#রঙ_বেরঙের_জীবন
পর্ব(২)
#নুশরাত_জাহান_মিষ্টি
পরেরদিন সকাল বেলা স্কুলের জন্য তৈরি হতেই আম্মা এসে রাত্রীকে বললো,” ইস্কুলের পর নানা বাড়ি যাবি। খবরদার আইজ ভুলেও বাড়ি আবি না”।
রাত্রী প্রশ্নচিহ্নের ন্যায় মুখ করে বললো,” কেন আম্মা? আজ বাড়িতে কি আছে”?
“আইজ পিংকিরে দেখতে আইবো, তোরে দেখলে বিয়াডা ভাইঙা যাইবো। তাই সাবধান বাড়ি আবি না”।
আম্মা চলে গেলো। রাত্রী চোখের কোনের অশ্রুটুকু মুছে বেরিয়ে পড়লো স্কুলের পথে। আজ সাঁকো পার হয়ে রুপমের দেখা মেলবে না ভেবেছিলো, কিন্তু তা আর হলো কই! রুপম ঠিক সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সেই ভুবন ভোলানো হাঁসি দিয়ে বললো,” মিথ্যা কইলা ক্যা”?
রাত্রী বেশ ভয় পেলো। মিথ্যে বলেছে সেটা রুপম জেনে গেছে। এখন তার কি হবে! রাত্রীকে ভয় পেতে দেখে রুপম বললো,” ভয় পাইয়ো না, আমি কিছু মনে করি নাই। আমারে পিছু থেকে দূর করতে মিথ্যা কইছো, তা আমি বুঝছি”।
রাত্রী বেশ সাহস সঞ্চায় করে বললো,” যখন বুঝতে পারছেন তখন পিছনে পড়ে আছেন কেন”?
আবার ভুবন ভোলানো হাঁসি দিলো রুপম। কয়েক মূহুর্ত রাত্রী রুপমের মুখশ্রীতে তাকিয়ে থাকলো। এই হাঁসি দেখলে মাঝেমাঝে মন বলে হারিয়ে যেতে। এত সুন্দর হাঁসি যার মন কাড়ে না তার আদো মন বলতে কিছু আছে! নিজের ভাবনায় নিজে অবাক রাত্রী। রুপমকে নিয়ে তার এত ভাবনার কি আছে! রুপমের আওয়াজ পেয়ে ভাবনা থেকে বের হলো রাত্রী,” এটা হলো পিরিতের ডাক। এ ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা কারো নাই। বুঝলা…”?
রাত্রী মাথা ডানে বামে নাড়ালো। যার অর্থ না, সে কিছু বুঝেনি৷ রুপম আবার হেঁসে দিলো তারপর বললো,” বুঝবা যেদিন সেদিন আমি না চাইলেও তুমি কাছে টানবা”।
রাত্রী বেশ সাহস নিয়ে বললো,” পথ ছাড়ুন”।
” আগে কও মরতে গেছিলা ক্যা”?
উত্তরের আসায় রাত্রীর মুখপানে তাকিয়ে রইলো রুপম। রুপমকে জবাব না দিয়ে রাত্রী বললো,” আমারে নিয়া আপনার এত কৌতূহল কেন”?
” নিজের মানুষের জন্যই তো কৌতুহল জন্মায়”।
রাত্রী বেশ অস্বস্তি অনুভব করলো। অস্বস্তি নিয়েই বললো,” আমার মধ্যে কি আছে যে আপনি আমারে নিজের মানুষ ভাবেন”?
রুপম নিজের মুখে হাঁসিটা ধরে রেখে বললো,” মায়া। তোমার মুখশ্রীতে তাকাইলে মায়ায় হারাইয়া যাই। তোমার মুখে একছের মায়া। এই মায়া যার চোখে পড়বো সে হারাইয়া যাইতে বাধ্য”।
মায়া! রাত্রী ভাবছে তার মুখে মায়া আছে। সত্যি আছে! তাহলে তার আম্মা তারে দেখে মায়া হয় না কেন! তারে দেখে মায়া পড়ে নাহয় একদিন ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়ে যেতো। নেয় না কেন! নিমিষেই রাত্রীর মুখে অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। রাত্রীর মুখ অন্ধকার দেখে রুপম বললো,” আইচ্ছা তোমার আমারে পছন্দ না ক্যান? আমি তোমার নাহান সকল কথা শুদ্ধ কইতে পারি না বইলা”?
একটু থেমে রুপম পুনরায় বললো,” তুমি আমারে জীবনে যায়গা দেও, আমি কথা দিতেছি একদিন তোমার মনের মতোন হইয়া দেহাইবো”।
রাত্রী বেশ বিষ্ময়কর একটি কথা বলে উঠলো,” স্কুল শেষের সময় আম বাগানে দেখা হবে”।
কথাটি বলে এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেলো রাত্রী। রাত্রীর চলে যাওয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রুপম ভাবছে, কি বলে গেলো রাত্রী! রাত্রী কি রুপমকে আম বাগানে দেখা করার আমন্ত্রণ জানালো! না এটা জানিয়ে গেলো আজ রাত্রী তার নানা বাড়ি যাবে। কারন আম বাগান তো রাত্রী নানা বাড়ির পথে পড়ে।
রাত্রী যাই বলুক না কেন, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রুপমকে আম বাগানে আমন্ত্রণ জানালো এটা ভেবেই রুপমের মুখশ্রীতে পুনরায় ভুবন ভোলানো সেই হাঁসি জেগে উঠলো।( লেখিকা এত ধরনের হাঁসি, ভয় মিশ্রিত মুখ, সাহসি মুখ কল্পনা করে রোল পেলে করতে গিয়ে আজ নিজ পরিবার থেকে অনেক উপাধি পেলো। আপনারাও লেখিকাকে কিছু বলে যান, ঘন্টায় ঘন্টায় এত ধরনের হাঁসির কারনসরুপ)
__________
রহিমা বেগম বড় মেয়ের ঘরে এসে বললেন,” পিংকি, পিংকি মা”।
পিংকি বিছানা থেকেই আম্মার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,” আমারে না বইলা পাত্র পক্ষরে আসতে বললা ক্যা আম্মা”?
রহিমা বেগম কঠিন গলায় বললেন,” তো তোমারে ঘরে বসাইয়া বদনাম কুড়াবো? বিছানা থেইকা উইঠা গোসল সাইরা বিকেলের জন্য তৈরি হইয়া নেও”।
পিংকি কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বললো,” আম্মা আমি বিয়া… ”
পিংকিকে থামিয়ে রহিমা বেগম বললেন,” বিয়া করবি না এই কতা কবি না, পাত্র পক্ষের তোরে পছন্দ হইলেই বিয়া হইবো”।
পিংকি স্বাভাবিক গলায় বললো,” আম্মা রাত আমার কাছে আয় না ক্যা? তুমি ওরে আমার কাছে আইতে বারণ কইরা দিছো”?
রহিমা বেগম কাঠকাঠ গলায় আওয়াজ তুলে বললেন,” ওরে দিয়া তোর কাম কি? ওর ছায়া তোর উপরে না পরাই ভালা”।
” আম্মা তোমার রাতরে এত অপছন্দ ক্যান? ও কি তোমার নিজের মাইয়া না”?
রহিমা বেগম এ প্রশ্নের কি উত্তর দিবেন ভেবে পায় না। প্রশ্নটি এড়িয়ে বললেন,” তোরে যা কইলাম তাই কর”।
পিংকি বেশ সাহস নিয়ে বললো,” রাতের মুখে ভালো কইরা কখনো তাকাইয়া দেখছো আম্মা? যদি দেখতা তয় বুঝতা ওর মুখে কত মায়া? সেই মায়া ছাইড়া তুমি ওরে অবহেলা করতে পারতা না আম্মা”।
রহিমা বেগম পিংকিকে ধমক দিয়ে গোসলে পাঠালেন। পিংকি আম্মার ধমক খেয়ে চলে গেলো। রহিমা বেগম পিংকির যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলেন। চোখের কোন দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো৷ অশ্রু মুছে মনেমনে বললেন,” ওর মায়া হারাইলে আমার যন্ত্রণা কি কমবো নাকি আমার মাথা থেইকা যন্ত্রণাময় সেই স্মৃতিগুলান মুইছা যাইবো”!
___________
স্কুল শেষে নানা বাড়ির পথে হাঁটা ধরলো রাত্রী। আম বাগানের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। সামনে রুপম দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিধাহীন রুপমের সামনে এসে দাঁড়ালো রাত্রী। রুপম পুনরায় তার হাঁসিটা দিলো। রাত্রীও মুচকি হাসলো তারপর বললো,” আপনি সবসময় এত হাঁসেন কেন”?
মুখে হাঁসি ধরে রেখেই রুপম বললো,” জীবনতো একটাই। হাঁসি ছাড়া এক জীবনডা কেমন জানো। তাই জীবনের জন্য মাঝেমধ্যে আমাগো হাঁসিটা ধইরা রাহোন উচিত”।
রাত্রী মনমরা হয়ে বললো,” জীবনে সবসময় হাঁসি ধরে রাখা কি যায়”?
” মানুষ চাইলেই যায়”।
দু’জনেই নিরব হয়ে গেলো। নিরবতা ভেঙে রুপম বললো,” আমারে ডাকলা ক্যান”?
রাত্রী না বোঝার ভান ধরে বললো,” আমি আপনাকে কখন ডাকলাম”?
” সেভাবে কও নাই কিন্তু ঘুরাইয়া তো আইতে কইছো”?
” কোথায় আসতে বলছি”?
” এখানে”।
” আমি আসছি”। বলে রাত চলে যেতে লাগলো। রুপম পিছন থেকে বললো,” তোমার মনে হাওয়া বইতে শুরু করছে রাত। এ যে সে হাওয়া নয় পিরিতের হাওয়া। বুইঝা শুইনা লইয়ো রাত”।
রাত্রী পিছন ঘুরে তাকালো একবার, তারপর পুনরায় সামনে এগিয়ে গেলো।
এদিকে রুপমের চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ দেখা গেলো। রাত্রীর মনে কিছু চলুক আর নাই বা চলুক। আজ রাত্রী প্রথমে তাকে এখানে আসার আমন্ত্রণ জানালো, তারপর রুপম রাত দু’বার বললো তাও কিছু বললো না। আগেরবার যখন রাত বলে সম্মোধন করেছিলো তখন রাত্রী বলেছিলো,” আমারে রাত বলবেন না। আমি কাছের মানুষের থেকে এই ডাকটি শুনতে পছন্দ করি, দূরের মানুষের থেকে নয়”।
মনেমনে একটু হলেও রাত্রী রুপমকে নিয়ে ভাবে এটা বুঝতে পেরে রুপমের খুশি ধরে রাখা দ্বায়।
অন্যদিকে রাত্রী নানা বাড়ির পথে যত এগোচ্ছো তত ভেবে চলেছে,” কাজটা কি ঠিক হলো”? রুপমকে এভাবে আসা দেখানো ঠিক হলো তার৷ রাত্রী ভিতর থেকে খুব একা, তাই জীবনে একজন বন্ধুর খুব প্রয়োজন অনুভব করছে। বন্ধুর কথা ভাবা প্রথমে কেন জানি না রুপমের কথাই মাথায় আসলো তার। কিন্তু রুপম তার বন্ধুত্বের ইঙ্গিতকে অন্যকিছু ভাববে না তো। অনেক ভেবে রাত্রী সিদ্ধান্ত নিলো কাল দেখা হলে বন্ধুত্বের ব্যাপারটা পরিষ্কার করে নেবে রুপমের সাথে।
ভাবতে ভাবতে নানা বাড়ি চলে এলো রাত্রী। রাত্রীকে দেখে তার নানা ভাই জড়িয়ে ধরলো। কপালে চুমু এঁকে বললো,” তুই আইছো আমি মেলা খুশি হইছি নানু ভাই”।
” আমিও তোমাদের দেখে খুব খুশি হয়েছি। কতদিন পর তোমাদের সাথে দেখা”।
পিছন থেকে মামী বলে উঠলো,” হ এবার তুমি মেলা দিন পর আইলা রাত”।
রাত্রী অভিমানী সুরে বললো,” তাও তো আমি আসলাম, তোমরা নিজ থেকে তো কখনোই যাও না”।
” যাবো যাবো, পিংকির বিয়ে ঠিক হলেই যাবো। মেলা দিন থেকে আসবো”।
মামা কাজ সেড়ে বাড়ি আসলেন সবে৷ এসে রাত্রীকে দেখে কথাটি বললেন। সবার সাথে কুশল বিনিময় করে রাত্রী ভিতরের ঘরে গেলো। নানা, মামা, মামী এই তিনজনকে নিয়ে এই সংসারটা গড়ে উঠেছে। মামা, মামীর কোন সন্তান নেই। মামী নাকি বন্ধ্যা। তবে এই নিয়ে তাদের মাঝে কোন মনোমানিল্য কারো চোখে পড়েনি৷ রাত্রীর মনে মামা, মামীর মধ্যে এই ভালোবাসা অন্য এক অনুভূতির জন্ম দেয়। ভালোবাসার কত রুপ! কারো কারো কাছে সন্তানটা এত গুরুত্বপূর্ণ হয় যে সে অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে পড়ে। কখনো কখনো সমাজের চাপেও দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধ্য হয় মানুষ। সেখানে সবকিছুকে পিছনে ফেলে মামা-মামী তাদের ভালোবাসার সংসারে দীর্ঘ বিশ বছর টিকে আছে। এরকম ভালোবাসা সবখানে দেখা যায় না।
খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত হলো রাত্রী। রাত্রীর এ বাড়িতে আসলে আরো একটি জিনিস খুব ভালোলাগে, তাহলো মামী তার সাথে ঘুমায়৷ সারারাত তার মাথায় বিলি কেটে দেয়। মামা, মামী রাত্রীকে খুব ভালোবাসেন। আজও তাই হলো মামী আর রাত্রী একসাথে ঘুমাতে নিলো। দু’জনের মাঝে টুকটাক গল্প হচ্ছিলো। গল্পের এক পর্যায় মামী বলে উঠলো,” তোর আম্মা তোরে ভালো পায় তো রাত”?
মামীর কথার কি জবাব দেবে ভেবে পায় না রাত্রী! রাত্রীকে নিরব দেখে মামী বললেন,” তোর আম্মা ব্যবহারে কষ্ট পাস না। তোর আম্মাও তোরে খুব ভালোবাসে। সময় বড়ো নিষ্ঠুর হয় রাত। সময় বড় নিষ্ঠুর। মানুষ আরো বড় নিষ্ঠুর। মানুষ মন্দ সময়টা কখনো ভুলতে চায় না। বুঝলিরে রাত”।
একটু থেমে পুনরায় বললেন,” তোর আম্মারে কখনো ঘৃনা করিস না রাত। সে তোরে ভালো না বাসলেও তুই তারে মেলা ভালোবাসিস”।
রাত্রী বুঝতে পারে তার আম্মার তারে অবহেলা করার পিছনে একটা কারন আছে। শুধু কারণটাই তার অজানা। এখন মামীকে উল্টো প্রশ্ন করলে সে কথা এড়িয়ে যাবে। তাই রাত্রী কথা বাড়ালো না। শুধু বললো,” আমি আম্মারে সবসময় খুব ভালোবাসবো”। তারপর দু’জনে গল্প করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।
চলবে,
[ভুলক্রুটি ক্ষমা করবেন ]