#রঙ_বেরঙের_জীবন
পর্ব (১২)
#নুশরাত_জাহান_মিষ্টি
সাঁকোর এপারে দাঁড়িয়ে আছে রাত্রী এবং শান্ত। রাত্রী বেশ মজার ছলে বললো,” আপনি রুপের সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন অথচ রুপকেই এগিয়ে নিতে হবে”।
শান্ত বুঝতে পারলো শান্তর সাঁকো পার না হতে পারার জন্য রাত্রী এমনটা বললো। শান্ত কিছু বললো না শুধু মুচকি হাঁসলো। কিছুক্ষনের মধ্যে রুপ সেখানে চলে এলো। রুপ এসে শান্তর সাথে কুশল বিনিময় করলো। তারপর বললো,” আমার সাহায্য নিয়া ওপারে যাইবার পারবা”?
শান্ত হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালো। রুপের সাহায্য নিয়ে শান্ত ওপারে গেলো। ওপারে গিয়ে তারা তিনজন নদীর পাড়ে গেলো। শান্ত মুখে হাঁসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বললো,” কারো সাথে আমার পরিচয় করানোর কথা ছিলো”?
রুপ বুঝতে না পেরে বললো,” এহানে অপরিচিত কেউ নাই তো”?
রাত্রী এসে রুপের হাত ধরলো। হাত ধরে শান্তর মুখোমুখি দাঁড়ালো তারপর বললো,” এ হলো রুপ। আমার ভালোবাসা। আর রুপ ও হলো শান্ত আমার বন্ধু”।
শান্ত রুপের হাতে হাত রাখা রাত্রীর হাতের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো তারপর নিজের হাত রুপের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,” রাতের ভালোবাসা হিসাবে পরিচয় পেয়ে ভালো লাগলো”।
রুপ হাঁসিমুখে বললো,” রাতের বন্ধুর লগে পরিচয় হইয়া আমারে মেলা ভালো লাগলো”।
এরপর তিনজন প্রচুর মজা করলো। এক সাথে হাঁসি মজায় মেতে উঠলো। শান্ত মাঝেমাঝে আড়চোখে রুপ এবং রাতের দিকে অন্যরকম দৃষ্টি দিলো। যে দৃষ্টিতে ছিলো একরাশ না পাওয়ার বেদনা। রুপ এবং শান্তকে রেখে রাত্রী চলে গেলো অন্যপাশে, যেখানে অনেকগুলো বাচ্চারা খেলা করছিলো। রাত্রীও গিয়ে তাদের সাথে ছোয়া-ছুয়ি খেলতে শুরু করলো। বাচ্চাদের সাথে মিশে বাচ্ছা হয়ে যাওয়া রাত্রীর দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইলো শান্ত। শান্তর মুগ্ধতার দৃষ্টি রুপের আড়াল হলো না। রুপ শান্তর কাঁধে হাত রাখলো। শান্ত চমকে রুপের দিকে তাকালো। রুপ স্বাভাবিক ভাবেই বললো,” জীবনে পাইবো না জাইনাও তারে ভালোবাসাটা খুব খাঁটি হয়”।
শান্ত হাঁসলো। সে হাঁসিতে কি ছিলো তা রুপের জানা নেই! শান্ত একমনে বললো,” যদি বলি আমি তেমন খাঁটি ভালোবাসা চাই না”।
রুপ এবারো স্বাভাবিকভাবে বললো,” তবে তার মনে যায়গা কইরা নিতে হইবো নয় তারে ভুইলা যাইতে হইবো”।
রুপ একটু থেমে পুনরায় বললো,” তয় তার মনে অন্যকেউ থাকলে তারে ভুইলা যাইয়া নতুন কাউরে নিয়া স্বপ্ন দেখা ভালো। নতুন কাউরে নিয়া জীবনডা রঙীন করে তোলাই উত্তম”।
শান্ত পুনরায় হাঁসলো। নিরবে অন্যদিকে চলে গেলো। রুপ শান্তর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শান্তর সাথে বন্ধুত্ব করে তার দুঃখটা বাড়িয়ে দিচ্ছে না তো তারা! শান্ত মুখে না বললেও তার দৃষ্টি বলে সে রাত্রীকে ভালোবাসে। একজন প্রেমিক হয়ে অন্য এক প্রেমিকের দৃষ্টির অর্থ বোঝাটা কঠিন নয়। সেজন্য রুপ বুঝতে পারে শান্তর মনের অবস্থা। রুপকে অবাক করে দিয়ে শান্ত নদী থেকে এক মুঠো পানি তুলে রুপের গায়ে ছুড়লো। কি হয়েছে বোঝার জন্য রুপ শান্তর পানে তাকাতেই দেখতে পেলো শান্তর মুখশ্রীতে হাঁসির রেখা। না এ হাঁসি বেদনার নয় বরং দুষ্টুমির। রুপ শান্তর দুষ্টুমি বুঝতে পেরে সেও শান্তর গায়ে পানি ছুড়লে। রুপ এবং শান্তর পাগলামি দেখে বাচ্চারাও রাত্রীকে এই খেলা খেলার জন্য বললো।
অবশেষে একঝাঁক বাচ্চাদের নিয়ে তিনজন কিশোর, কিশোরী মেতে উঠলো ছেলে মানুষি। না এবার আর শান্তকে দুঃখী মনে হচ্ছে না! মনে হচ্ছে না শান্ত রাত্রীর থেকে বন্ধুর বেশি কিছু চায়! সবাই এবার খুব খুশি।
সারাদিনটা তাদের ভালোই কাটলো। বিকেলে শান্ত, সাথী এবং পলাশ পাড়ি দিলো শহরের উদ্দেশ্যে। তারা তাদের গন্তব্যে চলে গেলো।
______
কেটে গেলো দু’মাস। রাত্রীর জীবন ভালোই কাটছে। রহিমা বেগম আগের মতো বকাঝকা করেন, তবে ভালোবেসে কাছেও টেনে নেন না। দু’মাসে রুপমের সাথে বেশ ভালোই কাটছিলো৷ শহর থেকে মাঝেমাঝে শান্তর চিঠি আসে। চিঠিতে বিশেষ কিছু লেখা নেই। সাধারণ বন্ধুসুলভ লেখা। শুধু যে রাত্রীর জন্য চিঠি পাঠায় তা নয় রুপমকেও পাঠায়। শান্ত তাদের দু’জনকে ভালো বন্ধু হিসাবে মেনে নিয়েছে।
পিংকি এ বাড়িতে চারবার এসেছিলো। তার জীবন ভালোই কাটছে। পিংকি এ বাড়িতে আসলে রফিক সাহেবের সাথে সৌজন্যমূলক বাক্য বিতরণ করে। রফিক সাহেব তাতেই তৃপ্ত। অন্যদিকে রাত্রী কাউকে বুঝতে দেয় না সে যে সত্যিটা জানে।
নদীর পাড়ে বসে ছিলো রুপ এবং রাত। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ একজন রাত্রীর চোখ বন্ধ করে দিলো৷ কারো হাতের ছোয়া পেয়ে রাত্রী চমকে উঠলো। রুপ সেদিকে লক্ষ্য করতেই লোকটি(শান্ত) ইশারায় চুপ থাকতে বললো। রাত্রী ভয়মিশ্রিত কন্ঠে বললো,” কে”?
শান্ত চোখের ইশারা রুপকে নিজের নাম বলতে বললো। রুপ শান্তর মজা বুঝতে পেরে বললো,” আমার ছোয়া তুমি চিনতে পারলা না”?
রাত্রী শান্তভাবে বললো,” এটা তুমি নও রুপ”।
” না এটা আমিই রাত”।
” উহু। এটা তুমি নও”।
” তয় কও কেডা”?
” জানি না”।
শান্ত রাত্রীর চোখ ছেড়ে দিয়ে সামনে এলো এবং হাঁসি মুখে বললো,” আমারে চিনতে না পারলেও সমস্যা নাই, রুপের স্পর্শ যে তুমি বুঝতে পারো তাতেই আমি খুশি”।
” আপনি”?
শান্ত চোখ বড়বড় করে বললো,” চিঠিতে কি বলেছিলাম”?
রাত্রী নিজের ভুল বুঝতে পেরে বললো,” আচ্ছা আপনি নয় তুমি”?
রুপ বললো,” তুমি আসবা আমাদের পূর্বে বলো নাই ক্যান”?
শান্ত মুচকি হেঁসে বললো,” এটারে বলে চমক”।
একটু থেমে পুনরায় বললো,” তোমাদের জন্য দ্বিতীয় চমক হইলো…..”।
রুপ এবং রাত দু’জনেই জিজ্ঞাসা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শান্তর দিকে। শান্ত বললো, ” বলবো না। বাড়ি চলো নিজেরাই জানতে পারবে”।
অনেক জোরাজুরি করেই শান্তর থেকে সত্যিটা জানতে পারলো না তারা। অবশেষে কিছুটা সময় সেখানে কাটিয়ে বাড়ি চলে গেলো।
বাড়িতে এসে রাত্রীর মুখশ্রী খুশিতে ভরে উঠলো। রুপের পরিবার রাতের বাড়ি এসে তাদের বিয়ে ঠিক করে গিয়েছে। সবটা তাদের না জানিয়ে যে ব্যবস্থা করেছে সে হলো শান্ত। দু’পরিবারকে বলে বিয়ের দিন তারিখ ও ঠিক করে নিলো তারা। রুপের বাবা বিয়েতে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করেছিলেন রাতের বিষ খাওয়ার ঘটনাটা নিয়ে। তবে শান্ত সব ঠিক করে নিয়েছে। শান্ত প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দিয়েছে।
রাত্রীর বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে তমা রাত্রীর সাথে দেখা করতে এলো। তমা মজা করে বললো,” আমার চিঠি আদান-প্রদানের কামডা তবে গেলো”।
রাত্রী লজ্জ পেলো৷ যবে থেকে বিয়ের কথা শুনেছে তবে থেকে লজ্জা পাচ্ছে। খুব লজ্জা পাচ্ছে। নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হচ্ছে। এতটা লজ্জাবতী সে হলো কবে থেকে! তমা রাত্রীকে লজ্জা পেতে দেখে বললো,” পিরিতির কালে এই লজ্জা ছিলো কই”?
শান্ত পিছন থেকে ফোঁড়ন কেটে বললো,” তখন সব ভালোবাসার বাতাসে উড়ে গেছিলো”।
তমা শান্তকে দেখে মনেমনে খুব খুশি হলো। এরা দু’জন পুনরায় মুখ খোলার পূর্বেই রাত্রী তমার উদ্দেশ্য বললো,” তুই কিন্তু দু’দিন আগে থেকে আসবি”?
” তার আর হইলো না”।
” কেন”?
শান্ত মুচকি হেঁসে বললো,” কারন তিনি বরপক্ষ”।
রাত্রী কথাটি শুনে বেশ অবাক হলো। রাত্রীর বিষ্ময় কাটাতে তমা বললো,” রুপ আমার মামাতো ভাই”।
রাত্রী দ্বিতীয়বারের মতো চমকালো। তমার মুখের পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তমার আম্মার ওকে রাত্রীদের বাসায় পাঠানোর অর্থ কিছুটা বুঝতে পারলো রাত্রী। রাত্রী বেশ রেগেমেগে বললো,” এতদিন ধরে তোমার আমার থেকে এটা লুকালি”।
তমা হাঁসিমুখে বললো,” ক্যান চমকটা ভালো লাগে নাই”?
” তবে রে”?
রাত্রী তমাকে আঘাত করতে উদ্ধৃত হবে বুঝতে পেরে তমা ছুটে পালালো।
দু’জনের পাগলামির সাক্ষী হলেন বড়রাও।
ধীরে ধীরে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। আজ রাত্রীর গায়ে হলুদ। সবাই খুব খুশি। সবাই রাত্রীর গায়ে হলুদ ছোয়ালো। সবশেষে শান্ত এসে রাত্রীর গালে হলুদ লাগালো। রাত্রী শান্তর চোখে চোখ রাখতেই শান্ত চোখ নামিয়ে ফেললো। শান্তর মনে বলছে,” ও চোখে তাকানোর অধিকার তার নেই”।
রাত পেরোলেই সকাল। সকাল হলেই বিয়ের তোড়জোড়। রাত্রী পিংকির থেকে সংসার ধর্মের জ্ঞান নিচ্ছে। অন্যদিকে রুপ সে কি করছে! ভালোবাসাকে পাওয়ার অপেক্ষা নাকি অন্যকিছু!
শান্ত একটি কোনায় চুপচাপ বসে ছিলো। পলাশ পিছন থেকে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো। পলাশ শান্তভাবে বললো,” তোর জীবনেও ভালোবাসার মানুষ আসবে”?
শান্ত মুচকি হাঁসলো। শান্তর হাঁসিতে যন্ত্রণা আছে সেটা পলাশ জানে! কিন্তু তার কিছু বলার নেই! যেখানে রুপ এবং রাত দু’জন দু’জনকে চায় সেখানে তাদের বাঁধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। পলাশ সান্ত্বনা দিয়ে বললো,” আমি বুঝতে পারছি তোর অবস্থা কিন্তু….”।
পলাশ বাক্যটি শেষ করার পূর্বেই সাথী পিছন থেকে বললো,” না তুমি বুঝতে পারছো না শান্তর অবস্থা। ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা তুমি কখনোই বুঝবে না। কারন তুমি হৃদয়হীন পাষাণ”।
সাথীর অভিমানের কথা শান্ত এবং পলাশ দু’জনেই বুঝতে পারলো। সাথী এক নাগাড়ে আরো কিছু বলে ওখান থেকে চলে গেলো।
রাতটা কেমন করে জেনে কেটে গেলো! কারো আনন্দে, কারো কষ্টে! সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। তাই রাতের আধার কেটে গিয়ে ভোরের সূর্য উদয় হলো। সকাল থেকে বিয়ে বাড়ি হৈ-চৈ তে মেতে উঠলো। শান্ত সবার সাথে মিলেমিশে এমনভাবে কাজ করছে, তাকে দেখেই মনে হচ্ছে না এ বিয়েতে তার কোন কষ্ট আছে! বন্ধু হতে হলে তো তার মতোই হওয়ার উচিত!
রাত্রীকে বধু বেসে সাজানো হলো। বধু বেসে রাত্রী অপেক্ষা করেছে সেই সময়ের, যে সময়ে তার ভালোবাসা তার হবে। হঠাৎ তমা এসে দাঁড়ালো রাত্রীর কাছে। রাত্রী তমাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে বললো,” কি রে তোর না বরযাত্রীদের সাথে আসার কথা ছিলো”?
একটু থেমে পুনরায় বললো,” রুপ চলে এসেছে বুঝি”?
তমা কিছু না বলে একটি চিঠি রাত্রীর হাতে তুলে দিলো। রাত্রী চিঠিটির দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। নিজেকে সামলে চিঠিটি খুলে পড়তে লাগলো। চিঠিটা পড়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ‘না’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো। রাত্রীর চিৎকারে পলাশ এবং শান্ত ভিতরে ডুকলো। দরজার এপাশে ভয়মিশ্রিত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রহিমা বেগম।( দূর্বল হার্ট অর্থাৎ আমার মতো আবেগী মানুষ হলে গল্পটি এখানেই পড়া বাদ দিন কারন শেষটা আপনার কল্পনার মতো হবে না। যাই হোক শান্ত ফ্যানরা জন্ম নিন।)
রাত্রী নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে পড়ে যেতে নিলেই পলাশ গিয়ে ধরলো। শান্ত বারবার জিজ্ঞেস করে চলেছে ‘কি হয়েছে’। তমা হাতের ইশারায় রাত্রীর হাতের চিঠিটা দেখালো। শান্ত রাত্রীর হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়তে লাগলো। চিঠি পড়া শেষে শান্ত অস্পষ্ট ভাবে বললো,” অসম্ভব”।
চলবে,
[ভুলক্রুটি ক্ষমা করবেন ]