রজনীগন্ধা, পর্ব:১৩

0
877

রজনীগন্ধা – ১৩
অলিন্দ্রিয়া রুহি

সকালটা শুরু হলো ঝলমলে রোদের লুটোপুটি খেলার মাধ্যমে। যেদিকে তাকানো যায়, চোখ ধাধানো রোদ। ঘরের মেঝে চিকচিক করছে। রোদ দেখে রজনী সময়টা আন্দাজ করল- নয়টার এদিক ওদিক। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল বিছানায়। গতকালকের কথা মনে পড়তেই ঠোঁট ভেঙে হাসিরা উঁকি দিয়ে উঠল। আদ্র নামক সাইক্লোনের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যেই অজ্ঞান হবার ভান ধরেছিল সে। নইলে কাল কী কী ঘটতো! কে জানে। তবুও রক্ষা পুরোপুরি হয়নি। নিজের কপালে আদ্র সাহেবের ঠোঁটের স্পর্শ লেপ্টে রয়েছে এখনো। হাতের উল্টোপাশেও ওষ্ঠদ্বয়ের ছোঁয়া… যখন পাজাকোলে করে নিলো আদ্র, তখন শ্বাস সত্যিকার অর্থেই আঁটকে আসছিল বারংবার। চোখ জোড়া না চাইতেও বার বার খুলে যেতে চাচ্ছিল। অনেক জোরের মাধ্যমে চোখের পাতা এঁটে ধরেছিল সে। যখন তাকে বিছানায় শুইয়ে আদ্র সাহেব বেরিয়ে গেল, তখন গিয়ে বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসলো স্বস্তির নিঃশ্বাস। সেই সঙ্গে অধর জোড়ায় মেতে উঠল এক ঝাঁক হুটোপুটি করা হাসি…

চুলগুলো আঙুলের মাধ্যমে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে এলোমেলো হাত খোঁপা বেধে নেমে পড়ল বিছানা ছেড়ে। বিছানা ঝেড়ে তোয়ালে হাতে ঢুকে গেল বাথরুমে ফ্রেশ হওয়ার জন্য।

নীল ব্ল্যাংকেটের ভেতর গুটিশুটি মেরে ঘুমে তলানো অর্থি। রজনী দরজা ঠেলে তাকে এ-অবস্থায় দেখে নিঃশব্দে হাসলো। মেয়েটার প্রচুর ঘুম… চাইলে সারাদিনও ঘুমোতে পারবে। এত ঘুমায় বলেই বোধহয় তার চোখেমুখে দারুণ ফোলা ফোলা একটি ভাব আছে,যেটি তাকে আরও কিউট করে তোলে। রজনী পা টিপে টিপে বিছানার কাছে গেল। অর্থির মাথার সামনে বসে ঝুঁকে তাকাল সে। ঘাড় সমান চুলগুলোয় বিলি কাটতে কাটতে আদুরে গলায় ডেকে উঠল,
-অর্থি… মামনী আমার। উঠো মা, সকাল হয়ে গেছে। সূর্য মামা অনেক আগে উঠে জেগে বসে আছে। কাল রাতেও ঠিকঠাক খাওনি। এখনো না খেয়ে ঘুমালে চলবে? শরীর খারাপ করবে না? উঠো মা… অর্থি…

অর্থির ফোলা গাল দুটোতে হাতের ছোঁয়া লাগাতেই নড়েচড়ে উঠল অর্থি। পিটপিট করে চোখ জোড়া মেলে রজনীকে দেখতে পেয়ে ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করল। তারপর আবার ঘুমের দেশে পাড়ি জমাতে চাইলো। রজনী আলতো হাতে অর্থির গাল জোড়া টিপে দিয়ে বলল,
-একদম না। মাইর দিব কিন্তু। উঠো… খালি ঘুম আর ঘুম! এত ঘুমালে শরীর খারাপ করবে তো।

-ননা মা… ফাইভ মিনিটস। প্লিজ…

আহ্লাদী কণ্ঠটা নাড়িয়ে আবদার করল অর্থি। রজনীর কী যে ভালো লাগলো বুকের মাঝটায়। এই পরীর মতো মেয়েটা তার… শুধুই তার। অর্থিকে বুকের মধ্যে তুলে নিলো রজনী। শরীরের উষ্ণ ওম পেয়ে অর্থিও কবুতরের বাচ্চার মতো গুটিশুটি মেরে ঢুকে গেল আরও। দু-হাতে রজনীকে জাপটে ধরে ঘুম পূরণ করল। তারপর একসময় নিজেই উঠে বসল।

-গুড মর্নিং ননা মা..

-শুভ সকাল মা। উঠো এবার.. ফ্রেশ হয়ে আসো যাও। বিছানাটা গুছিয়ে দেই।

-এসব কাজ করার জন্য অন্যরা আছে তো।

-তুমি বুঝবে না… সন্তানের সব কাজ নিজ হাতে করার মাঝে আলাদাই ভালোবাসা বিদ্যমান অর্থি।

অর্থি কথা বাড়ালো না। ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো। রজনী দ্রুততার সঙ্গে বিছানা গুছিয়ে অর্থিকে রেডি করিয়ে নিচে নেমে এলো। মা-মেয়েকে নিচে নামতে দেখে পিঠ সোজা করে বসল আদ্র। রজনীর উপর মেকী অভিমান জমেছে… তার জন্য শতশত মেয়ে মরে, আর এই মেয়ে কী-না নায়কের মন নিয়ে খেলছে! আদ্র যে মারা যাচ্ছে, তা দেখেও একটু দয়া-মায়া হয় না? আসলেই হয় না… পাষাণ রজনী।
আদ্র বিড়বিড় করে বলল,
-মেয়ে মানুষ এত কাঠখোট্টা হয়!!

-কী বলছেন আপনি?

রজনীর তীক্ষ্ণ চাহনি অতিক্রম করে ব্রেডে মাখন মাখানো শুরু করল আদ্র। জবাব দিল না দেখে রজনীর কপাল কুঁচকে গেল। একটা ব্রেডে মাখন মাখিয়ে অর্থির হাতে তুলে দিয়ে রজনী আবার প্রশ্ন করল,
-কী বলছিলেন? বললেন না।

জবাব দিলো না আদ্র। যেন শোনেইনি রজনীর কথা… সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার চেষ্টা। কোঁচকানো কপাল আরও কুঁকড়ে গেল। সেই সঙ্গে কুঁচকে এলো ঘন ভ্রু-যুগল। অর্থি তার পাপার দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে রজনীর মুখের দিকে তাকাল। রজনীর চোখমুখে আঁধার নেমেছে… একে তো আদ্র সাহেবকে ভুল করা থেকে বাঁচিয়ে দিল সে, আবার তাকেই রাগ দেখানো হচ্ছে! পাঠার ঘরের পাঠা! বলি দেব তোকে… মনে মনে বলে উঠল রজনী।

খাওয়া দাওয়ার পর্বটা একপ্রকার নিশ্চুপতার মাঝেই শেষ হলো। ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে গেল আদ্র। অর্থিরও খাওয়া শেষ তবু সে বসে আছে টেবিলে, রজনী তখনো খাচ্ছে।

-ননা মা, পাপা অভিমান করেছে।

রজনী চোখ তুলে তাকাল।
-তুমি কীভাবে বুঝলে?

-ওই যে, তোমার প্রশ্নের কোনো জবাব দিচ্ছিলো না যে। পাপা যখন রাগ করে, তখন সে একটা কথার জায়গায় তিনটে কথা শোনায় আর অনেক উচ্চ মেজাজে থাকে। আর যদি অভিমান করে,তখন কথাই বলে না। নিজেকে গুটিয়ে নেয়।

চেপে রাখা তপ্ত নিঃশ্বাসটা ফোঁস করে বেরিয়ে এলো বুক চিঁড়ে। মহাশয় তবে অভিমান করেছে? এখন এর অভিমান কী করে ভাঙাবে রজনী?

-অর্থি, তোমার পাপার অভিমান কীভাবে ভাঙানো যায়, বলো তো।

অর্থি মুচকি হেসে বলল,
-সেটা তুমিই খোঁজো ননা মা। আমি জানি না…

চোখ ছোট ছোট করে তাকাল রজনী। অর্থির ঠোঁট জুড়ে পৈশাচিক হাসি। কী দুষ্টু! হুহ! ভাবনায় পড়ে গেল রজনী। আদ্র বাবুর অভিমান ভাঙাতেই হবে এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, কিন্তু…
আদ্র বাবুর অবহেলা রজনীর হৃদপিণ্ডটা তলোয়ারের তীক্ষ্ণ ফলার মতো এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয় যে! ভাবুক রজনীর উদ্বেগ দেখেই মায়া হলো অর্থির। সে চেয়ার ছেড়ে নেমে দাঁড়িয়ে বলল,
-পাপা মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসে ননা মা…

সজোরে সিলভারের পাতিলটা ঝনঝন আওয়াজ তুলে মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে থেমে গেল। ভস্মীভূত চাহনি নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো অভি। এক কোণায় দাঁড়িয়ে রাগে ফোঁসফোঁস করতে থাকা দোলার চেহারাটা দেখে নিয়ে বলল,
-সমস্যা কী? সব কিছু ভেঙে ফেলতেছো কেন? এগুলা কী তোমার টাকার জিনিস?

-না আমার বাপের টাকার জিনিস। আমি ভাঙতেছি। মন চাইলে আরও ভাঙবো। তোমার সমস্যা কী? তুমি জিজ্ঞেস করার কে?

মেজাজ চড়লেও নিজেকে সংযত রাখলো অভি। দোলার থেকে সম্মান পাওয়া- স্বপ্ন দেখার মতো। আলাদা হওয়ার পর থেকে দোলা যেন আরও তেজী হয়ে উঠেছে। যখন যা বলবে, তাই করবে। না করতে দিলেই ভাঙচুর, চিৎকার-চেঁচামেচি, কান্নাকাটি করে একাকার করে দেয়। তাদের ফ্ল্যাটের মুখ বরাবর আরেকটি ফ্ল্যাট আছে। সেটি বাড়ি ওয়ালার। এই ক’দিনে দুইবার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়ে গেছে উনার। এভাবে চিল্লাপাল্লা করলে ভদ্র সমাজে থাকা যাবে না। দ্রুত বাড়ি ছাড়তে হবে।

আজকের চিল্লাচিল্লির উৎস হলো রজনী। রজনীকে টিভিতে দেখার পর নিজে থেকে অনেক কিছুই খোঁজ খবর নিয়েছে অভি। জানতে পেরেছে, সে বিখ্যাত সুপারস্টার আদ্র মেশতাকের বাসায় থাকছে এবং আদ্র মেশতাক তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন। ব্যাপারটায় প্রচন্ড অবাক হয়েছে অভি। রীতিমতো শক খেয়েছে সে। আদ্র মেশতাকের মতো এতবড় ফিল্মস্টার ওর মতোন সাধারণ একটা মেয়েকে কী দেখে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন কে জানে! ব্যাপারটা অভির মাথার মধ্যে তুমুল হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। দুপুরে খেতে বসে দোলার রান্না করা অখাদ্য শিমের তরকারি নাকমুখ কুঁচকে খেতে খেতে অভি শুধু বলেছিল,
-তোমার কী কোনোদিকেই ঠিকঠাক যোগ্যতাটা নাই? রজনী কত ভালো রানতো, জানো? ও অত বেশি সুন্দর না হলেও ওর যোগ্যতার কারণেই আদ্র মেশতাকের মতোন একজন বিয়ের প্রস্তাব দিছে। রজনী তো টপে উইঠা গেল। বড়লোক হয়ে যাইবো।

ব্যস, তারপর থেকেই শুরু চিৎকার চেঁচামেচি। অভির সামনে থেকে ভাতের প্লেটটাও টেনে নিয়েছে দোলা। রান্নাঘরে গিয়ে প্লেটটা ঝুড়ির মধ্যে ফেলে দিয়ে তরকারিসহ তরকারির পাতিলটা আছাড় মেরেছে সে। দোলা গজগজ করে চলেছে। তাকে কিছুই বলা যায় না। সব কথায় তার বাবার দেওয়া জিনিসপত্র আর টাকার ব্যাপারটা তুলবেই তুলবে…
বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে অভি দরজা খুলে বাইরে বেরোলো। অজান্তেই চোখ দুটো ঘোলা হয়ে উঠছে। রজনীর কথা খুব বেশিই মনে পড়ছে। রজনীকে ফিরে পাওয়ার আর কোনো উপায় আছে কী??

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here