রাজনীতির অন্তরালে, পর্ব:১

0
1572

#রাজনীতির_অন্তরালে
#তমসা_চক্রবর্তী

#পর্ব-১

।। ১ ।।

-উফ্, ঘুমটা জাঁকিয়ে বসেছিল একেবারে।আর একটু হলেই সব প্ল্যান চৌপাট হয়ে যেত।

মধ্যরাতে ঘুমটা ভাঙ্গতেই ধীমান বাবুর মাথায় কথাগুলো ঘুরপাক খেল একবার। কোনোমতে তন্দ্রা কাটিয়ে পাশ ফিরলেন ধীমান বাবু।প্রত্যাশা মতোই পাশে ইন্দ্রানী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।খাট থেকে নেমে সন্তর্পনে ঘরের ভেজানো দরজা খুলে পা টিপে টিপে সিঁড়ি ভেঙে ছাদের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন।বন্ধ দরজার ভিতর থেকে অমিত আর মৌয়ের ফিসফিসে গলার স্বর ভেসে আসছে।দরজায় কান পাততেই রক্ত হিম হয়ে এলো ধীমান বাবুর।

-“এবার কিন্তু তোমায় দাদার কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।এই নাটক, লুকোচুরি আর ভালো লাগছে না”!!

-“তুমি কেন ভুলে যাচ্ছো মৌ, দাদা একজন এম.এল.এ।ঠিক মতো পরিকল্পনা না করে তাড়াহুড়োর বশে যদি কোনো স্টেপ নিতে যাই, তাহলে কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে”!!

-“কিন্তু ওই লোকটাকে আমি আর সহ্য করতে পারছি না অমিত।প্লিজ কিছু একটা ব্যবস্থা করো”!

-“আমায় একটু সময় দাও মৌ। আমি সব সামলে নেব”!!

ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন ধীমান বাবু।এখনো নিজের কানকে ঠিকমতো বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না।যে মেয়েকে বছর তিনেক আগে এক ছাপোষা বাড়ি থেকে উঠিয়ে এনে এই বৈভবের জীবন দিয়েছিলেন, আজ সেই মেয়েই কিনা কাল নাগিনী হয়ে তার বিরুদ্ধে বিষ উগলে দিচ্ছে।

সন্তর্পনে ভেজানো দরজা খুলে পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকলেন ধীমান অধিকারী। বিছানায় ইন্দ্রানীকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে স্বস্তির শ্বাস নিয়ে, আবার নিজের জায়গায় শুয়ে পড়লেন। কিন্তু আর ঘুম এলোনা ওনার। মাথায় যে একটাই শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছে – ‘বিশ্বাসঘাতক’ ।।

।। ২ ।।

-“ব্যাপারটা প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন ম্যাডাম! আপনিই আমাদের শেষ ভরসা। কলকাতা শহরের হেন কোনো উকিল নেই তার দারস্থ আমরা হইনি। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে আমাদের কেসটা নিতে কেউই রাজি হচ্ছেন না”!!

কথা হচ্ছিলো মিলিদের ড্রইংরুমে বসে। সুধীর বাবু মানে মিলির বাবার এক অফিস কলিগের মেয়ে মৌমিতা কয়েকদিন আগে শ্বশুরবাড়িতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু মৌমিতার বাপের বাড়ির লোকেদের বদ্ধমূল ধারণা এটা আত্মহত্যা নয়। মৌমিতাকে কেউ পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। কিন্তু পুলিশ খুনের সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দিয়ে কোনো কেসই নিতে চাইছে না। তাই মৌমিতার বাবা সত্যনারায়ন পাত্রের বারংবার অনুরোধে সুবীর বাবু আজ ওনাদেরকে আহেলীর কাছে নিয়ে এসেছেন।

সত্যনারায়ন বাবুর বক্তব্য শোনার পর আহেলী অতি বিনয়ের সাথে বলেন,

-“দেখুন সত্যবাবু, আমি আপনার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনিও আমার দিকটা একটু বোঝার চেষ্টা করুন।
আপনি চাইলে আমি আপনার জন্য কোনো ভালো উকিলের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। কিন্তু আমার পক্ষে কেস লড়া সম্ভব নয়। আমাকে ক্ষমা করবেন “!!

-“কেন সম্ভব নয় মা!!কেসটা নিতে কিসের এত অসুবিধা তোমার”!!

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে মিলিকে ভস্মিভূত করে আহেলী দাঁত কিড়মিড়িয়ে জবাব দিলেন,

-“ওনারা না হয় আমার সম্পর্কে সেভাবে কিছু জানেন না, কিন্তু তোমার কাছে তো কোন কিছুই অজানা নয় মিলি”।

-“অজানা নয়,সেই জন্যই তো আজ প্রশ্নটা করলাম মা।তোমার যখন অ্যাক্সিডেন্টটা হয় তখন আমি অনেকটাই ছোটো,তাই ব্যাপারগুলো এত বুঝতাম না। কিন্তু এখন তো বুঝতে পারি মা।আর তাই যে মা, বরাবর আমাকে হার না মেনে লড়াই করতে শিখিয়ে গেছে, সেই মাকেই যখন দেখি সবার কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার ভয়ে সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে,তখন আমার খুব খারাপ লাগে মা। কোনদিনও তোমায় হয়ত বলিনি, কিন্তু তোমার এই সেচ্ছাবসর আমাকে আর বাপিকে শুধুই যন্ত্রনা দেয় মা। তোমার এই ‘সব ঠিক আছে’র মেকি হাসির আড়ালে লুকিয়ে রাখা ভাঙা স্বপ্নগুলো আমাদেরকেও বারংবার কাঁদিয়ে যায় মা।

আসলে কি বলতো, যে আহেলি গঙ্গোপাধ্যায় ওকালতির মোটামোটা বইগুলোর মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকতো, যে আহেলি গঙ্গোপাধ্যায় গায়ে কালো কোট চাপিয়ে কোর্টরুমের যুক্তিতর্কে বিরোধী পক্ষের উকিলের রাতের ঘুম উড়িয়ে দিত,যে আহেলি গঙ্গোপাধ্যায় অপরাধ প্রমান করার জন্য নিজের জীবনের পরোয়া না করে দুষ্কৃতীদের ডেরাতে পর্যন্ত হানা দিয়েছে,সেই আহেলী গঙ্গোপাধ্যায় গত দশবছর ধরে এই হুইল চেয়ারটাকেই নিজের জগৎ বানিয়ে ফেলেছে এটা ভাবতেই আমার ভীষন কষ্ট হয় জানোতো। প্লিজ মা, নিজেকে আর এইভাবে গুটিয়ে রেখে কষ্ট দিও না। তোমার মতো মুক্ত বিহঙ্গকে এইভাবে খাঁচায় বন্দি দেখলে আমাদের ভীষন কষ্ট হয় মা। নিজের জন্য না সই, অন্তত আমার জন্য একবার ওই কালো কোর্টটা গায়ে চাপিয়ে কোর্টে চলো মা”।

সবার থেকে বিশেষ করে মিলির কাছ থেকে এতগুলো বছর নিজের ভয়, যন্ত্রনা সবকিছু লুকিয়ে রাখার চেষ্টায় এক কঠিন বর্মের আড়ালে সব অনুভূতিগুলো লুকিয়ে নিয়েছিলেন আহেলী। সেই বর্মের পিছনে যে কি পরিমান হতাশা, দুঃখ আর ভয় জমে ছিল তার খবর আহেলী নিজের বাইরে আর কখনো কারুর কাছে প্রকাশ করেননি। তবে আজ কি হল তার!! কেন সেই কঠিন বর্ম মিলির কথায় একটু একটু করে নোনা স্বাদে চোখ ছাপিয়ে বরফের মত গলে পড়ছে!!মূহুর্ত খানেক চুপচাপ থাকার পর চোখের জল মুছে মিলির দিকে তাকালেন আহেলী। শান্ত গলায় বললেন,

-“শুধু কোর্টে গেলেই তো কেস লড়া যায় না মিলি।কেস লড়তে গেলে আরও অনেক রকমের কাজ করতে হয়।ক্রাইম সিন ইনভেস্টিগেট করতে হয়, সাসপেক্ট,সাক্ষী খুঁজতে হয়, এদিক ওদিক গিয়ে বিভিন্ন লোকের জবানবন্দি সংগ্রহ করতে হয়, আমার পক্ষে কি এসব সম্ভব মিলি”!!

-“আমি আছি তো মা! এই কেসে না হয় আমিই তোমার অ্যাসিস্টেন্ট থাকব।আর তারপর না হয় এক দুজন জুনিয়র রিক্রুট করো।কোনো অসুবিধা হবে না মা।আমাকে একটু বিশ্বাস করে শুরুটা করো”!!

মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরল মিলি। মিলির চোখে মায়ের প্রতি অগাধ আস্থা আর বিশ্বাসকে আজ আর আহেলী উপেক্ষা করতে পারল না।সত্যনারায়ন বাবু আর ওনার ছেলের উদ্দেশ্য বললেন,

-“আপনারা আমাকে কেসের ডিটেলসটা দিয়ে যান আজ। আমি দুটো দিন একটু পড়াশোনা করি, পুলিশের সাথে একটু কথা বলি, তারপর না হয় কেসটা প্রসেস করব।কেমন”!!

নিজের মেয়েকে ন্যায়বিচার দেওয়ার আশায় আহেলী গঙ্গোপাধ্যায়ের মত দুঁদে উকিলকে রাজি করাতে পেরে আপ্লুত সত্যনারায়ন পাত্র আর ওনার ছেলে করজোড়ে আহেলীকে বললেন,

-“আপনি যেমন ভালো বুঝবেন সেরকমই করবেন ম্যাডাম। শুধু আমার মেয়েটাকে যে পশুগুলো এমন নির্মমভাবে মেরে ফেলেছে তাদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করে দিন ম্যাডাম।।

।। ৩ ।।

রাত প্রায় তিনটে নাগাদ টেলিফোনের শব্দে ঝনঝনিয়ে উঠল অরণ্যের কেবিন।গত দু’সপ্তাহ টানা নাইট শিফট করতে করতে আজ রীতিমতো ক্লান্ত অরণ্য।তাই ফোনের ঝনঝনানিতে বেশ বিরক্তই বোধ করল। কোনমতে সোফা ছেড়ে উঠে ফোনটা ধরল।

-“ফোন তুলতে এত দেরি হয় কেন তোমার”!!

ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে গলার ঝাঁঝে বিরক্তি প্রকাশ করলেন কলকাতা পুলিশের হোমিসাইড স্কোয়াডের ডেপুটি কমিশনার সজ্ঞীব প্রধান।

-“আসলে ওয়াশ রুমে ছিলাম স্যার।তাই একটু দেরী হয়ে গেল ফোনটা তুলতে”!!

আমতা আমতা করে মিথ্যে কথাটা বলেই ফেললো অরণ্য।

-“যাকগে, ইমিডিয়েট ফোর্স নিয়ে বেড়িয়ে পড়ো।পার্কস্ট্রিট থানার ওসি লোকেশনে আছে ওনার সাথে কো-অর্ডিনেড করে নিও”!!

-“এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ছি স্যার। কিন্তু লোকেশনটা একজাক্টলি কোথায়”!!

-“ওহো্, দেখেছো!! এত ঝামেলার মধ্যে লোকেশনটা দিতেই ভুলে গেছি। তুমি টিম নিয়ে এম.এল.এ হোস্টেলে পৌঁছাও।ঠিকানাটা জানো তো!!না জানলে লিখে নাও।

2, Kyd St, Taltala, Kolkata, West Bengal 700016

এম.এল.এ হোস্টেল শুনেই অরণ্য আঁচ করতে পারল, যাই ঘটে থাকুক,সেটা হাই প্রোফাইল কেস।তাই আবার ঘুরিয়ে প্রধান সাহেবকে প্রশ্ন করল,

-“স্যার,কেসটা কি বলবেন একটু”!!

-“উফ্!!এত প্রশ্ন করো কেন বলতো! করিমপুরের এম.এল.এ, ধীমান অধিকারী, এম.এল.এ হোস্টেলের ২/৫ এ খুন হয়েছেন। নাউ নো মোর কোয়েশ্চেন। রান ফাস্ট”!!

ঠক করে ফোনটা রেখে দিলেন সজ্ঞীব প্রধান।এম. এল.এ খুনের খবর পেয়েই গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো অরণ্য।সব ক্লান্তিকে নিমেষে পকেট বন্দি করে ফোর্স সমেত রওনা দিল গন্তব্যের পথে।

।। ৪ ।।

এম.এল.এ হোস্টেলের সামনে সাংবাদিকের ভিড়ভাট্টা সামলে যখন কোনমতে বছর তিরিশের শোকস্তব্ধ সদ্য-স্বামীহারাকে গেটের বাইরে দাঁড় করানো পুলিশ ভ্যানে তুলে উদ্ধার করে নিয়ে গেলেন দুজন লেডি কনস্টেবল, ঘড়ির কাঁটা তখন পাঁচটার চৌকাঠ পেরিয়ে গেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় নির্বাক মহিলা তখন প্রায় চলচ্ছক্তিহীন।

এম.এল.এ হোস্টেলের সামনে ঘন্টা খানেক আগে পৌছানো প্রধান সাহেব আর উজানকে নিজেদের মধ্যে কথপোকথনে ব্যস্ত দেখে অরণ্য আর ওদের দিকে না এগিয়ে ২/৫ রুমের দিকেই আবার পা বাড়াল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতেই কাজের লিস্টটা একবার নিজের মাথায় ঝালিয়ে নিল অরণ্য।স্কেচ ম্যাপ বানাতে হবে, হোস্টেলের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্তের জন্য জরুরি প্রাথমিক তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে হবে,যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছু জিনিসপত্র ফরেনসিক টেস্টে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে , সিজার লিস্টের লেখালেখি বাকি। নাহ্, এখনো অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে।তবে সবার আগে ডেডবডি ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো দরকার।হাই প্রোফাইল কেস।বডি সকাল সকাল পাঠালে হয়ত ময়নাতদন্তের রিপোর্টটা সন্ধ্যের মধ্যেই হাতে চলে আসবে।

-“অরণ্য”!!

পিছন থেকে উজানের গলা পেয়ে থমকে দাঁড়ালো অরণ্য।

-“কি ব্যাপার বলতো!! দুদিন ধরে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো “!!

-“কি যে বলেন স্যার।আসলে, দু’সপ্তাহ টানা নাইট শিফট চলছে।আর শরীর দিচ্ছে না।তাই গত দু’দিন আপনি সকালের শিফটে জয়েন করলেই,আমি আর কোনদিকে না তাকিয়েই বেরিয়ে পড়ছিলাম”!!

অরণ্যের জবাবে, উজান হাত রাখলো ওর কাঁধে।

-“এক কাজ করো।তুমি এখনই বাড়ি চলে যাও”।

অবাক হয়ে উজানের মুখের দিকে তাকাল অরণ্য।

-“কি বলছেন স্যার!! এরকম হাই প্রোফাইল কেসের প্রাথমিক তদন্ত ছেড়ে দিয়ে আমি বাড়ি চলে যাব!! তারপর প্রধান সাহেব আমাকে আস্ত রাখবে ভাবছেন”!!

-“যেটা বললাম সেটাই করো।বাড়ি যাও।রেস্ট নিয়ে সন্ধ্যেবেলায় আবার ডিউটি জয়েন করো।ইটস অ্যান অর্ডার”!!

-“কিন্তু স্যার”!!

-“আর কোনো কিন্তু নয়।এদিকের বাকি ফরম্যালিটিস আমি পার্কস্ট্রীট থানার ওসিকে দিয়ে সালটে নেব। তুমি বাড়ি যাও”!

এরপরেও অরণ্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উজান আবার বলে,

-“শরীর আর মন ঠিক না থাকলে কিন্তু মস্তিষ্ক ঠিকমত কাজ করবে না অরণ্য।আর এই দুর্বল শরীর আর মস্তিষ্ক নিয়ে এরকম হাই প্রোফাইল কেসের তদন্ত করতে পারবে না কিন্তু!!
তাই বলছি, এখন বাড়ি গিয়ে রেস্ট নাও।আর অদূর ভবিষ্যতে যে আরও কতগুলো বিনিদ্র রজনী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভগবানই জানেন”!!

।। ৫ ।।

লালবাজারে উজানের চেম্বারে বসানো হয়েছে প্রয়াত এম.এল.এ ধীমান অধিকারীর স্ত্রী ইন্দ্রানী অধিকারীকে।সকালে এম.এল.এ হোস্টেল থেকে ইন্দ্রানী দেবীকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় এস.এস.কে.এমে। সেখান থেকেই দুপুরে ওনাকে লালাবাজারে নিয়ে আসা হয়েছে। ধীমান বাবুর মৃত্যুর একমাত্র সাক্ষী ওনার স্ত্রী ইন্দ্রানী দেবীর জবানবন্দি এই কেসে সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ইতিমধ্যেই সন্ধ্যে অবধি অপেক্ষা না করেই অরণ্যও শেষ দুপুরে আবার ডিউটি জয়েন করেছে। উজান আর অরণ্য যথাসাধ্য সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন মহিলাকে। প্রধান সাহেব স্বয়ং উপস্থিত হয়েছেন প্রশ্ন উত্তর পর্বের জন্য। অনেক সাধ্যসাধনার পর বিধ্বস্ত ইন্দ্রানী দেবীর মুখ থেকে একটাই কথা বের হলো,

-“আমি যে একেবারে একা হয়ে গেলাম”।

অরণ্য আর উজান নিজেদের মধ্যে একবার মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। প্রধান সাহেব খুব শান্ত গলায় ইন্দ্রানী দেবীকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললেন,

-“একটু শান্ত হন ম্যাডাম। আমাদের বিস্তারিত ভাবে সবটা বলুন প্লিজ”!!

একটু ধাতস্থ হওয়ার পর ইন্দ্রানী দেবী কাঁপা গলায় বলতে থাকেন,

– “কলকাতায় এলে কিড স্ট্রিটের এম.এল.এ হস্টেলেই উঠি আমরা। গত মাসের প্রথমদিকে মাঝে মাঝেই পেটে ব্যাথার কারনে বহরমপুরেই একজন ডাক্তার দেখান ধীমান বাবু।সেই ডাক্তার কিছু টেস্টের পর বলেন,ওনার গলব্লাডারে স্টোন হয়েছে। তারপর সেই ডাক্তারবাবুর রেফারেন্সেই আমরা কাল কলকাতায় আসি। ওঁর চিকিৎসার প্রয়োজনেই। উঠেছিলাম তিনতলার রুম নম্বর ২/৫-এ।
আজ সকালেই সল্টলেক আমরিতে ওঁনার অ্যাপন্টমেন্টও ছিল।আসলে উনি চেয়েছিলেন, সামনের মাসের গনমিছিলের আগেই সুস্থ হয়ে উঠতে।তাই এবারেই অপারেশন করিয়ে নেওয়ার সবরকম ব্যবস্থা করেন।
কাল আমরা কলকাতায় পৌঁছাই বিকেল চারটে নাগাদ। আমাদের সাথে ধীমান বাবুর বডিগার্ড সাবীর আর পার্টির একজন সর্বক্ষনের কর্মকর্তা আলমও আসেন।ওরা দুজন দোতলার ১/৭ রুমে উঠেছিলেন। বহরমপুর থেকে গাড়িতে এতটা পথ আসার ধকলের কারণে আমরা সবাই বেশ ক্লান্তও ছিলাম কাল।তাই রাত্রি নটার মধ্যেই খেয়ে দেয়ে আমি আর ধীমান বাবু শুয়ে যাই।
এরপর আমর ঘুম ভাঙে দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ শুনে।পাশে রাখা মোবাইলে দেখলাম রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। পাশ ফিরে দেখলাম, ধীমান বাবুরও সেই আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেছে।

উনি বললেন, ‘খুলে দাও। মনে হয় আলম এসেছে।কিছু দরকার আছে হয়তো’।

ওনার কথা শুনে আমি দরজা খুলে দিলাম। দরজা খুলতেই সামনে থেকে একজন আমার মুখ চেপে ধরল। তখনই দেখলাম, আরও একজন লোক আছে ওই লোকটার সঙ্গে। দুজনের হাতেই পিস্তল। একজন আমার গলায় সেটা ঠেকিয়ে মুখচাপা দিয়ে, খাটের উপর পড়ে থাকা আমার ওর্না আর চাদর দিয়েই আমার হাত-পা বাঁধল । তারপর টেনে হিজরে আমাকে বাথরুমের সামনে নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখল। আমি তখন ভয়ে প্রায় আধমরা। ইতিমধ্যেই একজন আমাকে শাসিয়ে গেল,’শব্দ করলে জানে মেরে দেবে’।

এরপরেই যে শাড়িটা পড়ে আমি কলকাতায় এসেছিলাম সেটাই সুটকেসের ওপর থেকে তুলে নিয়ে ধীমান বাবুর গলায় পেঁচিয়ে ধরল। আমি চিৎকার করতে গেলে একজন সজোরে আমার পেটে লাথি মেরে আমার মুখ চেপে ধরল। আর একইসাথে অকথ্য ভাষায় বলে উঠলো, ‘শালী হারামজাদী,আর একটাও আওয়াজ শুনলে বরটার সাথে তোকেও খতম করে দেব’।

এরপরেই আমার মুখটাও বেঁধে দেয় ওই লোকটা।
আমার চোখের সামনেই তখন ছটফট করছিলেন ধীমান বাবু।আমি চেষ্টা করেও ওনাকে কোনরকম সাহায্য করতে পারছিলাম না।চোখের সামনে ধীমান বাবুকে আর ওইভাবে ছটপট করতে দেখতে পারছিলাম না। এরপরেই আমি ধীরে ধীরে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ি।

তবে জ্ঞান হারানোর আগে মনে হচ্ছিল অনেক দূর থেকে ওরা বলছে, ‘মিটিং মিছিলটা এবার উপরে গিয়েই করো ধীমান অধিকারী’! এরপর আর কিছুই আমার মনে নেই অফিসার।

একটানা এতক্ষণ কথা বলে হাঁপাচ্ছিলেন ইন্দ্রানী দেবী। টেবিলে রাখা জলের গ্লাস ওনার দিকে এগিয়ে দিয়ে উজান আবার প্রশ্ন করল,

-“এরপর আপনার জ্ঞান ফিরল কখন”!!

গ্লাসের জলটা এক চুমুকে শেষ করে ইন্দ্রানী দেবী বললেন,

-“আমার জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম সাবীর আর আলম আমার চোখে মুখে জল ছিটাছে। আমাকে চোখ খুলতে দেখেই ওরা তড়িঘড়ি আমার আমার বাঁধন খুলে দিয়ে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসায়। তখনই বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখি মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা ওঠা অবস্থায় ধীমান বাবুর নিথর দেহটা বিছানায় পড়ে আছে।

আমাকে ওনার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ছলছল চোখে আলম বলল, ‘দাদা আর নেই’।

প্রায় পুরো ঘটনাটাই আমার চোখের সামনে ঘটে স্যার। কিন্তু নিঃশব্দে নিজের স্বামীকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলাম না স্যার।

ফের কেঁদে ফেললেন ইন্দ্রানী দেবী। ওনার বয়ানের শেষে প্রধান সাহেব নিজের চেয়ের ছেড়ে ইন্দ্রানী দেবীর সামনে এসে সমবেদনা জানিয়ে বললেন,

– “আপনার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন ম্যাডাম।তবে কথা দিচ্ছি, আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব যাতে খুব তাড়াতাড়িই খুনিরা ধরা পড়ে”।

#ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here