#রঙ_বেরঙের_জীবন
পর্ব (১০)
#নুশরাত_জাহান_মিষ্টি
নিজের ছয় বছরের ছোট বোনকে দেখে পাত্র পক্ষ বারবার যখন বড় বোনকে ফিরিয়ে দেয় তখন সেই মেয়েটির যন্ত্রণা কেউ কি উপলব্ধি করতে পারে! রহিমা এবং রাইসা দু’বোন। তারা বোন হলেও চেহারার গড়নে দু’জনের মধ্যে বিস্তার তফাত। রাইসা তুলনামূলক ভাবে রহিমার থেকে বেশ সুন্দরী। তাই পাত্রপক্ষের নজরে বারবার রাইসাই পড়ে। রহিমার বাবা-মা সবদিক বিবেচনা করে ঠিক করলেন রাইসাকে তার মামা বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। রাইসা যেতে চায়নি কারন তার ধারনা,” যে তাদের দু’বোনকে একসাথে দেখে আপাকে পছন্দ করবে, সেই মানুষটি খাঁটি সোনা হবে৷ সে কখনো তার আপাকে ঠকাবে না”।
কিন্তু গ্রামীন জীবনে কে তার এই যুক্তির দাম দেবে! এখানে বিয়েটাই নারীর ভবিতব্য! যথা সময়ে বিয়ে দিতে না পারলে বাবা মা নিজেদের সমাজের কাছে ছোট করে রাখে। রাইসার প্রতিবাদ রাইসাকে তার পরিবার থেকে দূরে পাঠানো আটকাতে পারিনি। রাইসার ভাই তাদের বাবা- মায়ের কথা মতো রাইসাকে মামা বাড়ী রেখে এলো। তাদের মামা বাড়ী শহরে। তাই ঠিক হলো রাইসা শহর থেকেই পড়ালেখা চালিয়ে যাবে।
রাইসার চলে যাওয়ার দিন পনেরো পর রহিমাকে দেখতে পাত্র পক্ষ এলো। পাত্রের নাম রফিক। পাত্র পক্ষের রহিমাকে পছন্দ হলো। বিয়ের দিন তারিখও ঠিক হলো! রহিমার বাবা- মায়ের ভুল ছিলো সেই বিয়েতে রাইসাকে না ডাকা। সেই ভুল থেকেই রাইসার মনে অভিমানের জন্ম নিলো। রাইসার অনুপস্থিতি রহিমাকে কষ্ট দিলেও সে নিজের মনকে মানিয়ে নিলো। অন্যদিকে রাইসা না আসায় মামা-মামীও আসেনি। তাছাড়া মামীর গ্রামের পরিবেশ পছন্দ নয় তাই তিনি পূর্বেই আসতে চায়নি।
তো যাই হোক বিয়ের পর রহিমার সংসার জীবন ভালোই চলছিলো। রফিকের ভালোবাসার উষ্ণতায় নিজের কালো গড়নকে ভালোবেসে ফেললো রহিমা। অন্যদিকে অভিমানের বসে রাইসা কখনো বাবা-মার কাছে ফিরে যাবে না বলে ঠিক করলো। রাইসার বাবা-মা বেশ কয়েকবার ছোট মেয়ের সাথে দেখা করে গেলেন। বাসার কথা বললে রাইসা মুখ ঘুরিয়ে নিতো৷
তখন রহিমার সংসার জীবনের আট বছর চলে। পলাশের জন্মের ছয়টি বছর কেটে গেলো। রহিমা দ্বিতীয়বারের জন্য মা হওয়ার সাধ গ্রহন করতে চলেছে। রফিক বেশি আয়ের আসায় শহরে তার বন্ধুর কাছে কাজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো৷ রহিমা মনেমনে কষ্ট পেলেও নিজেকে বুঝ দিলো তাদের জন্যই তো মানুষটি এত কষ্ট করছে।
রফিক চলে এলো শহরে বন্ধুর কাছে। কাজকর্মে দিনকাল ভালোই চলছিলো তার। অন্যদিকে রফিককে ছাড়া রহিমার কষ্ট হলেও পলাশের সাথে সময়টা ভালোই কাটাচ্ছিলো। আফসোস একটাই পিংকি তার গর্ভে বেড়ে ওঠার সময়টা রফিককে পাশে পাচ্ছেন না। তবুও সে খারাপ নেই।
অন্যদিকে শহরের হাজার মানুষের ভিড়ে রফিকের চোখে যে মেয়েটি আটকে গেলো, দূর্ভাগ্যবশত সেই মেয়েটি রাইসা। রাইসার রুপে রফিক প্রেমে পড়ে গেলো। রফিকের ধারনা মতে জীবনে সব পুরুষই মনেমনে রাইসার মতো সুন্দর কাউকে আসা করে। রহিমাদের তো বাধ্য হয়ে জীবনে মেনে নিতে হয়। কিন্তু রফিকরা জানে না পৃথিবীতে এমন মানুষও আছে যারা রহিমার মতো মানুষের অপেক্ষায় দিন গুনে৷
বেশ কিছুদিন রাইসার পিছু নিলো রফিক। অনেক চেষ্টার ফলে রাইসার সাথে ভাব জমাতে সফল হলো। মেয়েরা প্রেমিক হিসাবে যেমন প্রেমিক পছন্দ করে রফিক তেমন হওয়ার চেষ্টা করে। এক সময় রাইসাও রফিক প্রেমে পড়ে যায়। রাইসা চেয়েছিলো বাবা-মায়ের সম্মতি নিয়ে বিয়ে করতে। কিন্তু ঐ যে ভালোবাসা। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যায় রাইসা তাই রফিকের যুক্তিহীন তর্কে হেরে গিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করে নেয় তারা! ছয় মাস লুকিয়ে সাংসারিক জীবন কাটায় তারা। এর মাঝে রফিক একবার বাড়িতে গেছিলো, গিয়ে একদিনের মাথায় চলে আসে। রহিমার সাথে সেই একদিন বেশ বাজে ব্যবহার করে।
রহিমা পিংকির জন্ম একা একাই দিলো। লোকজনের মাধ্যমে সেই খবর রফিকের কাছে পৌছাতে সক্ষম হলো রহিমা। রফিক খবর শুনে বাড়ি এসেছিলো ঠিকই কিন্তু সেই সময়টা রহিমার জন্য সুখের নয় দুঃখের হয়েছিলো। পিংকির মুখশ্রীতে তাকিয়ে রফিকের বলা প্রথম বাক্যটি ছিলো,” মায়ের মতো গড়ন হইছে। আমার কপাল দুটো পোলা মাইয়া একডাও সুন্দর হইলো না”।
সেদিন রফিকের বলা বাক্যটি রহিমাকে বেশ আঘাত দিলো। কালো মানুষ অবহেলার সেই বাক্যটি পুনরায় রহিমার মাথায় ফুটে উঠলো। পলাশ এবং রহিমার মা পাশের রুমে ছিলো, রফিক কথাটি বেশ জোরেই বললো তাই তারাও শুনতে পেলো৷ ছোট্ট পলাশ সেদিন কি বুঝলো জানা নেই! তবে তার চোখে অশ্রুকোনা দেখা দিয়েছিলো।
রহিমা এবং রহিমার মায়ের জোরাজুরিতে তিনদিন সেখানে কাটালো রফিক। তিনদিন রহিমার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কোন কথা বলেনি রফিক৷ রফিকের এই ব্যবহার রহিমাকে কষ্ট দিচ্ছিলো। শহরে আসার দিন রহিমা খুব করুনভাবে বলেছিলো,” আর কিছুদিন থাহা যায় না”?
রফিকের চোখে তার সুন্দরী স্ত্রী রাইসার মুখশ্রী ভাসছিলো এমন সময় রহিমার অনুরোধ তার মন গলাতে পারেনি। সে চলে আসছিলো, রহিমা সাহস করে তার হাত ধরে অনুরোধ করলো। রফিক নিজের মাথা ঠিক রাখতে না পেরে রহিমাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো কাজ আছে বলে। একবারের জন্যও পিছন ঘুরে তাকায়নি। পিছনে ঘুরে তাকালে দেখতে পেতে রহিমা ধাক্কা খেয়ে টেবিলের সাথে গিয়ে পড়েছে, রক্তে পুরো ঘর তলিয়ে গেলো। রক্ত দেখে পলাশ তার মায়ের কাছে গিয়ে কান্না করে দিলো। পিংকির জন্মের বেশিদিন হয়নি তাই পেটে আঘাত লাগায় রক্ত নামছিলো। আঘাতটি যথেষ্ট জোরেও লেগেছিলো রহিমার।
অন্যদিকে রাইসা তিন মাসের গর্ভবতী। রাইসার পরিবর্তন তার মামী লক্ষ্য করেছিলো। মামীর জোরাজুরিতে রাইসা সব বলে দিলো। মামী মামার সাথে কথা বলে রফিকের সাথে তাদের দেখা করাতে বললো।
গ্রামে রহিমাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হলেও তাকে একবার শহরে টেস্ট করতে বলা হলো। রহিমা বাবা-মা ভাইয়ের সাথে সন্তানদের নিয়ে শহরে গেলো। তারাও মামা বাড়ী গিয়ে উঠলো। সেখানে গিয়ে রাইসার খবর শুনে মনেমনে কষ্ট পেলেও মেনে নিলো তারা। নিজ পছন্দ বিয়ে করাটা খারাপ তো নয়! যাই হোক ঠিক হলো রহিমার চিকিৎসা শেষে রফিকের সাথে সবার দেখা করাবে।
রহিমাকে ডাক্তার দেখানো হলো, তেমন গুরুতর কোন সমস্যা নেই।
রাইসা রফিককে তার পরিবারের সাথে দেখা করার কথা বললো৷ রফিক ভাবলো রাইসার পরিবার নিশ্চিয়ই শহরে থাকে। তাদের সাথে পরিচিত হতে সমস্যা কি! শুধু গ্রামে তার আর এক বউ আছে তা না জানলেই হবে! তাছাড়া রাইসা গর্ভবতী, এখনি সময় নিজের স্ত্রী হিসাবে ওর পরিচয় দেওয়ার।
পরেরদিন রফিক রাইসার সাথে দেখা করতে তার মামার বাড়ী এলো! রাইসা খুশিমনে রফিকের হাত ধরে বাড়ির ভিতরে নিয়ে এলো। রাইসা হাতে হাত রাখা রফিককে দেখে তার বাবা-মা চমকে গেলো। সেই সাথে চমকালো রহিমা। রহিমা কান্নায় সেখানেই বসে পড়লো। সবার মুখের ভাবভঙ্গি রাইসাকে বেশ ভাবালো। রাইসাকে বেশিক্ষন ভাবতে হলো না তার পূর্বেই তার ভাই তাকে সত্যিটা বলে দিলো। রাইসাও মাটিতে বসে পড়লো৷
বাড়ির পরিবেশ বেশ নিস্তব্ধ। যার জন্য রাইসাকে রহিমার বিয়েতে রাখা হলো না সেটাই হলো। আচ্ছা এটাকে কি ভাগ্য বলে! গ্রামে সবাইকে মুখ কি করে দেখাবে রহিমার বাবা-মা! তাদের ভাবনা জুড়ে সেটাই এলো। রফিক বারবার রাইসাকে বললো,” সে শুধু রাইসাকে ভালোবাসে”।
রহিমা তার মুখে রাইসাকে ভালোবাসার কথা শুনে আরো ভেঙে পড়লো। রাইসা এবার যা করলো তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলো না! রাইসা রফিকের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। রফিক অবাক নয়নে রাইসার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,” তুমি আমারে মারলা”?
” ঠক, প্রতারক। তোর সাহস কি করে হলো আমার আপাকে ঠকানোর”?
বাক্যটি বলে রাইসা দ্বিতীয় থাপ্পড়টি মারলো রফিকের গালে। সবাই রফিককে দোষারোপ করে চলেছে, সাথে রাইসাকেও কম বেশি দোষারোপ করছে। না জেনে না বুঝে একজনকে এভাবে বিয়ে করার মানে কি! তারা তাদের স্থানে ঠিক কিন্তু তারা কি করে জানবে ভালোবাসা মানুষকে অন্ধ করে দেয়! হ্যাঁ রাইসা অন্ধ হয়ে গেছিলো। তাই তো ভাগ্য তার সাথে খেলা করলো। রাইসা সবাইকে চলে যেতে বললো। সেই সাথে রহিমার উদ্দেশ্য বললো,” সমাজের ভয়ে হয়তো তুই তোর প্রতারক স্বামীর সাথে সারাজীবন ঘর করবি, তাতে আমার কোন সমস্যা নাই৷ তুই ভাবিস না আমি জেনেশুনে তোর সংসারে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো। আমি আমার এই সর্বনাশের গল্প নিয়ে কখনো তোদের সমাজে(গ্রামে) যাবো না”।
এরপর রফিকের উদ্দেশ্য বললো,”আপারে কখনো কষ্ট দিও না, আমার সাথে এটাই তোমার শেষ দেখা হোক”।
রফিক কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু রাইসা সে সুযোগ না দিয়ে সবাইকে বের করে দিলো। সবাই গ্রামে চলে এলো। রহিমা এবং পলাশ একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করলো। সমাজের জন্য রহিমা রফিককে কখনোই ছাড়তে পারবে না। একটি নারীর সাথে পুরুষের যে কারনেই বিচ্ছেদ ঘটুক না কেন দোষারোপ সবসময় নারীকেই করা হয়!
বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। রফিক রহিমার সাথে বেশ খারাপ ব্যবহার করে। বারবার রাইসার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। কেননা রাইসা তাকে সেই সুযোগ দেয়নি! মামী রাইসাকে বাচ্চাটি নষ্ট করতে বলেছিলো কিন্তু সে রাজি নয়। রাইসার ভাষ্যমতে,” সন্তানটা পাপের নয়। বিয়েটা কিন্তু হয়েছিলো। আমার সন্তানটা নাহয় ছোট বোনকে আড়ালে রেখে বড় বোনের বিয়ে দেওয়ার স্মৃতি হয়েই থাকবে”।
রাইসার যন্ত্রণাটা মামা-মামী উপলব্ধি করতে পারলেও কিছু করার নেই! তারা জানেন রাইসার চিন্তা-ধারা রহিমার মতো নয়! রাইসা ঠিক নিজের সন্তানকে একা মানুষ করতে পারবে, সেই ক্ষমতা তার আছে। সমাজের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা তার আছে। সমাজের কটুক্তিকে পিছনে ফেলে সামনে সে এগিয়ে যাবেই। কিন্তু রহিমা পারবে না তাই রহিমার জীবনেই রফিককে প্রয়োজন।
একদিকে রফিকের ব্যবহার রহিমার প্রতি দিন দিন খারাপ হচ্ছিলো, অন্যদিকে রাইসা মনেমনে নিজ সন্তানকে একা বড় করার ধীর প্রতিজ্ঞ নিচ্ছিলো। কিন্তু ভাগ্য সে তো রাইসার সঙ্গ দেয়নি। তাই সন্তান জন্ম দেওয়ার পরপরই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে হারিয়ে গেলো না ফেরার দেশে। শেষবারের জন্য সন্তানের কান্না শব্দ কানে আসলেও তার মুখশ্রী দেখা হয়ে উঠলো না রাইসার।
পরবর্তীতে রফিকের হাতে সন্তানকে তুলে দেওয়া হলো। রফিক সন্তানকে নিয়ে এসে রহিমার হাতে তুলে দিলো। রহিমা সন্তানটি হাঁসি মুখে হাতে তুলে নিলেও সন্তানটির সৌন্দর্য তার হাঁসি কেড়ে নিলো। একদিকে তার শ্যামবর্ন মেয়ে পিংকি অন্যদিকে সুন্দর এই ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটি। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে পারে এই ভয় বাচ্চাটির প্রতি ঘৃনা জন্ম দিলো রহিমার মনে। সন্তানকে মানুষ করার বিনিময়ে রহিমা রফিকের জন্য একটি শর্ত রাখলো৷ শর্তটি হলো,” বাচ্চাডার সাথে ও যে ব্যবহারই করুক না ক্যান রফিক কখনো প্রতিবাদ করতে পারবো না”।
মা হারা শিশুটির জন্য একজন মায়ের খুব প্রয়োজন। নিজের বোনের শেষ স্মৃতি হিসাবে রহিমা ততটা কঠিন হবে না নিশ্চয়ই৷ সেটা ভেবেই রফিক রাজি হলো। সেই থেকে ভালোবাসাহীন দায়িত্ব, কর্তব্যের সংসারে পড়ে আছে রফিক, রহিমা।( আমি পরকীয়াকে সাপোর্ট করছি এরকম ভাববেন না কেউ কিংবা আপনাদের মনে অন্য ভাবনার সৃষ্টি করছি যেটা আপনাদের জন্য খারাপ সেটা নয়। শুধুমাত্র গল্পের স্বার্থে লেখা৷ যাই হোক রাইসা, রহিমার গল্প আরো বিস্তারিত বর্ননা করা যেতো কিন্তু তাতে হয়তো বোরিং লাগতো৷ যাই হোক গোছানো হয়তো হয়নি, তবুও চেষ্টা করেছি। আর হ্যাঁ একটি কথা মাথায় রাখবেন এই গল্পে আমি আযানের ধ্বনি নামাজ এসব কিন্তু একবারো উল্লেখ করিনি কারন এটা উল্লেখ করলে একটা সময় গিয়ে আপনারা বলবেন এত নামাজি মানুষ প্রেম করে কেমনে, সেই সাথে আরো কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা আসবে যেটা ইসলামের দৃষ্টিতে গেলে কখনো সম্ভব নয় তাই আপনারা এটাকে ইসলামের সাথে মেলাবেন না দয়া করে। এটা লেখিকার অনুরোধ)
শান্ত বলা শেষে রাত্রীর দিকে দৃষ্টি দিলো। চোখের কোনায় অশ্রুগুলো ধরা দিলো। রাত্রীর অশ্রুমাখা নয়নে নয়ন রেখে শান্ত বললো,” সেই সন্তানটি তুমি রাত্রী”।
রাত্রী নিস্তব্ধ। তার বলার মতো কোন ভাষা নেই। শান্ত রাত্রীকে কিছুটা সময় দেওয়ার জন্য চলে গেলো। এই সময়টা রাত্রীর নিজের নিজেকে বোঝানোর। সান্ত্বনা দিয়ে আর যাই হোক কারো দুঃখ ঘোচানো যায় না৷ শান্ত চলে যেতেই পিছন থেকে রুপম এসে রাত্রীর কাঁধে হাত রাখলো। এতক্ষন আড়ালে দাঁড়িয়ে গল্পটি রুপমও শুনেছিলো। পিছন ঘুরে রুপমকে দেখে জড়িয়ে ধরলো রাত্রী। রুপমের বুকেই কান্নায় ভেঙে পড়লো। রুপম নিঃশব্দে কান্না করলো। জীবন মানেই রঙের মেলা। এখানে হাজার রঙ ঘুরেফিরে। কখন কোন রঙে জীবন আটকাবে তা কেউ জানে না! রঙের ভেলায় ভেসে চলা জীবনের রঙটা কখন বেরঙের মায়া বাঁধা পড়বে সে কথা কেউ জানে না! কিছু সময় পর রুপম বললো,” জীবনটা রঙীন যদি তুমি চাও তবে”।
রুপমের কথা মানে আজ বুঝতে অসুবিধা হলো না রাত্রীর। নিজেকে সামলে রুপমের সাথে ভিতরে গেলো। রুপম যথেষ্ট চেষ্টা করছে রাত্রীকে হাঁসি-খুশি রাখার। রুপম রাত্রীকে সবার মাঝে রেখে ঘরের ভিতর গেলো রহিমার সাথে কথা বলতে। রহিমা মহিলাদের সাথে মেয়ের চলে যাওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছিলো। রুপম সকলের মধ্যে থেকে রহিমাকে বললো,” কাকি আম্মা একটু কথা কইতে চাই”?
রুপমকে রহিমা চেনে। তমাকে জোরাজুরি করে রুপম রাত্রীর সম্পর্কের ব্যপারটা জেনে নিয়েছে। পিংকির বিয়েটা মিটলেই রাত্রীর বিয়ে ঠিক করবে সেটাও তারা ভেবে রেখেছে। পলাশের সাথে এ ব্যপারে কথা বলায় পলাশ রাজি হলেও সেই সাথে শান্তর জন্য কিছুটা কষ্ট প্রকাশ করলো। পলাশ রহিমার থেকে কিছু লুকায় না, সেই হিসাবে শান্তর ব্যপারটাও জানে তারা।
কয়েকদিন ধরে রাত্রীর ব্যবহারে তারা নিশ্চিত ছিলো রাত্রী কোন এক সম্পর্কে জড়িয়েছে৷ ইদানীং তমার ঘন ঘন এ বাড়িতে আসায় সন্দেহ হওয়ায় তমাকে তার আম্মার কাছে বলার ভয় দেখিয়ে সব জেনে নিয়েছে তারা। রহিমা যতই অবহেলা করুক রাত্রীর সিদ্ধান্ত তার কোন দ্বিমত নেই। রুপম হয়তো সে ব্যপারে কথা বলবে এটা বুঝতে পেরে রহিমা সবাইকে পিংকির রুমে যেতে বললো। সবাই স্বাভাবিকভাবেই চলে গেলো। রহিমা রুপমকে বললো,” কি কইবা”?
রুপম তার ভুবন ভোলানো হাঁসি দিয়ে বললো,” খারাপ সময় চাইলেই ভোলা যায় না এটা সকলের জীবনেই প্রযোজ্য কাকী আম্মা”।
রহিমা প্রথম বুঝতে পারলো না তাই জিজ্ঞেস করলো,” মানে”?
” রাত্রীরে মাইনা নেন কাকী আম্মা। কাউরে কষ্ট দিয়া তার জন্ম নেওয়াটা তো তার ভুল হইতে পারে না। সে তো জন্মের পূর্বেই জেনে আসে নাই সে কারো কষ্টের উপরে জন্ম নিছে”।
রহিমা বেশ অবাক হলো। রুপম এসব জানলো কিভাবে! রহিমা কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই রুপম বাঁধা দিয়ে বললো,” আমার কথার মানে আপনে ঠিকই বুঝছেন, আমি বেশি কথা বাড়াইতে চাই না। এই নিয়া কথা যত হইবো ততই যন্ত্রনা বাড়বো বই কমবো না। তাই সব ভুইলা মাইনা নেন রাত্রী আপনের গর্ভের সন্তান”।
একটু থেমে পুনরায় রুপম বললো,” সমাজের ভয়ে যেটারে আকড়ে ধরছেন, সেই আঁকড়ে ধরাটারে দ্বায়-বদ্ধতা নাই ভাইবা ভালোবাসা ভাবেন। যখন ভুল মানুষডার সাথেই সারাজীবন থাকবেন তহন তার ভুলটারে সুধরে নেন”।
এবার রহিমা মুখ খুললো। রহিমা ভালোই বুঝতে পারলো রুপম সব জানে। তাই বললো,” ভুল নয় সে তো পাপ করছে পাপ”?
” পাপীর থেইকা পাপরে ঘৃনা করা উত্তম। পাপীরে তো ভালোবাইসা বদলানো যায়”।
রুপম একটু থেমে পুনরায় বললো,” হয় পাপীরে জীবন থেইকা দূরে সরাইতে হয় নয়তো পাপীর সাথে থাইকা তারে বদলে নিতে হয়”।
রহিমা অবাক নয়নে রুপমের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে রইলো। রুপম পুনরায় তার ভুবন ভোলানো হাঁসি দিয়ে বললো,” জীবনের বেদনারে যহন দূরে রাখা যাইবোই না তহন তারে বেদনা নয় আনন্দ কইরা নিতে হয়। তহনি জীবনডা বেরঙের ছায়া থেকে মুক্ত হইয়া রঙের মায়ায় হারাইবো”।
রুপম হাঁসি দিয়েই চলে গেলো। রহিমা ওখানেই বসে পড়লো। রুপমের কথা মানে তার কাছে স্পষ্ট। রুপম তাকে বোঝালো,” সমাজের ভয়ে হোক বা অন্যকোন কারনে সে রফিকের সাথে যহন সারাজীবন থাকবোই তহন রফিকের ভুল ভুইলা তারে ঠিক মানুষডা বানাইয়া নিতে হইবো”।
রহিমা মনেমনে ব্যথিত হয়ে বললো,” কখনো এমনে তো ভাবা হয় নাই”।
অন্যদিকে শান্ত রাত্রীর সামনে এসে বললো,” শর্ত কথা মনে আছে তো”?
রাত্রী বেশ ভয়ে আছে৷ কে জানে শান্ত তাকে কি শর্ত দেয়! ভয়মিশ্রিত কন্ঠেই বললো,” কি শর্ত”?
শান্ত রাত্রীর ভয়মিশ্রিত মুখশ্রী বেশ উপভোগ করলো। মুখে হাঁসি ফুটিয়ে বললো,” শর্তটি হলো……
চলবে,