বেস্ট ফ্রেন্ড এর পাশে বধূ বেশে নিজের হারানো ভালোবাসা, প্রাক্তনকে দেখে যেন সবকিছু আবছা লাগছে রাফানের চোখে। সামনে ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়ানো ছেলেটাকে দেখে নববধূর মুখের হাসিও ম্লান হয়ে গিয়েছে। তার হাসিমুখে নেমে এসেছে আঁধারের ছায়া। দু’জনের কেউই হয়তো এই জায়গায় একে-অপরকে আশা করেনি।
প্রিয় বন্ধুকে দেখে তার কাছে এগিয়ে যায় আফসান। বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
“এত দেরি করে এলি কেন? আমি তোর জন্য সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করছি ভাই।”
আফসানের কথায় রাফান কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
“সত্যিই দেরি করে এসে বোধহয় ভুল করে ফেললাম।”
“যাইহোক, চল তোকে আমার স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।”
আফসানের সাথে রাফান জোহার সামনে এসে দাঁড়ায়। দু’জনের চোখের কোণেই বিন্দু বিন্দু পানি জমেছে। নিজের সাথে আনা ফুলের তোড়া জোহার দিকে এগিয়ে দিয়ে সে বলে,
“শুভকামনা রইল আপনাদের দু’জনের আগামী দিনের জন্য।”
জোহার হাত কাঁপছে। সে এখনো এখানে নিজের প্রাক্তনকে মেনে নিতে পারছে না। তবুও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে ফুলের তোড়া নিয়ে পাশে রাখে।
“জানো জোহা? আমি যখন বাইরে পড়তে গেলাম তখন আমার রাফানের সাথে পরিচয় হয়েছিল। তিশানের পর রাফান আমার একমাত্র বন্ধু কিংবা বেস্ট ফ্রেন্ড বলা যায়।”
আফসানের কথা শুনে জোহার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। শেষে কিনা এরা দু’জন বেস্ট ফ্রেন্ড!
“এই তোর সাথে বাকিরা আসেনি? শান, ফারহান, রিয়াদ সবাই কোথায়?”
“এই যে ভাই আমরা সবাই এসে গিয়েছি।”
আনিতার সাথে কথা বলতে বলতে স্টেজের দিকে এগিয়ে এসে থেমে যায় মৃত্তিকা। শানকে আফসানের পাশে দেখে তার চোখগুলো বড়ো হয়ে গিয়েছে। শানের দৃষ্টিও কেবল মৃত্তিকার দিকে। সে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে।
উপস্থিত প্রত্যেকে একে-অপরকে দেখে চরম পর্যায়ের বিস্মিত। যাদের থেকে পালাতে চেয়েছে আজ তাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে মৃত্তিকা।
“রেজিস্ট্রি অফিস থেকে লোক এসেছে। আফসান আর জোহাকে স্টেজে বসিয়ে দে।”
নিধির কথায় ধ্যান ভাঙে মৃত্তিকার। সে ইশারায় নিধিকে সামনে তাকাতে বলে।
“রাফান ভাইয়া এখানে!”
“তুই অবাক হচ্ছিস কেন নিধি? তুই জানতিস না আফসান ভাইয়া আর রাফান ভাইয়া বন্ধু?”
“বিশ্বাস কর আনিতা আমি সত্যি কিছু জানতাম না।”
“তোর ভাইয়ের বন্ধু আর তুই চিনিস না?”
“আরে বাবাহ বিদেশে গিয়ে ওদের সাথে হয়তো পরিচয় হয়েছে। আর ভাইয়ার ওই বন্ধুদের আমি সেভাবে চিনি না। ছবিও দেখিনি ওদের।”
“তোরা এাব আলোচনা বন্ধ কর। আমার এখন এটা ভেবে ভয় হচ্ছে যে বিয়েটা হবে তো?”
মৃত্তিকার এহেন প্রশ্নের জবাবে নিধি বলে,
“কেন হবে না? রাফান ভাইয়া তো এখন বিবাহিত।”
“না, সেদিন বিয়েটা হয়নি!”
চমকে ওঠে নিধি। কিছুটা জোরেই বলে ওঠে,
“বিয়েটা হয়নি মানে?”
“আস্তে কথা বল ভাই। বিয়েটা হয়নি। কারণ তাহিয়ার অন্য একজনের সাথে বিয়ে হয়েছে। আর রাফান ভাইয়া জোহাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে না বলে জানিয়েছিল। সেদিনের পর থেকে পাগলের মতো জোহাকে খুঁজছে সে। আমি সব জেনেও নীরব ছিলাম।”
“কেন নীরব ছিলি তুই?”
“জোহা যেন ভালো তাকে তাই। রাফান ভাইয়ার সাথে মেয়েটা ভালো থাকতে পারতো না রে।”
“আর তাই তুমি আমাকে মিথ্যা বললে তাই না?”
পুরুষালী কণ্ঠ শুনে হকচকিয়ে যায় মৃত্তিকা। শানকে দেখে কিছু না বলে অন্যদিকে চলে যায়।
“নিধি, আনিতা জোহার কাছে যাও তোমরা। বাবা শান, তুমিও আফসানের কাছে যাও। এখন ওদের রেজিস্ট্রি হবে।”
মায়ের কথামতো নিধি আনিতাকে নিয়ে স্টেজে চলে যায়।
দু’জনকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। আফসানের মুখে বরাবরের মতোই হাসি বিরাজমান। কিন্তু জোহা হাসতে পারছে না। চাইলেও ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টানতে পারছে না সে। তাকে এভাবে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে আফসান জিজ্ঞেস করে,
“কিছু হয়েছে? তোমাকে এমন বিচলিত লাগছে কেন?”
“আফসান আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।”
“আচ্ছা বলো।”
জোহা আর কিছু বলার আগেই তাদের সামনে একজন রেজিস্ট্রি পেপার রেখে বলে,
“আপনারা দু’জন এই কাগজে সই করুন।”
আফসান হাসিমুখে সই করে দেয়। বিপত্তি ঘটে তখন যখন একাধিক বার বলার পরেও জোহা সই করে না। মৃত্তিকা পাশে বসে বলে,
“এখন আর কিছু ভেবে লাভ নেই। চুপচাপ সই কর জোহা।”
জোহা একপলক তাকায় রাফানের দিকে। অতঃপর দীর্ঘ অপেক্ষার পর সই করে দেয় কাগজে। সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে তাদের শুভকামনা জানায়।
বোনের কাছে এসে বসে সিমি। তার কণ্ঠে উদ্বেগ প্রকাশ পাচ্ছে।
“রাফান এখানে কী করছে? ফুপি ওকে দেখার পর থেকে চিন্তা করছে। তুই ওকে এখানে আসতে বলেছিস জোহা?”
“তুমি কি পাগল হয়ে গেলে আপু? আমি ওকে এখানে কেন ডাকব?”
“তাহলে কে ডেকেছে?”
“আফসান ডেকেছে।”
“কী বলছিস তুই?”
“অবাক হওয়ার কিছু নেই। রাফান আফসানের বেস্ট ফ্রেন্ড। এটা আমিও জানতাম না। কিন্তু যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে।”
“রাফান যদি এখন এখানে কোনো ঝামেলা করে?”
“এতক্ষণ যখন কিছু বলেনি তখন ধরে নেওয়া যায় পরেও কিছু করবে না। তাছাড়া আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আকদ আগেই হয়েছে। আজ রেজিস্ট্রি হলো। এতকিছুর পর আর কিছু করেও বিশেষ কোনো লাভ হবে কী?”
“তুই এত স্বাভাবিক কীভাবে?”
“আমি আজই সবটা বলে দিব আফসানকে। রাফান যে আমার প্রাক্তন সেটাও বলে দিব।”
“ভুলেও এই কাজ করবি না তুই।”
“আপু আফসান আমার সম্পর্কে সবকিছু জানে। তাহলে এটা জানলে সমস্যা কোথায়?”
“দেখ আজ তোদের জীবনে বিশেষ একটা দিন। আজকে কিছু বলিস না। দুই দিন পর বললে এমন কোনো সমস্যা হবে না।”
বোনের কথায় চুপ করে যায় জোহা। আফসান বন্ধুদের কাছ থেকে ফিরে জোহাকে বলে,
“তখন তুমি আমাকে কিছু বলতে চাইছিলে। এখন বলো কী বলতে চাও?”
“আজ বলব না। সময় আসুক, আমি নিজে থেকেই সবকিছু বলব আপনাকে। শুধু একটাই অনুরোধ আপনার কাছে। আমাকে দয়া করে ভুল বুঝবেন না।”
“তোমাকে ভুল বোঝার কি কোনো কারণ আছে?”
“হয়তো আছে!”
ফোনের টুংটাং আওয়াজে স্ক্রিনের দিকে তাকায় জোহা। অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে,
“তোমার নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইল। তবে আমি কথা দিচ্ছি, তোমাদের আমি ভালো থাকতে দিব না।”
চলবে??
#রং_তুলির_ক্যানভাস
#দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_১
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
বিঃদ্রঃ প্রথম খন্ডের সাথে এই খন্ডের মিল রয়েছে। তাই সবাই প্রথম খন্ড আগে পড়ে নিবেন প্লিজ।