#রঙ_বেরঙের_জীবন
পর্ব (৩)
#নুশরাত_জাহান_মিষ্টি
পরেরদিন,
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা করে নিলো রাত্রী। মামী রান্নাঘরে কাজ করছিলেন। মামার এক পুরনো বন্ধু কোথা থেকে এসে উদায় হলো বহুদিন পর। শহরে চাকরির সুবাদে স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সংসারটা শহরেই গড়ে নিয়েছেন। কাল গ্রামের বাড়ি ঘুরতে আসলেন৷ বহুদিন পর গ্রামে আসা মামার সাথে সকাল সকাল দেখা করতে এসেছেন। পাশের ঘরে বসে তারা গল্প করছিলেন। স্কুলে চলে যাবো তাই মামার থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছিলাম তখনি তার সাথে দেখা। আমাকে দেখেই মামার বন্ধু বললেন,” এই বুঝি তোর ছোট বোনের মেয়ে”?
প্রশ্নটি শুনে মামা বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। অন্যদিকে রাত্রীর তেমন ভাবাবেগ হয়নি। ভাবাবেগ হলো তখন যখন মামার বন্ধু তার দ্বিতীয় উক্তিটি বের করলেন,” তা তোর বড় বোনের ছেলে-মেয়ের কি খবর”?
রাত্রী বেশ চমকালো। বড় বোন! ছোট বোন! রাত্রীর জানামতে তার মামা এবং আম্মা দুই ভাই-বোন। সেক্ষেত্রে বড় বোন, ছোট বোন আসলো কোথা থেকে! রাত্রী কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই মামা বললেন,” মেলা দিন পর গ্রামে আইলি তো তাই সব ভুইলা গেছো। আমার বোনই তো একজন সেখানে বড়, ছোট আইবো কই থেইকা”?
এক ধমে কথাগুলো বললো মামা। মামার কথা শুনে তার বন্ধুর মুখে জিজ্ঞাসা চিহ্নের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। মামার বন্ধু কিছু বলতে নিলে মামা তাকে বলতে না দিয়ে নিজে বললেন,” রাত স্কুল যাচ্ছিস? যা যা। স্কুল যাইতে তো মেলা সময় লাগবো। এহন যাইতে শুরু করলেই সময়মতো পৌছাবি”।
এক প্রকার জোর করে মামা রাত্রীকে পাঠিয়ে দিলেন। রাত্রী কিছুই বুঝলো না। গন্ডগোল যে আছে সেটা শুধু অনুভব করতে পারে।
ভাবনাগুলো বাদ দিয়ে রাত্রী মামী এবং নানা ভাইকে বলে বিদায় নিলো। স্কুলের পথে হাঁটা শুরু করলো।
আম বাগানের কাছাকাছি এসে রুপমের অস্তিত্ব আসা করেছিলো রাত্রী। আসাটা সত্য প্রমান করে রুপমকে আম বাগানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো রাত্রী। রাত্রী সামনে আসতেই রুপম বললো,” কালকে বইলা যাও নাই কখন আসবা, জানো সেই ভোর থেইকা এহানে দাঁড়াইয়া আছি”।
রাত্রী বেশ অবাক হলো, রুপম তার জন্য ভোর থেকে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কেন! রাত্রীকে বিষ্মায়িত দেখে রুপম বললো,” তুমি বুঝবা না”।
রাত্রী পুনরায় চমকালো। রুপম কি মনের কথা শুনতে পায়! রাত্রীকে চমকানো থেকে মুক্তি দিয়ে রুপম বললো,” চলো কোথাও বইসা কথা কই”?
রাত্রী কিছুটা ভয়মিশ্রিত কন্ঠে বললো,” বসে কথা বলবো”!
” তুমি যদি চাও তয় বসতে পারি”।
রাত্রী ভয়টা কাটিয়ে বললো,” কোথায় বসবেন”?
রুপম একটু ভেবে বললো,” আপত্তি না থাকলে শিশিরকন্যা(কাল্পনিক) নদীর পাশে যাইবা”?
‘শিশিরকন্যা’ নামটি রাত্রী পূর্বেই শুনেছে। অলন্দপুর গ্রামের শেষ প্রান্তে নদীটি অবস্থিত। নাম জানলে নদীটি কখনো চোখে দেখা হয়নি। ভয়, সংকোচ সবকিছু পেরিয়ে কেন জানি না মন স্বায় দিলো রুপমের কথা। রুপম রাত্রীর সম্মতি পেয়ে নদীর পথে এগাতো লাগলো।
কিছুক্ষনের মাঝেই নদীর পাড়ে চলে এলো তারা। নিরিবিলি একটি স্থান দেখে দু’জনে বসলো। দু’জনেই নিরব। নিরবতা ভেঙে রাত্রী বললো,” বন্ধু হবেন”?
খুশিতে রুপমের দু’চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। নাই হোক ভালোবাসা, বন্ধু হলে মন্দ কিসে! দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর একটি কথা আছে। রুপম খুশিখুশি মনে বললো,” হ হইবো”।
রাত্রীর নদীর পানির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,” আমার একটি বন্ধু চাই, যার সাথে মন খুলে সব কথা বলতে পারবো। যে আমার কথা বলার সাথী হবে। হবেন সাথী”?
” হ হইবো। তুমি যদি চাও সারাজনম বইসা বইসা তোমার কথা শুইনা যাইতে চাই। ভাইবো না এটা শুধু মুখের কথা। এটা মনের কথা। তুমি কথা বলতে বলতে বিরক্ত হইতে পারো, আমি কথা শুনতে শুনতে কখনো বিরক্ত হইবো না”।
রাত্রী নদীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রুপমের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
” তাহলে বন্ধু হবেন”?
” হ। তবে….”।
” তবে”?
” তবে আপনি নয় তুমি কইতে হইবো”।
” বন্ধু হলে তো বলবোই”।
” হলাম তো বন্ধু”।
রাত্রী মজার ছলে বললো,”কই হলাম”?
” মাত্র না তুমি বন্ধু হওয়ার আমন্ত্রণ দিলা আমি গ্রহন করলাম”।
” এভাবে বন্ধু হওয়া যায়”।
” মনের টান থাকলে যেকোন ভাবে বন্ধু হওন যায়”।
রাত্রী মুচকি হেঁসে বললো,” মনের টান নাই তো”?
রুপম হেঁসে বললো,” তাহলে বন্ধু হইলা কি দেইখা”?
” সত্যি বলবো”।
” হ”।
” সেটা না বলি”।
” তুমি না চাইলে না”।
বেশ কিছুক্ষন দু’জনে নিরব রইলো। নিরবতা ভেঙে রুপম বললো,” বন্ধু হইলা তো এবার বলবা বিষ খাইছিলা ক্যা”?
রাত্রী হেঁসে বললো,” কেন ভয় হচ্ছে”?
” ভয়? কিসের ভয় হইবো”?
” এই যে কলঙ্কিত একটি মেয়ের বন্ধু হলেন, পরে যদি আপনার গায়েও কলংকের দাগ লাগে”।
রুপম পুনরায় ভুবন ভোলানো হাঁসি দিয়ে বললো,” সেইটা ভাবলে কি বন্ধু হইতাম, কত লোকেই তো কত কথা কইলো, কই কারো কথা মনে রাইখা পিছু ছাড়িনি তো”?
নিমিষেই মুখ কালো হয়ে গেলো রাত্রীর। মনমরা হয়ে বললো,” গ্রামে আমার নামে খুব বাজে কথা হয় তাই না? আপনার আমার সাথে বন্ধুত্ব করা লাগবো না। শেষে আপনার নামেও বাজে কথা বের হবে”।
” সমাজের মানুষের কথা এত ভাবো বুঝি, ভাবলে মিথ্যা রটাইলা ক্যা”?
রাত্রী চমকে উঠলো। মিথ্যা! কি মিথ্যা! রুপম কি বলছে! রাত্রীর মনের কথা বুঝতে পেরে রুপম বললো,”বিষ না খাইয়া বিষ খাইছো রটানোর কথা বলছি আমি। রটানোর সময় যখন সমাজের কথা ভাবো নাই তহন এহন ভাইবো না”।
রাত্রী আস্তে করে বললো,” রটানো মানে? আপনি এসব কি বলছেন”?
রুপম পুনরায় হেঁসে দিলো তারপর বললো,” তোমাগো বাড়ি যে ডাক্তার গেছিলো তার থেইকা খোঁজ নিছি। আমি জানি তুমি না পিংকি বিষ খাইছিলো। পিংকির বদনাম চাও নাই বইলা নিজের নাম চালাইলা”।
রাত্রী সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললো,” নাম তো আমি চালাইনি, পাশের বাড়ির কাকিমাকে বলতেই সারা গ্রাম জেনে গেলো”।
” তাই তো এরা প্রতিবেশি। নিজের থেইকা পরের খবর বেশি রাখে”।
রাত্রী মুচকি হেঁসে দিলো। রুপমের সাথে কথা বলে তার বেশ ভালো লাগছে। রুপম মুখে হাঁসি ধরে রেখে বললো,” স্কুলের সময় তো পার হয়েছে। স্কুল যাবা না”?
রাত্রীর কেন জানি না স্কুল যেতে ইচ্ছে করলো না। তাই বললো,” নদীর পাড়ে বেশ লাগছে। আজ স্কুলটা মিস দেই”।
” দিবা! তো দেও”।
” আচ্ছা আমি আপনারে কি বলে ডাকবো”?
” আগে আপনি বলা বাদ দেও”।
” আচ্ছা তোমারে কি বলে ডাকবো”?
” আমার নাম রুপম। তুমি আমারে রুপ বইলা ডাইকো”।
” আচ্ছা”।
পুনরায় দু’জনের মধ্যে নিরবতা বিরাজমান। বেশ কিছুক্ষন নিরবেই বসে রইলো। হঠাৎ রুপম উঠে অন্যদিকে গেলো। রাত্রী বেশ অবাক হলো, না বলে উঠে যাওয়ার জন্য। রাত্রী মনেমনে রাগ হলেও প্রকাশ করলো না। নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো। একটু পর রুপম হাতে দুটো আইসক্রিম নিয়ে ফিরে এলো। রাত্রীর দিকে একটি আইসক্রিম বাড়িয়ে দিলে বললো,” না বইলা যাওয়ার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। কেউ একজন বেশ মনোযোগ দিয়া নদী উপভোগ করছিলো তাই বিগ্ন ঘটাইতে চাইনি৷ রাগ ভুলে আইসক্রিমটা খাওয়া হোক”।
রাত্রী রাগ করেছে রুপম বুঝতে পারলো। রুপম বুঝতে পারায় রাত্রী বেশ খুশি হলো। কিশোরী মন আর কি চায়! কেউ একজন না চাইতেও তাকে বুঝুক এটাই তো চায় কিশোরী মন! রাগ ভুলে আইসক্রিমটা নিলো রাত্রী। দু’জনে আইসক্রিম খাচ্ছিলো। হঠাৎ করে রুপমে ছেলে মানুষির করার ইচ্ছে জাগলো। কাজটি করা ঠিক হবে কিনা ভাবছিলো। পরক্ষনেই মন বললো, “প্রেমিক যতই বড় হোক না কেন প্রেমিকার কাছে ছেলে মানুষ হওয়া মন্দ নয়”। রাত্রী বন্ধু রুপম তো সম্পর্কটা নিয়ে অনেকটা ভাবে। নিজের মনের কথা শুনে রুপম রাত্রীর গালে আইসক্রিম মাখিয়ে দিলো। রাত্রী চমকে পাশে তাকালো। রুপম বেশ ভয় পেলো, রাত্রী ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিলো কিনা! রাত্রীর মুখে হাঁসি ফুটে উঠলো। রাত্রীও ছেলে মানুষি করে রুপমের গালে লাগিয়ে দিলো। রাত্রী হাঁসি দেখে রুপমের হাঁসিও ফিরে এসেছে। রুপম পুনরায় রাত্রীকে মাখাতে যাবে তখনি রাত্রী ছুটে পালালো। রুপম উঠে রাত্রীর পিছনে ছুটতে লাগলো। আর বললো,” রাত দৌড়াইয়ো না, আমার তোমারে দৌড়াইয়া ধরতে হইলে কিন্তু পুরো মুখে লাগিয়ে দিবো। তারচেয়ে স্বইচ্ছায় একটুখানি লাগাতে দেও”।
রাত্রী ছুটতে ছুটতে বললো,” আগে তো ধরো রুপ। পরেরটা পরে ভাবা যাবে”।
শুরু হলো দু’জনের ছোটাছুটি।
__________
রাত্রী বাসার পথে পাড়ি জমাচ্ছে। আজ রুপের সাথে কাটিয়ে বেশ ভালো লাগলো। আজকের দিনটা রাত্রী কখনো ভুলবে না। জীবনটা রঙিন সেটা আজ মনে হলো রাত্রীর। সারাদিন দু’জনের বেশ কাটলো। জীবনের রঙে প্রথমবার নিজেকে রাঙালো রাত্রী।
বাসায় ফিরে আম্মার আনন্দিত মুখ দেখে রাত্রী বুঝতে পারলো আপাকে পাত্র পক্ষের পছন্দ হয়েছে। রাত্রীকে দেখে রহিমা বেগম বললেন,” রাত আইছো”?
” জ্বী আম্মা”।
রহিমা বেগম বেশ খুশি মনে বললেন,” আজ থেইকা তুই পিংকির ঘরেই থাকিস। কাল পলাশ আইবো, তাই ওর ঘর খালি কইরা গুছিয়ে রাখতে হইবো”।
রাত্রী বললো,” আচ্ছা। আপারে কি পাত্র পক্ষর পছন্দ হইছে”?
রহিমা বেগম খুশির মাত্রা দ্বিগুন করে বললেন,” হ। কাল পলাশ আইলে তোর আব্বা আর পলাশ যাইবো ছেলের বাড়ি ঘর দেখতে”।
রাত্রী আচ্ছা বলে ভিতরের ঘরে চলে গেলো। ভাইয়ার ঘর থেকে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে আপার ঘরে রাখতে হবে। একটা জিনিস ও পলাশের ঘরে রাখা যাবে না! পলাশও আম্মার মতো রাত্রীকে পছন্দ করে না। রাত্রীর কোন জিনিস নিজের ঘরে পেলে বাসায় তুল-কালাম বাঁধিয়ে ফেলবে। নানা ধরনের ভবিষ্যত ঘটতে পারে ঘটনাগুলো ভেবে কাজে লেগে পড়লো রাত্রী। এমনিতেই পলাশকে খুব ভয় পায় রাত্রী। রাত্রীর দিকে নিক্ষেপ করা পলাশের রাগান্বিত চোখ গুলোকে অনেক ভয় হয় রাত্রীর।
ঝটপট সব জিনিসপত্র নিয়ে পিংকির ঘরে চলে এলো রাত্রী। পিংকির সাথে কিছুদিন সাক্ষাৎ হয়নি রাত্রীর৷ আম্মা সাক্ষাৎ বারণ করে দিয়েছিলো। বেশ কিছুদিন পর দেখা হয় রাত্রী খুব খুশি হলো। পিংকির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” কেমন আছিস আপা”?
পিংকি বিষন্ন মন নিয়ে বললো,” আছি কোনরকম”।
রাত্রী বুঝতে পারলো পিংকির মন খারাপ। বেশ আস্তে করে বললো,” যে চলে যায় তার কথা মনে রাখতে নেই আপা। যে তোর কথা ভাবিনি তার কথা ভেবে তুই কষ্ট পাচ্ছিস কেন”?
” ভালোবাসাটা মিথ্যে নয় রাত। সেও আমারে ভালোবাসতো। বাবা-মার চাপে অন্যত্র বিয়া করতে হইছে তারে। যেমন আম্মা আমারে জোর করতেছে”।
” আম্মা তোর ভালোর জন্যই”।
” জানি আমি। আমি এসব নিয়া ভাবি না রাত। আমি ভাবি আবেগের বসে করা আমার ভুলটার দ্বায়ভার তুই নিয়া সকলের সামনে বদনাম কুড়ালি তুই। তোর গায়ে লাগা এই মিথ্যা কলংকের বোঝা আমারে শান্তি দেয় না”।
রাত্রী পিংকির মাথায় হাত রেখে বললো,” যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমি কিছু মনে রাখিনাই তুইও ভুইলা যা আপা”।
” সমাজ তোরে ভুলতে দিবো না। সমাজ তোর নামে আরো বদনাম রটাইবো রাত”।
” সমাজ নিয়ে আমি ভাবি না আপা। তুই স্বাভাবিক ভাবে জীবন কাটা তাহলে আমার বদনামির একটু মান থাকবে”।
পিংকি স্লান হাঁসলো। রাত্রী তার আপাকে জড়িয়ে ধরলো। পিংকিও জড়িয়ে ধরলো। পিংকি হঠাৎ কুঁকড়ে কেঁদে উঠলো।
” চার অক্ষরের ভালোবাসা বড্ড কষ্ট দেয় রাত। বড্ড কষ্ট”।
চলবে,
[ লেখা কেমন অগোছালো হচ্ছে? ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন]