুস্থ হয়ে ওঠার আগেই একদিন রাতে প্রচুর ঘুমের ওষুধ খেয়ে নেন উনি”।

অরণ্যের মুখে ঘটনার প্রাথমিক বৃতান্ত শোনার পর উজান প্রশ্ন করলো,

-“কিন্তু এই ঘটনা থেকে নতুন কি অ্যাঙ্গেল পেলে”!

-“ঘটনা তো এখনো শুরুই হয়নি স্যার”!!

-“শুরুই হয়নি!!ওয়েল, কন্টিনিউ”!!!

-“আলমকে আজ জিজ্ঞাসাবাদ করার সময এই ঘটনার উল্লেখ করতে ওর থেকে দুটো স্বীকারোক্তি পাওয়া গেছে।

এক: মৌমিতা দেবীর সঙ্গে বিমান অধিকারীর বনিবনা না হওয়ায় প্রধান কারণ ছিলেন ধীমান অধিকারী”!!

চমকে উঠলো উজান। উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল,

-“ধীমান অধিকারী”!!

-“তাহলে আর বলছি কি স্যার”!!

অরণ্য সামনের টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে কিছুটা জল খেয়ে আবার বলতে থাকলো,

-“আসলে বিমান অধিকারী ছিলেন কিছুটা সন্ন্যাসী টাইপের মানুষ। ঠাকুর,দেবতা,পূজা অর্চনা নিয়েই থাকেন দিনের পুরো সময়। মেয়েদের ব্যাপারে উনি বরাবরই উদাসীন। যাকে বলে একেবারেই দাদার বিপরীত চরিত্র।

বছর তিনেক আগে এক বিয়েবাড়িতে অপরূপা মৌমিতা দেবীকে দেখে ধীমান অধিকারী ভাবেন এই মেয়েকে ভাইয়ের বৌ করে ঘরে তুললে হয়ত ভাইয়ের মতি শুধরাবে এবং ঘর সংসারের প্রতি তার একটা টান তৈরি হবে।

কিন্তু সে গুড়ে বালি।ওমন সুন্দরী মহিলাকে বৌভাতের রাতে একা ছেড়ে বিমান কীর্তন দলের সাথে চলে যায় ঝাড়খন্ডের কোন এক গ্রামে। কিন্তু বিমান বাবুর অনুপস্থিতিতেও সেদিন মৌমিতা দেবীর ফুলশয্যার অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছিল”!!

-“মাই গুডনেস”!!

-“আলমের বয়ান অনুযায়ী ফুলশয্যার রাত থেকেই বিমানের অনুপস্থিতিতে প্রতিদিনই মৌমিতা দেবী বিধায়ক সাহেবের হাতে ধর্ষিত হয়েছেন।

পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে থাকে বছর দেড়েক আগে বিধায়ক সাহেবের নতুন বডিগার্ড অমিত জয়েন করার পর থেকেই। এই অমিতের সাথে যেকোনো ভাবেই হোক অবৈধ এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন মৌমিতা দেবী।একটা সময় অমিত আর মৌমিতা দেবী বহরমপুরের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যানও করেন। কিন্তু ধীমান অধিকারী সেই পরিকল্পনার গন্ধ পেয়েই সজাগ হয়ে যান।আর কাকতলীয় ভাবে ঠিক যেদিন অমিত আর মৌমিতা দেবীর পালানোর প্ল্যান ছিল সেদিনই সুইসাইড করেন মৌমিতা দেবী।আর তারপর থেকেই অমিতেরও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি!আলম, সাবীর এদের সবারই ধারনা, ধীমান অধিকারী অমিতকেও মেরে পুঁতে দিয়েছিলেন কোথাও”!!

এরকম একটা ইন্টারেস্টিং ইনফরমেশনে উত্তেজনার বশে উজান নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে দাঁড়াল অরণ্যের সামনে। অরণ্যও স্যারকে দেখে উঠে দাঁড়াতেই ওর পিঠ চাপড়ে উজান বললো,

-“ব্রাভো অরণ্য,ব্রাভো!!সাংঘাতিক ইনফরমেশন জোগাড় করে এনেছো তো!!অন্তত তদন্ত শুরু করার একটা দিশা তো পাওয়া গেল”!!

-“আরও একটা ইন্টারেস্টিং ইনফরমেশন আছে স্যার”!!

-“আরে বলে ফেল”!!

ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে অরণ্য বললো,

-“মৌমিতা অধিকারীর সুইসাইড কেসটা মিলি বেশ কয়েকদিন ইনভেস্টিগেট করে ছিল‌। কিন্তু ফ্রুটফুল কিছু না পাওয়ায় কেসটা নিয়ে ওর আর এগোয়নি”।

-“মিলি”!!

।। ৮ ।।

-“তারপর আর কি!!নেতা মন্ত্রীদের পোষা লোকজন কি আর তাদের বিরুদ্ধে যাবে!!সব বেআইনি সুবিধা পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে যে!!তবে আমি কিন্তু এখনো হাল ছাড়িনি।কাল দুপুরে ধীমান অধিকারীর খুনের খবরটা পাওয়ার পরেই তোমার সাথে দেখা করার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু মায়ের শরীরটা একেবারেই ভালো ছিল না।তাই আর কথা বলা হয়ে ওঠেনি”!!

মৌমিতা অধিকারীর কেসটা ইনভেস্টিগেট করতে গিয়ে কি কি সমস্যায় পড়তে হয়েছিল সেই বর্ণনা দিতে দিতেই মিলি উজান আর অরণ্যের সাথে এসে পৌছাল এম.এল.এ হোস্টেলের ২/৫ রুমে।ঘরটা যদিও ঘটনার দিনই সিজ করে দেওয়া হয়েছিল।তাই একজন কনস্টেবল ঘরের সামনেই ডিউটিতে মোতায়েন করা হয়েছে। কনস্টেবল উজান আর অরণ্যকে দেখে ঘরটা খুলে দিল।

ঘরে ঢুকতেই একটা বাজে গন্ধ সবার নাকে ঝাপটা দিয়ে গেল। সেই গন্ধের প্রভাব কাটিয়ে, ঘরটাকে পুনরায় পর্যবেক্ষন করার তাগিদে তিনজনেই হাতে গ্লাভস লাগিয়ে কাজে লেগে পড়ল।

-“এই বিছানার উপরেই পাওয়া গিয়েছিল এম.এল.এ সাহেবের বডি”!!

হাতের ইশারায় ৬x৭ খাটটা মিলিকে দেখিয়ে বলে উঠলো অরণ্য।খাট বিছানা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে মিলি প্রশ্ন করল,

-“একটা কথা বলো উজান!! এরকম একটা জায়গা যেখানে নেতা-মন্ত্রী বা তাদের আত্মীয় স্বজনরা এসে থাকেন, সেখানে একটাও সিসিটিভি ক্যামেরা নেই”!!

মিলির প্রশ্নে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উজান জবাব দিলো,

-“ওখানেই তো কবি কেঁদে ফেলেছেন। রিসেন্টলি গোটা হোস্টেলেটারই রেনোভেশন হয়েছে। সিসিটিভি গুলো বহু পুরাতন হওয়ার কারণে মাঝে মাঝেই বিগড়ে যাচ্ছিল।তাই রেনোভেশনের বাহানায় সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোরও রিপ্লেসমেন্ট চলছিল”!!

-“তবে হোস্টেলের মেন গেটের সিসিটিভিটা সচল আছে”!!

উজানের বক্তব্যের সাথে নিজের কথাটাও যোগ করল অরণ্য।

-“সেটার ফুটেজ পাওয়া গেছে”!!

মিলির প্রশ্নের জবাবে উজান জবাব দেয়,

-“হ্যাঁ।তবে সেরকম কিছু পাওয়া যায়নি”!!

-“সেরকম কিছুই পাওয়া যায়নি মানে”!!

ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করল মিলি।

-“মানে মেন গেট ব্যবহার করে বাইরে থেকে সেরকম কারুর আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়নি”!!

-“মেন গেট ছাড়া আর অন্য কোনো এন্ট্রান্স আছে নাকি এখানকার”!!

-“ক্যান্টিনের পিছনে একটা দরজা আছে, রান্নাঘরে যাতায়াতের জন্য।তবে সেটা রাত আটটায় বন্ধ হয়ে যায়”!!

কোনো উত্তর না দিয়েই মিলি আবার নিজের কাজে মন দিলো। বেশ কিছুক্ষন ঘরটা ভালো করে খোঁজাখুঁজির পরেও কিছু না পেয়ে হতাশ মিলি উজানকে প্রশ্ন করলো,

-“সেদিন ভোরে যখন তোমরা খুনের খবর শুনে প্রথম এই ঘরে আসো,তখন ঠিক কি কি ঘটেছিল একটু ডিটেলে বলতো উজান”!!

নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে উজান বলতে থাকে,

-“সেদিন ভোররাতে মোটামুটি সাড়ে তিনটে নাগাদ আমরা এই ঘরে পৌঁছাই। সেইসময় ধীমান বাবুর মৃতদেহ বিছানার ওপর আড়াআড়িভাবে পড়েছিল।মুখ থেকে গ্যাজলা উঠে এসেছিল,চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার মতো অবস্থা ছিল।আর পাশের এই সোফাটায় মিসেস অধিকারী বিধ্বস্ত অবস্থায় বসেছিলেন। ওনার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছিল ওনাকেও ফিজিক্যালি অ্যাসল্ট করা হয়েছে। এরমধ্যেই দুজন লেডি কনস্টেবল ঘরে প্রবেশ করলে আলম ওনাদের বলে,
‘দিদিকেও মারধর করেছে ওরা। ওনার কিছু শারীরিক সমস্যাও আছে, তারমধ্যেই পেটে আঘাত পেয়েছেন। ওনাকে প্লিজ একটু ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করতে পারলে খুব ভালো হয়’।
এরপরেই আমরা মিসেস অধিকারীকে এস এস কে এমে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। কিন্তু মিসেস অধিকারী সোফা ছেড়ে উঠে দু পা যেতেই দুর্বল শরীরে টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে বসে পড়েন।তারপর আবার আমরা সবাই ওনাকে তুলে সোফায় বসালাম। জল টল খেয়ে খানিকক্ষণ পর উনি একটু সুস্থ বোধ করলে ওনাকে তখন আমাদের ভ্যানে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়”!!

উজানের মুখে সেদিন সকালের বর্ণনা শুনে সপ্রশ্ন চাহনিতে মিলি আবার প্রশ্ন করল,

-“আর কোনো কিছু দেখোনি!!আই মিন আনইউজুয়াল কিছু বা খুব নেগলেক্টেবল কিছু”!!

উজান অরণ্যের মুখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা ভেবে জবাব দিলো,

-“আনইউজুয়াল তো সেরকম কিছু দেখেছি বলে মনে পড়ছে না”!!

মিলি অরণ্যের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার একই প্রশ্ন করে,

-“তুই কিছু মনে করতে পারছিস”!!

খানিকটা মাথা চুলকে অরণ্য এবার জবাব দিলো,

-“আনইউজুয়াল কিছু দেখিনি।তবে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে মিসেস অধিকারী একবার বাথরুম গিয়েছিলেন।আলমের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি একটু বাথরুম যাব’। আলম ওনাকে সাহায্য করতে যাওয়ার আগেই যদিও লেডি কনস্টেবল ওনাকে ধরে বাথরুমে নিয়ে যায়”।

-“আলমকে বলেছিলেন বাথরুমে যাওয়ার কথা”!!

-“হ্যাঁ।আর একটা জিনিস আমার একটু আনইউজুয়াল লেগেছিল বটে। এই আলম তো ধীমান বাবুর সেক্রেটারি কাম পার্টির কর্মকর্তা। হিসেব মত মিসেস অধিকারীকে ওর ‘ম্যাডাম’ বলা উচিত, নিদেনপক্ষে ‘বৌদি’ বলা উচিত। কিন্তু আলম বরাবর মিসেস অধিকারীকে ‘দিদি’ সম্বোধন করছিল”!!

অরণ্যের কথা শেষ হতেই মিলি হন্তদন্ত হয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। উজান আর অরণ্যও বিনা বাক্যব্যয়ে ওর পিছু নিল। বেসিনের কল, বালতি, মগ, তোয়ালে এমনকি তাকে রাখা সাবান কেসটাও ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলো মিলি। কিন্তু কোথাও কোনো সুত্র খুঁজে না পেয়ে শেষে কমোডের ফ্ল্যাশের ঢাকনাটাও খুলে ফেললো। কিন্তু হতাশা ছাড়া আর কিছুই হাতে এলোনা ওদের।নিরাশ হয়ে বাথরুম থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎই মিলির চোখ পড়লো সাবান কেসের পাশে রাখা লরিয়্যাল প্যারিসের শ্যাম্পু আর কন্ডিশনারের দিকে।কি মনে হতে মিলি কন্ডিশনারের কৌটোর মুখটা খুলে ক্রিমের ভিতর হাত ঢুকিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করল। কিন্তু আবার হাতে এলো সেই হতাশা।তবে হতাশা ওদের গ্রাস করার আগেই অরণ্য বালতির মধ্যে রাখা মগটা মিলির সামনে ধরে বললো,

-“শ্যাম্পুটা এতে ঢেলে দেখ”!!

বিনা প্রশ্নে অরণ্যের কথা মতো মিলি প্রথমে মগে শ্যাম্পুটা পুরো ঢেলে নিলো। তারপর মগে হাত ঢুকিয়ে আবার পরীক্ষা করতে থাকলো মিলি।কয়েক মূহুর্ত পর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল মিলির ।শ্যাম্পুর ভিতর থেকে হাত বের করতেই ওর হাতে ছোট গোল একটা কিছু দেখতে পেল উজান আর অরণ্য।

-“কি এটা”!!

উজানের প্রশ্ন শুনে মুখে হাসিটা ঝুলিয়ে রেখেই বেসিনের দিকে এগিয়ে এসে কলের তলায় হাতটা রাখল মিলি।জলের তোড়ে মিলির হাত আর হাতে রাখা বস্তুটা পরিস্কার হয়ে যেতেই মিলি উজান আর অরণ্যের সামনে এক টুকরো মুক্তো তুলে ধরলো। বললো,

-“নাও, এই কেসের সবথেকে জরুরি সুরাগ”!!

উজানকে মুক্তটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিয়ে বললো,

-“খুব শিগগিরই অরণ্য কিন্তু তোমার ব্যবসা লাটে তুলবে মিলি”!!

মেকি দুঃখ প্রকাশ করে মিলিও উত্তর দিলো,

-“মা বলেছো। আমাকে মনে হচ্ছে এবার চাকরিই খুঁজতে হবে “!!

।। ৯ ।।

-“তুই যখন মিসেস মৌমিতা অধিকারীর কেসটা ইনভেস্টিগেট করতে আগেরবার বহরমপুর গিয়েছিলি,তখন ইন্দ্রানী অধিকারী বা আলম কারুর সাথে কথা হয়েছিল”!!

কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগর অবধি খারাপ রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে বেচারা ড্রাইভার সহ উজান, অরণ্য আর মিলির অবস্থা খারাপ।তাই প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে আর শরীরটাকে টানটান করে নেওয়ার জন্য গাড়ি দাঁড় করানো হল একটা চায়ের দোকান কাম রোড সাইড ধাবার সামনে।একটু ফ্রেশ হয়ে গরম চায়ের ভাঁড়ে প্রথম চুমুকটা দিয়ে অরণ্যের প্রশ্নের উত্তরে মিলি জবাব দেয়,

-“ইন্দ্রানী অধিকারীকে যাই প্রশ্ন করা হয়েছে তাতে একটাই জবাব দিয়েছিলেন,’আমি সেদিন বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম।তাই কি ঘটেছে,কেন ঘটেছে কিছুই বলতে পারব না’।
আর আলম!! বহরমপুরের ভাষায় বললে বলতে হয়,’কঠিন লোক’। ‘আমরা কিছু জানিনা’ এর বেশি একটা কথাও বের করতে পারিনি আগেরবার।
তবে ওই বাড়ির সব থেকে অদ্ভুত মানুষ হল বিমান অধিকারী। লোকটা কিরকম যেন একটা।ওর সুন্দরী বৌটা সুইসাইড করেছে, কিন্তু তাতে ওনার কোনোরকম বিকার নেই।মুখটা কেমন যেন ভাবলেশহীন।ইহ জগতের কোনো কিছুই যেন ওনাকে স্পর্শ করতে পারেনা”!!

মিলির কথা শেষ হতে, ওদের ড্রাইভার এগিয়ে এসে বলে,

-“স্যার বেলডাঙ্গা অবধি হাই ওয়েটা নতুন হয়েছে। একেবারে মাখন রাস্তা। কিন্তু তার পরের রাস্তাটা আবার খারাপ।এখনো প্রায় আড়াই ঘন্টার রাস্তা।এখন বেরিয়ে পড়লে তবু আলো থাকতে থাকতেই পৌঁছে যাওয়া যাবে”!!

ড্রাইভারের কথা মতো আবার সবাই গাড়িতে উঠে বসলে এবারে উজানের টি ইউ ভি নতুন হাইওয়েতে একশোর স্পিডে ছুটতে থাকে।বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে জানলার বাইরে তাকিয়ে কেসের পয়েন্টগুলো পরপর সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল মিলি। কিন্তু সব ফ্যাক্টগুলো পরপর সাজানোর চেষ্টায় বারবার ব্যর্থ মিলি এবার পাশে বসে একমনে ফোনে ব্যস্ত উজানকে বললো,

-“তোমার কাছে পোস্ট মর্টেমের রিপোর্টটা আছে”!!

মিলির প্রশ্ন শুনেও উজান কোনো প্রতিক্রিয়া না দিয়ে আগের মতোই ফোন ঘেঁটে চলেছে দেখে মিলি এবার উজানের ফোনটা কেড়ে নিতে যাওয়ার উপক্রম করলে, উজান নিজেই ফোনটা মিলির হাতে দিয়ে বললো,

-“টেকনোলজি ফর ম্যানকাইন্ড ম্যাডাম।এই নাও তোমার পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট”!!

উজানের ১৭ ইঞ্চি ফোন স্ক্রীনে ধীমান অধিকারীর পোস্ট মর্টেম রিপোর্টটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে মিলির চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। উজান আর অরণ্য মিলির এই অভিব্যক্তির সাথে ভালোই পরিচিত।

-“ধীমান অধিকারী কেন কলকাতায় এসেছিলেন”!!

-“গলব্লাডার অপারেশনের জন্য”!!

অরণ্যের উত্তরে মিলি ফোনটা অরণ্যের হাতে দিয়ে বললো,

-“কিন্তু পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট বলছে ধীমান অধিকারীর গলব্লাডারে কোনো স্টোনই ছিল না”!!

অরণ্য মিলির কথা শুনতে শুনতেই রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে ফোনটা উজানের হাতে দিয়ে বললো,

-“রিপোর্ট বলছে মিস্টার অধিকারীর সামান্য ফ্যাটি লিভারের সমস্যা আছে।দ্যাটস ইট”!!

-“এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমারা স্কিপ করে যাচ্ছিলাম!! নাহ্, মিলিকে কলকাতায় থাকতেই রিপোর্টটা দেখানো উচিত ছিল আমাদের”!!

উজানকে নড়েচড়ে বসতে দেখে মিলি বললো,

-“সবার আগে বহরমপুর পৌঁছে এই ডাক্তার মল্লিকের খোঁজ নিতে হবে। আর লালবাজারে ফোন করে পোস্ট মর্টেমের ভিডিওগ্রাফিটা মেল করতে বলো”!!

#ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here