#রঙ_বেরঙের_জীবন
পর্ব (৪)
#নুশরাত_জাহান_মিষ্টি
পলাশ ভাইয়া সকাল সকাল শহর থেকে বাড়ি এসেছে। আব্বা, আম্মার সাথে সাক্ষাৎ করে চলে গেলো পিংকির কাছে। আড়াল থেকে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে চলেছে রাত্রী। পলাশ পিংকির ঘরে এসে পিংকিকে জড়িয়ে ধরলো। অনেকদিন পর ভাই-বোন একে-অপরকে দেখে আবেগে আপ্লূত হয়ে পড়েছে। বেশ কিছুক্ষন তারা একে-অপরকে জড়িয়ে ছিলো। আড়াল থেকে দৃশ্যটি দেখে রাত্রীর চোখের কোনে অশ্রুকোনা ধরা দিলো। যদি এক মন থেকে অন্য মনে কথা শোনা যেতো তবে পলাশ ঠিক শুনতে পেতো, রাত্রীর মন বলছে,
“খুব একটা ক্ষতি হতো কি এই ভালোবাসাটা আমারে ছুয়ে দিলে? ভাইয়ের ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার কি আমার নেই”?
পিংকিকে ছেড়ে দিয়ে পলাশ বললো,” যা হয়েছে ভুলে যা। নতুন জীবন তোর জন্য অপেক্ষা করছে, সে জীবনের জন্য তৈরি হ”।
পিংকি মনমরা হয়ে বললো,” রাতের বদনামির উপরে তৈরি হওয়া জীবনডা আমি কেমনে সাঁজাবো ভাই”।
পলাশ চুপসে গেলো। সে রাতকে পছন্দ করে না সেটা ঠিক, তাই বলে বিনা দোষে রাতের ক্ষতি হোক সেটা চায় না! পলাশ ভাবহীন ভাবে জবাব দিলো,” তুই তো তাকে বদনামি দিস নি, সে নিজে বদনামি হাত পেতে গ্রহণ করে নিয়েছে। সেখানে তোর কোন দ্বায় নেই”।
” এইভাবে কি দ্বায় এড়ানো যায়”?
” জানি না। সব চিন্তা বাদ দিয়ে সামনের দিকে নজর দে। তোর এখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার সময়”।
পিংকি মনেমনে কিছু একটা ভেবে বললো,” ভাই আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে চাই। পরিক্ষার আগে বিয়াডা দিও না৷ এই অনুরোধটা রাহো”।
” রাহো কি রে? কতবার বলেছি রাতের মতো শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবি। আমার অশুদ্ধ ভাষা পছন্দ না”।
পিংকি মজার ছলে বললো,” শুদ্ধ ভাষা যহন পছন্দ তহন শুদ্ধ যে মানুষটা কয় তারে পছন্দ করলেই তো পারো”।
পলাশ বুঝতে পারলো পিংকি রাতের কথা বলছে। রাতের প্রসঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছে নেই পলাশের। তাই প্রসঙ্গ বদলাতে বললো,” আচ্ছা ছেলে পছন্দ হোক। পছন্দ হলে পরিক্ষার পর বিয়ের কথা বলবো। পরিক্ষার তো এখন বেশি দেড়ি নেই, সব বাদ দিয়ে পড়ালেখায় মন দে”।
পিংকি বুঝলো পলাশ প্রসঙ্গ বদলাচ্ছে। তাই খোঁচা মেরে বললো,” বুঝি বুঝি সবি বুঝি”।
” কি বুঝিস তুই”?
” তুমি শুদ্ধ বলা মানুষটারেও পছন্দ করো”।
বাক্যটি শুনে পলাশ পিংকির মুখের দিকে কিছুক্ষন দৃষ্টি দিলো, পরক্ষনেই দরজার আড়ালে দাঁড়ানো রাত্রীর দিকে আড় চোখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কঠিন গলায় বললো,” আমি তোর মতো শ্যামবরণ মেয়েদের পছন্দ করি। সুন্দর মেয়ে মানুষদের ঘৃনা করি। সুন্দর মেয়েরা ছলনাময়ী। তারা শুধু ছলনা করে অন্যের সংসার ভাঙতে পারে”।
পিংকি চমকে উঠলো, দরজার আড়াল থেকে রাত্রীও বেশ চমকালো। সুন্দরীরা ছলনাময়ী! তারা শুধু ছলনা করে। কে ছলনা করলো পলাশের সাথে! আমাদের ঘরে সবাই শ্যাম বর্নের। আম্মা, পিংকি, পলাশ, আব্বা। একমাত্র রাত্রীই সুন্দর৷ রাত্রীর মন রাত্রীকে প্রশ্ন করলো,” আচ্ছা ঘরের সবাই একরকম দেখতে সে ভিন্নরকম হলো কেন? সে কি ওদের আপন বোন নয়? আপন বোন হলে পলাশ রাতকে সহ্য করতে পারে না কেন”?
__________
আজও স্কুল বন্ধ দিয়ে নদীর পাড়ে বসে আছে রাত্রী এবং রুপম। রাত্রী বেশ ভাবনা পড়ে রয়েছে। মানুষ প্রেমে পড়লে নাকি স্কুল বন্ধ দিয়ে প্রেমিকের সাথে ঘুরতে যায়। কিন্তু সে কেন এসেছে রুপমের সাথে! সে কি রুপমের প্রেমে পড়লো! নাকি নিঃসঙ্গ জীবনে একজন সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে, একান্তভাবে কারো সঙ্গ পেতে এসেছে! ভাবনাগুলোকে মনের গহীনে সযত্নে লুকিয়ে রেখে রাত্রী বললো,” আচ্ছা তোমার কি মনে হয় আমি আমার আব্বা, আম্মার আসল মেয়ে নই”?
রুপমের কাছে রাত্রী জীবনের বেশ কিছু মূহুর্তের কথা ভাগ(শেয়ার) করে নিলো। আম্মার অবহেলা, ভাইয়ের ঘৃনা সবকিছুর পরিপেক্ষিতে রাত্রীর মনে প্রশ্নটি জেগে ওঠা স্বাভাবিক ভেবে রুপম বললো,” প্রশ্নগুলান সযত্নে মনের গহীনে লুকাইয়া রাখো। সময় হইলে একদিন ঠিক জানতে পারবা। একটা কথা মনে রাইখো সময়ের চাকা ঠিক সময়েই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়া যায়। যখন প্রশ্নগুলানের উত্তর খুঁজে পাবা না তখন ভাইবা নেবা উত্তরগুলো জানার সময় তোমার হয় নাই”।
একটু থেমে রুপম পুনরায় বললো,” সময় মতো প্রশ্নগুলো ঠিক যায়গায় কইরো তখন দেখবা উত্তরগুলা ঠিকই সামনে আইবো”?
রাত্রী কৌতুহলি চোখে তাকালো, রুপম পুনরায় বললো,” কিছু না বুঝলে, ছোট্ট মাথায় চাপ দেওয়ার দরকার নাই৷ আমি যা কই তাই শোন, আপাতত সব ভুইলা যাও। সময় মতো তোমার আম্মারে প্রশ্নগুলো কইরো”।
রুপমের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নদীর পানে তাকালো রাত্রী। রুপমের বলা মতো সময় হলে আম্মার কাছে প্রশ্নটা তুলবে রাত্রী। কিন্তু ভাববো না বললেই কি ভাবনাগুলো পিছু ছাড়ে! সে তো মনের গহীনে নিজের একটি ঠিকানা গড়ে নেয়। রাত্রীর মন খারাপ বুঝতে পেরে রুপম বললো,” কেউ কি আমার প্রেমে পড়লো”?
রাত্রী রুপমের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,” কে তোমার প্রেমে পড়বে”?
” কেউ একজন পড়ছে পড়ছে মনে হচ্ছে”। কৌতুকের সুরে
” তুমি কেউ একজন বলতে আমারে বুঝাচ্ছো”।
রুপম না বোঝার ভান ধরে বললো,” কই না তো”?
পুনরায় বললো, ” তুমি কি তোমারে ভাইবা লইছিলা”?
রাত্রী বেশ বিভ্রান্ত হলো। নিজেকে সামলে বললো,” না তো। আমি আমারে ভাববো কেন? তা কার কথা বলছিলে তুমি”?
বেশ সন্দিহান চোখে তাকালো রাত্রী রুপমের দিকে। রুপম বললো,” আছে একজন”।
” কে”?
রাত্রীর মনটা কিছুটা বিষন্ন হলো। রাত্রীর বিষন্ন মন দেখে রুপম বললো,” কত জনই তো ভালোবাসে আমারে, তা তোমার এইডা শুইনা খারাপ লাগলো কি”?
মন খারাপ নিয়ে রাত্রী বললো,” না আমার খারাপ লাগবে কেন? তোমারে একজন কেন শতজন ভালোবাসলেও বা কি”?
পুনরায় রাত্রী বললো,” আচ্ছা আজ আমি আসি”।
বাক্যটি বলে রাত্রী যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেই রুপম রাত্রীর হাত ধরে নিলো। ধরে থাকা হাতটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাত্রী জিজ্ঞাসা চিহ্নের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। রাত্রীকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুপমের চোখে অপরাধবোধ ফুটে উঠলো। রুপম সাথে সাথে হাতটি ছেড়ে দিয়ে বললো,” আমার দুঃসাহসের জন্য মাফ করবা। আমি হাতটি….”।
রাত্রী রুপমকে থামিয়ে দিয়ে বললো,” সমস্যা নেই”।
রুপম পুনরায় মুখে হাঁসির রেখা টেনে এনে বললো,” আমি রুপরে শতজন ভালোবাসলেও আমি রুপ একজনরেই ভালোবাসি। ভালোবাসবো। আমার ভালোবাসার প্রিয়জনটির নাম কখনো বদলাবে না। বিশ্বাস রেখে দেখতে পারো ঠকবে না”।
রাত্রী পিছনে ঘুরে মুচকি হাঁসলো। রুপমের কথা অজান্তেই মুখে হাঁসি ফুটে উঠলো রাত্রীর। রুপম পুনরায় বললো,” রাত দিবানিশি কখনো হাঁসিটা হারিয়ো না”।
রাত্রী বললো,” কেউ একজন বলেছিলো সবসময় হাঁসি ধরে রাখতে হয় মুখে। তার কথাটা মানার চেষ্টা করবো”।
রুপম পুনরায় ভুবন ভোলানো হাঁসি দিয়ে বললো,” তাহলে সে ধন্য হয়”।
দু’জনেই মুখের মাঝে হাঁসির রেখা ফুটিয়ে তুললো। নদীর পাড়ে পাশাপাশি দু’জনে হাঁটছে। দু’জনের মাঝে দূরত্বটা খুব কম। তবুও কেউ কাউকে স্পর্শ করছে না। স্পর্শহীন সম্পর্কের মাঝেও যে অন্যরকম অনুভূতি জন্ম নিতে পারে তা রাত্রী আজ বুঝতে পারলো। তমার মুখে শুনেছিলো স্পর্শ ছাড়া নাকি আজকাল কোন সম্পর্ক টেকে না। বন্ধুত্ব হোক বা ভালোবাসা স্পর্শটাই অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
আজ তমাকে বলতে ইচ্ছে করছে, ” তমা দেখে যা স্পর্শহীন সম্পর্কে এক নাম না জানা অনুভূতির জগতে হারিয়ে যাচ্ছি আমি”।
আচ্ছা এই নাম না জানা অনুভূতির নাম কি দিবো আমি!
__________
বাসায় ফেরার সময় রুপম রাত্রীর হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দেয়। গ্রামে মুঠোফোন আসলে সকলের হাতে হাতে পৌঁছায়নি৷ তাই মনের কথা বলার মাধ্যম চিঠিই। কখনো কখনো মনের অজানা কিছু কথা সামনাসামনি মুখ ফুটে বলা যায় না। সেগুলো বলার জন্য উত্তম মাধ্যম হলো কাগজ, কালি। এটা বলে চিরকুটটা রাত্রীর হাতে ধরিয়ে দিলো রুপম। রাত্রী বেশ খুশি মনেই বাড়ি চলে এলো।
বাড়ির উঠানো পা রাখতেই পলাশের সাথে সামনাসামনি দেখা। পলাশ বোধহয় কোথাও বাড়ি এসেছে৷ রাত্রী বেশ সাহস নিয়ে পলাশকে বললো,” কেমন আছো ভাইয়া”?
পলাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,” ভালোই আছি”।
রাত্রী আর কি জিজ্ঞেস করবে ভেবে না পেয়ে মাথা নিচু করে ভয়ে ভয়ে ভিতরে চলে গেলো। রাত্রীকে ভিতু ভিতু মুখ নিয়ে ভিতরে যেতে দেখে পলাশ মনেমনে বিড়বিড় করলো,” ভয় পাওয়ার মতো কি করলাম”?
খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে সকলের চোখু আড়ালে গিয়ে রাত্রী রুপমের চিঠিটা পড়লো লাগলো। চিঠিতে শুধু একটি লাইন লেখা,
” নাম না জানা এই অনুভূতির ভালোবাসা”।
‘ভালোবাসা’ শব্দটি মনেমনে দু’বার বিড়বিড় করলো রাত্রী।
চিঠিটার পানে কিছুক্ষণ নিরব দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রাত্রী। চোখ বন্ধ করে ফেললো, চোখ বন্ধ করতেই চোখে ফুটে উঠলো রুপমের হাত ধরে ফেলা, তারপর ক্ষমা চাওয়া। একটি মেয়ে জীবনে আর কি চায়! প্রিয় মানুষটি অনুমতি ব্যতীত স্পর্শর জন্য তার কাছে ক্ষমা চাইবে। অনুমতিহীন স্পর্শের জন্য তার দৃষ্টিতে অপরাধবোধ থাকবে, থাকবে সংকোচ। তবেই না অনুমতি চাওয়ার পূর্বেই হাতটি বাড়িয়ে দিবো ধরার জন্য।(লেখিকা আনরোমান্টিক সো লেখায় রোমান্টিকতা না থাকলেও কল্পনা ভাইবা নিবেন, কারন ইহা প্রেমের গল্প। লেখার মান খুব খারাপ হচ্ছে সে-সম্পর্কে দুই লাইন বলে গেলে খুশি হবো)
কেটে গেলো দু’দিন। পিংকির মাধ্যমিক শেষে তার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হলো। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে পলাশ চলে গেলো।
পলাশ চলে যাবার পর রাত্রীর স্কুল ব্যাগে হাত দিয়ে একটি ড্রেস পেলো রাত্রী। ড্রেসের সাথে একটি কাগজ রাখা ছিলো যাতে লেখা ছিলো,” এটা দায়িত্ব। দায়িত্বকে ভালোবাসা ভেবে কেউ ভুল না করে”।
লেখাটি পড়ে রাত্রীর মুখে হাঁসি ফুটে উঠলো। এটা দায়িত্ব হোক বা ভালোবাসা পলাশ তার জন্য এনেছে তাতেই সে খুশি। পিংকিকে তার চোখের সামনে ড্রেসটি দেওয়ায় সে বেশ কষ্ট পেয়েছিলো। তার জন্য যখন আনেইনি তখন পিংকিকে তার অগোচারে দিলেই তো পারতো। তখন শুধু শুধু কষ্ট পেলো রাত্রী। তার ভাই তার জন্যও তো এনেছে তবে সামনাসামনি দেয়নি।
চলবে,