রঙ বেরঙের জীবন পর্ব ৯

0
314

#রঙ_বেরঙের_জীবন
পর্ব (৯)
#নুশরাত_জাহান_মিষ্টি

গল্পের ফাঁকে শান্ত এবং রুপমের বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পুরোপুরি বন্ধুত্ব না হলেও কিছুটা বন্ধু হয়ে উঠেছে। সবাই গল্প করছিলো তার ফাঁকে রাত্রী এবং রুপম অন্যদিকে চলে গেলো। লোকজনের ভিড় নেই এমন একটা স্থানে গিয়ে দাঁড়ালো রাত্রী এবং রুপম। রাত্রী কৌতুহলী দৃষ্টিতে রুপমের মুখশ্রীতে তাকাতেই রুপম বললো,” পলাশের সাথে ছোটকালে আমার বন্ধুত্ব ছিলো। তোমার জন্য সেই বন্ধুত্বের দোহাই দিয়া ওর বইনের বিয়ার দাওয়াত নিলাম”।
রাত্রী এবার রুপমের আগমনের ব্যাপারটা বুঝলো। মনেমনে হাঁসলো। রুপম মিষ্টি হেঁসে বললো,” তোমারে বিরহ দহনে না পোড়ানোর জন্য আমারে কি দিবা”?
রাত্রী ভ্রু কুচকে বললো,” আমি কখন বললাম আমি বিরহ দহনে পুড়ছি, তুমি আমার কাছে চলে আসো”।
রুপম মুখে হাঁসি ধরে রেখে বললো,” মুখের ভাষা যে কেউ বুঝে, চোখের ভাষা বুঝতে যে পারে সে বিশেষ কেউ”।
একটু থেমে পুনরায় বললো, ” সে প্রিয় থেকেও প্রিয়জন”।
রাত্রী এবার রুপমের সামনেই মুচকি হাঁসলো। রুপম নিজের পকেট থেকে একটি কালো গোলাপ বের করে মাথার খোঁপায় গুঁজে দিলো। রুপমের হাত রাত্রীর মাথা স্পর্শ করতেই রাত্রী বেশ চমকে উঠলো। রুপম ফুলটি গুঁজে হাত সরিয়ে নিলো। রাত্রীর মুখশ্রীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে মুচকি হেঁসে বললো,” জানো তোমার মাথায় কি গুঁজলাম”?
রাত্রী মুখে হাঁসি ধরে রেখে বললো,” গোলাপ”।

” কোন রঙের”?
রাত্রী রুপমকে চমকে দিয়ে প্রথমবারের মতো রুপমের মনের কথা পড়তে পারলো এবং বললো,” কালো গোলাপ। বেদনার রঙ কালো। আমার রুপের ভাষ্যমতে বেদনা বেদনারে দেখে পালিয়ে যাবে, তাই কালো গোলাপ যাতে রাতের কাছে বেদনা এসে এই বেদনারে দেখে পালিয়ে যায়”।
রুপম তার ভুবন ভোলানো হাঁসিটা দিয়ে বললো,” হ তয় আরো একটা কারন আছে”।
” আর কি কারন”?

রুপম দু’ পা পিছনে এগিয়ে গেলো তারপর শান্ত কন্ঠে বললো,” লোকের নজর এড়াইতে আমাগো দাদা-দাদী কালো টিকা দিতো, আমি তোমারে কালো গোলাপ দিলাম। যাতে কম প্রেমিকের মন ভাঙে”।
একটু থেমে পুনরায় বললো, ” বেশি প্রেমিকের মন ভাঙলে শেষে দেহা যাইবো আমাগো সংসার তাগো চোখের জলে ভেঁসে যাচ্ছে”।
রাত্রী খিলখিলিয়ে হেঁসে দিলো। রাত্রীর দেখাদেখি রুপমও হেঁসে দিলো। বিয়ে বাড়ি লোকজন মোটামুটি কম নয় তাই রুপ বললো,” বেশিক্ষন এহানে থাকা ঠিক হইবো না”।
রাত্রী সম্মতি জানিয়ে বললো,” হ্যাঁ চলো”।
রুপ এবং রাত দু’জন দু’দিকে চলে গেলো। রাত্রী যেতেই কোথা থেকে জানো শান্ত এসে তার সামনে দাঁড়ালো। শান্ত রাত্রীর মুখশ্রী থেকে নজর সরিয়ে তার মাথায় নজর দিলো। বেশ কিছুক্ষন কালো গোলাপটি দেখে বললো,” কালো কেশে কালো গোলাপ বড্ড বেমানান। তবে এই রুপে কালো গোলাপ প্রয়োজন”।

প্রথম বাক্যটি বুঝলেও দ্বিতীয় বাক্যটি রাত্রীর বোধগম্য হলো। তাই জিজ্ঞেস করলো,” মানে”?
শান্ত হাঁসি দিয়ে বললো,” এ রুপে নজর টিকার প্রয়োজন ছিলো যাতে কারো নজর না লেগে যায়। টিকা হিসাবে গোলাপটি কাজ করলো, সেটাই বললাম”।
রাত্রী বেশ চমকালো। রুপের কালো গোলাপ দেওয়ার উদ্দেশ্য আর শান্তর অভিমত মিলে গেলো কিভাবে! শান্তকে নিয়ে ভাবতে চায় না রাত্রী তাই চুপচাপ পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। রাত্রীর চলে যাওয়ার দিকে দৃষ্টি রেখে শান্ত হাঁসলো। হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ অনুভব করতে পেরে শান্ত ঘুরে তাকালো। পলাশকে দেখে ভ্রু কুচকে তাকালো। পলাশ বেশ শান্তভাবে বললো,” সৌন্দর্যে ডুবতে নেই শান্ত। সৌন্দর্য তোকে অতল সাগরে এমনভাবে নিয়ে যাবে যে সেখান থেকে চাইলেও বের হতে পারবি না। পরিশেষে শুধুই যন্ত্রণা”।
শান্ত স্বাভাবিকভাবে বললো,” তুই কি তোর জন্মদাতার জীবন থেকে বললি”?
পলাশ আকাশের দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” যদি বলি তাই। আমার আব্বা সৌন্দর্যের পিছনে ছুটে জীবনটা নরক করে ফেলেছে। তাই তো আজ আব্বা, আম্মা শুধু সমাজের বাধ্যবাধকতায় এক হয়ে আছে। যেখানে মনের কোন টান নেই”।
” সৌন্দর্যকে ঘৃণা করিস বলেই সাথীর ভালোবাসা বুঝেও না বোঝার ভান ধরে থাকিস তাই তো”?
পলাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,” সাথীর কথা বাদ দে”।
” আচ্ছা বাদ দিলাম। তোর কথাটাই তবে তোকে বলি”?
” মানে”?

শান্ত বেশ স্বাভাবিকভাবে বললো,” সৌন্দর্য কিন্তু নিজ থেকে তোর আব্বার জীবনে আসেনি বরং তোর আব্বা সৌন্দর্যের কাছে গিয়েছিলো। সৌন্দর্য তাকে ধোঁকা দেয়নি, তিনি সৌন্দর্য ধোঁকা দিয়েছিলেন”।
পলাশ বেশ রেগে গেলো। রাগান্বিত কন্ঠে বললো,” তারমানে রাইমার কোন দোষ ছিলো না সেটাই বলছি চাইছিস তুই”?
পলাশ রেগে গেছে সেটা বুঝতে পারলো শান্ত। শান্ত মনেমনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” মাথা ঠান্ডা রেখে ভেবে দেখ৷ সত্যি কি তার কোন ভুল ছিলো”?

একটু থেমে শান্ত পুনরায় বললো,” হ্যাঁ তার ভুল ছিলো, ভালোবাসাকে সবার আড়ালে পূর্ণতা দেওয়াটা ভুল ছিলো”।
শান্ত পলাশের চোখে চোখ রাখলো এবার। খুব কঠিনভাবে বললো,” ভালোবাসার গল্পে এতটুকু ভুল কি সত্যি ভুল? ভুল মানুষের হতেই পারে কিন্তু জেনেশুনে মানুষ যেটা করে সেটাকে ভুল নয় অপরাধ বলে। যেটা তোরা করছিস রাতের সাথে। রাত সেই মেয়েটা যে জানেই না তার ভুল কি অথচ তোদের অবহেলাকে আপন করে নিচ্ছে”?
শান্ত চলে যেতে নিলো। পলাশ পিছন থেকে বললো,” তোর ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে না শান্ত”।
শান্ত পিছন ঘুরে তাকালো তারপর মুচকি হেঁসে বললো,” ভাগ্যে থাকলে হবে”।
শান্ত চলে গেলো। পলাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনেমনে বললো,” তোর রাতের জীবনে পূর্বে আসা উচিত ছিলো শান্ত। রাত তো জানেই না শান্ত তার জন্যই এসেছে এখানে”।
পলাশ বিভিন্ন ভাবনার মাঝে ডুবে গেলো।

______
সকাল থেকে বিয়ের আমেজে পুরো বাড়ি মেতে উঠেছে। চারদিকে হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেলো। তমা, সাথী, রাত্রী মিলে ঠিক করলো তারা শাড়ী পড়বে। অন্যদিকে ছেলেরাও পাঞ্জাবি পড়ার কথা ভাবলো।

সবার সাজ গোঁজ শেষ করে বাড়ির গেটে বের হলো। বরযাত্রী এখনি চলে আসবে তাদের গেট থেকে মিষ্টি মুখ করিয়ে নিয়ে আসতে হবে। সাথী এবং তমার পিছনে রাত্রীর নেমে এলো। শান্ত এবং রুপ একই স্থানে ছিলো। শান্ত রুপের সাথে বেশ ভাব জমানোর চেষ্টা করছিলো। রাত্রী উঠানে পা রাখতেই দু’জনের দৃষ্টিই রাত্রীর দিকে পড়লো। রাত্রী রুপমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাঁসলো। বিনিময়ে রুপমও হাঁসলো। তাদের হাঁসি বিনিময় শান্তর চোখ এড়ালো না। গতকাল পলাশের বলা কথার মানেটা সে আগেই বুঝেছিলো। রাত্রী এবং রুপমের চোখাচোখিতে কিছুটা বুঝতে পারলেও পুরোটা নিশ্চিত নয় শান্ত। রাতের প্রেম রুপ কিনা সেটা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে। অন্যদিকে তমা শান্তর দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করলো। এক গ্লাস শরবত নিয়ে শান্তর কাছে গেলো। মিষ্টি হেঁসে বললো,” সকাল থেইকা মেলা গরম পড়ছে নিন শরবতটা খেয়ে নিন”।
শান্ত তমার দিকে দৃষ্টি দিলো এবং বললো,” আমার গরম লাগছে না। আপনার লাগলে আপনি খেয়ে নিন”।
তমা আশাহত হলো তবে হাল ছাড়লো না। আস্তে করে বললো,” আপনারে মেলা সুন্দর লাগছে”।
শুকনো মুখে শান্ত বললো,” ধন্যবাদ”।
তমা পুনরায় বললো,” আমারে কেমন লাগছে”?
শান্ত এবার হাঁসলো। মনেমনে টিটকানি মেরে নিজেই নিজেকে বললো,” আমি যার প্রতি আসক্ত সে আমার প্রতি বিরক্ত। যে আমার প্রতি আসক্ত আমি তার প্রতি বিরক্ত”।
শান্ত তমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। অন্যদিকে রুপ চোখের ইশারায় রাতের প্রশংসা করে দিলো। রাত লজ্জা পেয়ে গেটের কাছে যাওয়া ধরতেই পিছন থেকে রহিমা বেগম তার হাত ধরে নিলো। রাত রহিমা বেগমের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললে,” কি হয়েছে আম্মা”?
রহিমা বেগম কাঠকাঠ গলায় বললেন,” বরের সামনে যাবি না তুই”।
” কেন আম্মা”?
রহিমা বেগম বিরক্ত হয়ে বললো,” তোর নজর পিংকির জামাইয়ের উপরে পড়ুক তা আমি চাই না। নজর তো নয় কু-নজর”।
রাত্রী বেশ আঘাত পেলো। তার নজর কু-নজর! রাত্রী কিছু না বলে বাড়ির পিছনের বাগানে চলে গেলো। নিরবে বসে কান্না করতে লাগলো। হঠাৎ আস্তে করে একটি কন্ঠ শুনতে পেয়ে রাত্রী কেঁপে উঠলো। শান্ত রাত্রীর কানের কাছে আস্তে করে বললো,” এই অবহেলার কারনটা আমি জানি”।
রাত্রী শান্তর মুখশ্রীতে অবাক নয়নে তাকালো। শান্ত বেশ স্বাভাবিকভাবেই বললো,” জানতে চাও কারনটা”?
রাত্রী কান্নারত অবস্থায় বললো,” আপনি কি জানেন”?
শান্ত নিরব হেঁসে বললো,” তোমার আম্মা তোমারে অবহেলা কেন করে তা আমি জানি”।
রাত্রী বিষ্ময় নিয়ে শান্তর দিকে তাকালো। শান্ত মুচকি হেঁসে বললো,” পলাশ আমারে সব বলেছে”।
রাত্রী এবার একটু সাহস নিয়ে বললো,” কি কি বলেছে”?
” বলবো তবে….”।
শান্ত থেমে গেলো। রাত্রী জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” তবে কি”?
শান্ত আস্তে করে বললো,” তবে আমার একটা শর্ত আছে”?
” কি শর্ত”?
” আগে বলো রাখবে”।
রাত্রী আস্তে করে বললো,” রাখার মতো হলে নিশ্চয়ই রাখবো”।
শান্ত একটু শব্দ করে হাঁসলো তারপর বললো,” রাখার মতোই”।
” তবে রাখবো”।
” তবে আমিও বলছি। আমার মনে হয় তোমার এখন সত্যিটা জানার সময় এসে গেছে। তোমার মনে রহিমা আন্টিকে নিয়ে বাজে ধারনা সৃষ্টি হওয়ার পূর্বেই সত্যিটা তোমার জানা উচিত”।
রাত্রী বেশ স্বাভাবিকভাবে বললো,” আপনি যদি সত্যিটা জেনেই থাকেন তবে বলেন”।
শান্ত আস্তে করে বললো,” হুম তবে শুরু করা যাক”।
রাত্রী সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালো। শান্ত বলতে শুরু করলো,

চলবে,
[ভুলক্রুটি ক্ষমা করবেন ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here